মরে যাওয়ার সুখ – তাসমিন আহমেদ

0
608

#গল্পপোকা_ছোটোগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০

মরে_যাওয়ার_সুখ
তাসমিন_আহমেদ

মরে যাওয়ার সুখ
– তাসমিন আহমেদ
বৃষ্টির ঝমঝম আওয়াজটা জামিলা খাতুনের ঘুম ভেঙে দিলো। শরীর কুকরে শুয়ে ছিলেন তিনি।ইশ কাথাটা যদি শরীরে থাকতো ঘুমটা ভাঙতো না। এই শান্তির ঘুম খুব কম আসে তার চোখে। সবকিছু ঘোলা ঘোলা। পাকা চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে একটা ছোটো খোপা করা। বিছানার পাশের টি টেবিলটার উপর থেকে চশমাটা দুই হাত দিয়ে চোখে দিলো।চশমাটা চোখে দেয়ার সাথে সাথে তার স্বামীর ছবিটা দেখতে পেলো জামিলা খাতুন। শেষ বয়সে তার স্বামী তাকে একা রেখে গেলো এই নিয়ে তার বুকে এক সমুদ্র অভিমান জমে আছে।ছেড়া নরম শাড়িটা ভেজা ভেজা লাগছে।একি! আজও ঘুমের মধ্যে প্রসাব করেছে।বুকটা ভারী হয়ে গেলো।বৌমা দেখলে তো ভীষণ রেগে যাবে এই সব তো সেই পরিষ্কার করে। বৌমাটা বড্ড ভালো মেয়ে এই তো শুধু একটু বোকা ঝোকা করে কাজের মানুষও তো এইসব করতে চায়না আর কয়টা মেয়ে আর এখন শাশুড়ীর প্রসাব পায়খানা পরিষ্কার করে এই বলে নিজেকে শান্তনা দিলো জামিলা খাতুন।ঘরে মিসেস আরিফা ঢুকতেই জামিলা খাতুনের খুব অসস্তি লাগলো।আরিফা বললো কখন থেকে খেতে ডাকছি আপনাকে? অসময়ে ঘুম দেন কেনো? আমি তো বারবার খাওয়া গরম করতে পারবো না ঠান্ডা খাবার খেলেও তো আপনার যত সমস্যা।জামিলা খাতুন চুপ করে ছিলো। একি আপনি আবার বিছানায় প্রসাব করেছেন? আমি কি আপনার দাসী নাকি যে সারাদিন আপনার প্রসাব পায়খানা পরিষ্কার করবো? আজকে আসুক আপনার ছেলে আমি বলে দেবো আমি অত পারবো না সে যেনো অন্য কাউকে ঠিক করে নহে আপনাকে গ্রামে দিয়ে আসে।
ঝুলন্ত কুচকানো চামড়ায় লেগে থাকা চশমা ঠিক করতে করতে জামিলা খাতুন কিছু বলতে চাইলেই মিসেস আরিফা রুম থেকে বেরিয়ে গেলো । গুজো হয়ে বিছানার চাদরটা তুলে জামিলা খাতুন বাথরুমে চলে গেলোবিছানার চাদরটা ধুয়ে দিতে হবে তো বৌমার উপর আর কত নির্ভর হবো।
কিছুক্ষন পর মি শিমুল রুমে আসলো
কি মা কি বলছে আরিফা এসব? আমিতো তোমাদের বাড়ির ঝামেলা নিয়ে এতো মাথা ঘামাতে পারবো না।তুমি একটু সামলে থাকতে পারো না?তুমি তো জানোই বাড়ির সম্পূর্ণ দায়িত্ব তোমার বৌমার উপর।সারাদিন ওকে কত পরিশ্রম করতে হয় অথচ তুমি যদি সারাদিন ওকে এইসবে ব্যস্ত রাখো তাহলেতো আমাদের বাচ্চাদের সামলানো কষ্টকর হবে। তুমি কি চাও আমি তোমাকে বৃদ্ধাশ্রম নহে গ্রামে রেখে আসি? যদি না চাও তাহলে এসব করোনা নিজেকে নিজে সামলাও তোমাদের ব্যাপার নিয়ে আমি চাকুরির সময়ে টেনশন করতে পারবো না।
খোকা আমি তো চেষ্টা করি রে কিন্তু বয়সের জন্যে ঘুমের মধ্যে কিভাবে হয়ে যায় বুঝিনা। তুই বৌমাকে রাগ করতে মানা করিস। আমি পারলে তো আমার কাপড় নিজেই ধুয়ে দেই কিন্তু শরীরে যে কুলায় না খোকা।
দাদী,ও দাদী বাঁচাও দেখো আম্মু আমায় মারছে।
-বউমা, ও বউমা কি হয়েছে ওকে মারো কেনো?
– আপনি চুপ করেন কোনো কথা বলবেন না। মুখ দিয়ে ওকে খারাপ করেছেন। এই বয়সে মায়ের উপর তর্ক করে এই বেয়াদব ছেলে। সাহস কত বড়। এই বয়সে এমন বড় হলে কি হবে?
-ও বৌমা। বাচ্চা মানুষ। আর করবে না রাগ করিও না বৌমা।
– যান তো আপনি রুমে যান।আমার ব্যাপার আমি বাচ্চা কিভাবে মানুষ করবো।

