#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৫
মীরার বিস্ময় এখনও কা*টেনি। ড: আকবর রেহমান ফের বলেন,
“ফ্রিশা খুব একা একা থাকে। ওর দাদুমনির সাথে যেটুকু সময় থাকার থাকে। তারপর নিজের মতো। শেহজাদও ওকে খুব একটা টাইম দিতে পারে না। বাসায় আসলেও কাজ ও ল্যাপটপেই বসে থাকে। মায়ের অভাবটা খুব বেশি কষ্ট দেয় ওকে। ওর ড্রয়িং খাতার ছবি দেখলেই বুঝা যায়। মাঝেমাঝে ও একা একা কথাও বলে।”
মীরা ঢোক গিলে নিজেকে ধাতস্থ করে ফ্রিশার দিকে দৃষ্টি ফেলে। পুতুলের মত বাচ্চাটা সবার সাথে কী সুন্দর মেতে আছে। দেখে মনেই হবে না বাচ্চা মেয়েটার হৃদয়ের অন্তস্থলে এক রাশ দুঃখ লুকিয়ে আছে। মীরা আকুল হয়ে শুধায়,
“ওর মায়ের কী হয়েছে?”
“মা*রা গেছে!”
মীরার বুকটা কেঁপে ওঠল। সাথে সাথে দোয়া পড়ল। তারপর প্রশ্ন করল,
“কী হয়েছিল?”
ড: আকবর রেহমান লম্বা নিঃশ্বাস ফেললেন। অতঃপর জবাব দিলেন,
“ফ্রিশার জন্মের সময় ফ্রিওনার কিছু প্রবলেম ছিল, যা ফ্রিওনা তখন কাউকে জানায়নি। পরে সেটা টিউমারে রূপ নেয়। টিউমার থেকে ক্যান্সার। ফ্রিওনার মায়ের মৃত্যুও এই কারণেই হয়েছিল।”
“উনি চিকিৎসা করায়নি?”
“নাহ্!”
মীরা ব্যকুল হয়ে জানার আগ্রহে আছে। ড: আকবর রেহমানের কণ্ঠে ঝড়ে পরে এক রাশ হতাশা। তিনি বলেন,
“নিজের অসুস্থতা ও প্রকাশ করতে চাইত না। শেহজাদও ঠিক তেমনটাই। ফ্রিওনার যখন গুরুতর অবস্থা তখন সে দ্বিতীয়বার প্রেগন্যান্ট। এইতো প্রায় আড়াই বছর আগের কথা। তখন তিন মাসের প্রেগন্যান্সি। শেহজাদ তখনি জানতে পারল সবটা। ফ্রিশার জন্ম আমেরিকাতে হওয়াতে ফ্রিওনা সবটা লুকাতে পেরেছিল। ফ্রিওনার প্রথম প্রেগন্যান্সি জানার কিছুদিন আগেই শেহজাদ বাংলাদেশে এসে ভার্সিটিতে জয়েন করেছিল। চাইলেও সব ছেড়ে যেতে পারছিল না। তখন ফ্রিওনার বাবা, দাদী ও শেহজাদের বাবা-মা আমেরিকায় ওর কাছেই ছিল। তাই শেহজাদ অনেকটা নিশ্চিন্তে ছিল। ফ্রিওনা নিজের আসল প্রবলেমের কথা কাউকে জানতে দেয়নি। সে ভেবেছিল এটা ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু যখন সেকেন্ড প্রেগন্যান্সির সময় শেহজাদ সব জানতে পারল তখন ফ্রিওনাকে বারবার বলা হয়েছে, বেবি এ*বোর্ট করে ট্রিটমেন্ট করাতে। কিন্তু ফ্রিওনা এতোটাই জেদি যে সে দরকার পরলে সব ছেড়ে চলে যাওয়ার হু*মকি পর্যন্ত দিয়েছে। তারপর আর কী! প্রেগন্যান্সির সেভেন মান্থে ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশনে ওকে হসপিটালে এডমিট করা হয়।”
থেমে একটু দম নিল ড: আকবর রেহমান। মীরা অস্থির হয়ে আছে। শরীর কাঁপছে তার। সে অধৈর্য হয়ে শুধায়,
“তারপর?”
এরইমধ্যে মীরার ডাক পরল। জিনিয়া ডাকছে ছবি তোলার জন্য। ড: আকবর রেহমান বলল,
“যাও, ছবি তুলো। বাকিটা তুমি হয়তো আন্দাজ করতে পারছ।”
মীরা ঠোঁট কা*ম*ড়ে লম্বা শ্বাস নিলো। ওই সময়টা নিজে কল্পনা করতে নিলেও ঘাবড়ে উঠছে মীরা। অতঃপর ঘাড় নেড়ে, আঁচল দিয়ে কপালের ঘর্ম বিন্দুদের মুছে নিয়ে বন্ধুদের দিকে এগুলো। জিনিয়া মীরাকে টেনে এনে বলে,
“ধর ক্যামেরা ধর। স্যারের সাথে সুন্দর একটা ছবি তুলে দে। তারপর ফ্রিশার সাথেও।”
মীরা বিনাবাক্যে ক্যামেরা নিয়ে ঠিকঠাক করে ছবি তুলে দিল। এরপর জিনিয়া মীরার হাত থেকে ক্যামেরা নিয়ে মীরাকে স্যারের পাশে দাঁড়াতে বলল। মীরা একটু ইতস্তত করছিল কিন্তু এখন ছবি না তুললেই বরং অস্বস্তিকর লাগবে। তাই ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি রেখে ছবি তুলল। একটা ছবি তোলার পরেই ফ্রিশা উচ্ছাসিত হয়ে বলে ওঠল,
“আমিও আন্টি ও বাবার সাথে ছবি তুলব।”
জিনিয়া সায় দিয়ে বলে,
“অবশ্যই। তুমি দাঁড়াও বেবি। আন্টি তুলে দিচ্ছি।”
মীরা ও শেহজাদ দুজনেই অপ্রস্তুত হয়ে গেল। অন্যকারও বেলায় ফ্রিশা এই জেদ করেনি। নির্দিষ্ট দূরত্বে দাঁড়িয়ে ছিল। শেহজাদ বলে,
“তোমরা তুলো। আমি আর তুলব না।”
কিন্তু ফ্রিশা জেদ ধরেছে।
“না বাবা। তোমাকে তুলতেই হবে। প্লিজ বাবা প্লিজ।”
মীরাও জিনিয়াকে চোখের ইশারায় না করলে, জিনিয়া বরং আরও বলে,
“স্যার, আপনি ফ্রিশার কাঁধে এক হাত রাখুন। আর মীরাও।”
জিনিয়া বলতে দেরি কিন্তু ফ্রিশা ওদের এক হাত নিজের কাঁধে রাখতে দেরি করে না। তৎক্ষণাৎ মীরা ও শেহজাদ দুজনেই চকিত দৃষ্টিতে একে অপরের দিকে তাকায়। জিনিয়া তার পটু হাতে মূহুর্তেই সেটা ক্যাপচার করে নিল। তারপর ওরা দৃষ্টি সরিয়ে সামনের দিকে তাকালে আরেকটা ছবি তুলে নেয়। ছবি তোলা শেষে শেহজাদ বলে,
“অ্যাই ফিল সো হ্যাপি টু মিট অল অফ ইউ। হ্যাভ ফান। বায়। টেক কেয়ার।”
সবাই উষ্ণ বিদায়বার্তা দিয়ে শেহজাদদের বিদায় দেয়। এরপর মীরা ও তার বন্ধুরা আগে থেকে বুকড করা রেস্টুরেন্টে যায়।
_______
বাড়ি ফিরে মীরা ফ্রেশ হয়ে আজকের দিনের ছবিগুলো দেখছিল। পরপর ফ্রিশা ও শেহজাদ স্যারের সাথে ছবি দুটো দেখে কিয়ৎ সময় ব্যয় করে। ছবিটা দেখেই কেমন অস্বস্তি হতে থাকে তার। তৎপর জলদি করে ফোনের স্ক্রিণ অফ করে চোখ বুজে নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজেকে ধাতস্থ করে নেয়। হালকা মাথা ধরেছে। চা খেতে হবে। চটজলদি রান্নাঘরে গিয়ে চু*লোয় চায়ের জন্য গুড়ো দুধ গুলিয়ে বসাল। তখন নিধি ও শারমিন রান্নাঘরের কাছেই ছিল। নিধি বলল,
“চা বানাচ্ছ? তাহলে আমার ও ভাবির জন্যও বানিও।”
শারমিন হাসতে হাসতে বলে,
“আমার ও নিধির চা তো নিধির চা-খো*র বি*চ্ছুটাই অর্ধেক খেয়ে ফেলে। এটুকুন বাচ্চার চায়ের এত নে*শা!”
নিধিও হেসে উঠে বলে,
“আর বলো না ভাবি, সে তো বিকেল হলেই আমাকে নজরে নজরে রাখে। মাঝেমধ্যে বিকেলে তুমি-আমি যে ওকে লুকিয়ে চা খাই তা সে বুঝতে পেরে গেছে।”
“নিহানের দেখাদেখি সিয়ামও চামচ দিয়ে চা খেতে চায়।”
মীরা আরও দুধ গুলিয়ে ও সাথে তরল দুধও দিয়ে দিয়েছে। ভাবিদের কথা শুনে মিটিমিটি হাসছেও। তার ছোটো ভাইয়ের সাড়ে তিন বছরের ছেলে নিহানটা একদম তার ফুফির মতো চা-খো*র হয়েছে। বড়ো ভাইয়ের দেড় বছরের ছেলেটাও নাকি চা খেতে চায়! ভাবা যায়! মীরা তিন কাপ চা বানিয়ে নিল। ভাবিদের দিয়ে নিজেও নিয়ে সাথে বসল। আড্ডায় আড্ডায় চা খাওয়া শেষ করে আবার নিজের ঘরে চলে গেল।
________
মিসেস শাহিদা রেহমান, স্বামীকে চিন্তিত দেখে পাশে এসে বসলেন। অতঃপর শুধালেন,
“কী হয়েছে? কিছু নিয়ে চিন্তিত?”
ড: আকবর রেহমান নিজের স্টাডিরুমে চেয়ারে গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে ছিলেন। স্ত্রীর কণ্ঠস্বরে ঠিক হয়ে বসলেন। ম্রিয়মাণ স্বরে বললেন,
“হ্যাঁ। তোমাকে বলেছিলাম না একটা মেয়ের কথা? যার সাথে কাল ভার্সিটিতে কথা হলো।”
“হ্যাঁ। কী হয়েছে?”
“মেয়েটার সাথে পার্কে আজও দেখা হলো। সবটা বললাম। জানিনা কী সিদ্ধান্ত নিবে। তবে একজন অবিবাহিতা মেয়ে কি এই প্রস্তাবে রাজি হবে? তা নিয়ে সন্দিহান আমি।”
মিসেস শাহিদাও বললেন,
“এটা ঠিক বলেছ। হয়তো রাজি হবে না। কিন্তু তুমি ওই মেয়েকেই কেন বললে?”
“কারণ মেয়েটা সফট হার্টের। আমার রিসার্চ স্টুডেন্ট ছিল। বেশ ডেডিকেটেড। রেজাল্টও ভালো। রিসার্চ স্টুডেন্টদের সাথে অনেকটা সময় আড্ডাও হতো, তখন এসব বিষয় উঠলে ওকে বলতে শুনতাম যে, ‘মেয়েরা অন্যের বাচ্চাকে তো বেশ আদর-যত্ন করে কিন্তু স্বামীর আগের ঘরের সন্তানকে সহ্য কেন করতে পারে না? আগের ঘরেররই তো সন্তান। আগের স্ত্রীর বিয়োগেই তো বিয়ে করেছে। জেনেই তো বিয়ে করেছে। এমন তো না যে স্বামী তাকে চি*ট করে অন্য মহিলাকে তার সংসারে ঢুকিয়েছে।’ ওর চিন্তা-ধারা সুন্দর। সাথে ওর অতীতও জানি আমি। যাকে মীরা ভালোবাসত, সেই বর্ণও আমার মাস্টার্সের রিসার্চ স্টুডেন্ট ও লাস্টবার জিটিএ ছিল। বর্ণ জাপানে গিয়ে বিয়ে করে নিল, তারপর মীরাও মাস্টার্স করতে ইন্ডিয়া চলে গেল।”
ড: আকবর রেহমান থামলেন। চিন্তা হচ্ছে তার। যদি মীরা রাজি নক হয়? মিসেস শাহিদা বললেন,
“মীরা রাজি হলেও, ওর পরিবার? তাছাড়া শেহজাদ? কী যে হবে! এতে চিন্তা ভালো লাগে না। বয়স হয়েছে। কখন কী হয়ে যায়।”
মিসেস শাহিদা হতাশ নিঃশ্বাস ফেলে ফ্রিশার খাওয়ার সময় হওয়াতে চলে যান।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।