#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১১)
নুসরাত জাহান লিজা
নওরীন নিজের ঘরে এসে দেখল রিয়াদ এসেছে ওকে নিতে। কোনো প্রশ্ন করার আগেই সে রিয়াদকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, শার্ট ভিজে যাচ্ছে চোখের জলে।
রিয়াদ একরাশ উৎকণ্ঠা নিয়ে বারবার প্রশ্ন করে যাচ্ছে, “কী হয়েছে? নওরীন, এই নওরীন.. কথা বলো প্লিজ, চিন্তা হচ্ছে তো।”
কিন্তু কোনো উত্তর এলো না, নওরীন নিজেকে কোনোভাবেই ধাতস্থ করে উঠতে পারছে না, অনেক কথা গলার কাছে এসে আটকে যাচ্ছে।
রিয়াদ স্ত্রীকে আগলেই বিছানায় এনে বসালো। এরপর উঠে গিয়ে টেবিলে রাখা জগ থেকে পানি ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিল।
গ্লাসটা হাত বাড়িয়ে নিয়ে পানিটা খুব ধীরে ধীরে শেষ করল নওরীন। এরপর বলল, “কিছু হয়নি, তুমি চিন্তা করো না।”
“আচ্ছা, করলাম না চিন্তা। কিন্তু তোমার কী হয়েছে সেটা কি জানতে পারি?”
একটু সময় নিয়ে গ্লাসটাকে দুই হাতের তালুর মধ্যে ঘোরাতে ঘোরাতে নিজেকে খানিকটা ধাতস্থ করে নিয়ে বলল,
“আমাদের সংসারটা কখনো পরিপূর্ণ হবে না, তাই না?”
“তুমি আবার এসব বলছো? ডাক্তার তো আমাদের শতভাগ নিরাশ করেননি। তাহলে?”
“আমার স্কুলে সব বাচ্চাদের মায়েরা মেয়েকে কী সুন্দর করে সাজিয়ে হাত ধরে ধরে স্কুলে নিয়ে আসে। টিফিনের সময় মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। আশেপাশে কত মানুষ সন্তানদের নিয়ে খেলে, হাসে। ব্যথা পেলে কেঁদে ফেলে। আমার কোলটা বড্ড খালি খালি লাগে। আমি কেন পেলাম না? একটা ছোট্ট প্রাণ আমার মধ্যে বেড়ে উঠছিল। আমি ওকে অনুভব করতাম, জানো? কিন্তু ধরে রাখতে পারলাম না। তোমারও তো কষ্ট হয়েছে, বলো?”
কেমন অপ্রকৃতস্থের মতো কথা বলে যাচ্ছে নওরীন। বাচ্চাদের স্কুলে সে স্বেচ্ছায় যোগ দিয়েছিল, অনেক অনেক শিশুদের মাঝে থাকলে নিজের অভাবটুকু খানিকটা ভুলে থাকা যাবে ভেবে। কিন্তু ফলাফল উল্টো হয় মাঝেমধ্যে। অন্যের প্রাচুর্যতার মাঝে নিজেকে কখনো কখনো বড্ড দীনহীন বলে মনে হয়। তবুও নিষ্পাপ মুখগুলো ওকে স্বস্তি দেয়। তাদের হাসি-কান্না, দুষ্টুমি সবকিছু যে ওকে প্রশান্তি দেয়। তাদের সে ভীষণ মমতায়, যত্নে পড়ানোর চেষ্টা করে। সবার কথা মন দিয়ে শোনে।
রিয়াদ দুই হাতের মধ্যে নওরীনের চিবুক ধরে মুখটা আলতো করে তুলে গভীর আবেগে বলল, “তুমি আমার পাশে আছো, এটা ভাবলে আমার কষ্ট হয় না। সত্যি বলছি। মাঝেমধ্যে যে কিছুটা খারাপ লাগে না সেটা বললে মিথ্যে বলা হবে। আমাদের সম্পর্কে কোনো মিথ্যে নেই, তাই বলতেও চাই না। তবে একটা কথা কি জানো? তুমি আমার জীবনে এসেছ, এই প্রাপ্তির যে প্রশান্তি, এর তুলনা নেই। এই শান্তি অন্য অপ্রাপ্তিকে ছাপিয়ে যায়। তখন কোনো কষ্ট থাকে না। তখনই কেবল কষ্ট হয়, যখন তুমি এভাবে কাঁদো, মনমরা হয়ে বসে থাকো। একটু হাসো প্লিজ? তোমার হাসি খুব সুন্দর!”
নওরীনের নিজের ভাগ্যের উপরে কখনো কখনো রাগ হয়, তবে রিয়াদের মতো একজনকে জীবনের সহযোদ্ধা হিসেবে পেয়েছে এটা ভাবলে সেই খেদ নিমিষেই হারিয়ে যায় কোন মহাশূন্যে। সে নিশ্চয়ই সৌভাগ্যবতী, নইলে রিয়াদকে সে কী করে পেল জীবনে! ওর মুখ জুড়ে আঁধার কেঁটে গিয়ে ঝলমলে আলোকের দ্যুতি খেলে গেল মুহূর্তেই।
***
লিলি নিচে এসে নওরীনের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে দেখল ভেতরে রিয়াদ আছে। ওর আর কথা বলে মনের ভার হালকা করা হয় না। সে নিজের ঘরে এসে বিছানায় শুয়ে বালিশে মুখ গুঁজে কেঁদে ফেলে।
চারদিক থেকে এত এত চাপে ওর মানসিক স্থিতি যেন হারিয়ে যাচ্ছে। বড্ড অবসন্ন লাগছিল, সেভাবেই সে ঘুমিয়ে পড়ে। নওরীন যাবার আগে এসে ওকে ঘুমাতে দেখে আর জাগায় না। চলে যায়।
সন্ধ্যায় নেহাল ঘরে এসে দেখে লিলি আজ বড্ড নীরব। অন্যদিনের মতো আ ক্রো শে ওর দিকে তাকায় না, সে এসেছে বুঝতে পেরেও বিন্দুমাত্র হেলদোল নেই। বড্ড বেশি নিস্পন্দ বসে রয়েছে।
নেহালের একবার মনে হলো কথা বলবে না, বললেই হয়তো কথায় কথা বাড়বে, অশান্তি হবে। কিন্তু সে এড়িয়ে যেতে পারল না। লিলির মায়ের কাতর আকুতি মনে পড়ল, একজন মাতৃস্নেহে কাতর মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে, সেটা থেকে সে পিছিয়ে আসতে পারে না৷ তাছাড়া যেভাবেই হোক, মেয়েটা ওর জীবনের সাথে জুড়ে গেছে। এই দায় সে কোনোভাবেই এড়াতে পারবে না।
“কিছু কি হয়েছে?”
লিলি একবার তাকিয়ে চোখ নামিয়ে নিল। নেহাল আরেকটু এগিয়ে গিয়ে বিছানার পাশে এসে দাঁড়িয়ে আরেকবার প্রশ্ন করল,
“আন্টিকে মিস করছো, লিলি?”
এবার সে নেহালের দিকে গাঢ় দৃষ্টিতে তাকালো। কেন যেন প্রশ্নটা বন্ধুসুলভ মনে হলো লিলির কাছে৷ মন থেকে সাড়া না এলেও সে মুখ খুলল,
“নওরীন আপুর ব্যাপারটা আমি জানতাম না। আজ পাশের ছাদে একটা বাচ্চাকে দেখে এক্সাইটমেন্টে একটা কথা বলে ফেলেছিলাম। আপু কষ্ট পেয়েছে।”
নেহাল খানিকটা বিস্মিত হলো লিলির কথায়৷ এই কয়দিনে দেখে মনে হয়েছিল, মেয়েটা কাউকে পরোয়া করে না। কে কী ভাবল সেসবও ভাবে না। কিন্তু আজ নেহালের সেই দৃষ্টিভঙ্গি যেন হোঁচট খেল। কেবল ওর সাথেই মেয়েটা এমন রূঢ়, বাকিদের জন্য সে অন্তর দিয়ে ভাবে। নইলে কয়েকদিনের চেনা একজনের জন্য এভাবে বিমর্ষ হয়ে পড়ত না।
নেহালের ইচ্ছে করল হাত ধরে সান্তনা সূচক কিছু কথা বলে। কিন্তু এটা করল না, প্রথম দিনে বলা কথাটা মনে পড়ল। যেচে পড়ে কে অপমানিত হতে যায়।
“যেটা বলে ফেলেছ সেটা তো আর ফেরত নেবার কোনো উপায় নেই। তুমি ওর সাথে একবার সামনা-সামনি কথা বলে নিও। তাহলেই হবে। ও যে ধরনের মানুষ, এসব কথা পুষে রাখবে না।”
“আপু তো চেলে গেছে।”
“কাল যাবে আমার সাথে? সকালে আমি বেরুবার সময় ওর স্কুলে নামিয়ে দিয়ে যাব। নাহয় স্কুল টাইমের পরে ওর বাসায় যেয়ো।”
“কথা বলার পরে সেটা ফেরত নেবার কোনো যন্ত্র থাকা প্রয়োজন ছিল।”
নেহাল হেসে ফেলল, “যেহেতু নেই, তাই কথা বলার আগে একটু ভেবে নিলে ভালো হয়।”
লিলির নিজেকে কিছুটা হলেও নির্ভার লাগল। ও নেহালকে এই কয়দিন যেভাবে কটাক্ষ হেনে কথা বলেছে, তার শোধ লোকটা আজ চাইলেই নিতে পারত। কিন্তু কোনোটাই করেনি। মনে মনে কিছুটা যেন কৃতজ্ঞতাবোধ করল। যদিও হাবেভাবে তা প্রকাশ করতে সে অপারগ।
“চা খাবেন?”
“তুমি বানাবে?”
“হ্যাঁ। যদিও খুব একটা ভালো হয় না। তবে আম্মু পছন্দ করে।”
“আচ্ছা, খাবো।”
লিলি বেরিয়ে গেল, নেহাল স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। যাক, আজ কোনো কথা কাটাকুটির মধ্য দিয়ে যেতে হলো না। নেহাল একবুক সাহস নিয়ে ‘তুমি’ বলেছে আজ। মেয়েটা খেয়াল করেছে কিনা বুঝতে পারছে না। ওর বলতে ইচ্ছে করছিল তাকেও যেন লিলি ‘তুমি’ করে বলে। কিন্তু সাহস করে উঠতে পারেনি। পাছে আবার বয়স নিয়ে কথা শুনতে হয়।
মেয়েটার ভালো মুড আজ দীর্ঘস্থায়ী হোক। সেটাই মঙ্গল নেহালের জন্য।
***
নওরীন কিছুদিন থেকে চলে গেল বলে রোমেনার মন কিছুটা খারাপ ছিল। তবে এখন ঠিক আছে৷ তিনি সন্ধ্যার নাস্তার ব্যবস্থা করছিলেন। মালতি সাহায্য করছিল।
“তুমি আমাকে ডাকলে পারতে। এসে গল্প করতাম।”
লিলিকে দেখে রোমেনা একগাল হেসে বললেন, “তোর শরীর ঠিক আছে? সারাদিন দেখা নেই। আমি একবার গিয়ে দেখলাম ঘুমিয়ে পড়েছিলি।”
নওরীন কি রোমেনাকেও কিছু বলেননি, নাকি তিনি জেনেও এড়িয়ে গেলেন! লিলিও আর সে প্রসঙ্গে গেল না।
“মন খারাপ ছিল এখন ঠিক আছে।”
“তৌহিদা কল করেছিল। তুই একবার দেখা করে আসিস। আমি ওকে কত করে আসতে বললাম। সে রাজি হয় না। আরে আমি তোর মেয়ের শাশুড়ির আগে তো তোর প্রাণের বান্ধবী। সেটা কি ভুলে গেছিস?”
লিলিরও মন কেমন করে মায়ের জন্য। কিন্তু জেদ ওকে বাঁধা দেয়। তবে কাল সে নওরীনের সাথে কথা বলে মায়ের সাথে দেখা করে আসবে বলে ঠিক করল।
“আমি পাশের চুলায় চা করি?”
“কর।”
“তোমার ছেলে কেমন চা পছন্দ করে বলো তো?”
রোমেনা লিলির দিকে তাকিয়ে নিজের স্বস্তি গোপন করে বললেন, “ঘন দুধের চা ওর বেশি পছন্দ। তুই পারবি?”
“যা পারি তাই খাবে। আজ নাহয় পাতলা চা-ই খেলো। সে কোন দেশের রাজাধিরাজ, যে সব মেপে মেপে দিতে হবে?”
লিলির বলার ভঙ্গিতে রোমেনা ঘর কাঁপিয়ে হাসলেন।
“সেটাই। আমার ছেলেটা সারাক্ষণ নিয়মের মধ্যে থাকতে চায়। মাঝে মাঝে অনিয়ম না করলে আর জীবনের মজা কোথায়। তুই ঘাড়ে ধরে হতচ্ছাড়াটাকে একটু অনিয়ম শিখিয়ে দিস তো।”
তার কথা শেষ হতে লিলি মনে মনে দেখেও ফেলল সে নেহালকে ঘাড়ে ধরে ট্যালট্যেলে চা খাওয়াচ্ছে আর বেচারা কাঁচুমাচু মুখে নিতান্ত অনিচ্ছায় চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। বেচারা নেহাল! লিলি যে কে এবার ঠিক সে বুঝিয়ে দেবে! আজকের জন্য কেবল মাফ করেছে প্রতিদান হিসেবে।
কল্পদৃশ্যটা ভাবা মাত্রই লিলিও রোমেনার সাথে হেসে লুটোপুটি খেল।
শাশুড়ি আর বউয়ের এমন যৌথ হাসির শব্দে আশফাক আর নেহালও ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে রান্নাঘরের সামনে।
নেহাল বিয়ের আগে দেখা সেই ছবিতে এমন হাসি দেখেছিল লিলির, আজ চোখের সামনে দেখল। কী উচ্ছল, প্রাণবন্ত হাসি! একরাশ স্নিগ্ধতা মেয়েটার চোখেমুখে লেপ্টে আছে যেন। সুখ সুখ একটা কীসের যেন ব্যাথা বেজে উঠল নেহালের হৃদয়পটে!
…….
(ক্রমশ)
#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১২)
নুসরাত জাহান লিজা
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠেছে লিলি। নেহালের খুব ভোরবেলায় উঠার অভ্যাস। একদিনও ঘুম ভেঙে সে নেহালকে পাশে পায়নি। আজ নওরীনের স্কুলে যাবে বলে এলার্ম দিয়ে রেখেছিল। পরে একা একা তার বাসায় যাবার চাইতে স্কুলে যাওয়ার প্রস্তাবটা লিলির বেশি মনে ধরেছে।
সকালের নাস্তার টেবিলে লিলি রোমেনাকে জিজ্ঞেস করল, “আমি আজ নওরীনে আপুর স্কুলে যাব।”
“সে তো ভালো কথা। যা, খুশি হবে মেয়েটা।”
লিলি খানিকটা ইতস্তত করে রুটির টুকরো আলু ভাজিতে নাড়াচাড়া করতে করতে বলল, “বলছিলাম, কী পরে যাব?”
নেহাল খাওয়া থামিয়ে একবার লিলির দিকে তাকালো। রোমেনা উত্তর দিলেন, “তোর যা ভালো লাগে তাই পরবি। শোন, বিয়ে করেছিস বলে জিজ্ঞেস করে পোশাক পরার কোনো দরকার নেই। কোনো সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রেও সেটা যদি ভালো কিছু হয়, তবুও করে ফেলিস। আমরা এখন তৌহিদার পরে সবচাইতে আপন মানুষ। ও তোকে যেভাবে বড় করেছে, যা তোর অভ্যাস, সেসব নিয়ে আমরা কোনোদিন মাথা ঘামাব না। বুঝলি? তুই যেমন আমরা তোকে সেভাবেই ভালোবাসি। রেসপন্সিবিলিটির প্রশ্ন যদি আসে সেটা আলাদা ব্যাপার। সময়ের সাথে সাথে ওটা এমনিতেই আসবে। একবারে সব কয়টা আনার দরকার নেই। ধীরেসুস্থেই আসুক।”
কথা শেষে মৃদু হাসলেন রোমেনা, লিলির ভারি ভালো লাগল। এতকিছু ভেবে সে কথাটা বলেনি। রোমেনার ব্যাপারে মা’য়ের কাছ থেকে শুনে একটা ধারণা তৈরি হয়েছিল, এই কয়দিনে তার সাথে মিশে সেটা পোক্ত হয়েছিল। আজ মন থেকে মানুষটার প্রতি শ্রদ্ধার জায়গা তৈরি হলো।
উত্তর যদি নেতিবাচক হতো, লিলি সেটা মানতে পারত না বোধহয়। নাকি ওর অবচেতন মন জানত মায়ের কাছ থেকে যেমন প্রশ্রয় পেয়ে এসেছে, তেমন প্রশ্রয় সে অন্য মায়ের কাছ থেকেও পাবে!
লিলি ঘরে এসে ওর পছন্দের একটা সালোয়ার কামিজ বের করে পরল। পুরোপুরি তৈরি হয়ে বসার ঘরে এসে নেহালের জন্য অপেক্ষা করতে লাগল।
সে খেয়াল করেছে এই ছেলের তৈরি হতে অনেক সময় লাগে৷ ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক সময় লাগায়। এতক্ষণ কী করে কে জানে! ভাগ্যিস ব্যাটা পুরুষ মানুষ, নারী হলে মনে হয় দিনের অর্ধেক সময় লাগিয়ে দিত রূপচর্চা আর সাজুগুজুতে।
নেহাল বেরিয়ে আসতেই লিলি বলল, “যাক সাজুগুজু শেষ হলো আপনার। মেকওভারের জন্য একটা বিউটিশিয়ান রাখতে পারতেন, তাহলে তাড়াতাড়ি হতো।”
নেহাল নিঃসন্দেহে দেখতে সুপুরুষ, তার উপর বেশভূষায় ভীষণ পরিপাটি। লিলি খেয়াল করল একটা চুল পর্যন্ত এলোমেলো নেই। অন্যসময় মুখটাও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত মনে হয়। এখন অবশ্য তা মনে হচ্ছে না। লিলির কথায় ভড়কে গিয়ে মুখে একটা বোকা বোকা অভিব্যক্তি ফুটেছে৷ সেই বোকাটে অভিব্যক্তিকে খুব ধীরে ধীরে প্রতিস্থাপিত করছে রাগ।
“সাজুগুজু করতে যাব কেন?”
“তাহলে আয়নার সামনে এক ঘণ্টার চার ভাগের একভাগ সময় কী করেন? বিউটি কন্টেস্টে যাবেন?”
নেহাল হাতের ঘড়িটায় একবার চোখ বুলিয়ে বলল, “এবার চলো। আমার দেরি হয়ে যাবে। অফিসে লেট করলে ঝামেলা হবে।”
ছেলেবেলা থেকে শুনে আসা বহুল চর্চিত একটা কৌতুক বলার লোভ সংবরণ করতে পারল না লিলি। সে নিজের হাসি বিস্তৃত করে বলল,
“লেট করলে দেরি তো হবেই, তাই না! তবে এরজন্য কিন্তু আপনি নিজেই দায়ী।”
নেহালের লাল হয়ে যাওয়া মুখটা উপভোগ করার সুযোগ বেশিক্ষণ পেল না লিলি। বেরসিক বুড়োটা কথার কোনো উত্তর না দিয়ে হনহনিয়ে হাঁটতে শুরু করেছে। চিৎকার করে বলল,
“মা, আমি বেরুচ্ছি।”
কথার উত্তর না দিলে তাকে জ্বালিয়ে মজা আছে নাকি! ধূর!
রোমেনা বেরিয়ে এলেন ততক্ষণে, প্রতিদিন বেরুবার আগে তিনি দোয়া পড়ে ফু দিয়ে দেন। আজ দুজনকেই দিলেন।
লিলি অবলীলায় বলল, “আসি মা। ফিরতে হয়তো সন্ধ্যা হবে।”
খাবার টেবিলেই লিলি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রোমেনাকে সে মা বলে ডাকবে। হতে পারে এই বিয়ে নিয়ে ওর মনে কোনো ইতিবাচক অনুভূতি নেই, হতে পারে তার ছেলেকে ওর অপছন্দ। কিন্তু এই স্নেহময়ী ভদ্রমহিলাকে সে এড়িয়ে যেতে পারে না। তার মধ্যে একটা সম্মোহনী শক্তি রয়েছে।
রোমেনা তার ডান হাতে লিলির মাথায় আদর করে দিয়ে বললেন, “আয় তবে।”
***
নেহালের মোটরবাইকের পেছনে বেশ স্বচ্ছন্দ ভঙ্গিতে বসল লিলি। যদিও বাইকে বসার তেমন অভিজ্ঞতা ওর নেই। তবে ওর মানিয়ে নেবার ক্ষমতা ভালো এক্ষেত্রে।
বাইক চলতে শুরু করলে লিলি এক হাতে নেহালের কাঁধ কিঞ্চিৎ চেপে ধরল, আরেকহাত বাইকের পেছনদিকে রেখে ব্যালেন্স করে বসেছে। এবারও সে নিঃসংকোচেই আছে বলা যায়৷ তবে নেহাল কিছুটা চমকিত হলো। তবে সামলে নিল দ্রুত।
“তুমি ক্লাসে যাচ্ছো না কেন?” প্রথমে নেহালের প্রশ্ন লিলি শুনতে পায় না৷ নেহাল গলা চড়িয়ে আরেকবার প্রশ্নটা করতে সে উত্তর দিল,
“সে উপায় কি রেখেছেন?” লিলিরও গলার স্বর চড়েছে।
“আমি কি বিধিনিষেধ জারি করেছি নাকি?”
“সবাই প্রশ্ন করবে। বরের ছবি দেখতে চাইবে। টিকা টিপ্পনী আমাকেই সহ্য করতে হবে।”
কাল থেকে লিলির প্রতি একটা ভালো ইম্প্রেশন তৈরি হচ্ছিল নেহালের মনে, আজ এই কথায় সেটা যেন টলে উঠল। নিজের বয়সের ব্যাপারটা কেন বারবার যে সে ভুলে যায়!
বাইরে মৃদু রোদ উঠেছে আজ, তীব্রতা এখনো সেভাবে ছড়াতে শুরু করেনি। তবুও সেই মৃদু উত্তাপেই যেন নেহালের ভেতরে জমে উঠা সদ্য জন্মানো অনুভূতিটা ভস্ম হয়ে যাচ্ছে।
বাতাসে লিলির চুল উড়ছে, কিছু চুল নেহালের মুখের আশেপাশে চলে আসছে। এতক্ষণের মিষ্টি আবেশটুকুতে কেউ যেন মুহূর্তেই এক সমুদ্র চিরতার রস ঢেলে দিয়েছে। তিক্ততার প্রাবল্য বাড়তে থাকল নেহালের মনে। নিজের জন্য, নিজের বাড়তি কিছু বয়সের জন্য, একটা উচ্ছল মেয়ের স্বপ্নভঙ্গের জন্য। কী যে দহন সেখানে!
দগ্ধ প্রাণে নেহাল নওরীনের স্কুলের সামনে লিলিকে নামিয়ে দিয়ে একটা কথাও না বলে বাইক ছুটিয়ে চলে গেল অফিস পানে।
***
নওরীন কয়েকদিন থেকে খেয়াল করেছে ক্লাস থ্রি’র পুস্পিতা মেয়েটা অনুপস্থিত। সে ওদের ক্লাস টিচারের ডেস্কের সামনে রাখা চেয়ারে এসে বসল।
শাহানা প্রশ্ন করল, “কী খবর?”
“চলছে।”
“তোমার?”
“ভালো। তা আজ হঠাৎ আমার কথা কেন মনে হলো সেটা বলো?”
“পুস্পিতা নামের মেয়েটা কয়েকদিন আসছে না কেন বলতে পারো?” সমবয়সী বলে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্ব ভালো।
“ও, মেয়েটার মা খুব অসুস্থ। ভদ্রমহিলার ডিভোর্স হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। মেয়েকে নিয়ে একাই থাকেন। উনি সমস্যার কথাটা আমাদের জানিয়েছেন। তবে..”
“তবে কী?”
“তেমন ডিটেইলে জানি না। তবে জটিল একটা অপারেশন হবার কথা রয়েছে। ওদিকে তাদের লাভ ম্যারেজ ছিল, বাড়ি থেকেও মেনে নেয়নি। তার মা এসেছেন। কিন্তু উনার মায়েরও বয়স অনেক।”
শুনতে শুনতে নওরীনের চোখে পুস্পিতার সরল মুখটা ভেসে উঠল। কী মায়াকাড়া নিস্পাপ মুখ! ক্লাসে খুব চুপচাপ থাকে বলে নওরীনের নজরে পড়েছিল। ওদের ইংলিশ ক্লাসটা সে নেয়। কিছু জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়, নয়তো শান্ত হয়ে বসে থাকে। বসেও এক কোণায়। তেমন কোনো বন্ধুও নেই বোধহয়।
নওরীন সিদ্ধান্ত নিল আগামীকাল যেহেতু শুক্রবার আছে, সে পুস্পিতার বাসায় যাবে, ঠিকানাটা নিতে হবে।
***
ক্লাস নেবার জন্য নওরীন বেরুচ্ছিল, একজন এসে খবর দিল অভিভাবকদের জন্য নির্ধারিত ওয়েটিং রুমে একজন ভিজিটর এসেছে ওর। সময় দেখে নিয়ে সেদিকে প্রায় ছুটে এসে লিলিকে দেখতে পেল। ওকে একদমই আশা করেনি।
বিশ্রাম কক্ষ তখন গিজগিজ করছে। এরমধ্যে লিলি উঠে এসে সবার সামনেই নওরীনকে জড়িয়ে ধরল।
“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। ইনটেনশনালি কিছু বলিনি। তুমি প্লিজ আমার সাথে রাগ করে থেকো না। খুব কষ্ট হচ্ছে আমার।”
নওরীন বলল, “সেটা আমি জানি। কিন্তু সবাই কী ভাববে বল তো?”
লিলি সম্বিতে ফিরল, নওরীনকে ছেড়ে দিয়ে বলল, “তোমার ক্লাস আছে এখন? থাকলে আমি অপেক্ষা করব। ফ্রি আওয়ারে সামনের কফিশপে যাবে আমার সাথে। তারপর আড্ডা দিয়ে চলে যাব।”
“এখন ক্লাসেই যাচ্ছিলাম। চল্লিশ মিনিটের ক্লাস। এতক্ষণ অপেক্ষা করবি?”
“আমার সমস্যা নেই।”
লিলি একেবারে কোণেরদিকে গিয়ে জায়গা করে বসল। ফোন ঘাটছিল, কিন্তু সেদিকে ওর মন নেই। আজ নেহালকে বলা কথাটার জন্য নিজের কাছেই যেন কেমন লাগছে। নিজেকে খুব তুচ্ছ, ক্ষুদ্রমনা মনে হচ্ছে।
বারবার একই কথা যে সে কেন বলে! এটা ঠিক, সে অকপট স্বীকারোক্তি দিতে পছন্দ করে। তবুও একই কথা লোকটাকে সে কেন জানাচ্ছে! কেন তার মতো সে-ও সহজ হতে পারছে না! কোথায় বাঁধছে আসলে, বয়স নাকি কেবলই ইগো!
জোর করে চাপিয়ে দেয়া একটা সম্পর্কে ওকে বাধ্য করা হয়েছে বলে ওর ইগোতে ভীষণভাবে আঘাত লেগেছে বিষয়টা সেজন্য!
হারজিতের খেলায় বাধ্যগত হারকে ওর অবচেতন মন কিছুতেই মানতে পারছে না৷ আবার একটা মানুষকে ক্রমাগত কথা দিয়ে আহত করতেও কোথায় যেন বাঁধছে। সে না পারছে সম্পর্ক মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যেতে, না পারছে সবটা চুরে ভেঙে পায়ে দলতে। এমন একটা দ্বিধায় ওকে কেন ফেললেন মা! নিজেকেই কেমন অচেনা লাগছে, নিজের ভেতরের এই দ্বৈত বৈপরীত্যে টালমাটাল অনুভূতিতে সে পেন্ডুলামের মতো দুলছিল।
একটা রোলার কোস্টারের পাশে সে যেন একা স্থির দাঁড়িয়ে আছে। তুফান তোলা গতিশীল সব, লিলি একা আটকে আছে কোনো এক বদ্ধ প্রকোষ্ঠে! নিশ্চল, নির্জীব, নিস্পৃহ, নিস্পন্দ!
……
(ক্রমশ)