রাতটা ঘন হয়ে এসেছে। জামিলা খাতুনের ঘুম আসছে না। চোখের চশমাটা ঠিক করে হেটে হেটে তার স্বামীর ছবির কাছে গিয়ে দেয়াল থেকে ফ্রেমটা খুলে নিলেন তিনি। এই মানুষটার প্রতি তার বেশ অভিযোগ। সে তো বলেছিলো কখনো একা ফেলে যাবে না। কত সুখ অদল বদল করে নেওয়ার কথা ছিলো আরও। সুখ হোক অথবা দুঃখ কখনো কোনো কিছু সম্মুখীন একা হতে হবে না তাকে এই তো কথা ছিলো তবে কেন অসময়ে ছেড়ে চলে গেলো সে? এই বিছানায় জামিলা খাতুন অসুস্থ হয়ে পড়ে থাকায় তার স্বামী তার কতো সেবা করলো অথচ যাওয়ার বেলায় তাকে সাথে নিলো না। বেশ।বেশ ভালো।বেঁচে থাকাটাই কি সুখ?বেঁচে থাকাটাই সুখ নয় স্বামীর উপস্থিতিতে যেই সুখটা ছিলো তা তো ৩ বছর আগেই সাথে নিয়ে চলে গেলে। অনেক অভিমান জমে আছে। এই অভিমান শেষ হবে না।কোনোদিন শেষ হবেনা। আঁচল দিয়ে চোখটা মুছে নিলো সে।
সকাল হতে না হতেই কিছু ভাঙার আওয়াজে জামিলা খাতুনের ঘুমটা ভেঙে গেলো চোখে চশমা দিয়ে চমকে উঠলো জামিলা খাতুন। একি বাসু তুই ফ্রেমটা ভেঙে দিলি?এখন কই পাবো এই ফ্রেম?
-সরি দাদী।ভুল করে বল চলে আসছে তুমি টেনশন করিওনা আব্বুকে বলে আমি দাদার ছবিটা আবার ফ্রেম করে টাঙিয়ে দেবো।
– খোকা কে একটু বলিস রে বাসু।উনার ছবিটা সামনে না থাকলে আমার ভালো লাগে না।সাথে সাথে মি.শিমুল রুমে ঢুকলো। কি ব্যাপার কি ভাঙলো?
– খোকা ওখোকা ভুল করে বাসুর বল লাগে তোর বাবার ছবিটা ভেঙে গেলো যে।তুই একটু আরেকবার ফ্রেম করে ওখানে রাখবি?
– আচ্ছা আমি ফ্রেম করে দেবো সময় হলে। এখন আমি অফিস যাচ্ছি।জামিলা খাতুন গুজো হয়ে কাপতে কাপতে হেঁটে কাচ সরিয়ে ছবিটা তুলে বিছানায় রাখলো।
জামিলা খাতুন কয়েকদিন ধরে বেশ অসুস্থ।হঠাৎ হঠাৎ সবাইকে চিনতে সমস্যা হয় তার। আবার চিনতেও পারে।বিছানা থেকে উঠতেও বেশ সমস্যা হয়।প্রসাব পায়খানা সব বিছানায় করছে।মিসেস আরিফা সেগুলো পরিষ্কার করে তবে খুব বিরক্তিতে। মিসেস আরিফা মি.শিমুলকে বললো – শুনো তোমার মা এবার সুস্থ হলে তুমি তাকে গ্রামে দিয়ে এসো।আমি সারাদিন তোমার মায়ের সেবা করবো নাকি আমার বাচ্চাদের দেখাশোনা করবো?গ্রামে অনেক মানুষ আছে কেউ দেখাশোনা করতে দ্বিধা করবেনা আর যদি না পারো আমাকে বলে দাও আমি আমার মায়ের বাড়ি চলে যাবো।
আহা আরিফা তুমি রাগ করছো কেন? মায়ের দেখাশোনা না করে যদি গ্রামে দিয়ে আসি তবে সবাই তো তখন প্রশ্ন তুলবে। অন্য ভাইয়েরা বলবে আমি এতো টাকা কামাই করি শহরে থাকি অথচ মায়ের দেখা শোনা করতে পারলাম না। বলবে জমি লিখে নেওয়ার জন্যই শুধু শুধু তাকে তাকে আর বাবাকে আমার কাছে রেখেছি।
– তোমার ভাইয়েরা যদি এতো প্রশ্ন তুলে তাহলে তাদের কাছে দিয়ে এসো দেখবো কে সেবা করে।
– তুমি চিন্তা করো না দেখি কি করা যায়। সুস্থ হয়ে উঠলে কাছে বৃদ্ধাশ্রমে দিয়ে আসবোভেবেছি।
রুম থেকে ডাক আসলো- খোকা ও খোকা
– কি হয়েছে? চিনতে পারছো আমাকে?
– কেনো পারবো না রে খোকা।ও আমার খোকা তুই তোর বাবার ছবিটা ফ্রেম করে ওখানে রাখে দে না আমার বড্ড ইচ্ছে করে তাকে দেখতে।
– আচ্ছা আচ্ছা রাখবো আমি । তুমি ঘুমাও ডাক্তার বলেছে রেস্ট নিতে।
– একটু জলদি করে রাখিস না রে খোকা।
– আহা বলছি তো রাখবো।
বিরক্তি নিয়ে মি.শিমুল বললো।

একটু পর –
মা দেখো দাদী কেমন করছে।
মিসেস আরিফা দৌড়ে এলো আর বাসুকে বললো তোর বাবাকে ডেকে আনতো।
মি.শিমুল ডাক্তার কে নিয়ে এলো।ডাক্তার একটা ইঞ্জেকশন দিয়ে দেয়ায় জামিলা খাতুন ঘুমিয়ে গেলো।৩ ঘণ্টা পর জ্ঞান আসাতে জামিলা খাতুন ঘোলা ঘোলা দেখতে পেলো। বাসু দাদীর চোখে চশমা লাগিয়ে দিয়ে বললো দেখোতো এইটা কি? জামিলা খাতুন তাকায় থাকার পর তার চোখ উজ্জ্বল হয়ে গেলো কাপা কাপা অসুস্থ গলায় বললো একি খোকা ওর বাবার ছবিটা ফ্রেম করে এনেছে? এই বলে উঠে বসতে চাইলে বাসু তাকে ধরে বসালো।বাসু বললো বাবা না আমি করেছি। বাসুরে তুই অনেক ভালো এই বলে জামিলা খাতুন বাসুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো।জামিলা খাতুন ছবিটা বুকে চেপে ধরলেন। বাসু বললো দাও টাঙিয়ে দেই।
জামিলা খাতুন বললো দিস পরে।আমি একটু নিয়ে থাকি।জামিলা খাতুন ছবিটা বুকে নিয়ে রাখলো নিজের চোখ বন্ধ করে নিলো।দুই হাত দিয়ে সেই যে আকড়ে ধরলো আর ছাড়লো না।ছাড়বে কি করে সে তো সুখ পেলো। মরে যাওয়ার সুখ টা। তার স্বামীর ভালোবাসা তাকে স্বামীর কাছে টেনে নিলো। বেঁচে থাকার ব্যথাকে ফেলে সে মরে যাওয়ার সুখ পেলো।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে