#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৬
দুইদিন পর শেহজাদ কারও কথা তোয়াক্কা না করে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসে। প্রায় তিন বছর পর সে নিজ জন্মভূমিতে যাচ্ছে। শেষবার সে তার মায়ের সাথে বাবার লা*শ নিয়ে বাংলাদেশ গিয়েছিল। আজ একা যাচ্ছে। তাও মনের ভেতর অভিমানের গাড়ো আস্তর নিয়ে। প্লেনে বসে শেহজাদ ভাবছে, সে তো চাইলেই পারতো সব ভুলে ফিওনার সাথে আগের মতো সব ঠিক করে নিতে। কিন্তু করলো না কেন? নিজের উত্তর নিজেই পায় না। শুধু নিজেকে ছোটো মনে হচ্ছে। সে তো হাসিল করায় বিশ্বাসি নয়। সে বিশ্বাস করে ভালোবাসা দিয়ে জয় করা। তবে ফিওনা তাকে হাসিল করতে এতোকিছু কেন করলো? এসব ভাবতে ভাবতে নিজের উপর তার রাগ হচ্ছে। অতঃপর মনকে শান্ত রাখতে প্লেনের লম্বা জার্নিতে ঘুমানোটাই উত্তম মনে করলো।
এদিকে ফিওনা এয়ারপোর্টের ফ্লোরে বসে নিজের দাদি ও শেহজাদের মাকে জড়িয়ে কাঁদছে। সে তো খুব ভালোবাসে। যেভাবেই হোক, সে চেয়েছিল নিজের ভালোবাসা নিজের হয়ে থাকুক। ভালোবাসাতে নাকি সবকিছু জায়েজ? তবে সে তো শুধু তিনটা সত্য আড়াল করেছিল!
কিছু সময় পর ফিওনা কিছুটা শান্ত হলে শেহজাদের মা আদুরে কণ্ঠে বলেন,
“ডোন্ট ওয়ারি। হি উইল বি ব্যাক। হি জাস্ট অ্যা লিটল বিট এংরি। এভরিথিং উইল বি ফাইন।”
ফিওনা জবাবে কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর শেহজাদের মা ও ফিওনার দাদি, ফিওনাকে এয়ারপোর্ট থেকে বাড়িতে নিয়ে আসে।
_____
বাংলাদেশে এসেই শেহজাদ ভার্সিটিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর হিসেবে জয়েন করে। সেমিস্টার ব্রেক শেষ হতেই সেও নতুন কর্মক্ষেত্রে মানিয়ে নিতে থাকে। ড: আকবর রেহমান ও মিসেস শাহিদা এতে বেশ খুশি। উনারা এখনও শেহজাদের এখানে আসার পেছনের কারণ সম্পর্কে অবগত নয়। দেখতে দেখতে এক মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ একদিন একটা খবর পায়। খবরটা এতোটাই ভ*য়ংক*র সুন্দর ছিল যে শেহজাদ ভার্সিটিতে নিজের ডেস্কেই বিস্মিত হয়ে বসে রয়। সে বাবা হচ্ছে। ফিওনা তিন মাসের প্রেগন্যান্ট। এই খবরটা তার মা, তাকে দিয়েছে। খবরটা শুনে শেহজাদ নিজের অনুভূতি ঠিক বুঝতে পারলো না। কিন্তু তার খুব সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। এক নিমিষেই সব ভুলে হোয়াটসএপে ফিওনাকে কল লাগায়। ফিওনাও যেন এটারই অপেক্ষা করছিল। সঙ্গে সঙ্গে ফোন রিসিভ করে নিরব থাকে। অপরদিকে শেহজাদ চুপ। দুই পাশে পিনঃপতন নিরবতা বিরাজ করছে। দুজনেই চাইছে, অপরপক্ষ আগে কিছু বলুক। কিন্তু কিছু সময় পর ফিওনা আর শান্ত থাকতে পারলো না। সে শব্দ করে কেঁদে উঠলো। শেহজাদ ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে শীতল কণ্ঠে শুধালো,
“হোয়াই আর ইউ ক্রায়িং?”
কান্নারত স্বরে ফিওনা জবাব দিলো,
“ডোন্ট ইউ নো?”
“আই নো।”
“দেন, হোয়াই ডু ইউ স্টে সাইলেন্ট?”
ফিওনার কণ্ঠে অভিযোগ ও অভিমানের ভীড়। শেহজাদ হালকা হেসে বলল,
“ডাক্তার কী বলল? ফার্স্ট টাইম মি*সক্যা*রেজের জন্য কোনো হেলথ ইস্যু?”
ফিওনা আবারও একই ভুল করলো। সে এবারও রি*স্কের কথা আড়াল করে গেল । যদিও রি-স্ক সামান্য। ভেবেছে ডাক্তারের বলা মতো চললে সেটা ঠিক হয়ে যাবে। শেহজাদ বলেছে, সে প্রায় সাড়ে তিন পর ফিরে আসবে। এই সেমিস্টারটার সবে দেড় সপ্তাহ হয়েছে। ফিওনা তাতে ভিষণ খুশি।
সময়ের চক্রে সাড়ে তিন মাস সময়টাও পেরিয়ে গেল। আর মাত্র কিছু দিন পর ফিওনার প্রেগন্যান্সি সাত মাসে পড়বে। সে ইতোমধ্যে জেনে গেছে, তার মায়ের রোগটা সে পেয়েছে! তবে সেটা অতোটা ক্ষতিকর পর্যায়ে নেই। তার জড়ায়ুতে ছোটো একটা টি*উমা*র হয়েছে। ডাক্তার বলেছে, বাচ্চা জন্মের সময় টি*উ*মারও অপসারণ করা হবে। এখন সে কোনোভাবেই চায় না শেহজাদ আমেরিকায় আসুক এবং বিষয়টা জানুক। সে শেহজাদকে আসতে নিষেধও করে কিন্তু শেহজাদ চায় এই সময়ে তার স্ত্রীর পাশে কিছুটা সময় হলেও থাকতে। তাই সে আসে।
শেহজাদ আমেরিকায় আসার পর যে কয়টাদিন শেহজাদ আমেরিকায় ছিল, ততোদিন ফিওনা খুব কৌশলে জড়ায়ুর টি*উ*মা*রের ব্যাপারটা লুকিয়ে গেছে। শেহজাদের মাও এই সম্পর্কে অবগত নন। এদিকে ফিওনার দাদি অনেক অসুস্থ। তার জন্য আলাদা নার্স রাখা হয়েছে। ফিওনা ও শেহজাদের মা চায়, বাচ্চা জন্মের পর ওরা বাংলাদেশে যাবে। শেহজাদ যতদিন আমেরিকায় ছিল ততোদিন ফিওনার সবরকম যত্ন সে করেছে। ফিওনা কোনো না কোনো ভাবে শেহজাদকে ব্যস্ত রেখেছে যাতে শেহজাদ খোঁজ না করতে পারে। এতে ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড ফিওনাকে সাপোর্ট করেছে! শেহজাদও সন্দেহ করেনি কারণ সে ভেবেছিল, ফিওনা নিজের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত। তারপরও নিশ্চয়ই একই ভুল সে করবে না।
খুব দ্রুতই শেহজাদের দেশে ফেরার সময় এগিয়ে এসেছে। নির্দিষ্ট সময় পর শেহজাদ দেশে ফিরেও এলো। তারপর সব তার নিজ নিজ গতিতে চলতে লাগলো। শেহজাদ ফিরে আসার এক মাস পর হঠাৎ গভীর রাতে শেহজাদের হোয়াটসএপে কল এলো। বলা বাহুল্য যে, শেহজাদ ওই সময়টাতে সবসময় ফোনের ডাটা অন করে রাখতো। কারণ প্রেগন্যান্সির শেষ তিন মাস ও প্রথম তিন মাস খুব ক্রুশিয়াল। খুব সাবধানে থাকতে হয়। শেহজাদ আমেরিকায় তার পরিচিত, নিকটস্থ এক ড্রাইভারকে আগে থেকে বলে রেখেছে যাতে যেকোনো সময় দরকারে তাকে পাওয়া যায়।
হঠাৎ ফোনের রিংটোনে শেহজাদের ঘুম ছুটে যায়। তার মস্তিষ্কে আগে থেকে সেট করা মাঝরাতের সতর্কতায় দ্রুত ফোন রিসিভ করে। ফোনের অপরপাশ থেকে শুনতে পায়, ফিওনার ডেলিভারি পেইন ওঠেছে। কথাটা শোনামাত্র শেহজাদের শ*রীরে যেন হিমশীতল হাওয়া বয়ে গেল। সে কিয়ৎক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পায়। তদ্রূপ আর সময় ব্যয় না করে আমেরিকার পরিচিত ড্রাইভারকে ফোন করে ফিওনাকে হসপিটালে নিয়ে যেতে বলে। এতোকিছুর মধ্যে শেহজাদ এক মূহুর্তও শান্তি পাচ্ছে না। অস্থিরতার পারদ যেন তার মাত্রা অতিক্রম করে ফেলছে! সে গিয়ে তার ফুফা ও ফুফিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে খবরটা জানায়। মিসেস শাহিদা, শেহজাদকে ধৈর্য ধরতে ও দোয়া করতে বলেন। ফজরের আজান হতে এখনও ঘণ্টাখানেক বাকি।
ফজরের পর ধরণীতে ভোরের শুভ্র আলো ফুটতেই শেহজাদের কাছে সুসংবাদ আসে। সে কন্যাসন্তানের পিতা হয়েছে। সি*জা*রের মাধ্যমে ফিওনা সুস্থ ভাবে কন্যাসন্তানের জন্ম দিয়েছে। প্রথম বাবা হওয়ার সংবাদে শেহজাদ নিজের খুশি, আনন্দ মুখে বা অভিব্যক্তিতে ব্যক্ত করতে পারছে না। নিজের কাছে নিজেকে সবচেয়ে সুখী মানুষ বলে গণ্য হচ্ছে তার।
ড: আকবর রেহমান খুশিতে আমেরিকার ফ্লাইটের চারটা টিকেট কে*টে ফেলেছে। তার নাতনী হয়েছে বলে কথা! আজ রাতেই তারা রওনা হবে।
_____
আমেরিকায় পৌঁছে প্রথমবারের মতো নিজের মেয়েকে কোলে নিয়ে শেহজাদ যেন চোখের পলক ফেলতেই ভুলে গেছে। মেয়েকে কোলে নিয়ে সে সময়জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে অবস্থা। বিষয়টা শেহজাদের মা, ফুফা-ফুফি ও ফিওনার বেস্টফ্রেন্ড মারিয়া দেখে মিটিমিটি হাসে। অতঃপর শেহজাদের মা এগিয়ে গিয়ে নিজের ছেলের কাঁধে হাত রেখে বলেন,
“এবার আমাদের নাতনীকে আমাদেরও একটু দাও। তুমি একটু ফিওনার সাথেও বসে কথা বলো। আসার পর একটু ‘এখন কেমন আছ?’ এটুকুতে কথা সেড়ে মেয়েকে নিয়ে পড়েছ। যাও এবার।”
এদিকে ফিওনা তার বেস্টফ্রেন্ডের হাজবেন্ড পিটারকে বলছে,
“শেহজাদ শুড নট নো দিস। বি কেয়ারফুল।”
“ইয়াহ। ডোন্ট ওয়ারি এবাউট দিস। এভরিথিং ইজ ফাইন। এন্ড ইউ আর ফাইন।”
শেহজাদ ফিওনার কাছে এসে পিটার বলা কথাটা শুনে হাস্যজ্জ্বল মুখে শুধায়,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”
ফিওনা ও পিটার দুজনেই ভড়কে যায়। পিটার কী বলবে ভাবতে ভাবতেই ফিওনা জবাব দেয়,
“একচুয়ালি, টুডে দে আর গোয়িং টু ডিসচার্জ মি। সো…”
“ওহ। ওকে। থ্যাংকস পিটার। ইউ হেল্পড আস সো মাচ।”
পিটার মৃদু হেসে বিদায় জানিয়ে চলে যায়। শেহজাদও ফিওনার পাশে বসে।
______
আমেরিকায় নিজের স্ত্রী, নবজা*তক কন্যা ফ্রিশার সাথে দুইদিন থেকে শেহজাদকে ফিরে আসতে হয়। আস্তে আস্তে সময় পেরোয়। ফ্রিশাও বড়ো হতে থাকে। কয়েক মাস পর ফিওনার দাদির মৃ*ত্যু হলে, শেহজাদ সবাইকে বাংলাদেশে আনার ব্যবস্থা করে। বাংলাদেশে এসে ফ্রিশাও একটু একটু করে বড়ো হতে থাকে। দেখতে দেখতে ফ্রিশার দুই বছর পেরোলে শেহজাদের মাও না ফেরার দেশে চলে যান। শেহজাদের বাবার পাশেই শেহজাদের মাকে শায়িত করা হয়।
সুখ-দুঃখ সবমিলিয়ে যেমন জীবন, তেমনি সময়ে সাথে সবকিছুকে স্বাভাবিকে আসতে হয়। ফ্রিশার তিন বছর বয়সে ফিওনা আবার প্রেগন্যান্ট হয়। এবারও আগের মতোই সমস্যা তবে আরও গুরুতর। প্রেগন্যান্সির তিন মাসেই টি*উ*মার অনেকটা বড়ো হয়ে গেছে। এবার শেহজাদ সবটা জানতে পারে। সে সত্যি ভাবতে পারেনি, ফিওনা তার থেকে এতবড়ো ঘটনা আড়াল করে যাবে। সবাই মিলে ফিওনাকে এ*বরশ*নের কথা বললেও ফিওনা নারাজ। কেন যেন তার মনে হচ্ছিল, এবার শেহজাদ তাকে মাফ করবে না। তাই এব*রশ-ন সে করতে চায় না। তারপর সাত মাসে পড়ার আগেই প্রচণ্ড পেটে ব্যাথা নিয়ে হসপিটালে ভর্তি হলে, ওটাই ছিল ফিওনার শেষ সময়।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড,,
শেহজাদ অতীতের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে চশমা খুলে টেবিলে রাখলো। রাত এখন অনেক গভীর। রুমের দিকে উঁকি দিয়ে বুঝলো মীরা এতক্ষণে গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন। সে নিজে নিজে স্বগোতক্তি করে বলে,
“আমি চাইনি ফিওনার জন্য তোমার মনে কোনোরকম নেগেটিভ কিছু আসুক, মীরা। চাইলেই সবটা বলতে পারতাম। কিন্তু কী হতো? ফিওনা তো কখোনো তোমার লাইফ কম্পলিকেটেড করতে ফিরবেও না। তাহলে কেন আমি তোমার মনে থাকা ওর জন্য সম্মানটা নষ্ট করব? তুমি আর ফিওনা দুজনেই নিজেদের আলাদা আলাদা সময়ে আমার জীবনে এসেছ। কারও টাইমের সাথে কারওটায় মিল নেই। আমি চাই না তুমি ফিওনাকে খারাপ ভাবো। সে যা করেছে আমায় ভালোবেসে করেছে। যদিও সেসবকে আমি সাপোর্ট করি না। এটা তো সত্যি, ও আমাকে ওর নিজের চাইতেও বেশি ভালোবেসেছে। আমি সত্যি ফরচুনেট পার্সন। বাট অলসো আনফরচুনেট। এতো ভালোবাসা পেয়েও ভালোবাসার মানুষটাকে প্রকৃতির কঠোর সত্যতে হারিয়ে ফেলেছি।”
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে শেহজাদ উঠে দাঁড়ালো। শব্দহীন পায়ে রুমে প্রবেশ করে বিছানার ফাঁকা স্থানে শুয়ে পড়লো।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
লেখা এলোমেলো আমিও বুঝতে পারছি। অতীতটা যতো সংক্ষিপ্তে শেষ করা যায় করেছি।
আগামী পর্ব বুধবার আসবে এবং অতীত আজকেই শেষ। আমি গতকালই পর্ব দিতাম। অনেকটা লেখা ছিল। ফের রেস্ট নিতে গিয়ে ঘুমিয়ে গেছি।
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।
#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৭
পরদিন খুব ভোরে ঘুম ভাঙলো মীরার। ভোরের আবছা আলোয় রাতের অন্ধকার এখনও পুরোপুরি দূর হয়নি। জানালা দরজা লাগানো ও পর্দা দেওয়া থাকায় অন্ধকারে থৈ থৈ। শুধু দেয়ালে ডিজিটাল ঘড়িটায় সংখ্যা জানান দিচ্ছে এখন সময় ৪টা বেজে ১৪ মিনিট। ফজরের আজান পড়ে গেছে। মীরা বেড সাইড টেবিলের ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে বিছানার সাথে হেলান দিয়ে বসে শেহজাদের দিকে তাকালো। শেহজাদকে দেখে মনে হচ্ছে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন। মীরা মনে মনে ভীষণ প্রফুল্ল হলো। সে মৃদু স্বরে শেহজাদকে ডাকলো। প্রথমবার ডাকে উঠলো না। বারকয়েক ডাকতে শেহজাদের ঘুম হালকা হয়ে এলো। শেহজাদ পিটপিট করে চোখ মেলে কুঁচকানো ভ্রু নিয়ে বলল,
“সকাল হয়ে গেছে?”
“হ্যাঁ তো। আজ আপনার আগে আমার ঘুম ভাঙলো। গতকাল আপনাকে বলেছিলাম, আমাকে ভোরে ডেকে দিবেন, কিন্তু দেখুন। আমিই আপনাকে ডাকলাম।”
শেহজাদ ঈষৎ তন্দ্রাভাব নিয়েই হালকা হাসলো। তারপর বলল,
“যাও নামাজের জন্য প্রস্তুত হয়ে এসো।”
মীরাও বিনিময়ে মুচকি হেসে ওযু করতে যায়।
নামাজ শেষে মীরা জিজ্ঞেসা করে,
“আপনার কি কালকেই ছুটি শেষ?”
“হ্যাঁ।”
“আমার তো পরশু পর্যন্ত ছুটি। ভেবেছিলাম আব্বু-আম্মুর কাছে আমি, আপনি, ফ্রিশা একদিন থেকে আসব। আজকে তো উনারা আসবেন। ওইযে বিয়ের পরদিন বা দুইদিন পর যায় যে।”
মীরার চোখে-মুখে বিষণ্ণতার মেঘ এসে ভিড়েছে। শেহজাদ নরম কণ্ঠে বলল,
“বৃহস্পতিবার যাব। তুমি নিজেও তো ক্লাস মিস দেওয়ার সাইড এফেক্ট বুঝো।”
মীরা ভেবে দেখলো। অতঃপর বলল,
“হুম। আচ্ছা। বৃহস্পতিবার যাব। এখন ফ্রিশার ঘরে গিয়ে দেখি?”
উঠতে উঠতে শেষোক্ত কথা বলতেই শেহজাদ বলল,
“ও-কে ৬টার দিকে ডেকো। সবে তো ৫টা বাজে। এক কাজ করো, আমার জন্য ব্ল্যাক কফি বানিয়ে নিয়ে এসো আর যদি তুমিও ব্ল্যাক কফি পছন্দ করো তবে তোমার জন্যও। বানাতে পারবে?”
মীরার মুখশ্রীতে প্রথমে হাসির রেখা ফুটলেও শেহজাদের শেষোক্ত কথায় চোখ ছোটো ছোটো করে প্রত্যুত্তর করলো,
“আপনার কী মনে হয়? আমি অক*র্মা! সামান্য কফিও বানাতে পারি না?”
“আই ডিডেন্ট মিন দ্যাট। একচুয়ালি সবাই কফি সুন্দর করে বানাতে পারে না। মাঝখানে বাড়িতে একজন এক্সট্রা মেইড রেখেছিল, সে কফির স্বাদকে বিস্বাদ করে ফেলতো।”
শেহজাদের সেল্ফ এক্সপ্লেনেশন শুনে মীরা মুখ বাঁকিয়ে বলল,
“আচ্ছা বুঝেছি। যদিও আমি ব্ল্যাক কফি তেমন একটা পছন্দ করি না। কিন্তু বানাতে পারি। প্রচণ্ড মা*থাব্যথা হলে তখন ব্ল্যাক কফি মাঝেমধ্যে খাই।”
“আচ্ছা। বানিয়ে নিয়ে আসো তবে।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে শেহজাদের কোনো প্রতিক্রিয়া না দেখে কফি বানাতে চলে যায়। মীরা যেতেই শেহজাদ নিজের চেপে রাখা হাসি এবার মুক্ত করে। নিঃশব্দে হেসে বুকশেলফের কাছে যায়।
_______
দুপুরের আগে মীরার পরিবার, রাইমা ও কুঞ্জ মীরার শ্বশুরবাড়িতে আসে। মিসেস শাহিদা ও মীরা মিলে সার্ভেন্টের সাহায্যে আপ্যায়নের সব ব্যাবস্থা করে ফেলেছে। প্রথমেই মীরা সবার জন্য আপেলের ঠান্ডা ঠান্ডা শরবত পরিবেশন করে। তারপর একে একে হালকা কিছু নাস্তা। রাইমা মীরার ব্যস্ততায় দেখে মীরাকে টেনে এক জায়গায় এনে অভিমানী স্বরে বলে,
“তুই আমার সাথে কথাই বলছিস না। কাজেই লেগে আছিস!”
রাইমার অভিমানী মুখ। মীরা ওর গা*ল টেনে দিয়ে হেসে বলে,
“বল বল। তোরা সবাই মাত্র এলি। তাই ভাবলাম রেস্ট নে তারপর কথা বলব।”
“রেস্ট নেওয়া লাগবে না। সময় নেই। আজ সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এখান থেকে সরাসরি আমি আর কুঞ্জ এয়ারপোর্টে যাব।”
“কী বলিস! আজকেই?”
“হ্যাঁ রে। তোর বিয়ের জন্য তিন দিন প্লাস রবিবার তো ছুটিই। কালকে মাস্ট জয়েন করতে হবে।”
মীরা মন খারাপ করে বলে,
“আবার কবে দেখা হবে! বিয়ের ব্যস্ততায় তোর সাথে ঠিকমতো কথাই হলো না।”
“পরেরবার আবার আমার বিয়েতে দেখা হবে। বুঝলি। তাছাড়া ভিডিওকল তো করবই। তুই নিজেই কিন্তু এগুলো আমাকে বলে এসেছিলি।”
মীরা ও রাইমা দুজনেই মন খারাপের রেশে নিরব হাসে। মীরা বলে,
“তোর যা মন! বিয়ে যে কবে করবি তার ঠিক নেই। বেচারা কুঞ্জদা….”
রাইমা জলদি করে মীরাকে থামিয়ে বলে,
“৩১ ডিসেম্বর আমার বিয়ে। এবার ফিক্সড। তোর জন্য তো আলাদা করে স্পেশাল কার্ডও বানিয়ে এনেছি। ওয়েট, নিয়ে আসছি।”
মীরাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রাইমা ছুট লাগায়। রাইমা যাওয়ার কয়েক সেকেন্ড পর শেহজাদ কোলে করে সিয়ামকে এনে বলে,
“ফ্রিশা, মৃদুলা ও নিহান ও-কে এতোবার বলল খেলতে। কিন্তু সে আমাকে ডেকে ইশারায় তোমাকে দেখাচ্ছে। তোমার কাছে আসবে। নাও তোমার ভাতিজাকে।”
মীরা আদুরে মুখ করে সিয়ামকে কোলে নিতেই সিয়াম হাতে তালি দেয়। মীরা ও শেহজাদ হালকা শব্দ করে হেসে ওঠে। তখনি রাইমা, কুঞ্জকে নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে এসে বলে,
“এই যে আমাদের বিয়ের কার্ড। আর তোর বিয়ের গিফট। আমার বিয়েতে তোকে, জিজুকে ও ফ্রিশুমনিকে এটাই পড়তে হবে কিন্তু!”
মীরা সন্দিহান হয়ে গিফট বক্সটা দেখে তা ধরে শুধায়,
“কী আছে এতে?”
“আছে কিছু। আগে কার্ডটা দেখ তারপর তোর ঘরে গিয়ে আরাম করে ওটা খুলবি।”
মীরা, শেহজাদের হাতে মাঝারি বড়ো আকৃতির গিফট বক্সটা কোনোরকমে দিয়ে বিয়ের কার্ডটা খুলে। সত্যি সত্যি রাইমা ও কুঞ্জর বিয়ে। মীরা রাইমাকে জড়িয়ে ধরে শুভ কামনা জানিয়ে গিফ্টবক্স সহ ওদেরকে নিয়ে নিজেদের রুমে যায়। অতঃপর সুন্দর করে আনবক্স করে দেখে তার মধ্যে একটা ডার্ক এ্যাশ রঙের পাজামা-পাঞ্জাবি, ডার্ক এ্যাশ রঙের লতানো ডিজাইনের বোনারসি ও ফ্রিশার জন্য একটা এ্যাশ রঙের নেটের উপর ডিজাইনার লেহেঙ্গা। মীরা উপহার গুলো দেখে একদম হা হয়ে গেলো। সে অবাক কণ্ঠে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“এতোকিছু তোকে কে করতে বলেছে? হ্যাঁ!”
রাইমা ভাব নিয়ে বলে,
“আগে বল, পছন্দ হয়েছে? অবশ্য আমার চয়েজ বলে কথা!”
“তোর পছন্দ করা কিছু আমার পছন্দ হবে না? অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু এতোকিছু কেন করতে গেলি!”
শেহজাদও তাল মেলায়,
“ইয়াহ, রাইমা। এসবের দরকার ছিলো না। তুমি ইন্ডিয়া থেকে নিজের বেস্টফ্রেন্ডের জন্য এসেছ।”
রাইমা বলে,
“আপনার বউকে দেখবেন, কী করে! আমার বিয়েতে নাকি সে বিয়ের শাড়ি দিবে! আমি ও-কে অনেক কষ্টে বুঝিয়েছি। বিয়ের শাড়ি আমি আমার মায়ের পছন্দে নিব। মা আমার জন্মের পর থেকে কোনো শাড়ি দোকানে গেলেই আমার জন্য বিয়ের শাড়ি দেখে। তাতে আপনার বউ মেনেছে। এখন সে কী করে, তাতো আমি জানিনা। তবে আমি কেন পিছিয়ে থাাকব? হুহ্!”
মীরা ও-কে চি*ম–টি কে**টে বলে,
“হয়েছে। চুপ কর। তোর বিয়েতে আমিও আমার পছন্দের কিছু দিব। তবে তোর গিফটা খুব কিউটরে। থ্যাংকিউ ইয়ার।”
মীরা, রাইমাকে জড়িয়ে ধরলে। রাইমা বলে ওঠে,
“দূরে যা এবার। তোর বরের অধিকার আমি নষ্ট করলে জিজু পরে আমার উপর রাগ করবে। তুই দূরত্ব বজায় রাখ।”
রাইমার কথা শুনে শেহজাদ থতমত খেয়ে কিছু একটা বাহানা করে সিয়ামকে নিয়ে সেখান থেকে সটকে পড়ে। তা দেখে রাইমা শব্দ করে হাসলে মীরা কপট রাগ দেখিয়ে ও-কে দু ঘা লা*গিয়ে দেয়। কুঞ্জও রাইমাকে ইশারায় থামতে বলে।
______
দুপুরের খাওয়া-দাওয়া শেষে সবাই ফ্যামিলি আড্ডায় বসেছে। কথায় কথায় শারমিন, নিধি ও রাইমা মিলে মীরাকে গা*ন গাইতে বলে। মীরা বারবার নাকচ করলে শেহজাদ যখন বলে,
“সবাই বলছে যখন গাও।”
মীরার মনে শিতল হাওয়া বয়ে যায়। যা তার লোমকূপ পর্যন্ত বইয়ে গেছে। লাজুক হেসে মীরা গা*ন ধরে….
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।