মরীচিকার সংসার পর্ব-০২

0
5

#মরীচিকার_সংসার (২)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

বাবা আমার শ্বশুড়বাড়িতে পা দিতে তাকে বসিয়ে আমার শ্বশুড়, শাশুড়ী, ননদ একের পর এক আমার দোষের গল্প বলতে শুরু করেছে। আমার শাশুড়ী মা বলছে,“আপনার মেয়েকে আমি কি দিয়ে জ্বা লাই? ভাতে জ্বা লাই নাকি কাপড়ে? সেই মেয়ে আমাকে আজ চোর অপবাদ দিচ্ছে। কাল তো আমাকে মে রে হাসপাতাল পাঠিয়ে দিবে।”

এই কথার সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্বশুড় বলল,“আপনার মেয়ে আজ এই ঘটনা ঘটালো। কাল তো বড় কিছু ঘটাবে। বড় কোন দূর্ঘটনা ঘটার আগে আমি চাই আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে চলে যান।”
এসবের মাঝে নিরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে বাবা। সে মাথানত করে সবার কথা শুনে যাচ্ছে। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছে না। এক ঘন্টা যাবত বাবাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে সবাই আমার দোষগুলো বললো।অতঃপর বাবা বলার সুযোগ পেয়ে নরম গলায় বললো,“আমার মেয়ের নাহয় একটা ভুল হয়ে গেছে। এই কারণে আপনারা তাকে বাড়ি পাঠিয়ে দিবেন। দেখুন ও ছোট মানুষ। ওর ভুল হয়ে গেছে। আপনারা ক্ষমা করে দিন।”

“সেই ক্ষমা ভাবী চেয়েছে? সে তো তখন থেকে আমাদের চোর বলে যাচ্ছে।”
আমার ননদের কর্কশ কন্ঠে বলা মিথ্যা কথাটি শুনে আমি আর চুপ থাকতে পারলাম না। আমি বললাম,“আমি ক্ষমা চেয়েছি। বিনা কারণে ক্ষমা চাওয়ার পরও তোমরা আমার বাবাকে এই মাঝরাতে ডেকে পাঠালে। আবার মিথ্যা কথা বলছো। একের পর এক মিথ্যা দোষারোপ তো দিয়ে যাচ্ছো।”

“দেখেছেন আপনার মেয়ের স্বভাব। মুখে মুখে তর্ক করা অভ্যাস হয়ে গেছে। আপনার বউ ম রার আগে তাকে কিছু শিখিয়ে যায়নি।”
আমার শাশুড়ী কথাটি বলে উঠলো। সেই সঙ্গে আমার স্বামী মহাশয় তাল মিলিয়ে বলে,“বড় ছোট কাউকে মানে না। আমার মায়ের মুখে মুখে অব্দি তর্ক করে বেড়ায় আপনার মেয়ে।”

পলাশ আজ আমাকে বারবার হতাশই করছে। আমার ভালোবাসা যে ভুল সেটা প্রমান করে দিচ্ছে। আচ্ছা স্বামী কি এমন হয়? কই। আমার বাবাকে তো দেখেছি সবসময় আমার মায়ের কথায় গুরুত্ব দিয়েছে। আমার মায়ের কোন ক্রুটি থাকলে সেটা সকলের সামনে গোপন করেছে। সংসার জীবনে আমার মায়ের শক্ত এক অবলম্বন হয়েছে। তাহলে পলাশ এমন কেন? এসব কথাবার্তা আমার বাবা বন্ধ করলেন। সে নরম গলায় বললেন,“আপনারা এবারের মতো রিমিকে মাফ করে দেন। সে আপনাদের কাছে ক্ষমা চাইবে। সেই সাথে আমি আপনাদের কথা দিচ্ছি, রিমির থেকে এমন কিছু আর হবে না।”

বাবার এই কথায় অবশ্য প্রথমে কেউ রাজি হতে চায়নি। তারা পারলে এখনই আমাকে এই বাড়ি থেকে তাড়ায়। তবুও বাবা অনেক অনুনয় বিনয় করে তাদের রাজি করালো। বাবার এই অসহায়ত্ব দেখে আমি খুব কষ্ট পেলাম। বাবাকে বাধা দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু বাবা তার আর হতে দিলো না। আমাকে অনুরোধ করে বললো,“দয়া করে তুই এখানে আর কোন কথা বলিস না। যা বলছি তাই কর। সবার কাছে ক্ষমা চা। প্লীজ…।”

বাবার এই নরমস্বরে করা অনুরোধ ফেলতে পারলাম না। বাবার কথামতো সবার কাছে ক্ষমা চাইলাম। সবাই অবশ্য এবার মেনে নিলো। সবার কথা শুনে মনে হচ্ছে, এই বাড়িতে তারা আমাকে দয়া করে থাকতে দিয়েছে। নয়তো আমার স্থান এখানে হওয়ার কথা ছিলো না।
__
বাবা চলে যাবার আগে আমার সাথে একান্তে কথা বলতে চাইলেন। আমিও ঘরে আসলাম। বাবাকে আলাদা পেয়ে আমি বললাম,“বাবা এভাবে তুমি মাথানত করে তাদের সব অভিযোগ শুনলে? সত্যি মিথ্যা নিয়ে একটা কথা তুললে না? তাছাড়া আমাকে তাদের কাছে ক্ষমা চাইতে বললে অথচ একবারও ঘটনা সত্যি কি-না তা জানতে চাইলে না? কেন বাবা?”

আমার এই কথার জবাবে বাবা অসহয় গলায় বলে,“ মা রে সংসার জীবন বড় কষ্টের। এখানে মানিয়ে নিতে না পারলে সব শেষ। সংসারে একসাথে থাকতে হলে এরকম সমস্যাগুলো এড়িয়ে যেতে হবে। তাছাড়া মেয়ে মানুষের জন্য স্বামীর ঘরই সব। এখানে টিকে থাকতে না পারলে দিনশেষে সব দোষ মেয়েটারও হবে।”
বাবা একটু থেমে পুনরায় বলেন,“আমি জানি তুই সঠিক। তোর ননদের কানে আমি তোর মায়ের সেই চিরচেনা কানের দুল দেখেছি। কিন্তু এখানে আমার কিছু করার নেই মা। তোকে যদি আজ আমি ঝামেলা করে বাড়ি নিয়ে যাই তাহলে তোর কি হবে? আমি আজ আছি কাল নেই। তোর ভাই, ভাবী তোকে কতদিন দেখবে? এক মাস দুই মাস। তারপর যখন অতিষ্ট হয়ে পড়বে তখন তাদের তিক্ত কথাগুলো শুনে তোর মনে হবে এই সংসারটাই তোর জন্য ঠিক। অন্তত এখানে তোর নিজের সংসার। কেউ তোকে এটা বলতে পারবে না, অন্যের সংসারে বোঝা হয়ে আছিস। তাছাড়া এসব টুকটাক বিষয় এড়িয়ে যেতে হয়।”

“টুকটাক? আমার মায়ের কানের দুল?”
এই কথার জবাবে বাবা অসহয় মুখে আমার দিকে তাকিয়ে একটি হাসি দেয়। নরম গলায় বলে,“সংসারে থাকতে হলে বোবা এবং অন্ধ হয়ে চলতে হয়। এভাবে মানিয়ে নিয়ে, এড়িয়ে গিয়ে সংসার করে যা। তোর জন্য আমার এই পরামর্শই। আমি এখন আসি।”

“এই রাতের বেলা চলে যাবে? তাও শুকনো মুখে?”
এই কথার জবাবে বাবা মুচকি হাসলো। যে হাসির আড়ালে কষ্টগুলো লুকানো ছিলো। যেখানে বাবা হয়তো বলছে, তোর বাড়িতে আজ এত এত কথা গিলেছি যে পেটে জায়গার বড্ড অভাব। এই বাড়িতে রাতটা কাটালে যদি তোর তাতে দোষ হয়ে যায়, সেই ভয়ে রাত কাটালাম না। বাবার মনের এই কথাগুলো আমি বুঝতে পারলাম। তাই বাবাকে বাধা দিলাম না। তাকে যেতে দিলাম। শুধু আস্তে করে বললাম,“সাবধানে যেও বাবা।”


বাবাকে বিদায় দিয়ে শোবার ঘরে এসে বসলাম। পাশেই পলাশ শুয়ে আছে। আমার উপস্থিতি বুঝতে পেরে আমার দিকে ফিরে শুইলো। আমি তার দিকে তাকালাম না। যেই মানুষটা আমার নয় তার দিকে তাকিয়ে মায়া বাড়িয়ে লাভ আছে। পলাশ বিষয়টা বুঝতে পেরে বলে,“তোমার বাবা দেখলে ঠিক বুঝলো। শেফার কানের দুলের সাথে তোমার কানের দুলের ডিজাইনটা কিছুটা মিলে তাই তুমি ভুল বুঝলে।”

আমি জবাব দিলাম না। পলাশ আবারও বলে উঠলে,“এটা তুমি আগে বুঝলেই হতো। তাহলে এত ঝামেলা হতো না।”
এই কথা শুনে আমি ম্লান হেসে বললাম,“তুমি এই কথাগুলো এই ঘরের বাহিরে না নিলেই হতো। তাহলে এতকিছু হতো না। এখানে দোষটা কার দিবো? কারোর না। দোষটা আমার কপালের।”
আমার এই কথায় পলাশ চুপ করে গেল। সে বিরক্ত হলো বোধহয়। তবে আমি কথা বাড়ালাম না। উল্টো দিকে মুখ করে শুয়ে পড়লাম। এতক্ষণ অব্দি নিজেকে সামলাতে পারলেও এবার পারলাম না। এবার চোখ দিয়ে গড়িয়ে পানি পড়তে থাকলো। আমি চেয়েও নিজের কান্না থামাতে পারছি না। এই সংসারে কাকে আপন ভাববো?ননদকে দোষ দিবো? শাশুড়ীকে দিবো? লাভ কি? যদি স্বামীই ঠিক না থাকে। এখানে তো আামর মহা শত্রু পলাশ। সে যদি আমার ভালোবাসা বুঝতো, আমাকে ভালোবাসতো তাহলে এসব কিছু হতোই না।

পলাশ আজ যা করলো তাতে আমার মনে তার জন্য থাকা ভালোবাসায় ভাঙন ধরে গিয়েছে। সেই ভাঙন আরও বেড়ে গেল তখন যখন আমি কান্না করছি বুঝতে পেরেও পলাশ আমার কাছাকাছি এলো। আমি বাধা দিতে চাইলে পলাশ বলে,“স্বামীকে না করতে নেই। এখন আমার ইচ্ছা করছে। আমাকে কষ্ট দিও না।”
যার জন্য আমি কষ্টে জর্জরিত। সেই মানুষটি আমাকে বলে তাকে জানো কষ্ট না দেই। নিজের বুকের কষ্টে বুকের ভেতর রেখে, নিজের অনিচ্ছা সত্ত্বেও পলাশের ইচ্ছে পূরণ করতে হলো। পলাশ জোর করে করলো। আমি যখন বললাম,“এখন না পলাশ।”

“চুপ। স্বামী হই তোর। যখন প্রয়োজন তখনই দিবি। বউ থাকতে আমি কি রাত পার করবো কষ্টে?”
এই কথা বলে কোন বাধা না শুনে পলাশ আমার সাথে মিলিত হলো। এটা তো শুরু ছিলো। এখান থেকেই সাংসারিক ঝামেলা, পলাশের গায়ে হাত তোলা, সব মিলিয়ে একটা ঝগড়া শেষে আবার সেই মানুষটিই রাতে কাছাকাছি চলে আসে। এমন এক জীবনের শুরু হয় আমার। বিবাহিত জীবনের আট মাসের মাঝেই এই তিক্ত অভিজ্ঞতার সাক্ষী হলাম আমি। শুরু হলো সংসার নামক মরীচিকার খেলা। যাকে আমি আপন করতে চেয়েছিলাম। খুব আপন।

চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে