#মরীচিকার_সংসার (৩)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি
গতরাতের পলাশের কর্মকান্ড আমাকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয়। গত আট মাসের সংসার জীবনে শাশুড়ীর সব বিষয়ে দোষ ধরা। কটু কথা সবকিছুকে মানিয়ে নিয়ে সংসারটাকে আপন করেছিলাম। কখনো পলাশকে কোন কথা বলেনি। শাশুড়ীকে নিজের মায়ের মতো ভেবেছিলাম। কিন্তু কানের দুলটা আমার অনেক প্রিয় ছিলো। মায়ের শেষ স্মৃতি বলে কথা। সেজন্য পলাশকে না পেরে বললাম। পরিশেষে কপালে দূর্ভোগ ছাড়া কিছুই ঘটলো না। গতকালের ঘটনায় স্পষ্টভাবে আমি বুঝে গেলাম, পলাশকে তার মায়ের কটু কথা, বোনের ন্যাকামি নিয়ে বললে লাভ হতো না। দিনশেষে সে আমাকেই দোষ দিতো। যদিও মাঝে মাঝে আকারে ইঙ্গিতে পলাশকে তার খারাপ লাগা বোঝাতো। পলাশ সেসবে পাত্তা দিতো না। আমার মন খারাপ আছে জেনেও কাছে আসতো। সেটাকে স্বাভাবিকভাবে নিলেও গতকালের ঘটনা আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারলাম না। তার উপর বাবার শুকনো মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তার জীবনটা সুখের নয়। সব মিলিয়ে মনমরা হয়ে বসে দাঁড়িয়ে ছিলাম। আনমনে জীবন নিয়ে ভাবছিলাম যার ফলস্বরূপ দুধ উতলে পড়ে যায়। এটা দেখে হন্তদন্ত হয়ে বারান্দা থেকে ছুটে আসে শাশুড়ী মা। সে বলে,“এই নবাবের ঝি কোন দিকে তাকিয়ে দুধে ঝাল করছিস?”
শাশুড়ীর কর্কশ কন্ঠে হুঁশ ফিরে আমার। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গিয়েছে। শাশুড়ী এসে দুধ উনুন থেকে নামিয়ে নিলো। সেই সাথে তার মুখও চলতাছে। কথায় কথায় এক কথা,“চোরের জাত আমাকে বলে চোর। এখন মন দিয়ে কার না কার কথা ভাবছিলো। আমার সংসারে আ গুন লাগানোর প্লান করছে। সংসারে অলক্ষী এনে ঘরে তুললে তো এটাই হবে।”
শাশুড়ী একা একা বলে যাচ্ছে। আমি কথা বললাম না। শাশুড়ীর চেঁচামেচি শুনে ননদ আসলো। সেও মায়ের কথায় সঙ্গ দিচ্ছে। আমি কথা না বাড়িয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। শাশুড়ী মা অবশিষ্ট দুধ দিয়ে চা বানিয়ে নিলেন। আমাকে উদ্দেশ্য করে বলেন,“এখানে সংয়ের মতো দাঁড়িয়ে না থেকে থালা-বাসন গুলো ধুঁয়ে আসো।”
আমি মাথা নাড়িয়ে সেই কাজে চলে গেলাম।
___
সকাল সাড়ে নয়টার দিকে দরজা খুলে দেয় ভাবী। এতক্ষণ অব্দি দরজার বাহিরে বসে ঝিমুচ্ছিলো বাবা। ভাবী দরজা খুলে বাবাকে এমনভাবে দেখে অবাক হয় না। মুখ ভেঙচি দিয়ে বলে,“মেয়ের বাড়িতে রাতটুকু জায়গা হয় নাই?”
