#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩
ব্যালকনির গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে মীরা। আজ আবারও পাত্রপক্ষ তাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। তাতে মীরার দুঃখ নেই। বরং আনন্দ হচ্ছে এরকম মনোভাব পোষণকারী পরিবার থেকে আগেই বেঁচে গেছে। যদি উনারা নিজেদের মনোভাব লুকিয়ে বিয়ে পর্যন্ত চলে যেত তাহলে? কিন্তু মাঝেমাঝে বাবা-মায়ের মুখের দিকে তাকালে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়। নিজের অতীতের জন্য তাদেরকে কষ্ট দিয়ে ফেলল না-তো? দীর্ঘশ্বাস ফেলল মীরা। রাতের আঁধারে তারকাময়ী আকাশটা বড্ড সুন্দর দেখাচ্ছে। তার মাঝে একটা চ্যাপ্টা আকৃতির শুভ্র চন্দ্রমা। একাকি নির্জনে, নীরবে এই সৌন্দর্যের মোহ যেকাউকে মোহিত করবে। আচমকা ফোনের রিংটোনে ঘোর কাটে মীরার। ব্যালকনির দরজার কাছেই বুক সেলফের উপর ফোনটা রাখা ছিল। ফোনটা হাতে নিয়ে দেখে, হোয়াটসএপে তার ইন্ডিয়ার বান্ধবী, রুমমেট ও কলিগ রাইমার কল এসেছে। মীরা ফোন রিসিভ করে ‘হ্যালো’ বলতেই অপরপাশ থেকে ভেসে আসে,
“কবে আসবি ইয়ার? অ্যাই রিয়েলি মিস ইউ।”
“আসব। দুই সপ্তাহের ছুটি তো। আর ছয় দিন বাকি।”
রাইমা উৎসাহী হয়ে জিজ্ঞাসা করল,
“আজ না তোকে পাত্রপক্ষ দেখতে এসেছিল? কী বললো তারা? আশীর্বাদের ডেট ফিক্সড করে গেছে?”
“না। রিজেক্ট করে গেছে।”
রাইমা যেন ভীষণ অবাক হলো। সে বিস্ময়ের কণ্ঠে বলল,
“ওমা! কেন? সেইবারে না হয় বুঝলাম যে ওরা কম বয়সী মেয়ে চেয়েছে। এইবার তো ঘটককে আগে থেকেই বলে রেখেছিল। তাহলে?”
মীরা ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলল,
“আমার খুঁত আছে। আমি ইন্ডিয়াতে জব করি। তাই বলে রিজেক্ট করে গেল।”
রাইমা যেন হঠাৎই উত্তেজিত হয়ে পরল। ফুঁসে উঠে বলে,
“ধুয়ে দিসনি ওদের? সবসময় মেয়েদের চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বভাব হয়ে গেছে। আমার তো মন চায় কানের নিচে একটা দিই। জন্মেছে তো এক নারীর গর্ভে। তাও নারীর চরিত্রের বিচার করে। আবার নিজে নারী হয়েও।”
“থাম তুই। সবে ল্যাব থেকে এসেছিস। রেস্ট কর। বায়।”
রাইমা আরও কিছু বলতে চাইছিল তার আগেই মীরা কল কেটে দিল। রাইমা হতাশ হয়ে বলে,
“ওই স্বরবর্ণ না ব্যঞ্জনবর্ণটাকে হাতের কাছে পাই শুধু! আচ্ছা মত ভ*র্তা করব! হুহ্!”
রাইমা তারপর ফ্রেশ হতে চলে যায়।
মীরা তার মায়ের ঘরে যায়। সেখানে বাবা-মা দুজনেই আছে। মীরা বলে,
“আমি আর পাঁচ দিন পর চলে যাব। তোমরা এর মধ্যে কিছু করতে পারলে করো নয়তো এইবারের ছুটিতে সম্ভব না।”
মীরার বাবা মিস্টার রফিক তালুকদার গম্ভীর স্বরে বলেন,
“তুমি দেশেই জবের খোঁজ করছ না কেন? ইন্ডিয়া অত দূরে যাওয়ার কী দরকার?”
“খুঁজব। ওই বায়োটেক ল্যাবটা ভালো। অভিজ্ঞতা হবে ভালো। সিভিতে ভালো ইম্পেক্ট ফেলবে।”
মেয়ের কথায় মিস্টার রফিক তালুকদার সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। তিনি রুষ্ট স্বরে বললেন,
“আজকেও ওরা ফিরে গেল, ইন্ডিয়ার জবের কারণে।”
বাবার কথাটা শুনে মীরা ভ্রুকুটি করে। সে জবাবে বলে,
“মোটেও না। তাদের প্রবলেম, চাকরি নিয়ে। ওরা আমার চরিত্রে প্রশ্ন তুলেছে। শোনো বাবা, চরিত্র হচ্ছে নিজের কাছে। যে ধরে রাখতে জানে, সে দেশ-বিদেশের যেখানেই থাকুক নিজের চরিত্রের উপর আঁচ আসতে দেয় না। ওদের বিয়ের আগেই এত সন্দেহ তো বিয়ের পর কী করবে?”
মীরার মা মিসেস মলি জাহান, মেয়েকে ইশারায় থামতে বলছেন। মীরা এবার মাকে বলে,
“বারবার এসব ভালো লাগে না। আমি আর পাঁচদিন আছি, তার মধ্যে বিয়ে ঠিক করতে পারলে করো। তারপর আমি চলে যাব। পরেরবার আসলে বিয়ের কাজ। আর আমি দেশেও জবের ট্রাই করব।”
এটুকু বলে মীরা হনহনিয়ে বাবা-মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে নিজের রুমে এসে দরজা দেয়। মীরার বড়ো ভাবি শারমিন, তার শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরের বাহিরেই ছিল। সে ভেতরে গিয়ে বলে,
“মা-বাবা, ওর উপর এত রাগ করবেন না। বিয়ের হুকুম হলে তো বিয়ে হবেই।”
মিসেস মলি জাহান শান্ত স্বরে বললেন,
“জানি মা। কিন্তু মেয়ের বিয়ের আগ পর্যন্ত চিন্তা যে কমে না। তোমারও তো মেয়ে আছে। সেও বড়ো হবে। তখন তোমারও এমনই চিন্তা হবে। দেখা যাক কী হয়।”
শারমিন নীরব সম্মতি দিয়ে চলে আসে। শারমিন তার পাঁচ বছরের মেয়ে মৃদুলাকে পাঠায় তার ফুফির ঘরে পড়তে। মৃদুলাও খুশিমনে পড়তে যায়।
_______
শেহজাদ তার বাড়িতে পা রাখা মাত্রই এক ছোটো পাঁচ বছরের পুতুলের মত লালচে বাদামী চুলের বাচ্চা দৌঁড়ে এসে ‘বাবা’ বলে জড়িয়ে ধরে। শেহজাদও খানিক নিচু হয়ে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“সারাদিন কী কী করলে মাম্মাম? হোমওয়ার্ক কম্পিলিট করেছ?”
বাচ্চা মেয়েটা কপালে হাত দিয়ে বলে,
“উফ বাবা! সবসময় শুধু পড়াশোনা তোমার। আমার হোমওয়ার্ক দেয় অল্প একটু। ওটা আমি স্কুল থেকে ফিরেই দাদুমনির সাথে করে ফেলি।”
মেয়ের কথা শুনে শেহজাদ হাসে। তার সারাদিনকার ক্লান্তি নিমিষেই শেষ।
(এখানে শেহজাদকে ‘তুমি’ সম্বোধনে লিখা ও নামের সাথে কোনো পদবী উল্লেখ না করাতে এভাবে লিখা।)
শেহজাদ বলল,
“এইতো গুড গার্ল। তোমার দাদুমনি কোথায়?”
“দাদুমনি চাচ্চুর ঘরে। চাচ্চুর সেলাইন শেষ। বদলে দিচ্ছে।”
“আচ্ছা তুমি খেল। আমি ফ্রেশ হয়ে আসি।”
শেহজাদ তার মেয়েকে কোল থেকে নামিয়ে ফ্রেশ হতে চলে যায়।
***
রাতের খাবারের সময় শেহজাদ ও তার পরিবারের সবাই একসাথে হয়েছে। রাত দশটা বাজে। শেহজাদের মেয়ে ফ্রিশা আগেই খেয়ে নিয়ে এখন ড্রয়িং করছে। খেতে খেতে শেহজাদের ফুফা ড: আকবর রেহমান বলেন,
“ফ্রিশাকে দেখো শেহজাদ। ওর কথা ভেবে হলেও থেকে যাও। তুমি কি চাও, ও একা একা বড়ো হোক?”
শেহজাদ তাকালো না। এক ধ্যানে খাচ্ছে। ড: আকবর রেহমান নিজের স্ত্রীকে ইশারা করলেন। উনার স্ত্রী শাহিদা রেহমান বলেন,
“এমন জেদ করছ কেন? আমেরিকায় তুমি কাকে পাবে? ভাই-ভাবীও তো জীবিত নেই।”
শেহজাদ এবার খাওয়া থামাল। অতঃপর বলল,
“তাহলে আপনারা জেদ ছেড়ে দিন। আমিও কোথাও যাব না।”
“তুমি চাও না, ফ্রিশা মায়ের আদর পাক?”
ড: আকবর রেহমানের প্রশ্নে শেহজাদ সরাসরি জবাব দেয়,
“না! চাই না। ওর নিজের মা ছাড়া কেউ ওকে মায়ের আদর দিতে পারবে না। তাছাড়া একটা মেয়েকে আমি শুধু ফ্রিশার মা হিসেবে তো আনত পারব না। তাই না? বিয়ে করতে হবে আমার। আমি ফ্রিওনাকে ছাড়া আর কাউকে ভালোবাসতে পারব না।”
মিসেস শাহিদা রেহমান বললেন,
“একা এভাবে কতদিন থাকবে। আমরা চলে গেলে তুমি আর ফ্রিশা একদম একা হয়ে যাবে।”
“আপনারা তাহলে এতদিন কী-সের আশায় ছিলেন? খারাপ লাগলে আগেই সরি। আপনাদের একজনের কিছু হলে অন্যজন কী-ভাবে থাকবেন?”
“কথার জালে জড়িও না শেহজাদ। ফ্রিওনাও কিন্তু মৃত্যুর সময় ফ্রিশার জন্য মায়ের আবদার করে গিয়েছিল। সেই সাথে তোমার জীবনেও একজন ভালোবাসার মানুষের।”
শেহজাদ প্লেটের খাবারের শেষটুকু খেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,
“আপনারা আমায় কথার জালে জড়াচ্ছেন। আমি নিজের জন্য ভালোবাসার মানুষ যদিও খুঁজে পাই কিন্তু কোথাও ফ্রিশার জন্য মা খুঁজে পাব না। বারবার এক কথা বলবেন না। নাহলে কিন্তু আমি বাধ্য হব।”
শেহজাদ উঠে চলে গেলে, ড: আকবর রেহমান ও উনার স্ত্রী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
রিচেক করা হয়নি। ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।