#মাইনাসে_মাইনাসে_প্লাস (পর্ব ১)
“বাচ্চা মেয়ে বিয়ে করবি না মানে কী? তোর কী মনে হয় তোর বয়সী মেয়েরা তোর জন্য শোক পালন করে বরমাল্য নিয়ে বসে আছে? কবে তোর সুমতি হবে আর ওদের কপালে বিয়ের ফুল ফুটবে?”
নেহাল মায়ের কথায় হতভম্ব হয়ে গেল, মিনমিনে গলায় কোনোমতে বলল, “তাই বলে কেবল অনার্স ভর্তি হয়েছে এমন মেয়ে? আমার বয়স কত জানো মা?”
“তোর বয়স আমি না জানলে কে জানবে, গাধা? তোরে এত মাস পেটে রেখেছি, জন্ম দিয়েছি। আজ মনে হচ্ছে একটা গাধা পুত্র জন্ম দিয়েছি। এসব কী ধরনের প্রশ্ন করিস? দিন দিন তোর বুদ্ধি তোর বাপের মতো হাঁটুতে চলে যাচ্ছে। যাবে নাই-বা কেন, রক্ত তো।”
“উফ মা, আমি প্রশ্ন করেছি নাকি। তুমি এত বাজে কথা বলো…”
নেহাল বাকি কথা বলতে পারল না, তার আগেই তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, “হ্যাঁ, এখন আমি বেশি কথা বলি, আমার কথা কারো সহ্য হয় না, গায়ে ফোস্কা পড়ে। থাক তোরা, তুই আইবুড়ো হয়ে বসে থাক, তোর বাপকে আরেকটা বিয়ে করা। আমি যেদিকে দুচোখ যায়, চলে যাই।”
নেহাল দীর্ঘশ্বাস ফেলল একটা, ওর মা রোমেনা সবসময় একটা ছোট বিষয় নিয়ে এমন এক্সাইটেড হয়ে যান, ইমোশনাল ব্ল্যা”ক”মেইল করে কাজ হাসিল করেন। বাবার সাথেও সারাদিন খিটমিট লেগে থাকে। দুজন পারেও, ‘বিনা যু* *দ্ধে নাহি দেব সূ”চা”গ্র মেদেনি’ পন্থা অবলম্বন করে! কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ।
“প্লিজ মা, থামো এবার। যা ইচ্ছা করো। একটা স্কুলের ন্যাদা বাচ্চা ধরে আনলে তাকেও বিয়ে করব। ইউনিফরম পরিয়ে, চুলে বিনুনি বেঁধে, ব্যাগে বই, খাতা, পেন্সিল টিফিন বক্স ভরে স্কুলে দিয়ে আসব, আবার নিয়ে আসব, হোমওয়ার্কও করে দেব। এখন খুশি?”
মা অগ্নিদৃষ্টি হেনে বললেন, “তোর মতো দা”ম”ড়া”র জন্য স্কুল পড়ুয়া মেয়ে আনার মতো অবিবেচক আমি না। বলেছি না মেয়ে অনার্স ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে।”
“তোমার যা খুশি, করো। একটা করাও, দশটা করাও তাও করব, তবুও শান্তি দাও মা, প্লিজ।”
“ও, তাই তো বলি, তলে তলে দশটা বিয়ের মতলব আঁটা শেষ। আর আমি হাহুতাশ করে মরি।”
“মা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটু চুপ করো।”
দাঁতে দাঁত চেপে কথাটা বলে উঠে চলে গেল নেহাল, পিছনে তাকালে মায়ের মুখে স্বস্তিটুকু চোখে পড়ত!
***
নেহালের বয়স বত্রিশ যাই যাই করছে, রোমেনা ছেলের বিয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছেন। ছেলে যে কেন এখনো বিয়েতে রাজি হয় না সেটা তিনি আজও বের করতে পারলেন না। তবে এবার তিনি বদ্ধপরিকর। তার ছেলেবেলার বন্ধু তৌহিদার সাথে তার কথা বলাও শেষ। তার মেয়ে লিলির বিষয়ে। নেহালের সাথে বয়সের একটা সুস্পষ্ট ব্যবধান থাকবে ঠিকই, কিন্তু মেয়েটাকে তার বড্ড ভালো লাগে। কী প্রাণবন্ত একটা মেয়ে, একটু ছটফটে, কিন্তু বয়সটাই তো এমন। নিজের চাপা স্বভাবের ছেলের জন্য এমন একটা মেয়েকেই তার পছন্দ। লিলির মতামত অবশ্য জরুরি, এখন সেখান থেকে সবুজ সংকেত পেলেই নিজের ছেলের সাথে তিনি যুঝে নেবেন। কী পেয়েছে সে! সন্নাসী হবে? তাহলে হিমালয়ে চলে যাক, এই বাসায় তার চোখের সামনে নয়! এসব রোমেনা এক ফোঁটাও বরদাস্ত করবেন না।
পত্রিকা থেকে মুখ তুলে আশফাক বললেন, “ছেলেটাকে এমন ইমোশনাল ব্ল্যা ক মে ই ল না করলেই পারতে। বিয়ে নিয়ে একটু সুস্থির হয়ে ডিসিশন নেয়া যেত না?”
রোমানার ধারণা আশফাক একজন উদাসীন মানুষ, ছেলেও হয়েছে ঠিক বাপের মতো। কই তার মেয়ে তো এমন হয়নি, তাদের মেয়ে নওরীন তো কী সুন্দর সংসার সামলাচ্ছে, একটা স্কুলে পড়াচ্ছেও সুন্দর করে। তিনি গলায় একটু ঝাঁঝ ঢেলে বললেন,
“একজন পুত্রদায়গ্রস্ত পিতার মুখে এমন বুলি মানায় না। সব দায় শুধু আমার। মা তো! বলি, ছেলেটার যে মেঘে মেঘে বেলা হয়ে তাও পড়ন্ত অবেলা হয়ে যাচ্ছে, ওদিকে ছেলের মন নাকি এখনো লাটিমের মতো ঘুরছে। আরও সময় দিতে হবে?”
খানিকটা থেমে রোমেনা ষড়যন্ত্রীর মতো বললেন, “নাকি শ্বশুর হয়ে যাবে এটা মানতে পারছ না? শোনো, ছেলের বিয়ে দিলেও তুমি বুড়ো হয়েছো, না দিলেও বুড়াই থাকবে। তাই টাংকি মা”রা”র চিন্তা ঝেড়ে ফেলো। বুঝেছো? আমি ছাড়া আর কোনো নারী তোমার দিকে কোনোদিন মুগ্ধ চোখে তাকায়নি, তাকাবেও না।”
স্ত্রীর এমন অদ্ভুত তত্ত্বে আশফাক এখন আর হতচকিত হয়ে যান না! অভ্যস্ত হয়ে গেছেন, কিন্তু শুরুর দিকে এমন ভিরমি খেতেন, কথাতেই মনে হয় তার উদর পূর্তি হয়ে যেত, খাওয়া দাওয়া না করেও। তিনি পত্রিকার পাতায় পুনরায় চোখ রাখতে রাখতে নির্বিকার গলায় বললেন,
“টাংকি মানে কী?”
“ও মা, তুমি জানো না? আকাশ থেকে এইমাত্র টুপ করে পড়লে নাকি? তোমার পেটে পেটে যে কী তা তো এতগুলো বছর ধরে দেখেছি। ছেলেকে একটু টিপস্ টুপস দিতে, কী করে মেয়ে পটাতে হয়! তাহলে আর পুত্র দায়গ্রস্ত পিতামাতার তকমা আমাদের কপালে জুটত না।”
“আমি কবে মেয়ে পটালাম?”
“আমি কী এমনি এমনি বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম নাকি? তোমার ওই পটানি মার্কা লাল্টু বল্টু কথা শুনেই তো হ্যাঁ বলে দিলাম। কপাল আমার!”
এরপর আশফাক মেনে নেয়া ছাড়া আর অন্য কোনো উপায় খুঁজে পান না। জোঁকের মুখে নুন পড়লে যেমন তারা খোলসে ঢুকে যায়, তিনিও তাই গেলেন। তর্ক এখন আর করতে ইচ্ছে করছে না, যখন ইচ্ছে হবে তখন মনে করিয়ে দেয়া যাবে! স্ত্রীর গজগজ উপেক্ষা করে তিনি আবারও পত্রিকায় ডুবে গেলেন।
***
লিলি এখানে ভর্তির পরপর সোহানের সাথে পরিচয় হয়েছিল। প্রথমে তো একটু অন্যরকম মনে হয়েছিল বলে পাত্তা দিয়েছিল খানিকটা। এই তো সেদিনই প্রপোজ করেছিল, দুদিন ঘুরিয়ে ‘হ্যাঁ’ বলে দিয়েছিল। কিন্তু আজ সে বলছে,
“লিলি, তুমি একটু নিজেকে পাল্টানোর চেষ্টা করো। এমন যখন যা ইচ্ছে তাই করা, তাই বলাটা ভালো নয়।”
“কেন? তুমি তো বলেছিলে আমি এমন বলেই তোমার ভালো লেগেছে। তাহলে এখন কেন নিজেকে বদলাতে হবে?”
“তুমি এমন থাকলে আমার পরিবারে তোমার কথা বলতে পারব না। কেউ পছন্দ করবে না তোমাকে।”
“তাহলে তুই আমার পিছে ঘুরলি কেন? ঘ্যানঘ্যান করলি কেন? তখন মনে হয় নাই?”
“এভাবে কথা বলছো কেন? তুই বলে…”
“আমার মেজাজ অত্যন্ত গরম হয়ে আছে, এক মিনিটের মধ্যে আমার চোখের সামনে থেকে বিদায় না হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।”
“আরে…”
“দুই সেকেন্ড চলে গেছে। বলতে বলতে আরও..”
তবুও সোহান বসে আছে, লিলি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “তোমার ফ্যামিলির আগে আমি তোমার সাথে ব্রেকআপ করলাম। এখানে বসে থাকো। আর কোনোদিন যেন আমার সামনে তোমাকে না দেখি। আজ যথেষ্ট ভদ্রতা বজায় রেখেছি। এরপর আমি কী ধরনের সিনক্রিয়েট করতে পারি তোমার ধারণা আছে অবশ্যই।”
বড় করে একটা শ্বাস টেনে ভরা রেস্টুরেন্ট থেকে শিস বাজাতে বাজাতে বেরিয়ে এলো লিলি। কেউ কেউ ঘুরে ওকে দেখল, কিন্তু এতে সে থোড়াই কেয়ার করে!
বাইরে এসে দেখল প্রচণ্ড রোদ, চোখ ধাঁধিয়ে গেল। একটা রিকশায় উঠে বসে ফোনটা বের করল। কল করল ওর সবচাইতে কাছের বন্ধু তরীকে। তিনজনের একটা ছোট্ট দল ওদের। আরেকজন সদস্য মিতু। সে ঢাকায় নেই আপাতত। খালাতো বোনের বিয়ের দাওয়াতে গেছে বলে ওকে বিরক্ত করেনি। আরও কয়েকজন আছে, কিন্তু এরা ওর ভেতর পর্যন্ত চেনে।
কল রিসিভ হতেই লিলি বলল, “ব্রেকআপ করলাম।”
“সে কী! এক সপ্তাহও হয়নি, এখনি ব্রেকআপ?”
“ভেড়া চিনতে পারলে আর এগুবো কেন?”
“তোর মন খারাপ?”
“ধূর! কোনো ধরনের ইমোশনাল এটাচমেন্টই তৈরি হয়নি। হতো কিনা জানি না! তবে ওর আগের কথাবার্তার সাথে পরের কথাবার্তার মিল নেই। যেন আমাকে পেয়ে গেছে একেবারে! ফাজিলের ফাজিল। কী মনে করে! আমি বিরহে কাতর হয়ে বোতল ধরব দেবদাসের মতো নাকি আগের সিনেমার নায়িকাদের মতো কাঁদতে কাঁদতে গান গাইবো আর পেছনে কয়েক হাত লম্বা আঁচল মেলে বন বাদারের ধূলোময়লা পরিষ্কারের দায়িত্ব নেব? আমি এত সস্তা?”
“আচ্ছা, ওইসব নিয়ে ভেবে কাজ নেই তাহলে। তুই আমার বাসায় আসবি আজ? নেটফ্লিক্সের নতুন সিরিজটা দেখা যেত একসাথে।”
“না রে! আম্মু চিন্তা করে বাইরে থাকলে। একবার কী কান্ড হলো তোর মনে নেই?” এবারের কথাটা বলল সহজ গলায়। নিজের কথাগুলো ঝেড়ে ফেলতে পেরে স্বস্তি পাচ্ছে।
“এই তরী, পরে কল করি, আম্মু কল দিয়েছে রে। কা”ট।”
রিকশা হেলেদুলে চলছে, ওদের গলিতে চলে এসেছে প্রায়।
“মা,.. ”
“কখন আসবি বাসায়?”
“এই তো চলে এসেছি প্রায়।”
লিলি ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছে ততক্ষণে। সোহানের ব্যাপারটা আর মাথায়ই নেই এখন।
***
ফোন রেখে মেয়ের ফেরার অপেক্ষা করতে লাগলেন তৌহিদা। নিজের মেয়েকে নিয়ে তিনি ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এমন বে*য়া*দব আর উ*গ্র হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। ইন্টারমিডিয়েটে ভর্তির পর থেকে এসবের সূত্রপাত। একগাদা অ*কাট বে*য়া*ড়া বন্ধুবান্ধব তখনই জুটেছিল। এদের চক্করের প্রভাব পড়েছে রেজাল্টেও। এরপর প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছে কিছুদিন হলো। সেখানেও আরও কিছু জুটেছে বলেই তার মনে হচ্ছে। এখন সময় ভালো না, কী থেকে কী করে বসে ভাবলেই তার গা, হাত, পা ঠান্ডা হয়ে আসে।
তার বাল্যবন্ধু রোমেনাকে সব খুলে বলতেই একটা অদ্ভুত সমাধান পাওয়া গেছে। কিন্তু তাতে তিনি সায় দিতে পারছেন না৷ রোমেনার ছেলেকে তিনি চেনেন৷ অত্যন্ত ভদ্র আর শান্ত ছেলে। তার ঘাড়ে নিজের এই দস্যি মেয়ের দায়িত্ব সঁপে দেয়া মানে তো সুযোগ নেয়া।
রোমেনা চিরকালই ঝোঁকের মাথায় সিদ্ধান্ত নেন, সমস্যা যত কঠিনই হোক, তার কাছে সেটার অত্যন্ত সহজ সমাধান থাকে। ভীষণ প্রাণবন্ত মহিলা। তৌহিদা নিজের জীবনের অনেক চড়াই-উতরাইয়ের গল্প তার সাথে নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিয়েছেন। সেজন্যই মনের সাথে এই দ্ব*ন্দ্ব।
তাছাড়া মেয়ের বয়সও কম, কী করবেন ভেবে পান না। স্বামী গত হয়েছে বহু বছর আগে, যখন তার একমাত্র মেয়ে লিলির বয়স ছিল মাত্র চার বছর। আর বিয়ে করেননি, কারোর সাথে নিজেকে জড়াননি। একাই হাল ধরে মেয়েকে বড় করছেন। কিন্তু লিলিটা অতি স্নেহ আর ভালোবাসা পেয়ে পর্যাপ্ত শাসনের অভাবে এভাবে বিগড়ে যাচ্ছে ক্রমশ!
একটা সিদ্ধান্তে এলেন তিনি, নাহ্! এবার একটু শক্ত হাতে রাশ টেনে ধরতেই হবে। প্রয়োজন হলে রোমেনার প্রস্তাবটাও লুফে নেবেন তিনি। মেয়ে রাজি হোক বা না হোক।
……
(ক্রমশ)
নুসরাত জাহান লিজা