মরীচিকার সংসার পর্ব-০১

0
6

#মরীচিকার_সংসার (১)
#নুসরাত_জাহান_মিষ্টি

আমার হারিয়ে যাওয়া কানের দুল ননদের কানে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। দুই মাসের আগে শাশুড়ী মা আমার কানের দুল পড়ে এক অনুষ্ঠানে যায়। তারপর থেকে কানের দুল খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। আজ সেই কানের দুল ননদের কানে দেখে ভীষণ অবাক হলাম। রাতে স্বামী বাড়ি ফিরলে। তার বুকে মুখ গুজে কান্না করে দিলাম। আমার কান্নার শব্দ পেয়ে আমার স্বামী নরম গলায় জিজ্ঞেস করলো,“কী হয়েছে? কান্না করছো কেন?”

“তুমি তো জানতে আমার কানের দুলগুলো আমার কত শখের ছিলো। আমার মায়ের শেষ স্মৃতি।”
এই কথা বলে আরও কান্নায় ভেঙে পড়লাম। স্বামী আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলে,“এখনো ঐ কানের দুলের কথা ভেবে কষ্ট পাচ্ছো। দেখো যা হারিয়ে যায় তা যদি কান্না করলে ফেরত পাওয়া যাবে? মন খারাপ করো না।”

“তুমি জানো আজ আমি সেই কানের দুল তোমার বোনের কানে দেখেছি। হারিয়ে গেলে নাহয় মন খারাপ করতাম না। কিন্তু….।”
আমি কান্নায় কথাটি সমাপ্ত করতে পারলাম না। আমার স্বামী আমাকে পুরো ঘটনা খুলে বলতে বললো। অতঃপর আমি তাকে ভরসা করে সব বললাম। আমি নিশ্চিত আমার শাশুড়ী মা কানের দুল হারায়নি বরং সেটা তার মেয়েকে দিয়েছে। দুই মাসে আমি সব ভুলে গেছি ভেবে আজ ননদ সেটা পড়ে আমার সামনে অনায়েসে ঘুরলো। আমি কথাগুলো স্বামীকে খুব বিশ্বাস, ভরসা করে বলেছিলাম। ভেবেছিলাম স্বামী আমার পাশে থাকবে। কিন্তু না। আমাকে ভুল প্রমাণ করে দিয়ে আমার স্বামী আমাকে তার বুক থেকে সরিয়ে দিয়ে রাগান্বিত গলায় বলে,“তুই কি বলতে চাস? আমার মা, বোন চোর? তারা তোর ঐ দুই পয়সার কানের দুল চুরি করেছে?”

নিজের স্বামীর মুখে এমন কথা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমার স্বামী আবারও কঠিন গলায় বললো,“আমার মা, বোনকে তোর কি মনে হয়? তারা জীবনে সোনার জিনিস চোখে দেখেনি? যে তোর মনে হয় তারা তোর সোনার জিনিস চুরি করছে?”

“আমি সেটা বলতে চাইনি। আমি শুধু বলতে চেয়েছি….।”
আমাকে থামিয়ে দিয়ে আমার স্বামী অর্থাৎ পলাশ বলে,“আমি বেশ ভালোভাবে বুঝেছি তুই কি বলতে চাইছোস। দাঁড়া আমি আমার মা, বোনকে ডাকি। যা ফয়সালা হওয়ার তাদের সামনেই হোক।”
আমি পলাশকে থামাতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু পারেনি। সে এতজোরে চিৎকার, চেঁচামেচি করছিলো যে বাড়ির সবাই দরজার সামনে এসে উপস্থিত হয়ে গিয়েছিলো। পলাশ দরজা খুলতে সামনে আমার শাশুড়ী এবং ননদ পড়লো। পিছনে শ্বশুড়ও দাঁড়ানো ছিলো। পলাশ সবার সামনে কোন ভণিতা ছাড়া জিজ্ঞেস করলো,“মা তুমি নাকি রিমির কানের দুল চুরি করে শেফাকে দিয়েছো?”

“কি?”
আমার শাশুড়ী মনে হলো আকাশ থেকে পড়লো। ননদ আরও এক ধাপ উপরে। সে সঙ্গে সঙ্গে কান্না করে দিলো। তারপর বলছে,“এমনিতে বাপের বাড়ি কম আসি। যাতে ভাবীর চোখের বিঁষ না হতে হয়। এখন দেখছি আসাই যাবে না। একেবারে সোজা চোর বানিয়ে দিলো আমাদের।”
ননদের সাথে তাল মিলিয়ে শাশুড়ী বললো,“এই দিন দেখার জন্য শখ করে ছেলের বউ নিয়ে আসছিলাম। আজ আমি কি-না চোর। শুনছো ওগো। আমি নাকি বৌমার কানের দুল চুরি করে শেফাকে দিয়েছি।”

শাশুড়ী এবং ননদ তাদের অভিনয় শুরু করে দিয়েছে। তারা নিজেদের ন্যাকা কান্না দিয়ে মূহুর্তে পরিবেশ অনেক জটিল করে তুলেছে। শাশুড়ী মা আমার কাছে এসে বলে,“বৌমা তোমার যদি শেফার কানের দুল পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তুমি আমাকে বলতে পারতে। আমি তোমার দুল হারিয়েছি তার বিনিময় নাহয় শেফার দুলটা তোমায় দিতাম। তাই বলে এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিবা। আমাকে চোর বানিয়ে দিলে।”

“হ্যাঁ ভাবী। এই দুল যদি তোমার পছন্দ হয়ে থাকে তাহলে তুমি রেখে দাও। তবুও আমাদের এভাবে মিথ্যা অপবাদ দিও না।”
এই কথা শুনে পলাশ আমার দিকে রাগীচোখে তাকিয়ে বলে,“দেখলি তুই? এটা আমার মা, বোন। যাদের বিরুদ্ধে তুই অভিযোগ দিচ্ছিলো তারা তোকে এক কথায় দুল দিয়ে দিতে রাজি। আর তুই কি-না…।”
পলাশের এই কথার জবাব দেওয়ার মতো কোন শব্দ আমার কাছে ছিলো। থাকবে কিভাবে? যে মানুষটির হাত ধরে এই বাড়িতে এসেছি। সেই মানুষটির কাছেই আমার কথার গুরুত্ব নেই। আমি মিথ্যা বলছি মনে হচ্ছে। তখন তাকে কোন শব্দ বা বাক্য দিয়ে বললেও যে সে বুঝবে না এটাই স্বাভাবিক। আমি বুঝতে পেরে চুপ করে গেলাম। এটা দেখে শাশুড়ী মা বলে,“কি বৌমা এখন মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছে কেন? মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার সময় তো চুপ ছিলে না। তা এখন চুপ কেন? কানের দুল পছন্দ হলে নিয়ে যাও। তাও দয়া করে চোর অপবাদ দিও না। আমরা চোর নই।”

“আম্মা আমার স্বামীই আমার কথা বিশ্বাস করছে না। সেখানে আমার কোন কথাই এখানে গুরুত্ব পাবে না। তবে আমিও জানি আপনিও জানেন ঐ কানের দুল আমার। আমার মাকে সারাজীবন আমি এই কানের দুল পড়ে থাকতে দেখেছি। আমার বিয়ের পর থেকে আমি পড়েছি। এই কানের দুল আমি চিনবো না সেটা হতেই পারে না।”
আমার এই কথা ঘরের মধ্যে বিস্ফোরকের মতো পড়লো। সবাই হতভম্ব হয়ে যায়। এই কথা শুনে আমার শাশুড়ী মা শ্বশুড়কে উদ্দেশ্য করে বলে,“শুনলে বৌমার কথা? বৌমা আমাকে সরাসরি চোর বললো। আমি চোর?”

”বৌমা তুমি চাও কি? সংসারে কেন অশান্তি করছো? তোমার কানের দুল কেন শেফাকে দিবে তোমার শাশুড়ী? শেফার কি কম আছে?”
শ্বশুড় এই কথার বলার সঙ্গে সঙ্গে শাশুড়ী ফোঁড়ন কেটে বলে,“না তো। আমার মেয়েকে তো ভিখারি বাড়ি বিয়ে দিয়েছি। আমরা ভিখারি। একমাত্র তোমার বৌমা কোটিপতি। বাপের বাড়ি থেকে কোটি টাকার জিনিস নিয়ে আসছে। আমরা সেটা চুরি করেছি।”

“না আম্মা। আমার বাবার বাড়ি থেকে কোটি টাকার জিনিস হয়তো নিয়ে আসিনি। তবে অনেক মূল্যবান আমার মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে আসছিলাম। যেটা এখন শেফার কানে রয়েছে।”
এই কথা শুনে তৎক্ষনাৎ পলাশ একটি থাপ্পড় বসিয়ে দেয় আমার গালে। সবার সামনে পলাশ এভাবে আমার গায়ে হাত তোলায় কিছুটা হতভম্বই হলাম। পলাশ রাগান্বিত গলায় বলে,“তোর সমস্যা কি? আমার মা, বোন এই বাড়িতে না থাকুক সেটা চাস? সেজন্য তখন থেকে উল্টাপাল্টা কথা বলে যাচ্ছিস। তুই আমার মা, বোনকে চোর বলছিস?”

“তোর বউ তো এটাই চায়। আমি আমার মেয়ে এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই। তোর বউ একা রাজত্ব করুক। তাই বলে এভাবে চোর বললো। আমি কি চোরের জাত? তোর বউয়ের মতো চোরের জন্মা না আমি। যে চুরি করবো।”
আমি আর জবাব দিতে পারলাম না। শাশুড়ী এবং ননদের ন্যাকা কান্নার মাঝে আমার চোখের পানি সবার আড়ালেই রইলো। বিষয়টা এখানেই থামতে পারতো। তাদের ন্যাকা কান্না দেখে, পলাশের অবিশ্বাস দেখে আমিই বললাম,“আমার ভুল হয়ে গেছে। আমাকে মাফ করে দিন আপনারা। আমি হয়তো ভুল দেখেছি। হয়তো বা আমার মায়ের কানের দুলটা আজ আর আমি চিনতে পারছি না।”
এই কথার পর সব থামতে পারতো। কিন্তু থামলো না। আমার শাশুড়ী এবং ননদ বিষয়টিকে আরও বড় করলো। শাশুড়ী মা তো আমার জাত, পাত, বাবা, মা তুলে কথা বলতে শুরু করেছে। পলাশ নিরব দর্শকের মতো সব শুনছে। এক পর্যায়ে শ্বশুড় বললো,“বৌমার বাবাকে ফোন দাও পলাশ। সে এসে মেয়েকে নিয়ে যাক৷ নয়তো আজ চুরির অপবাদ কাল তো নির্যাতনের মামলা দিয়ে বাড়িতে পুলিশ ডাকবে। এই মেয়ের সাথে আমাদের একসাথে থাকা সম্ভব হবে না।”
আমার শ্বশুড়ের কথায় সম্মতি জানিয়ে যখন পলাশ আমার বাবাকে ফোন দিলো আমার অনুরোধ উপেক্ষা করে তখনই আমি বুঝে গেছি, এই সংসারে আমার আপন বলতে কেউ নেই। আমার এই সংসারে আমার আমির অস্তিত্বই নেই। আমি বিষয়টিকে জটিল করতে না চেয়ে পলাশকে অনুরোধ করে বলেছিলাম,“না পলাশ। আমার বাবাকে ফোন দিও না। প্লীজ আমাকে ক্ষমা করে দাও।”

“না। আজ তোমাকে ক্ষমা করে দিলে তুমি লাই পেয়ে যাবে। আজ চোর বানাচ্ছো কাল হয়তো বড়সড় কিছু করবে। তাই আজই এর বিচার হওয়া উচিত।”
সংসারে যে মানুষটির হওয়া উচিত ছিলো আমার শক্ত একটি খুঁটি। সেই মানুষটিই আমাকে নিয়ে বিচার বসাতে উঠে পড়ে লেগেছে। একটা মরীচিকার সংসারকে আপন করে, একজন ভুল মানুষকে ভালোবেসে এই সংসারে নিজের সবটুকু দিয়েছে আমি সেটা বুঝতে আর বাকি রইলো না আমার। আমার চোখের সামনে পলাশ আমার বাবাকে খুব কড়া ভাবে এই বাড়িতে আসতে বলে। এসে তার মেয়ের দোষগুলো শুনে যেতে বলছে।



চলবে,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে