#মহুয়া
#শারমিন_আক্তার_সাথী
পর্ব: ৭
প্রিয়তির মা রেহেনা পলাশকে বলল,
_” শুনছো? প্রেমাকে ফোন করো? দেখো তো ও কী করছে কোথায় আছে?
পলাশ প্রেমার ফোন ট্রাই করল। দুবার রিং হবার পর প্রেমা রিসিভ করে বলল,
_” হ্যাঁ বাবা বলো? প্রিয়তির কী খবর? বেঁচে আছে নাকি মরছে?
প্রেমাকে পলাশ সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে তারমানে এ জন্য যে, মেয়ের যা তা কথা শুনে র্নিবোধ মেরুদন্ডহীনের মত চুপ থাকবেন। তিনি প্রেমাকে কঠিন ধমক দিয়ে বললেন,
_” তুই এত অমানুষ কি করে হলি? আমার রক্ত এতটা জঘণ্য হবে তা কিন্তু চিন্তাও করিনি। প্রিয়তি তো তোর নিজের বড় বোন। বড় বোনের এত বড় ক্ষতি করেও এভাবে কথা বলছিস? সামান্যতম মায়াও কি কাজ করে না তোর মধ্যে? মানুষ এমনও হয়?
প্রেমা ঝাঁজালো কন্ঠে উত্তর দিল,
_” তোমার মেয়ের মতে তো আমি মানুষ না আমি একটা ডাইনী। তাই ডাইনীদের মায়া থাকতে নেই।
পলাশ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ত্যাগ করল। প্রেমা হাতের বাইরে বহু আগেই চলে গেছে। তাকে এখন ফেরানো মুশকিল। যখন ফেরানের প্রয়োজন ছিল তখন ফেরায়নি, এখন বড্ড দেরী হয়ে গেছে। লোকে ঠিকই বলে, লোহা যখন গরম থাকে তখন তাকে নিজের পছন্দমত রূপ দিতে হয়। পরে ঠান্ডা হয়ে যাবার পর নতুন রূপ দিতে গেলে হয় নিজে ভেঙে যায়, নাহয় অন্যের ক্ষতি করে। পলাশের প্রেমার সাথে কথা বলার ধৈর্য্য আর হলো না। তিনি ফোনটা রেহেনার হাতে দিয়ে বললেন, তোমার ইতর মেয়ের সাথে তুমিই কথা বলো। মেয়েটা হাত থেকে একদম বেড়িয়ে গেছে। রেহেনা কিছু বুঝতে না পারলেও আন্দাজ করতে পারলেন। ফোনটা কানে নিয়ে বললেন,
_” হৃদয় তোর নামে মামলা করেছে। বাড়ি হয়ত যে কোনো সময় পুলিশ যেতে পারে। তুই আপাতত তোর কোনো বান্ধবীর বাসায় গিয়ে থাক। আমরা পরে সবটা সামলে নিব।
প্রেমা চড়া মেজাজে বলল,
_” হৃদয় কেন মামলা করছে?
_” প্রিয়তিকে হত্যা করতে চেষ্টা করার দায়ে আর ওর সন্তানকে হত্যার দায়ে।
_” ওহ।
_” তোর ভয় করছে না?
_” ভয় কেন করবে? বরং প্রিয়তির পেটে ঐ পরিবারের অংশ নেই বলে ভালো লাগছে। একটা পাপ পৃথিবীতে আসার আগেই কমছে।
রেহেনা চরম বিরক্ত হয়ে বলল,
_” তুই সত্যি উচ্ছন্নে গেছিস রে প্রেমা। যা ভালো মনে হয় কর। ফোন রাখলাম। তোকে পুলিশ ধরলে তখন আমাদের কাছে ন্যাকা কান্না করিস না।
প্রেমা রেহেনার কথায় হালকা ভয় পেলেও নিজের অহংকারকে বেশি প্রধান্য দিল। আর জোরাল কন্ঠে বলল,
_” আসতে দাও পুলিশকে। আমিও দেখে নিব।
৯!!
তিথির মা জাহানা তিথিকে রুমে এনে বলল,
_” প্রেমা তোকে মারল কেন?
তিথি সবটা খুলে বলতেই তিনি বললেন,
_” ওহ।
তিথি বলল,
_” মা তুমি কিভাবে প্রিয়তি আপুর বিষয়টা জানলেন? মানে তার বাচ্চা নষ্ট হবার কথা।
_” হৃদয়কে ফোন করেছিলাম। ওর ফোন মনে হয় ওর বোন হৃদিতার কাছে। ওর সাথে কথা বলে জেনেছি অনেকক্ষণ আগে। তোর খারাপ লাগবে ভেবে বলিনি। প্রিয়তিকে তো তুই খুব ভালোবাসিস। আর প্রেমা! ওকে বলার কি আছে?
_” মা তুমি প্রেমা আপুর গায়ে হাত তুললে চাচি জানলে তুলকালাম করবে।
_” করুক। আমিও চাই সেটা। ঝামেলা না হলে সমাধান হয় না। এবার ভাবি ঝামেলা করলে আমিও করব। নিজের মেয়েকে নূন্যতম শিক্ষা দিতে পারেনি, তারা বড় কথা কোন মুখে বলবে। তোর বড় চাচা চাচির সন্তানদের ভিতর এমন ভেদাভেদ করার ফল আল্লাহর কাছে দিতে হবে।
_” মা আমরা কি সত্যি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব?
_” প্রথমত যাবার ইচ্ছা নেই। আমার বাবার বাড়িতে আমার জমির যে অংশটা আছে সেটা বিক্রি করার ব্যবস্থা করেছি। সেটা বিক্রি করে যা টাকা পাব তাতে তোর বাবার চিকিৎসা করালে ইনশাআল্লাহ তোর বাবা সুস্থ হয়ে যাবেন। আর তিনি সুস্থ হলে তো আমাদের আর কোনো কষ্ট থাকবে না। সব মুসকিল আলহামদুলিল্লাহ্ আছান হয়ে যাবে। দেখা যাক এখন জমিটার ন্যায্য দাম পাই কিনা। ততদিন এ বাড়িতেই থাকতে হবে।
_” বাবা সুস্থ হলে আমরা এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাব। এখানের অসুস্থ পরিবেশে আমার ভালো লাগে না। পড়াশোনাও ঠিকমত করতে পারি না। একটু পড়তে বসলেই চাচি বার বার ডাকেন। এটা সেটা করতে বলেন, তার চুলে বিলি কেটে দিতে বলেন, হাত পা টিপতে বলেন। এক গ্লাস পানি লাগলেও আমাকে ডেকে দিতে বলেন। যেনো আমি এ বাড়ির মেয়ে না কাজের বুয়া। সামনে আমার HSC পরীক্ষা তা তার মাথায় থাকে না। অথচ তার ছেলে মেয়েদের যখন পরীক্ষা হত তখন এক গ্লাস পানির জন্যই বাইরে বের হতে দিতেন না। কিন্তু আমার বেলায়!
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল জাহানারা। মেয়েটা সত্যি বলছে। ওর বাবা অসুস্থ হবার পর ওরা কতটা অসহায় তিনি জানেন। মেয়েটাও সবসময় চুপচাপ থাকে। ওর বয়সী মেয়েদের কত কত আবদার থাকে কিন্তু তিথি বাবা মায়ের অবস্থা বুঝে। খুব প্রয়োজন ছাড়া কারো কাছে কিছু চায় না।জাহানারা তিথির মুখের দিকে তাকিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না। তিথির গোলাপি ফর্সা গালে প্রেমার হাতের ছাপ পড়ে গেছে। জায়গাটা লাল হয়ে বেশ ফুলে গেছে। জাহানারা মনে মনে বললেন, মেয়েটা গায়ের রঙ, চেহারা দেখলে আমার নিজেরই নজর লাগে, আল্লাহ রূপ ঢেলে দিতে কোনো কমতি রাখেনি। পা থেকে মাথা পর্যন্ত যেনো নিপূন ভাবে তৈরী করেছেন। সুন্দর হবার কারনেই ক্লাস নাইন থেকে ভালো ভালো বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করেছে। কিন্তু জাহানারা মেয়ের ব্যাপারে খুব সচেতন। একটাই সন্তান তার। তাকে বিয়ে দিয়ে দায় সারতে চান না। তিনি মেয়েকে তার মত অসহায় রাখতে চান না। তিনি মেয়েকে উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করে ওর নিজের পরিচয় করে দিতে চান। মাঝে মাঝে জাহানারা আফসোস করে, ইস যদি পড়ালেখাটা ভালো করে জানতাম, তবে স্বামীর এমন র্দুদিনে সবার কাছে হাত পাততে হত না। নিজেই কাজ করে সংসারের হাল ধরতে পারত। নিজের অসহায় পরিস্থিতি থেকে যে, শিক্ষা পেয়েছেন, তাতে মেয়েকে তিনি আত্মর্নিভশীল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঘরের মধ্যে পুরুষের ভারী গলা পেয়ে সচকিত হল জাহানারা। মাথায় ওড়নাটা পেচিয়ে যথাসম্ভব নিজেকে ঢেঁকে সামনে গিয়ে পুলিশ দেখে বেশ অবাক হল। পুলিশ প্রেমাকে বলছেন,
_” আপনি প্রেমা?
প্রেমা বেশ র্নিভয় হয়ে কনফিডেন্টের সাথে বলল,
_” হ্যাঁ।
অফিসার রকিব বলল,
_” আপনাকে গ্রেফতার করতে এসেছি।
_” আমার অপরাধ?
_” মিঃ হৃদয় তার স্ত্রীকে হত্যার চেষ্টা এবং তার অনাগত সন্তানকে হত্যার মামলা করেছেন।
_” অন্যায় যে আমি করেছি তার প্রমাণ?
_” প্রমাণ থানায় গিয়ে নিজেকে র্নিদোষ প্রমাণ করাতে আপনি দিবেন। বাকিটা আমাদের মত আমরা তদন্ত করব।
_” আপনি প্রমাণ ছাড়া কাউকে গ্রেফতার করতে পারেন না।
_” আমাকে আইন শেখাবেন না। স্বেচ্ছায় চলুন থানায়, নয়ত আমরা জানি কিভাবে নিতে হবে?
_” বাদী এটা বলেনি কেন বা কি কারণে তার স্ত্রীকে হত্যার প্রচেষ্টা করেছি?
_” হ্যাঁ বলেছে।
_” তাহলে এটাও নিশ্চয় বলেছে তার বাবা কি করেছেন?
অফিসার রকিব বেশ রাগী। প্রেমার ওভার স্মার্ট কথায় রাগে তার গা রি রি করছে। রকিব ধমক দিয়ে বলল,
_” বেশি কথা না বলে চলুন আমাদের সাথে।
জাহানারার দিকে তাকিয়ে বললেন,
_” আপনি কে হন এ বাসার?
জাহানারা বেশ ভয় পেলেন। খানিকটা শুকনো গলায় বললেন,
_” জি প্রেমা আমার ভাসুরের মেয়ে।
রকিব বলল,
_” আপনার মতে মিঃ হৃদয় কি সত্যি অভিযোগ করছেন?
_” জি। আমরা বাসায়ই ছিলাম। হৃদয় সত্যি বলছে।
_” আর কেউ দেখেছে ঘটনাটা ঘটতে?
_” জি আমার মেয়ে। ও সরাসরি সেখানেই ছিল, যখন প্রেমা প্রিয়তিকে ধাক্কা মারে।
_” আপনার মেয়েকে ডাকুন।
জাহানারা তিথিকে ডাকলে। তিখি ভীতু পায়ে সবার সামনে এল। রকিব হা হয়ে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে রইল তিথির দিকে। এটা মেয়ে নাকি পরী। মুগ্ধকার চূড়ান্তে পৌঁছে দেয়ার মত মোহময়ী মেয়েটা। রকিব নিজেকে কন্ট্রোল করে বলল,
_” আপনার নাম?
_” তিথি।
_” বয়স?
_” ১৯।
_” আপনি ঘটনাটা সরাসরি দেখেছেন?
_” জি।
রকিব প্রেমার দিকে তাকিয়ে বলল,
_” মিস প্রেমা যেখানে ঘরের লোক মূল সাক্ষী সেখানে কে বাঁচাবে আপনাকে?
প্রেমা রহস্যময় হাসল। বলল,
_” আমি নিজেকে বাঁচাতে জানি। কারো হেল্প প্রয়োজন নেই আমার।
প্রেমাকে নিয়ে রকিব চলে গেল।
১০!!
সুবেহ সাদিকের রক্তিম আভা কাটিয়ে সূর্যমামা কেবল উঁকি দিব দিব করছে। কিছুক্ষণ পরই নিজের উজ্জল আভা নিয়ে তেতে উঠবে ধরনীর বুকে। প্রথমে মৃদু আলোয় আড়মোরা ভেঙে নিজে জাগবে, তারপর দীপ্তমান আলোয় পুরো পৃথিবী জাগাবে। মৃদু নরম আলোটা ধীরে ধীরে তেজী হয়ে উঠবে। একটু একটু করে সকালের নরম আরামদায়ক রোদটা তীব্র পোড়া রোদে পরিনত হবে। সকালের রোদটা যতটা মৃদু আয়েশী আরাম দেয়, দুপুরের রোদটা তেমনি খিটখিটে হয়।হসপিটালের কেবিনের ছোট্ট জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রিদু। ঘুম হয়নি রাতে এক বিন্দুও। অসহ্য মনের যন্ত্রনায় ছটফট করেছে। ডাবল বেডেট কেবিন নিলেও সারা রাত প্রিয়তির বেডের পাশে বসে আধশোয়া হয়ে কাটাল। প্রিয়তিকে রাতে হাই ডোজের ঘুমের ইনজেকশন দেয়ায় প্রিয়তি সারা রাত একটানা পড়ে পড়ে ঘুমিয়েছে। জাগেনি একবারও। কিন্তু রিদু এক ফোটাও ঘুমাতে পারেনি। চোখে ঘুম আসা কি সহজ ব্যাপার?
যন্ত্রনার ছটফট মেশানো কুই কুই শব্দে রিদু প্রিয়তির দিকে তাকাল। প্রিয়তির ঘুম ভেঙেছে। নিজে নিজে ওঠার চেষ্টা করছে। রিদু দ্রুত পাশে এসে বলল,
_” আজব তুমি উঠছ কেন?
প্রিয়তি হাতের হাতের কনুই আঙুল দেখিয়ে মৃদু স্বরে বলল,
_” খুব জোরে এক নাম্বার পেয়েছে। সেই গতকাল গিয়েছি। তলপেটটা মনে হয় ফেটে যাবে এখন। ব্যথাও করছে খুব।
রিদু প্রিয়তিকে ধরে বসাতে বসাতে বলল,
_” আমাকে ডাকলে কী হত।
_” না মানে?
_” হয়েছে চলো আমি নিয়ে যাচ্ছি।
প্রিয়তিকে কোলে করে বাথরুমে ঢুকিয়ে রিদু পাশে দাঁড়াতেই প্রিয়তি লজ্জামাখা গরম চোখে বলল,
_” আজব না গেলে আমি কাজ সারব কি করে?
রিদু মৃদু হেসে বের হয়ে গেল।
কয়েক মিনিট পর প্রিয়তি দরজায় টোকা দিল। রিদু ভিতরে গিয়ে প্রিয়তিকে ধরল। প্রিয়তির চোখে প্রচন্ড ভয়। রিদুকে বলল,
_” রিদু আমার পিরিয়ড কেন হচ্ছে? প্রেগনেন্ট মেয়েদের তো পিরিয়ড হয় না। তাছাড়া আমাকে ন্যাপকিন বা যাবতীয় কিছু কে পরিয়ে দিয়েছে?
রিদু বলল,
_” আমি পরিয়ে দিয়েছি।
_” কিন্তু আমার পিরিয়ড কেন হচ্ছে?
রিদু একবার ভাবল বলবে যে ও প্রেগনেন্ট ছিল না। কিন্তু পরোক্ষণে ভাবল বাচ্চা হারাবার কথা হোক বা কনসিভ করেনি যাই বলুক প্রিয়তি মোটামুটি ধাক্কা খাবে। তাছাড়া বাচ্চা হারানোর কথা আপাতত ওকে বলা যাবে না। সুস্থ হলে বুঝিয়ে বলবে। রিদু এমন প্রশ্নের জন্য পূর্বেই প্রস্তুতত ছিল। তাই বলল,
_” কাল থেকে খুব প্রেশার গেছে তো তোমার উপর তাই হালকা ব্লিডিং হচ্ছে। ঠিক হয়ে যাবে শীঘ্রই।
_” আমাদের বাচ্চার কোনো ক্ষতি হবে নাতো?
_” না।
রিদুর কথা শুনে প্রিয়তি স্বস্তি পেলেও, না বলতে গিয়ে রিদুর বুকটা কেঁপে উঠল। যে সন্তাই নেই, যে কখনো আসবে না, তাকে নিয়ে মিথ্যা বলতে হচ্ছে ওকে। এ যে কতটা কষ্টের তা রিদু ছাড়া কেউ বুঝবে না। রিদু মনে মনে বলল,
_” জলদি সুস্থ হয়ে যাও প্রিয়তি। তোমাকে সত্যিটা না বলে যে, শান্তি পাচ্ছি না।
চলবে________