মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-৩৪+৩৫

0
661

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৪
সময়ের পাতা খুব দ্রুত উলটে যায়। ঋতু পরিবর্তন হয়ে শরৎ, হেমন্ত। তারপর এখন শীত ঋতু। পর্ণমোচী উদ্ভিদেরা নিজেদের রিক্ত করে প্রকৃতিতে কাঙালের রূপ নিচ্ছে। কনকনে শীতের ভোর সকালে মীরা ফজরের নামাজ পড়ে পুকুর পাড়ে শাল জড়িয়ে এসে বসেছে। গতকাল রাতেই তাঁরা কলকাতায় পৌঁছেছে। রাইমার বিয়ে যে আজ। একটু পরেই বাড়ির মহিলা সদস্যরা জল সইতে চলে আসবে। রাইমার দধিমঙ্গলের অনুষ্ঠান চলছে, আসার পথে মীরা রাইমার দুয়েকটা ছবি তুলে নিজেও ও-কে এক লোকমা খাইয়ে চলে এসেছে (এই বিষয় আমার তেমন জ্ঞান নেই)। শেহজাদ নামাজ পড়ে আবার ঘুমিয়েছে। আর ফ্রিশা এখনও জাগেনি। পুকুর পাড়ে বসে বসে গতরাতের কথা ভাবছে মীরা। রাইমা তাকে হাসি-ঠাট্টার মাঝেই হুট করে জিজ্ঞাসা করে বসে,

“তুই ভালোবাসিস জিজুকে? জিজু তোকে ভালোবাসে তো?”

এর বিপরীতে এক কথায় কোনো উত্তর দিতে পারেনি মীরা। সারারাত তার ঘুমও ঠিকমতো হয়নি এসব ভাবতে ভাবতে। আজ সতেজ, শীতল পরিবেশে চোখ বন্ধ করে নিজের মন থেকে উত্তর খুঁজছে। দুজনের কারোর জীবনেই তো কেউ প্রথম ভালোবাসা না। দ্বিতীয়বার কি ভালোবাসতে পেরেছে আদৌও? এই প্রশ্ন জর্জরিত মীরার মন মোহনা। বিগত ছয় মাসের স্মৃতি রোমন্থন করে মনের অভ্যন্তর থেকে খুব আকুল ভাবে সাড়া পেলো, সে দ্বিতীয় বার ভালোবাসতে পেরেছে। সত্যি পেরেছে। মুদিত আঁখি যুগল মেলে স্থির জলরাশির দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকালো। এই শুষ্কতম ঋতুতেও তার মনে ফাগুনের হাওয়া বয়ে যায়। ও*ষ্ঠকোণে ফুটে উঠে লাজরাঙা হাসি। খানিক সময় পেরোতেই রাইমার বাড়ির মহিলা সদস্যদের এদিকে আসারা পদধ্বনি শুনে মীরা উঠে দাঁড়ায়। অতঃপর তাদের জন্য স্থান ফাঁকা করে সেখান থেকে চলে আসে। যদিও রাইমার কাকিমা, মীরাকে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু মীরার এখন ফ্রিশাকে তুলতে হবে। তারপর রাইমার সাথে থাকতে হবে, তাই রাইমাদের বাড়ির পথে হাঁটা দেয়।

________

কুঞ্জদের বাড়ি থেকে কুঞ্জর গায়ে ছোঁয়ানো হলুদ এসেছে। এখন রাইমাকে উঠোনে আনা হয়েছে গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য। মীরা ও রাইমার দুয়েকজন ভাবী ও কাজিন বোনেরা বরপক্ষ থেকে আসা মানুষদের আপ্যায়নে গিয়েছে। বরপক্ষ থেকে আসা এক সুদর্শন যুবক ছেলে তো মীরাকে দেখে সেখানেই হাঁ হয়ে বসে আছে। ফ্রিশা ওদিকে বাড়ির বাচ্চাদের সাথে খেলছে। মীরা ফাঁকা ট্রে হাতে সেখান থেকে চলেই আসছিল তখন সেই যুবকটি মীরাকে ডাকে। সে মীরার নামটা শুনতে পেয়েছে রাইমার ভাবি ও কাজিনদের মুখ থেকে ডাক শুনে। অচেনা কোনো পুরুষ কণ্ঠে নিজের নাম শুনে ভ্রু কুঁচকে পিছু ফেরে মীরা। ছেলেটি মীরার সামনে এসে কিছুটা এটিটিউটের সাথে হাত বাড়িয়ে বাঁকা হেসে বলে,

“হ্যালো। আমি রাহুল।”

মীরার মুখভঙ্গির বিন্দু মাত্র পরিবর্তন হয়নি। কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে যখন যুবকটি মীরার থেকে কোনো প্রত্যুত্তর পেলো না তখন সে আবার বলে,
“আমি কুঞ্জের মাসতুতো ভাই। আপনি নিশ্চয়ই রাই বৌদির বোন হোন?”

মীরা মুখে জোরপূর্বক হাসির রেখার টেনে বলে,
“ওহ আচ্ছা। আমি রাইয়ের বোন না কিন্তু বোনের মতো বান্ধবী।”

“পরিচিত হতে পারি?”

মীরা তীক্ষ্ম দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সামনে দাঁড়ানো লোকটির কথা বলার ধরণ বুঝতে চাইলো তখন সবটা তার মস্তিষ্কে ধরা দেয়। লোকটা তার সাথে ভবিষ্যতে ফ্লার্টিং করার ধা*ন্দা করছে। মীরা মুচকি হেসে সেই আশায় জল ঢালতে বলল,
“কেন পারবেন না? আপনি তো আমার নাম জানেনই। সাথে এটাও জানলেন যে আমি রাইয়ের ফ্রেন্ড। এখন আমি আমার বাকি পরিচয়টাও দিচ্ছি। ওই যে দেখছেন (আঙুল তা*ক করে) একটা লোক পিলারে সাথে হেলান দিয়ে বুকে হাত গুঁজে দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে এদিকেই তাকিয়ে আছে? সেই লোকটা আমার স্বামী! আর একটু পরপর যে বাচ্চারা এদিকে দৌড়াদৌড়ি করছে না? তার মধ্যে যেই বাচ্চাটার রেড-ব্রাউন চুলের রং, সেই বাচ্চাটা আমার মেয়ে! আর কিছু জানতে চান?”

যুবকটি থতমত খেয়ে হা হয়ে একবার শেহজাদের দিকে তাকাচ্ছে তো আরেকবার মীরার দিকে তাকাচ্ছে। মীরার মনে মনে ভীষণ হাসি পেলেও সে যত্র হাসলো না। ঘুরে চলে যেতে নিলে পেছন থেকে যুবকটি প্রশ্ন ছুঁড়লো,

“কিন্তু আপনার সিঁথি তো ফাঁকা! আজকালকার মেয়েরক বিয়ের পরও সিঁথি ফাঁকা রেখে অবিবাহিত ছেলেদের গুমরাহ করে। কী যে মজা পায়! গ*ড নওজ!”

মীরা আবার পিছু ঘুরে মুচকি হেসে জবাবে বলে,
“আমি মুসলিম তাই বিয়ের পরও আমার সিঁথি ফাঁকা। আর কিছু জানার বাকি? বাকি থাকলে বাড়ি গিয়ে কুঞ্জদার থেকে জেনে নিবেন। ধন্যবাদ।”

মীরা আর দাঁড়ালো না। সেখান থেকে চলে আসলো। পিছনে ছেলেটা নিজের কপাল চাঁপড়ে নিজেদের লোকদের কাছে চলে গেল। মেহমান ঘর থেকে বেরোতেই শেহজাদ এসে মীরার পথ রোধ করে দাঁড়ালো। মীরা হুট করে শেহজাদকে গম্ভীর মুখে দেখে শুধালো,

“কী হলো? সামনে এসে দাঁড়ালেন কেন?”

শেহজাদ জবাব দেয় না। মীরা কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থেকে বলে,
“কী বলবেন বলুন নয়তো আমি রান্নাঘরে এটা (ট্রে টা দেখিয়ে) রেখে আসি।”

শেহজাদ হুট করে মীরার হাত থেকে ট্রে টা এক প্রকার ছিনিয়ে নিয়ে বিয়ে বাড়ির মানুষজনদের মধ্যে কাউকে ডেকে ট্রে টা দিয়ে রান্নাঘরে রেখে আসতে বলে। তারপর মীরার হাত ধরে বাড়ির একটা ফাঁকা কোনায় নিয়ে যায়। মীরাকে দেয়ালের সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়া করিয়ে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে শুধায়,

“ওই ছেলেটার সাথে এতক্ষণ যাবত কী কথা বলছিলে?”

মীরাও চোখ ছোটো ছোটো করে তাকায়। অতঃপর প্রত্যুত্তরে বলে,
“চিনিনা আমি।”

“না চিনলে ওই ছেলের সাথে এত কথা কী-সের?”

“আরেহ! ওই ছেলেই তো আমাকে ডাকলো! আমি কি সেধে সেধে গিয়েছিলাম কথা বলতে? আপনি তো সেখানে দাঁড়িয়ে দেখলেনই।”

“কী কথা হচ্ছিলো তোমাদের?”

মীরা এবার দেয়ার থেকে সরে আসতে চাইলে শেহজাদ নিজের হাতের দ্বারা দেয়াল ধরে মীরার পথ রোধ করে। মীরা শেহজাদের চোখের দিকে তাকালে খানিক ঘাবড়ে যায়। শেহজাদের চোখে কেমন একটা রাগের আভাস! মীরা ভীতু স্বরে বলে,

“আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? তেমন কোন কথা হয়নি। আমি ওই ছেলেকে দেখাচ্ছিলাম যে আপনি আমার স্বামী, আর ফ্রিশামনি আমার মেয়ে। এটাই।”

“ওই ছেলে তোমাকে ডিস্ট্রাব করছিল?”

মীরা ভাবলো শেহজাদকে শান্ত করতে হবে। বলা যায় না, যদি কোনো ঝামেলা করে বসে? বরপক্ষের লোক ওরা। মীরা হুট করে শেহজাদের গলা জড়িয়ে বলল,

“ব্যাপার কী হুম? এতো পজেসিভ? ভয় হচ্ছে? যদি আপনার সুন্দরী বউকে কেউ নিয়ে নিতে চায়? ভালোবেসে ফেললেন বুঝি?”

আচমকা মীরার স্বর পালটে যাওয়াতে হতভম্ব হয়ে গেল শেহজাদ। সে মীরার কথা পাত্তা না দিয়ে বলে,
“সবসময় একটু বেশি বুঝো তুমি। আমি তো তোমার সেফটির জন্য বলছিলাম। বিয়ে বাড়িতে কিছু ছেলেরা মেয়েদের সাথে অস*ভ্য*তামি করার চেষ্টা করে। একটা অচেনা ছেলে তোমাকে ডাকলো, তুমি কথা বললে। তোমার সাথে কোনো অস*ভ্যতা*মি করেছে কী-না? যাইহোক বাদ দাও। অস*ভ্যতা*মি না করলে তো ভালোই। তুমি তোমার কাজে যাও।”

এই বলে শেহজাদ সেখান থেকে সরে যাচ্ছিল, তখনি মীরা শেহজাদের বাম হাতের কব্জি ধরে আটকায়। ফের শুধায়,
“ভালোবাসেন আমাকে?”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৫
শেহজাদ একদৃষ্টে মীরার মুখপানে দৃষ্টি স্থির রেখেছে। মীরার অনুভূতি মিশ্রিত প্রশ্নে তার মন হঠাৎই অশান্ত হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগের রাগ যেন কর্পূরের ন্যায় হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। প্রায় মিনিট খানিক পেরোনোর পর বিয়ে বাড়ির মানুষজনের হুড়োহুড়িতে চলাফেরার মধ্যে একজন হুট করে শেহজাদকে সামান্য ধা*ক্কা দিলে সে বাস্তবে ফিরে। মীরার উদগ্রীব নয়ন যুগলে তাকিয়ে থাকা যেন ভীষণ ভয়ের হয়ে দাঁড়িয়েছে তার জন্য। পরন্তু শেহজাদ নজর নামিয়ে মীরার হাত ছাড়িয়ে যেতে চাইলে মীরা ফের হাত আঁকড়ে ধরে আবার করুণ স্বরে বলে ওঠে,

“ভালোবাসেন না। তাই না? এটা মুখে বললেও আমি তেমন কিছু মনে করতাম না। বলে দিলে অন্তত মিথ্যে আশায় থাকতাম না।”

শেহজাদ এবারেও চুপ করে আছে। তাই জন্য মীরা নিজেই শেহজাদের হাত ছেড়ে দিয়ে ঠোঁটের কোণে বিস্তর কৃতিম হাসি টেনে এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি তো পরশু সন্ধ্যার ফ্লাইটে ফিরে যাবেন। আমি যাচ্ছি না।”

শেহজাদ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়েও যখন দেখলো মীরা উত্তর দিচ্ছে না। তখন প্রশ্ন করেই বসে,
“কেন যাবে না?”

“এখন আমার ফ্রি সময়। খাতাও দেখে শেষ করে এসেছি। তাই সময়টা একটু নিজের মতো থাকতে চাই। ফ্রিশাও আমার সাথে থাকবে।”

“তুমি সাডেনলি এসব কেন বলছো?”

“ইচ্ছে হলো তাই। আমার ইচ্ছে হতে পারে না? নাকি শুধু আপনারই ইচ্ছে হতে পারে? ফ্রি সময়ে বাড়ি ফিরে কী করব? আপনাকে দেখব? কেন দেখব? তার থেকে ভালো আমি প্রকৃতি দেখি। অন্তত মাইন্ড ফ্রেশ হবে।”

মীরা এবার শেহজাদকে ফেলে চলে যাচ্ছে। পেছন থেকে শেহজাদ বলে ওঠে,
“তুমিও আমার সাথে ফিরবে, মীরা।”

“না!”

“প্লিজ, মীরা। সবসময় জেদ করলে চলে না।”

“আশ্চর্য! আমার লাইফ, আমি জেদ করব। আমি তো জেদ নিজের সাথে করছি। এতে আপনার কোনো ক্ষতি তো হচ্ছে না।”

“মীরা!”

মীরা উত্তর না করে পেছন না ঘুরেই চলে যাচ্ছে। শেহজাদ হুট করে বলে ওঠে,
“নিজেরটাই দেখছো। আমি কীভাবে থাকব?”

থামে মীরা। পেছনে ঘুরে ফিরে এসে কড়া কণ্ঠে শুধায়,
“কেন? আমার এখানে থাকার সাথে আপনার কী সম্পর্ক? আপনার মেয়ের জন্য? ওকে। ফ্রিশাকে সাথে করে নিয়ে যান।”

“এখানে ফ্রিশার কথা আসছে না। আমি তোমার কথা বলছি।”

“আমার কথা কেন? আমি থাকলেও কী আর না থাকলেও কী? ইউ ডোন্ট লাভ মি রাইট? অভ্যাস হয়ে গেছি তাই? অভ্যাস বদলাতে শিখতে হয়। ইন ফিউচার, আমি না থাকলে তখন এই অভ্যাসটা আপনার জন্য কাল হয়ে দাঁড়াবে।”

শেহজাদ আবার রেগে গিয়ে মীরা ডান হাতের কব্জি শক্ত করে ধরে টেনে কোথাও একটা নিয়ে যাচ্ছে। মীরা হতবাক হয়ে শেহজাদকে দেখছে। শেহজাদের চোখে যেন রোশা*গ্নির স্ফু*লিঙ্গ জ্ব*লছে। মীরা কয়েকবার হাত ছাড়তে বলেছে, নিজেও ছাড়াতে চেয়েছে। কিন্তু পারেনি!
শেহজাদ মীরাকে নিয়ে রুমে গিয়ে দরজা লাগিয়ে এবার বলে,

“হঠাৎ কী হয়েছে তোমার? এমন করছো কেন?”

মীরা ছাড়া পেয়ে আবার আগের মুডে গিয়ে শান্ত হয়ে বসে। তারপর নিজের হাতের অবস্থা দেখতে দেখতে বলে,
“কী করলাম? কিছুই তো করিনি।”

“কিছু করোনি?”

“না তো। আপনিই বরং বেশি রিয়াক্ট করছেন। এখন আমার উচিত রাইয়ের কাছে থাকা! আর আপনি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন!”

শেহজাদ মীরার কাছে এগিয়ে ওর হাঁটুর সামনে বসে চোখের দিকে চেয়ে বলে,
“আমি যদি বলি ভালোবাসি, তবে তুমি খুশি হয়ে যাবে?”

মীরা কয়েক মূহুর্ত নিশ্চুপ থেকে বলে,
“মন থেকে বলতে হবে।”

“তাহলে মন থেকে বুঝতেও হবে। মুখে বললেই ভালোবাসা হয় আর না বললে হয় না? মুখে তো অন্যের খুশির জন্য কতোকিছুই বলা যায়। ভালোবাসা এক্টিভিটিতে বুঝতে হয়, মিসেস মীরা। সো এখন থেকে তাই করুন।”

অতঃপর মুচকি হেসে শেহজাদ উঠে দরজা খুলে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। মীরা সেখানেই ঠায় বসে রয়। আপন মনে ভাবতে থাকে, ‘আমি কি একটু বেশিই ফোর্স করে ফেললাম? উনি কি রাগ করলেন? ধ্যাত শুধু শুধু। তবে পরশুদিন আমি সত্যি ফিরব না। দেখি উনি কী করে?”

এসব ভাবার মধ্যেই মীরার ফোন বেজে উঠলো। রাইমা কল করছে। মীরা ফোন রিসিভ না করেই দ্রুত ওর কাছে যেতে রুম থেকে বের হয়।

________

প্রায় সন্ধ্যার দিকে রাইমাকে নিয়ে পার্লার থেকে ফিরেছে মেয়েরা। রাইমাকে এতটা সুন্দর দেখাচ্ছে যে তা নিয়ে মেয়ে-বউদের মাঝে হাসির অন্ত নেই। লতানো ডিজাইনের লাল কাতান বেনারসি। পাড়ে পাতি-পুতির কাজে শাড়ির মাহাত্ম্য আরও বাড়িয়েছে। ভারী ফুল নেক জড়োয়া হার ও পাতলা চেইনের মতো একটা সিতা হার। টিকলি ও হালকা টানা দিয়ে ছোটো সোনার মুকুটের সাথে শুভ্র শঙ্খ মুকুট তো আছেই। কপালের কলকাটা ছোটোর মধ্যে অসাধারণ। দুই হাতেও একটা করে মোটা বালার সাথে শাখা-পলা। মীরা, রাইমাকে বসিয়ে রুমে এসে রাইমার জন্য গিফটটা নিয়ে আবার যায়। তারপর রাইমার হাত ধরে হাতে ডায়মন্ড গোল্ডের দুটো চুড়ি পড়িয়ে দেয়। রাইমা নিজের হাতে ব্রেসলেটটা দেখে বলে,

“মীরু! তুই এগুলো কেন আনতে গেলি? পা*গ*ল নাকি!”

“কেন তোর পছন্দ হয়নি? কুঞ্জদার জন্য রিচ ওয়াচও নিয়েছি। ওটা কুঞ্জদাকেই দিব।”

“পছন্দ হওয়া নিয়ে না। এতো গহনা এসব কি আমার খুব একটা পড়া হবে বল তো?”

“চুপ! তোদের বিভিন্ন অনুষ্ঠান হয়। পূজো এসব। পড়া হবে ঠিকই। এখন শান্ত হয়ে বস। একটু পড়েই পিঁড়ি নিয়ে আসবে। আমি একটু দেখি ফ্রিশা কই।”

এই বলে মীরা ফ্রিশাকে খুঁজতে বেরোয়। পথে শেহজাদকে দেখে যত্র থেমে যায়। সিলভার রঙের পাঞ্জাবি-পাজামাতে শেহজাদকে ভীষণ সুদর্শন দেখাচ্ছে। মীরা মুগ্ধ হয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে এবার নিজের দিকে তাকায়। সিলভার রঙের বেনারসি শাড়ির সাথে সে মুক্তো ও স্বর্ণের, নেক পিস ও সিতা হার পড়েছে। চুলগুলো রিং করে খোলা রেখে অর্ধেকটা এক পাশ করে এনে রেখেছে। সাথে সাদা ডেইজি তো আছেই। তাকেও নিশ্চয়ই কম সুন্দর লাগছে না! এগিয়ে গিয়ে শেহজাদের পাশে দাঁড়িয়ে হালকা কেঁশে শুধায়,

“এখানে একা দাঁড়িয়ে কী দেখছেন? বিয়ে বাড়িতে আবার চোখের মতিভ্রম হলো না-কি?”

শেহজাদ এক পলক চেয়ে মুচকি হেসে প্রত্যুত্তরে বলে,
“পাশে যদি এমন একজন থাকে তবে নজর কোনো হুরপরীর দিকেও যাবে না।”

“হ্যাঁ? কী বললেন?”

মীরার চোখে-মুখে অন্যরকম উজ্জ্বলতা। শেহজাদ হুট করেই গম্ভীর স্বরে বলে,
“মেয়েকে দেখো। দৌড়াদৌড়ি করেই চলেছে। ড্রেসের সাথে পা বেধে পড়ে যেতে পারে।”

শেহজাদ সেখান থেকে নিরবে সরে যায়। মীরা ফ্রিশাকে সামনে খুঁজতে খুঁজতে পাশে তাকিয়ে দেখে শেহজাদ নেই! তদ্রুপ সে কোমড়ে হাত গুঁজে চোখ ছোটো ছোটো করে বলে,
“এই লোক আমাকে ফাঁকি দিলো! অভ*দ্র লোক!”

এরপর মুখ ভার করে ফ্রিশাকে খুঁজতে ছুটলো।

_______

পিঁড়িতে বসিয়ে মুখ পানপাতা দিয়ে ঢেকে রাখা রাইমাকে ছাদনাতলায় আনা হয়েছে। এবার ও-কে কুঞ্জের চারিপাশে পদক্ষিণ করানো হচ্ছে। অতঃপর শুভদৃষ্টি। শুভদৃষ্টিতে রাইমার থেকে কুঞ্জকেই বেশি লাজুক দেখাচ্ছিল। ফ্রিশা তার বাবার কোলে চড়ে বিয়ে দেখছে আর ফুল ছিটাচ্ছে। ফ্রিশা বলে,

“বাবা? রাই আন্টিকে নামাবে না? আন্টি যদি পড়ে যায়?”

“নামাবে সোনা। আরেকটু পরেই নামাবে।”

“ফেইরিমাম্মাম, তোমার বন্ধুকে বলো না? ভালো করে ধরে বসতে। পড়ে যাবে তো।”

মীরা হেসে জবাব দেয়,
“পড়বে না, বাচ্চা। আর তোমার রাই আন্টি যদি পড়েও যায় তোমার কুঞ্জ আঙ্কেল আছে তো। সারাজীবন সামলানোর জন্য।”

ফ্রিশা কী বুঝলো নিজেও জানে না। মিষ্টি হেসে বিয়ে দেখছে।
মালাবদল শেষে রাইমাকে নামানো হয় তারপর বিয়ের রীতিনীতি শুরু হয়। অতঃপর সাতপাক, সিঁদুর দানের মাধ্যমে রাইমা বাঁধা পড়ে কুঞ্জের সাথে। বিয়ের সব রীতি শেষে যেখানে বাসর জাগবে সেখানে রাইমা ও কুঞ্জকে নেওয়া হয়। সবাই নাচ-গানের মাধ্যমে আসর জমিয়ে রেখেছে। রাইমা এবার মীরাকে খুব করে ধরলো গান গাইতেই হবে। অতঃপর মীরাও গান ধরলো,
“আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো,
আমার পরানো যাহা চায়।
তোমা ছাড়া আর এ জগতে মোর কেহ নাই, কিছু নাই গো
আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরানো যাহা চায়।
তুমি সুখ যদি নাহি পাও, যাও সুখের সন্ধানে যাও। (২)
আমি তোমারে পেয়েছি হৃদয়মাঝে, আর কিছু নাহি চাই গো।
আমার পরানো যাহা চায়।”
~রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
(গানটা আমার ভীষণ পছন্দের। বাকিটুকু নিজ দায়িত্বে শুনে নিবেন।)

গানটা শেষ করে মীরা শেহজাদের দিকে তাকায়। দুজনের অপলক শুভদৃষ্টিতে রাইমা তুড়ি বাজিয়ে ভাঙিয়ে বলে,
“এই যে? বাসরটা আমার। আর তোমরা এখানে শুভদৃষ্টিতে মেতে আছো? নট ডান জিজু।”

শেহজাদ খানিক লজ্জা পেয়ে যায়। মীরা তো কপট রা*গ দেখিয়ে রাইমাকে দুয়েকটা লাগিয়েও দিয়েছে। এরপর হাসি-আড্ডায় রাত দেড়টার মতো বেজে গেলে শেহজাদ ঘুমন্ত ফ্রিশাকে নিয়ে সেখান থেকে উঠে যায়। মীরাকে তো রাইমা উঠতেই দিবে না। তাদের কথাই আছে রাইমার বাসর জাগাতে মীরাকে সাথে থাকতে হবে।

পরদিন সব রিচুয়ালের পর কনে বিদায় হয়। যাওয়ার সময় রাইমার ও তার পরিবারের কান্নাতে মহল বেশ ভার। মীরা ও শেহজাদরা রাইমাদের বাড়ি থেকে একটা হোটেলে ওঠলো। যদিও রাইমার মা-কাকিরা নিষেধ করছিলো কিন্তু ফ্রিশার বিয়ে বাড়ির ভিড়ে শরীর খুব একটা ভালো যাচ্ছে না। দুই রুমে হোটেলে উঠেই ফ্রিশা কোলাহোল মুক্ত পরিবেশ পেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।

_______

রাইমার বৌভাতের অনুষ্ঠানও খুব সুন্দর ভাবে মিটে গেছে। গাড়ো নীল শাড়িতে রাইমাকে বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিলো। বৌভাতের অনুষ্ঠানে শেহজাদ মীরার হাতে তিনটি এয়ার টিকেট ধরিয়ে দিয়ে বলে,
“আমরা দার্জিলিং যাচ্ছি।”

মীরা অবাক হয়ে শুধায়,
“দার্জিলিং? সত্যি? কিন্তু আপনার তো ফিরতি টিকেট ছিল।”

“তোমার সত্যি মনে হলো, আমি তোমাকে রেখে ব্যাক করব?”

মীরা অপলক শেহজাদের চোখের দিকে চেয়ে আছে। চাহনিতে আছে পরিতৃপ্তির আভাস।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে