#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩২
আজকের দিনটা বেশ সারপ্রাইজিং ছিল মীরার জন্য। শেহজাদ ও-কে ভার্সিটিতে নামিয়ে দিয়ে যাওয়ার পর কলিগদের থেকে শুরু করে স্টুডেন্টদের ভালোবাসায় মন সিক্ত হয়েছে তার। আজকের দিনে যে কয়টা ক্লাস নিয়েছে, প্রতিটা ক্লাস থেকে কিছু না কিছু গিফট তো পেয়েছেই। সাথে স্টুডেন্টদের আন্তরিক শুভেচ্ছা। তারমধ্যে প্রত্যেকের থেকে ফুলের তোড়াও উপহার পেয়েছে। ভার্সিটির অফিস টাইম শেষে মীরা অপেক্ষা করছে শেহজাদের জন্য। মীরার কলিগ দুজনের মধ্যে কনক ম্যাম নিজের ব্যাগ গুঁছিয়ে বেরোবে তখন হাস্যরসে বলে,
“হাসবেন্ডের জন্য অপেক্ষা করছো? আমারও এমন হতো। বিয়ের প্রথম দিকে। কষ্ট করে হলেও নিতে আসবেই।”
মীরা মৃদু হাসে। সাবিহা ম্যামও সাথে তাল মেলায়,
“আমার জন বড্ড অলস। সকালে দিয়ে যায় তারপর বিকেলে এই ট্রাফিক ঠেলে তার নিতে আসতে মোটেও ইচ্ছে করে না। তাই আমি উবার ডেকে চলে যাই। কনক ম্যামের তো এখন নিজস্ব গাড়িই আছে।”
“গাড়ি থাকলেও কী! অলসতার জন্য ড্রাইভিং শিখতে পারলাম না।”
“রিল্যাক্সে বাড়ি ফিরতে পারলে শেখার থেকে না শেখাই ভালো। তবে সেফটির জন্য শেখা থাকা উচিত।”
মীরা ওদের কথায় এবার প্রত্যুত্তর করে,
“আমিও উনাকে ট্রাফিকের কথা বলেছিলাম, কিন্তু শোনেনি। ভালোই হয়েছে, উবার বা পাবলিক ট্রান্সপোর্টে একটু কেয়ারফুল থাকতে হয়।”
“হুম। থাকো তবে। উবার কাছাকাছি চলে এসেছে। গেলাম।”
সাবিহা ম্যাম চলে গেলেন। কনক ম্যামও ফোন আসাতে কথা বলতে বলতে বিদায় জানিয়ে বেরিয়ে পড়েন।
প্রায় আধঘণ্টা পর শেহজাদ কল করলে মীরা নিজের অফিস রুম থেকে আজকের উপহার গুলো নিয়ে বেরোয়। সে গাড়ির কাছে পৌঁছালে, ড্রাইভিং সিটে বসে শেহজাদ গাড়ির ফ্রন্ট সিটের ডোর খুলে দেয়। মীরা গাড়িতে বসেই আগে নিজের ব্যাগ ও ফুলগুলো পিছনের সিটে রেখে তারপর ডোর লক করে। শেহজাদ সরু দৃষ্টিতে এসব দেখছে। মীরা সোজা হয়ে বসলে শেহজাদ জিজ্ঞাসা করে,
“এতো ফ্লাওয়ার?”
“হ্যাঁ স্টুডেন্টরা দিলো। সুন্দর না দেখুন? লিলি ফ্লাওয়ারের দুটো রঙের দুটো তোড়া। তারপর ডিফরেন্ট কালারের ডেইজি ফ্লাওয়ারের একটা তোড়া। খোঁপায় দেখুন। (মীরা হালকা পিছ ঘুরে তার খোঁপা দেখালো) একটা কালো গোলাপ ও দুইটা লাল গোলাপ। হলুদ ও হালকা গোলাপি ও সাদার মিশেলেরও গোলাপ দিয়েছে। তোড়াগুলোর মধ্যে রেখে দিয়েছি। আসলে তিনটা খোঁপায় পড়িয়ে দিলো বলে তোড়াটা খুলতে হলো।”
শেহজাদ গাড়ি স্টার্ট করে বলে,
“ওয়াও! ভার্সিটিতে কোয়াইট ফেমাস তুমি!”
মীরা এটাকে কম্পিলিমেন্ট হিসেবে নিলেও শেহজাদ মোটেও এটা প্রশংসাবাদ দেয়নি। মীরা খুশি মনে বলে,
“ফেমাসের জন্য না। বিয়ের পর আজকে ফার্স্ট ক্লাস নিলাম। ওরা নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। ওরা খুব ফ্রেন্ডলি।”
“ইয়াস্টারডে তো আমিও ভার্সিটিতে গেলাম। তো?”
মীরা এবার শেহজাদের বলার ধরণ খেয়াল করে। সামান্য ঘুরে বসে শুধায়,
“আপনি কি জে*লাস? আপনার স্টুডেন্টরা আপনাকে কেন ফুল দিলো না তাই জন্য?”
শেহজাদ থতমত খেয়ে চো*রা নজরে একবার তাকিয়ে কণ্ঠে স্বাভাবিকতা এনে বলে,
“অফকোর্স নট। জাস্ট আস্কিং। ফ্লাওয়ার এসব ফিমেইল ফ্যাকাল্টিদেরকেই স্টুডেন্টরা দেয়। তোমার স্টুডেন্টদের ম্যাক্সিমাম কি ফিমেইল?”
“না। এভারেজ। কিছু ক্লাসে মেয়ে বেশি, কিছুতে ছেলে বেশি। আপনি তো বুঝেনই।”
“হুম। আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?”
“করুন।”
“যখন তুমি আমার স্টুডেন্ট ছিলে, তখন তোমার আমাকে কেমন মনে হতো? লিটারেলি আমি দেখি স্টুডেন্টরা আমাকে দেখলে কেমন রো*বটের মতো থেমে যায়। লিফটে এমনটা বেশি হয়। করিডরে তো জলদি করে সালাম দিয়ে পাশ কা*টা*তে পারলেই যেন বেঁচে যায়, এমন ভাবে চলাচল করে।”
মীরা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে অতি স্বল্প আওয়াজে নিজে নিজেই বলে,
“ভার্সিটির ফার্স্ট দিন আপনাকে ফার্স্ট দেখেই তো আমি সহ আমার বান্ধবীরা ক্রা*শ খেয়ে বসেছিলাম! এটা এখন কীভাবে বলি!”
শেহজাদ নিজের প্রশ্নের জবাব না পেয়ে ফের শুধায়,
“বললে না?”
“ও ও হ্যাঁ।!
মীরা দ্রুত সোজা হয়ে বসে। শেহজাদেে দিকে তাকালে শেহজাদ ইশারায় বলতে বলে সামনের দিকে ফিরে ড্রাইভ করতে থাকে। মীরা বলেই ফেলে,
“আপনি তো ডিপার্টমেন্টের মেয়েদের ক্রাশ ছিলেন!”
শেহজাদ মীরার দিকে সরু দৃষ্টি নিক্ষেপ করে হেসে বলে,
“তোমারও?”
“না না। আমার ক্রাশ হতে যাবেন কেন! আমি সবার কথা বলছি।”
মীরা জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে ঠোঁট কা*ম*ড়ে সিটে গা এলিয়ে দেয়। অতঃপর ঠিক হয়ে আবার গাড়ির সামনে রাখা পানির বোতল নিয়ে পানি খায়। শেহজাদ ওর অস্থিরতা দেখে মুচকি হেসে কয়েক সেকেন্ড নিরব থেকে বলে,
“যেদিন আমার মেয়ে পৃথিবীতে এলো, সেদিন ক্লাসে সবাইকে নিউজটা দিতেই সবাই চমকে উঠেছিল। মেয়েরা একযোগে আস্ক করে বসে, ‘স্যার আপনি ম্যারিড?’ সেদিনি আমার টিএ অফিস আওয়ারে এসে ব্যাপারটা নিয়ে আমাকে বলছিল। ডিপার্টমেন্টের মেয়েরা নাকি আজ অনেক দুঃখী।”
মীরা বলে,
“আমরা কিন্তু আপনার মেয়ে হওয়াতে অখুশি হয়েছিলাম, তেমনটা না। আসলে আপনাকে দেখে মনে হতো না আপনি ম্যারিড। তাছাড়া ফেসবুকে আপনার রিলেশনশিপটা হাইড করা। নিজেও কখোনো বলেননি। হঠাৎ করে বেবির খবর পেলে শকড তো হবেই।”
“হুম বুঝলাম। বাদ দাও টপিক। সামনে মেবি ছোটো জ্যাম পড়বে। টায়ার্ড হলে ঘুমাতে পারো।”
মীরা চুপ করে সিটে হেলান দিয়ে থাকলো।
_______
রাতের ডিনার করে মীরা, ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে নিজেও ফ্রিশার পাশে ঘুমিয়ে পড়েছে। শেহজাদ রাত সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত বই পড়ে হঠাৎ খেয়াল হলে মীরাকে খুঁজতে ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখে মা-মেয়ে দুজনে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। শেহজাদ হালকা হেসে ভিতরে গিয়ে ফ্রিশার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে আদুরে ঠোঁ*ট ছুঁইয়ে দেয়। অতঃপর মীরাকেও। মীরা খানিক নড়েচড়ে উঠলে দুজনের গায়ে চাদর টেনে দিয়ে লাইট নিভিয়ে শেহজাদ সেখান থেকে বেরিয়ে আসে। নিজের রুমে এসে শেহজাদও লাইট বন্ধ করে শুয়ে পড়ে।
পরদিন সকালে ফজরের আজানের সময় মীরার ঘুম ভাঙলে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে দেখে উঠে বসে। চোখ লেগে যাওয়াতে এখানেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। উঠে আস্তে আস্তে নিজের রুমে গিয়ে দেখে শেহজাদ ঘুমাচ্ছে। মীরা মৃদু স্বরে ডাকে। তারপর দুজনে একসাথে নামাজ পড়ে। মীরা কফি বানিয়ে আনে। মীরা ড্রাইকেক খেতে খেতে বলে,
“রাতে কীভাবে চোখ লেগে গেছে। টেরই পাইনি।”
শেহজাদ মীরার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,
“টায়ার্ড ছিলে। হয় এরকম।”
“হুম। আজ কিন্তু আমার সকালে ক্লাস নেই। আমি পড়ে যাব।”
“আচ্ছা। ড্রাইভার ফ্রিশাকে স্কুলে ড্রপ করে তোমাকে ভার্সিটিতে পৌঁছে দিবে।”
মীরা মাথা নেড়ে কফি শেষ করে দুটো মগ ও বাটি নিয়ে কিচেনে চলে যায়। সবার জন্য নাস্তা বানাবে আজ।
_______
আজও মীরা ফ্রিশাকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সেখানেই ঘুমিয়ে গেছে। শেহজাদ, গতদিনের মতো ফ্রিশাকে দেখতে ও মীরাকে খুঁজতে গিয়ে ওদের গায়ে চাদর টেনে রুমের আলো নিভিয়ে চলে আসতে নিবে তখন দরজায় মিসেস শাহিদাকে দাঁড়ানো দেখে। উনার হাতে পানির বোতল। মিসেস শাহিদা শুধালেন,
“মীরা এখানেই ঘুমিয়ে গেছে? তুললে না ও-কে?”
“থাক। ঘুমাক। আপনিও শুয়ে পড়ুন।”
“হুম। গতকালকেও দেখলাম মীরা এখানে ঘুমাচ্ছে। ভাবলাম ঝামেলা হলো কী-না?”
“না ফুফিজান। ঝামেলা হবে কেন? ও টায়ার্ড তাই ঘুমিয়ে পড়েছে।”
“আচ্ছা। সব ঠিক থাকলেই ভালো।”
মিসেস শাহিদা চলে যান। শেহজাদও নিজের রুমে চলে আসে।
গতদিনের মতো মীরা আজও ভোরে ঘুম থেকে উঠে নিজেকে ফ্রিশার ঘরে আবিষ্কার করে নিজে নিজেই বলতে থাকে,
“আরে আমার এই স্বভাব কি যাবে না! বিছানায় একটু গা এলালেই ঘুমে তলিয়ে যাই! স্যার কী ভাবছেন এখন কে জানে! বাড়ির অন্যকেউ নোটিশ করলে তো ভালো দেখাবে না। নাহ্ কাল থেকে ঘুমানো যাবে না।”
মীরা উঠে নিজের রুমে যায়।
______
নিজের ক্লান্তির ধারাবাহিকতা রেখে মীরা পরদিনও একই কাজ করে! ঘুমিয়ে পড়ে। শেহজাদ আজকেও ফ্রিশার রুমে গিয়ে এই অবস্থা দেখে বিড়বিড় করে বলে,
“এই মেয়ে এতো ঘুমকাতুরে কেন? আজকেও ফুফিজান দেখলে কেমন হবে ব্যাপারটা! নাকি আমিও এখানেই থেকে যাব?
কিছু একটা ভেবে শেহজাদ চট করে মীরাকে পাঁজাকোলা করে তুলে নেয়। ঘুমের মধ্যেই মীরা ধড়ফড়িয়ে উঠে চোখ খুলে নিজেকে শেহজাদের কোলে দেখে ভয়ার্ত স্বরে প্রশ্ন করে,
“কী হয়েছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
মীরার ভয়ার্ত আঁখিযুগল বলছে, আচমকা ঘুম ভেঙে যাওয়াতে মীরা পরিবেশ বুঝতে পারছে না। শেহজাদ নরম স্বরে বলে,
“রিল্যাক্স। তুমি আজও এখানে ঘুমিয়ে পড়েছিলে। প্রথমে ভেবেছিলাম আমিও থেকে যাব এখানে কিন্তু চাই না ফুফিজান আজও দেখুক। আগামীকাল না আমরা তোমাদের বাড়িতে যাব? তাই ভেবেছিলাম, তোমার ঘুম না ভাঙিয়ে নিয়ে যাই।”
মীরা বুকে হাত দিয়ে লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,
“না মানে সরি। আমি আজ ঘুমাব না ঘুমাব না করে আবার ঘুমিয়ে গেছি। আসলে আমি কিন্তু এতো জলদি ঘুমাই না। ফোন কাছে থাকলে তো বারোটারও বেশি বাজে ঘুমাতে। আচ্ছা নামান আমাকে।”
“কেন? একেবারে রুমে নিয়ে নামাই।”
“আমি তো জেগেই গেছি। নামিয়ে দেন।”
শেহজাদ কোনো কথা না বলে নিশ্চুপে মীরাকে কোলে নিয়েই হাঁটতে থাকে। বাহিরে শীতল হাওয়া তবে বৃষ্টি আসার ভাব হলেও হয়তো আসবে না। শেহজাদের নিরবতায় মীরা খানিক কেঁপে ওঠে। ব্যালকনির দরজা দিয়ে আসা ঠান্ডা হাওয়ার পরিবেশটা বেশ আকাঙ্ক্ষিত! প্রণয়ের হাওয়া দুটি হৃদয়ে এসে ভীড়েছে তারই বহিঃপ্রকাশ যে এ!
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৩
বৃহস্পতিবার, ভার্সিটি থেকে ফিরে শেহজাদ ও মীরা, ফ্রিশাকে নিয়ে মীরার বাবার বাড়িতে আসে। পৌঁছানো মাত্রই মীরার পরিবার তখন থেকেই আপ্যায়নে ব্যাস্ত। শেহজাদকে যেন মৌ*মা*ছির মতো ঘিরে ধরেছে। অবশেষে রাতের খাবারের শেষে শেহজাদ জামাই আদর থেকে আজকের মতো ছুটি পেলো। শেহজাদ মীরার রুমে এসে বিছানায় বসে। মীরা এখনও রুমে আসেনি। পাশের রুমে ভাবিদের সাথে গল্প করছে। ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহানদের সাথে খেলছে। ফ্রিশা আজ মৃদুলার সাথেই ঘুমাবে। মৃদুলাও ফ্রিশার মতো আলাদা ঘরে ঘুমায়। কিছুক্ষণ গল্প করার পর মীরার বড়ো ভাবি শারমিন বললেন,
“মীরু, তুমি এবার তোমার ঘরে যাও। ভাইয়া ঘরে একা আছেন। ফ্রিশার চিন্তা করো না। ও মৃদুলার সাথে খেলতে খেলতে ঘুমিয়ে যাবে।”
“যাই ভাবি। ওদের একবার বলে যাই।”
এই বলে মীরা সেখান থেকে ওঠে মৃদুলার ঘরে গেল। তারপর ফ্রিশা ও মৃদুলার উদ্দেশ্যে বলল,
“জলদি ঘুমিয়ে পড়ো। বেশিক্ষণ খেলবে না কিন্তু। যাও শুয়ে পড়ো।”
মৃদুলা আদুরে মুখ করে বলল,
“প্লিজ ফুপি। আরেকটু।”
“না মৃদু। রাত এগারোটা বাজে, বাবু।”
এবার ফ্রিশাও এলো।
“প্লিজ, ফেইরিমাম্মাম। একটু খেলব। ফাইভ মিনিটস।”
“কাল সকালে খেলবে, বাচ্চা। অনেক রাত হয়েছে তো।”
“প্লিজ প্লিজ প্লিজ! ফাইভ মিনিটসই তো।”
মীরা গালে হাত দিয়ে বিছানায় বসে বলে,
“তোমাদের ফাইভ মিনিট ফিফটি মিনিট হতে সময় লাগবে না। খেলো! তারপর যখন মৃদুর আম্মু লা*ঠি নিয়ে আসবে! তখন এমনিই সোজা হয়ে যাবা।”
মৃদুলা ও ফ্রিশা মুখে হাত দিয়ে খিলখিল করে হেসে উঠে। মীরা হতাশ হয়ে সেখান থেকে চলে আসে। মৃদুলা ও ফ্রিশা আবার তাদের ওয়ার্ড গেম খেলতে শুরু করে।
_____
মীরা রুমে এসে দেখে শেহজাদ কপালে ও চোখের উপর হাত দিয়ে শুয়ে আছে। মীরা বসে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“আপনি ঘুমিয়ে গেছেন?”
শেহজাদ চোখের উপর থেকে হাত সরিয়ে লম্বা করে শ্বাস নিয়ে বলে,
“না। এমন অবস্থায় ঘুম আসে!”
ভ্রুকুঞ্চন করে তাকায় মীরা। ফের শুধায়,
“কেমন অবস্থায়?”
“এইযে দেখো! প্রায় গলা পর্যন্ত খাবার উঠে আছে। দুই-তিন দিক থেকে প্লেটে খাবার দিতে থাকলে আমি কী করব বলোতো? তুমি তো একটু বলতে পারতে।”
মীরা ফোন হাতে নিয়ে বলে,
“আমি কী বলব? জামাই আদর করবে না? আপনার জামাই আদরে আমি কথা বললে আমি বুঝি ধ*ম*ক খাব না? সবার সামনে ব*কা খেতে কার ইচ্ছে করে বলুন তো?”
শেহজাদ একটু উঠে বসে চুপ করে থাকে। মীরা ফোন রেখে শেহজাদের মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞাসা করে,
“গ্রিনটি খাবেন? ভালো লাগবে।”
“আনো।”
মীরা উঠে গ্রিনটি বানাতে চলে যায়। অতঃপর পাঁচ মিনিট পর দুইটা মগে গ্রিনটি নিয়ে হাজির হয়। তারপর শেহজাদের দিকে একটা মগ এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন। গ্রিনটি আগে অনেক খেতাম। তারপর কফি খাওয়া শুরু করেছি। তাও মা গ্রিনটি খায় বলে বাড়িতে আনা হয়।”
“থ্যাংকিউ।”
শেহজাদ মগটা নিয়ে এক চুমুক খেয়ে জিজ্ঞাসা করে,
“ফ্রিশা ঘুমিয়েছে?”
“না! পাঁচ মিনিটের নাম করে ওরা পঞ্চাশ মিনিট খেলবে। তারপর বড়ো ভাবি যাবে এরপর সোজা হয়ে ঘুমাবে। আমার দিকে ওরা কিউট কিউট ফেস করে তাকিয়ে সবসময় পার পেয়ে যায়! আমিও মোটেও স্ট্রিক্ট হতে পারি না!”
মীরা মুখ ফুলিয়ে গ্রিনটিতে চুমুক দিচ্ছে। শেহজাদ খানিক হেসে বলে,
“ভাবির থেকে ট্রেনিং নাও।”
“তা লাগবে না। ফ্রিশা এখানেই একটু এমন করবে। বাসায় ফিরলে ঠিক হয়ে যাবে। একদিনই তো।”
“হুম।”
তারপর দুজনেই গ্রিনটি শেষ করলে মীরা মগগুলো রেখে আসে। মীরা বিছানা গুছাতো গুছাতে শেহজাদ রুমের ভিতরে কয়েক চক্কর হেঁটে শুয়ে পড়ে।
______★
দিনকে দিন ওদের সম্পর্কে বন্ধুত্বটা প্রকট হচ্ছে। যদিও ভালোবাসার প্রকাশ এখনও প্রচ্ছন্ন! সময়ের চক্রে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এখন আগষ্ট মাসের শেষোর্ধ। প্রকৃতি শরতের অনন্য রূপে সেজে ওঠছে। নীল অম্বরে পেঁজা তুলোর মতো মেঘমল্লার ভেসে বেড়ায়। কিছু জায়গায় কাশফুলের সমারোহ দেখা যায়। তাই বলে বর্ষার দাপট কিন্তু শেষ হয়নি! খানিক কালোমেঘের রাজত্বও দৃশ্যমান হয় অম্বরপটে। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টিও ঝড়ে। আজ ফ্রিশার ৬তম জন্মদিন। মীরা আজ ভার্সিটি থেকে ছুটি নিয়েছে। সকাল সকাল নাস্তার সাথে সাথে ফ্রিশার জন্য ক্ষীরও বানিয়েছে, যা ফ্রিশার পছন্দের খুব। তারপর শেহজাদ ভার্সিটিতে চলে গেলে, মীরা ফ্রিশাকে নিয়ে ঘুরতে বেরোয়। সাথে মিসেস শাহিদা ও আবিরও আছে। যাচ্ছে জাতীয় শিশুপার্কে। ফ্রিশা খুব এক্সাইটেড। শিশুপার্কে ঘোরাঘুরির পর তাঁরা যাবে চিড়িয়াখানায় ঘুরতে। যদিও খুব বেশি সময় ঘুরবে না। আজ কোনো ছুটির দিন না। তাই দুই স্থানেই ভীড় তুলনামূলক কম হবে। প্রথমেই শিশুপার্কে পৌঁছে ফ্রিশা ছুটে ছুটে বিভিন্ন রাইডে উঠতে যাচ্ছে। মীরা ওর পিছু ছুটছে সাথে ভিডিও করছে। রাতে এসব শেহজাদকে দেখাবে। ফ্রিশার চোখে-মুখে উজ্জ্বলতা ও উৎফুল্লতার হাসি। দুপর হতেই চারজন শিশুপার্ক থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে রওনা করে চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। কিছুটা জ্যাম থাকায় দেড় ঘণ্টার মতো লেগেছে। বিকেল প্রায় তিনটার দিকে চিড়িয়াখানায় পৌঁছে পরিচিত কিছু প*শুর খাঁচা ঘুরে, পা*খিদের দেখতেই দুই ঘণ্টা শেষ। সিং*হের খাঁচার সামনে গিয়ে ফ্রিশা ‘লা*য়*ন! লা*য়*ন’ বলে চিৎকারও করেছে। বেচারি, বা*ঘের দেখা না পাওয়াতে মাঝে বেশ মন খারাপও করেছিল। প*শু-পাখি সব দেখলেও মীরা ইচ্ছে করেই ও-কে সা*প দেখাতে নেয়নি। তার নিজেরই ভয় করে, সেখানে ফ্রিশাকে নিবে! সারাদিন ঘোরাঘুরি করার পর ফ্রিশার মন বেশ আনন্দিত কিন্তু শরীর অবসন্ন। ফেরার পথে গাড়িতেই মীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মীরা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। বাড়ি ফিরতে ফিরতে প্রায় ছয়টা বেজেছে। চিড়িয়াখানা থেকে কাছেই। বাড়ির প্রায় কাছাকাছি আসতেই শেহজাদ মীরাকে কল করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিতেই শেহজাদ সালামের জবাব দিয়ে বলে,
“তোমরা এখন কোথায়?”
“এইতো কাছাকাছি। আপনি কি বেরিয়েছেন?”
“হ্যাঁ আজ একটু জলদি বেরিয়েছিলাম। তাড়াতাড়ি চলে আসব। ফ্রিশার জন্য কিছু নিব বলে শপিংমলে এসেছি।”
“ও আচ্ছা। কী নিবেন?”
“ভাবছি ওর পছন্দের প্রিন্সেস গাউন নিব সাথে একটা ব্ল্যাক-হোয়াইট টেডি। দুই বছর ওর জন্মদিনে কিছু করা হয়নি।”
মীরা ফ্রিশার মুখপানে চেয়ে মুচকি হেসে বলে,
“ফেরার পথে বেকারি শপ থেকে সন্দেশ, ছানা, রসমালাই এসব নিয়ে আসবেন। কেক আমি গিয়ে বানাব। আর হ্যাঁ, আইসক্রিমও।”
শেহজাদ হেসে বলে,
“আচ্ছা আনব। মা-মেয়ে দুজনেই মিষ্টি পা*গ*ল! ফ্রিশা মনে হচ্ছে তোমার সঙ্গদোষে মিষ্টির প্রতি আরও অ্যাডিক্টেড হয়ে গেছে।”
মীরার দৃষ্টি সরু হলো। সে বলল,
“হলে হয়েছে। আপনার সমস্যা কী? আপনাকে আনতে বলেছি আনবেন।”
মীরা খট করে ফোন কেটে দেয়। পাশে বসা মিসেস শাহিদা মুচকি হাসেন। শেহজাদ ফোনের দিকে চেয়ে হেসে স্বগতোক্তি করে,
“পুরো বাচ্চাদের মতো রাগ করে এই মেয়ে! কে বলবে এই মেয়ে ভার্সিটির টিচার আবার ছয় বছরের এক বাচ্চার মা হয়েছে?”
অতঃপর শেহজাদ শপিংমলে ঘুরে প্রিন্সেস ড্রেস পছন্দ করে।
________
রাতে ড্রয়িংরুমে ঘরোয়া পরিবেশে টেবিল সাজানো হয়েছে। মীরার বাবা-মাও এসেছেন। সাথে মৃদুলাও। মীরা ফ্রিজ থেকে একটু আগের বানানো কেকটা বের করে আনলো। তারপর ফ্রিশাকে তৈরি করতে গেলো। শেহজাদের আনা প্রিন্সেস ড্রেস ও মীরার আনা পার্লস ব্রেসলেট ও নেকলেসে ফ্রিশাকে বেশ সুন্দর লাগছে। লালচে-বাদামী চুলে ক্রাউনও পড়েছে সে। মীরা আয়নায় তাকিয়ে বলে,
“হাই প্রিন্সেস।”
“ফেইরিমাম্মাম, অ্যাম অ্যাই লুক লাইক অ্যা বেবি ফেইরি?”
“ইয়েস, বাচ্চা। ইউ আর মাই কিউট বেবি ফেইরি। লেটস গো। এভরিওয়ান ইজ ওয়েটিং।”
ফ্রিশা একহাতে তার ড্রেস উঁচু করে এগিয়ে চলছে। মীরা ওর আরেক হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারপর ড্রয়িংরুমে সবার সাথে কেক কা*টে ফ্রিশা। প্রথম বা*ইট সে তার ফেইরিমাম্মামকে দেয় তারপর তার বাবাকে। এরপর বাকিদেরও কেক খাওয়ায়। ফ্রিশাকে সবাই গিফট দিয়েছে সাথে দোয়া তো আছেই। কেক খাওয়ার পর সবাই এদিকে গল্প করছে, ওদিকে মীরা রান্নাঘর থেকে খাবারগুলো ডাইনিংয়ে এনে রাখছে। মলি জাহান মেয়ের কাছে যান। মাকে দেখে মীরা একটুকরো মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে নিজের কাজ করছে। তিনি মেয়েকে থামিয়ে জিজ্ঞাসা করেন,
“শেহজাদ কি তোকে মন থেকে মানতে পেরেছে?”
মীরা কপাল কুঁচকে জবাব দেয়,
“মেনে নিবে না কেন? কী যে বলোনা তুমি, মা!”
মীরা আবার কাজে হাত দিলে মিসেস মলি জাহান আবারও মেয়েকে থামিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়া করিয়ে বলেন,
“দেখ আমার চিন্তা হয়।”
“উফ মা, সব ঠিকই তো চলছে। আমাদের সম্পর্কে সব স্বাভাবিকই চলছে, যেমনটা অন্যান্য স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কে থাকে। তুমি অযথা চিন্তা করছো। যাও তো। ড্রয়িংরুমে গিয়ে সবার সাথে বসো। আমি বাকিগুলো এনে সবাইকে ডাকছি।”
মিসেস মলি জাহান মেয়ের কথা মেনে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসেন। কিন্তু তার চিন্তা কমে না। কারণ মীরা তার মায়ের সাথে যাই শেয়ার করে সব ফ্রিশাকে নিয়ে। শেহজাদকে নিয়ে যেন বলেই না। তাই উনার মনে ভয় ঢুকেছে।
________
খাওয়া-দাওয়া ও আড্ডার পর্ব শেষে সবাই ঘুমোতে চলে গেছে। শেহজাদ ও মীরা নিজেদের রুমে যেতেই শেহজাদ বলে,
“ওয়েট, তোমার জন্য কিছু এনেছি।”
“কী?”
শেহজাদ প্রত্যুত্তর না করে কাভার্ড থেকে একটা ব্যাগ বের করে মীরার হাতে দেয়। মীরা ব্যাগ থেকে একটা ছোটো বক্স বের করে। যা একটা ঘড়ির বক্স। ডিজিটাল ঘড়ি। মীরা খুশি হয়ে বলে,
“ওয়াও! কখন নিলেন?”
“ফ্রিশার জন্য ড্রেস কেনার সময় ভাবলাম তোমার জন্য কিছু নিব। কী নিব কী নিব ভেবে ঘড়ির কথাই মা*থায় আসলো। শাড়ির কথা ভেবেছিলাম কিন্তু তোমার যদি পছন্দ না হয়? ঘড়ি তো তোমার পছন্দ খুব।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড শেহজাদের চোখের দিকে চেয়ে থেকে বলে,
“আপনি আমার জন্য যা পছন্দ করবেন, তা চোখ বন্ধ করে আমি পছন্দ করে নিব।”
অতঃপর কালক্ষেপণ না করে মুহূর্তের মধ্যে শেহজাদকে জ*ড়িয়ে ধরে। শেহজাদ কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে কথার লুকানো অর্থ বুঝে নিজেও মীরাকে নিজের সাথে আগলে নেয়।
চলবে ইনশাআল্লাহ,