বাবা জবাব দিলো না। ভাবী আবারও বলে উঠলো,“তা আপনার মেয়ে কি কান্ড ঘটিয়েছে? নিশ্চয় শ্বশুড়বাড়িতে আমাদের মান-সম্মান ডুবিয়েছে? আমি জানতাম, রাতের বেলা আপনাকে জরুরিভাবে ডেকেছে মানেই কোন অঘটন ঘটিয়েছে। তাই তো আপনার ছেলেকে আপনার সাথে যেতে দেইনি।”
বাবা কোন কথার জবাব না দিয়ে আস্তে করে ভেতরে যায়। ভাবী এটা দেখে শুনিয়ে শুনিয়ে বলে,“যান যান। মেয়ে অপকর্ম ঘটিয়েছে না। এখন তো চুপচাপ যাবেনই। এগুলো আমি করলে ঠিকই সারা পাড়া করতেন।”
এই কথা শুনে বাবা চুপ করে থাকতে পারলেন না। সে শান্ত গলায় বলেন,“তুমি যা করো বৌমা সেসব নিয়ে কথা বললে প্রতি ঘন্টায় বিচারে বসতে হতো। আর হ্যাঁ আমার মেয়ে কিছু করেনি। তবুও তার আত্মসম্মানকে বিসর্জন দিয়ে আমি আমার মেয়েকে ঐ বাড়িতে দাঁত কামড়ে যে পড়ে থাকতে বলেছি সেটাও তোমার জন্য বৌমা। নয়তো যে সামান্য কারণে তারা আমার মেয়েকে নিয়ে বিচার বসিয়েছে তাতে আমার বিবেক, আমার আত্মসম্মান আমাকে বারবার বলছিলো আমার মেয়েটাকে বাড়ি নিয়ে আসি। কিন্তু পারিনি।”
বাবার এই কথায় ভাবী তেলেবেগুনে জ্ব লে উঠে। সে অহংকারের সাথে নিজেকে এই সেই দাবি করে, শ্বশুরবাড়ির সবাইকে তুচ্ছ করে কথা বলে। এসব দেখে বাবা নিজের ঘরে গিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয়। মাঝরাতে বাড়ি ফিরে দরজা ধাক্কালে নিজের গুনবতী বউয়ের মুখ দিয়ে কত যে বাজে কথা শুনতে হবে সেই ভয়ে বাহিরে ছিলো। এসব কারণেই বাবা নিজের মেয়ের শ্বশুড়বাড়িতে মাথানত করতে বাধ্য হয়েছেন। নয়তো মেয়েকে নিয়ে চলে আসতেন। কিন্তু এই বাড়িতে এখন আসলে যে জীবন আরও জাহান্নাম হয়ে উঠবে। সেজন্যই নিয়ে আসেননি। অনেকে বলে শাশুড়ী, ননদ খারাপ হয়। এরা জীবনে ভালো হয় না। কিন্তু বাস্তবতা এটা নয়। বাস্তব হলো যে মানুষ খারাপ সে সব সম্পর্কে খারাপ। কিন্তু সম্পর্কে ধরে মানুষ খারাপ হয় বিষয়টি ভুল। বাবা এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নেয়। বাহির থেকে ভাবীর মুখের কটুক্তির শব্দ শোনা যাচ্ছে।
____
সকালের ঘটনাকে ভিন্নরূপে শাশুড়ী বাড়িয়ে পলাশের কাছে তুলে ধরে। এতদিন এসব করে বেড়ায়নি। কিন্তু গতকাল থেকে বুঝতে পেরেছে পলাশ কখনো বউয়ের হয়ে তর্ক করবে না। পলাশকে দিয়ে বউকে অকারণে শায়েস্তা করা যাবে। সেজন্য এখন এই কাজটিও করতে শুরু করেছে। আমি বিষয়টা ভালোভাবে বুঝতে পারলাম। হলোও তাই। পলাশ বিচার বিবেচনা ছাড়া আমাকে কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলো,“এই ঘরে শান্তিতে থাকতে চাস না? যদি থাকতে চাস। তাহলে আমার মা যেভাবে বলে সেভাবে থাক। পরবর্তীতে জানো আমি এই বিষয়ে আর কোন কথা না শুনি।”
পলাশের মুখে এই কথা শুনে রাগে অভিমানে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। এই মানুষকে এখন আর কেন জানি সহ্য হচ্ছে না।
এটা তো সবে শুরু হলো। এতদিন কথার আঘাতে শাশুড়ী, ননদ জীবনটা তেজপাতা করে দিয়েছিলো। এখন শুরু করেছে নতুন নাটক। পলাশ তাদের দলের বুঝতে পেরে পলাশ আসার আগে ভারী কাজ নিয়ে বসে শাশুড়ী। পলাশকে দেখেই বলবে,“ও মা গো। কোমরের ব্যথায় টিকলাম না। এই দিন ছিলো আমার কপালে।”
শাশুড়ীর এই ন্যাকামি দেখে পলাশ কোন কথা ছাড়া এসে একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয়। তার কথা হলো,“তুই থাকতে আমার মাকে অসুস্থ শরীর নিয়ে কাজ করতে হয় কেন?”
“বাড়ির কাজ সব আমিই করেছি। লোক দেখানো কাজ শেষ করছে। এখানে আমার কি করার?”
এই কথা বলতে দেরি পলাশের আমার পেটে লাথি মা রতে দেরি হয় না। কয়েকটা লাগিয়ে দিয়ে সে আমার উদ্দেশ্য বলে,“ভুল করে আবার মুখে মুখে তর্ক। উল্টাপাল্টা কথা বলিস। তোকে আমি…।”
“থাক বাবা ছাড়। ওর তো মা নেই। এসব শেখাবে কে? হয়তো বা ওর মায়ও এমন অজাতের ছিলো। তাকে দেখে শিখেছে।”
নিজের মাকে নিয়ে এমন কথা কোন সন্তান মে নে নিতে পারে। আমিও পারিনি। কড়া গলায় বললাম,“আমার মায়ের সম্পর্কে কোন বাজে কথা বলবেন না। একদম না। আমার মা আপনাদের মতো খারাপ ছিলো না।”
“তারমানে আমরা খারাপ?”
শুরু হলো শাশুড়ীর ন্যাকা কান্না। আহাজারি। তার ন্যাকা কান্নার শব্দের সাথে পলাশের গায়ে হাত তোলাও শুরু হলো। ইচ্ছামতো মে রে মুখ চেপে ধরে বলে,“তোর এই মুখ দিয়ে এমন কোন শব্দ বের করবি না যেটা আমার মাকে অসম্মান করে।”
আমি মুখ দিয়ে কোন কথা বের করতে পারলাম না। এতসব কান্ড সন্ধ্যাবেলা করে সেই পলাশ রাতে যখন কাছে আসে তখন নিজেকে মন চায় শেষ করে দেই। তার প্রতি কোন আগ্রহ জন্মায় না। না ভালোবাসা। শুধুমাত্র কোনমতে মরীচিকার এই সংসার করে যাই। এমন করেই পার হচ্ছে জীবন। দিনের পর দিন পলাশ এবং তার পরিবারের অত্যাচারও বাড়ছে। এমন এক পরিস্থিতির মাঝে পলাশ আবার চাচ্ছে বাচ্চা। সেদিন রাতে যখন পলাশ বললো,“চলো না বউ আমরা একটা বাচ্চা নেই।”
তৎক্ষনাৎ আমি মুখের উপর বলে ফেললাম,“না। এমন এক সংসারে বাচ্চা নিয়ে কি তাকে শেখাবো দেখ, তোর মাকে তোর বাবা কত অসম্মান করে? কত নিচু চোখে দেখে? এসব? তাকে এমন অসুস্থ পরিবেশে রাখবো।”
আমি কথাটি বলে পলাশের দিকে তাকালাম। পলাশ কিছু বলতে নেয় তখন আমি বললাম,“জানি এখন তুমি গায়ে হাত তুলবে। অকথ্য ভাষায় কথা বলবে। সত্যি বলতে ঠিক এই কারণেই বাচ্চার কথা ভাবতে ভয় হয়।”
প্রথমবার খুব শান্ত গলায় পলাশকে বোঝালাম। নারীরা বিয়ের পর একটা সংসারে আসে নিজেকে নতুনভাবে গড়তে। নিজের একটা সংসার সুন্দরভাবে সাজাতে। যেই সংসারে তার ছোট ছোট অনেক ইচ্ছের মূল্য দেওয়া হবে। অনেক স্বপ্নের মূল্য দেওয়া হবে। তার চাওয়া পাওয়ার মূল্য দেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে তার শক্ত খুঁটি তার স্বামী রুখে দাঁড়াবে। কিন্তু আমার জীবনে এসবের কিছুই হয়নি। শুধু কি তাই? এখানে তো আমার স্বামীই আমার বিপক্ষে একটা কিছুর সুযোগ খুঁজে। যাতে সে আমার গায়ে হাত তুলতে পারে। এমন এক পরিবেশে নিষ্পাপ এক বাচ্চা নিয়ে এসে কি তার জীবন জাহান্নাম করে দিবো? এই কথার পরিপেক্ষীতে পলাশ কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কিন্তু আমি শুনলাম না। আমি পাশ ফিরে শুয়ে পড়লাম। পলাশ বোধহয় কিছুটা আহত হলো।
’
’
চলবে,