মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২৩+২৪

0
617

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৩
কফির মগ হাতে রুমের আলো নিভিয়ে শেহজাদ ও মীরা ব্যালকনিতে যায়। গ্রিলহীন খোলা ব্যালকনিতে মুখোমুখি চেয়ার পাতা, মধ্যিখানে ছোট্ট একটা টেবিল। চারপাশে সব অন্ধকারে আবৃত। কেবল মাথার উপর বিস্তৃত অম্বরে লাখো তারকারাজির মাঝে এক অর্ধচন্দ্রমার রাজত্ব চলছে। যার স্নিগ্ধ আলোকরশ্মি জোৎস্না স্বরূপ পৃথিবীর ঘন অন্ধকারকে দূর করার আপ্রাণ প্রয়াস করে চলেছে। মীরা চাঁদের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে,

“বলুন এবার।”

শেহজাদ কফির মগে এক চুমুক দিয়ে বলে,
“আমার তো মনে হচ্ছে, আমার স্টোরি শোনার জন্য তুমি অনেকদিন ওয়েট করে ছিলে!”

মীরা ফিক করে হেসে ফেলে বলে,
“আপনার ও ফিওনা আপুর লাভ স্টোরি জানার জন্য পুরো ডিপার্টমেন্ট উৎসুক ছিল। পুরো ডিপার্টমেন্টের মধ্যে মেয়েরাই বেশি। ”

শেহজাদও হালকা হাসে। ফের বলে,
“কিন্তু এটা তো লাভ স্টোরি না!”

“মানে? লাভ স্টোরি না হলে একটা মেয়ে নিজের সব ছেড়ে আপনার কাছে চলে এসেছে?”

মীরার কণ্ঠে বিস্ময়। শেহজাদ লম্বা নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করে,
“আমি তাকে ভালো বাসতাম না কিন্তু সে ভালোবাসতো। ফিওনা ছিল আমার ইউনিভার্সিটির প্রফেসরের মেয়ে এন্ড ভার্সিটিতে ওয়ান ইয়ার সিনিয়র। আমার এইচএসসির পর বাবা-মা ও আমি আমেরিকা শিফট হই। সেখানেই ভার্সিটিতে ভর্তি হই। আমেরিকায় শিফট হওয়ার পর আমরা যেই বাড়িটিতে উঠেছিলাম, সেটার একটা বাড়ি পরেই ছিল প্রফেসর হ্যারিসনের বাড়ি। ফিওনার বাবা তিনি। প্রফেসর হ্যারিসন তার মা ও মেয়ের সাথে সেখানে থাকতেন। ফিওনার মা ওর জন্মের সময় মা**রা যান। তারপর স্যার আর বিয়ে করেননি। তিনি নিজের কাজ, রিসার্চ, পাবলিকেশন এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। আমার ইউনিভার্সিটিতে এডমিশনের জন্য বাবাকে তিনি অনেক হেল্প করেছিলেন। সেই সুবাদে আমাদের দুই পরিবারে একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। ইউনিভার্সিটিতে ফিওনা আমার সাথে খুব মিশতে চাইতো। অফডে বা ফ্রি টাইমে আমাদের বাড়িতেও চলে আসতো। আমার সাথে গল্প করতে চাইতো। আমি এসব নিয়ে ভাবতাম না। আমি নিজের পড়াশোনাতেই মনোযোগ দিতাম। এভাবেই তিন বছর পেরিয়ে যায়। তখন ফিওনার গ্রাজুয়েশন কম্পিলিট। একদিন ফিওনা আমাকে কল করে বলে ব্রেক টাইমে ভার্সিটির এক জায়গায় দেখা করতে। আমি প্রথমে ভেবেছিলাম যাব না। তাই ব্রেক টাইমে যাইনি। তারপর ছুটির পর কী ভেবে ওইদিক দিয়ে বাড়িতে যাওয়ার ওয়েটা ইউজ করেছিলাম। ওটা একটু লম্বা পথ। সচরাচর সেখান দিয়ে যেতাম না। সেখানে গিয়ে দেখলাম, ফিওনা একা সেখানে বসে ছিল। তখন উইন্টার সিজন। বিকেলবেলা, সন্ধ্যা নামবে নামবে ভাব। হিম শিতল বাতাসে শুষ্ক পাতার ধ্বনি জনমানবহীন পরিবেশটা কেমন অদ্ভুত! ফিওনা ছাড়া আশেপাশে কেউ নেই। ফিওনাকে একা বসে থাকতে দেখে আমি এগিয়ে গিয়েছিলাম। ওর পাশে যথেষ্ঠ দূরত্ব রেখে বসেছিলাম। আমি বসা মাত্রই ও আধো বাংলায় বলে উঠেছিল,
‘খুব লেট করে ফেলেছ, শেহজাদ!’
ওর মুখে প্রথমবার নিজের মার্তৃভাষা শুনে আমি অবাক হয়ে তার দিকেই চেয়ে ছিলাম। তারপর ও ফিরলো আমার দিকে। হঠাৎ আমার হাত ধরে হাসি মুখে বলেছিল,
‘আই রিয়েলাইজ আই অ্যাম নট ইম্পরট্যান্ট ফর ইউ। নেক্সট উইক ইউ আর ইনভাইটেড।’
ওর কথা ও মুখের হাসির সাথে চোখের ভাষার মিল ছিল না। আমি কারণ জিজ্ঞাসা করলে বলে, নেক্সট উইক নাকি ওর বিয়ে। কথাটা বলে ও দেরি করে না। সাথে সাথে উঠে চলে যায়। একবারও পেছনে ফেরেনি।”

থামে শেহজাদ। মীরা হা করে বোকার মতো চেয়ে আছে। আলোক স্বল্পতার কারণে এটা শেহজাদের দৃষ্টিগোচর হয় না। শেহজাদ এবার কফির মগে শেষ চুমুক দিয়ে নিরব হয়ে রয়। মীরা উৎকণ্ঠিত হয়ে শুধায়,
“তারপর কী হয়েছিল, স্যার?”

“তারপর আর কি! ফিওনার বিয়ে!”

“বিয়ে? আপনার সাথে?”

“না।”

“এ্যাঁ! তাহলে কার সাথে? কী বলতেছেন আপনি? ফিওনা আপুর সাথে আপনার বিয়ে হয়নি?”

শেহজাদ হাত থেকে কফির মগ রেখে চেয়ারে কম্ফোর্টেবল ভাবে বসে আবার বলতে শুরু করে,
“আমি সেদিন বাড়ি ফিরে ফিওনার সেদিনকার বিহেভিয়ার গুলো ভাবছিলাম। সকালে ফোনে তার কণ্ঠে একটা এক্সসাইটমেন্ট, ভয় ছিল যা বিকেলে ছিল না। কিন্তু এসব ভাবনা-চিন্তা আমার বেশি লং টাইমের জন্য হয়নি। কারণ আমার মনে ওর জন্য কোনো ফিলিংস ছিল না। আমার দিন আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতোই চলছিল। দুইদিন পর প্রফেসর হ্যারিসন ইনভাইটেশন কার্ড নিয়ে আমাদের বাড়িতে আসেন। সেদিন উইকেন্ড ছিল। ফিওনা তার এক ক্লাসমেটকে বিয়ে করছে। খুব তাড়াহুড়ার মধ্যে। স্যার বলছিলেন যে ফিওনা হুট করে তাকে বিয়ে কথা বলে আর যাকে বিয়ে করবে তার নামও বলে। তারপর…”

কথার মাঝেই মীরা থামায় শেহজাদকে। সে জিজ্ঞেসা করে,
“ফিওনা আপু না আপনাকে পছন্দ করতো? তাহলে অন্য ছেলেকে বিয়ে করার কথা বলল কীভাবে? তাও ক্লাসমেট। মানে বুঝলাম যে আপনি ইগনোর করাতে সে হার্ট হয়েছিল কিন্তু বিয়ের জন্য ছেলে সে নিজেই সাজেস্ট করেছিল?”

“হ্যাঁ করেছিল। সে রেনডমলি ছেলে পছন্দ করেছিল। সে ছিল ইউনিভার্সিটিতে মোস্ট ফেমাস এন্ড এট্রাক্টিভ গার্ল। সবার ক্রাশ বলা যায়। অতিরিক্ত সুন্দরী। তাই সে রেনডমলি নিজের এক ক্লাসমেটকে চুজ করেছিল বিয়ে করার জন্য। যাকে চুজ করেছিল, সেই ছেলে ফিওনাকে প্রপোজ করা ছেলেদের মধ্যেই একজন। বলা যায়, সবার শেষে প্রপোজ ওই ছেলেই করেছিল।”

“তারপর কী হলো? আপনি কি ফিওনা আপুর সাথে কথা বলেননি?”

“না! আমি কেন কথা বলব? ওর বিয়ে ও করবে। আমি গেস্ট হিসেবে ফ্যামিলি নিয়ে জাস্ট বিয়ে এটেন্ড করেছিলাম। বিয়ের আগ পর্যন্ত ফিওনা আমার দিকে চেয়ে কয়েকবার হাসি বিনিময়ও করেছিল। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায়। এরপর এক বছর আমার সাথে ফিওনার কোনো দেখা-সাক্ষাত বা কথা হয়নি। শুনেছিলাম, অন্য শহরে হাসবেন্ডের সাথে শিফট হয়েছে। আমার গ্রাজুয়েশন শেষ হয়। তিন মাস জব করে মাস্টার্সে ভর্তি হই। তারপর হঠাৎ একদিন বিকেলে ভার্সিটি থেকে বাসায় ফিরে দেখি ড্রয়িংরুমে মায়ের সাথে বসে ফিওনা ও তার দাদি গল্প করছে। তাকে হঠাৎ অনেকদিন পর দেখে অবাক হলেও আরও বেশি অবাক হই তার চোখের নিচে ডার্কসার্কেল, রুক্ষতায় ভরা চেহারা। আগের ফিওনার সাথে মিলাতে পারছিলাম না। ফিওনা আমাকে দেখে দৌড়ে এসে হুট করেই জড়িয়ে ধরেছিল। আমি তখন পুরো ব্যাপারটাতে রোবটের মতো স্টিল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ফিওনা কাঁদছিল। আমি কিছুক্ষণ পর বিষয়টা বুঝতে পেরে ও-কে সোজা করে দাঁড়া করিয়ে কী হয়েছে? জানতে চাইলে সে জানায়, তার হাসবেন্ডের সাথে তার ডিভোর্স হয়ে গেছে। তাদের নাকি মতের মিল হচ্ছিল না। তার হাসবেন্ড তাকে মেন্টালি টর্চার করছিল। তারপর অন্য এক মেয়ের সাথে টাইমস্পেন্ড করতো। তখন ও-কে কী বলব আমি বুঝতে পারছিলাম না। মা এসে তখন ও-কে নিয়ে যায়। এরপর পরেরদিন ও-কে নিজের ক্লাসে দেখে আমি আরেকদফা অবাক হয়েছিলাম। ও নিজ থেকে আমার পাশে এসে বসেছিল। হাই-হ্যালো এতটুকুই। ধীরে ধীরে ও আগেরমতো প্রাণবন্ত হতে শুরু করে। যেখানেই ঘুরতে যাবে, আমাকে জোর করে হলেও নিয়ে যাবে। এমন একটা অবস্থা যে রাতে ঘুমানোর সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ও আমার সাথেই থাকতো। বাবা-মায়ের সাথেও ওর খুব মিষ্টি সম্পর্ক হওয়াতে ও অনায়াসে স্টাডি, আড্ডা যাই করুক উনারাও বাধা দিতেন না। স্যারও এদিকে নিশ্চিন্ত। মেয়ের ডিভোর্সের পর মেয়েকে নিয়ে তিনি খুব দুশ্চিন্তায় ভুগতেন। হাই ব্লাডপ্রেশার ও হার্টে প্রবলেম ছিল উনার। তাই ফিওনাকে আমার সাথে হাসি-খুশি থাকতে দেখে তিনি কিছুটা হলেও নিশ্চিন্তে ছিলেন।”

শেহজাদ আবারও থামে। এবার উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদকে উঠতে দেখে মীরা প্রশ্ন করে,
“কী হলো? উঠলেন কেন?”

“পানি খাব। তুমি তো শুনছ, আর আমি বলছি।”

মীরা অবাক হয়ে বলে,
“এতটুকু বলতে আপনার পানি খেতে হবে? ক্লাস লেকচারের সময় তাহলে কী করেন? তখন তো পানি লাগে না।”

“মীরা!”

“ওকে ওকে। আপনি বসুন। আমিই পানি নিয়ে আসছি।”

এই বলে মীরা বিড়বিড় করে শেহজাদকে ব*কতে ব*কতে পানি আনতে রুমে যায়। রুমে গিয়ে দেখে জগে পানি নেই। এতে সে আরও বিরক্ত হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে নিচে ডাইনিং থেকে পানি আনতে যায়।
শেহজাদ চেয়ারে বসে আকাশপানে নিরন্তর চেয়ে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে আর বলে,

“ফিওনা! ইউ ওয়ার সো স্টাবর্ন!”

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২৪
মীরা তড়িঘড়ি করে পানি নিয়ে ফিরে আসে। শেহজাদের সামনে পানিভর্তি গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নিন, পানি।

শেহজাদ ধন্যবাদ জানিয়ে মীরার হাত থেকে পানির গ্লাস নিয়ে পানি খেল। সে খালি গ্লাসটা টেবিলে রাখা মাত্রই মীরা অতিআগ্রহী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“এরপর কী হয়েছিল? বলুন।”

“কী?”

শেহজাদের কণ্ঠে কেমন গা ছাড়া ভাব। মীরা ভ্রুকুঞ্চন করে শুধায়,
“কী মানে কী? এরপরের ঘটনা বলুন। বিয়ে কীভাবে হলো সেসব।”

শেহজাদ লম্বাশ্বাস নিয়ে মলিন হাসে। তার হাসি যদিও মীরার দৃষ্টির আড়ালেই রয়ে গেছে। সে বলতে শুরু করল,
“এরপর সময় পেরিয়ে গেছে। আমাদের মাস্টার্স শেষ হয়। আমার ও ফিওনার দুজনের মাঝে ফ্রেন্ডশিপটা অনেক গাঢ়ো হয়েছিল। তারপর ফিওনা আমায় প্রপোজ করে। আমাদের ধর্ম আলাদা ছিল বলে আমি না করে দিয়েছিলাম। তারপর সে জানায় সে ইসলাম গ্রহণ করবে, তাও আমাকেই বিয়ে করতে চায়। ফিওনার বাবা ও গ্যান্ডমাও রাজি। তারপর আর কী! বিয়ে হলো। তারপর ভালোই চলছিল সব। আমি জবের সাথে সাথে পিএইচডি করতে ভর্তি হই আর ফিওনা নিজের ফ্যাশন ডিজাইনের একটা শখকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে কোর্সে ভর্তি হয়। এরপর কয়েক মাস পর ফিওনার বাবা হঠাৎ হার্ট অ্যা*টা*কে মা*রা যান। বছর খানেক পর আমার বাবাও অফিসে নিজের ডেস্কেই সাডেন স্ট্রোক করেন, তিনিও না ফেরার দেশে চলে যান। তারপরই ফুফা ও ফুফিজান আমাকে বলেছিলেন দেশে আসতে। উনারা খুব রিকোয়েস্ট করেছিলেন। তখন আবিরের অবস্থা অনেক ক্রিটিক্যাল ছিল। মেন্টাল সাপোর্ট ও পাশে থাকার জন্য আমাকে, মাকে ও ফিওনাকে দেশে আসতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি একাই এসেছিলাম। দেশে এসে এক মাস পর জানতে পারি ফিওনা প্রেগন্যান্ট। আমার মা ও ফিওনার গ্র্যান্ডমা ছিল বলে উনারাই সব দেখছিল। আমিও যেতে পারছিলাম না। তারপর ফ্রিশার জন্ম হলো। এইতো কাহিনী।”

মীরা গালে হাত দিয়ে বলে,
“আমি ভাবলাম আরও কতোকিছু! যার জন্য আপনার গলা শুকিয়ে গিয়েছিল! যাইহোক, ঘুমাবেন না?”

শেহজাদ অন্ধকারের মাঝে আঁধারাচ্ছন্ন অন্তরীক্ষের পানে চেয়ে নিরব দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়ে। মুখে জবাব দেয়,
“আমার এখন ঘুম পাচ্ছে না। নেটে একটু রিসার্চ করব। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো।”

“ওকে। আমি ঘুমোতে গেলাম। আপনিও বেশি রাত জাগবেন না। ঘড়িতে কিন্তু বারোটা বাজে। যদিও আমিও লেটনাইট জাগি, কিন্তু আজ টায়ার্ড লাগছে। গুডনাইট।”

“গুডনাইট।”

মীরা চলে যায়। মীরা চলে যাওয়ার পর শেহজাদ ল্যাপটপটা এনে বসে। কিন্তু তার মন ল্যাপটপে নেই। তার মন পড়ে আছে অতীত স্মৃতিতে। সে ইচ্ছে করেই ওই ঘটনাগুলো মীরাকে বলেনি। ঘটনাগুলো শুধু সে নিজে, ফিওনা ও তাদের ক্লোজ কিছু ফ্রেন্ডসরা বাদে কেউ জানেনা। পরিবারের কেউ তো নয়ই।
শেহজাদ ভাবতে থাকে সেদিনের কথা, যার জন্য সে ফিওনাকে বিয়ে করেছিল।

ফ্ল্যাশব্যাক,
ফিওনা জোর করে শেহজাদকে একটা নাইটক্লাবের লেটনাইট পার্টিতে নিয়ে এসেছে। বলেছিল দুই বছরের এতো প্রেশার থেকে মুক্ত আজ তাই একটু সময় আনন্দ করবে। আজ তাদের মাস্টার্সের গ্রাজুয়েশনের দিন ছিল। ফ্রেন্ডসদের সাথে গেটটুগেদারের পর ফিওনা জেদ করে, জোর করে শেহজাদকে নিয়ে এসেছে। এতো গা*ন-বাজনার মাঝে শেহজাদ একটু দূরে সোফায় একা বসে আছে। কিছুক্ষণ পর পর শেহজাদ ফিওনার ফোনে কল করছে, মেসেজ করছে যে এবার বাড়ি ফিরতে হবে। কিন্তু ফিওনা দূর থেকে ইশারায় বারবার বলছে, সে আরও কিছু সময় থাকতে চায়। শেহজাদের এসব ভালো লাগছে না। সে ফোনে গেইমস খেলছিল তখন ফিওনা শেহজাদের জন্য অরেঞ্জ জুস নিয়ে এসে বলে,

“ওয়ান্না ড্রিংক? ইটস অরেঞ্জ জুস।”

“ওকে। পার্টি ডান? উই নিড টু গো ব্যাক হোম।”
(আচ্ছা। পার্টি শেষ। আমাদের বাড়ি ফিরতে হবে।)

“ইয়াহ। জাস্ট অ্যা লিটল হোয়াইল।”
(হ্যাঁ। আর একটু সময়।)

ওদের কথা-বার্তার মাঝেই সেখানে ফিওনার এক্স হাজবেন্ড মাইকেল, একটা মেয়ের সাথে এসে উপস্থিত হয়। এসেই ফিওনাকে দেখে আপত্তিকর কিছু বলা শুরু করে। তখনি শেহজাদ আওয়াজ তুললে সে ফিওনার সাথে শেহজাদকে জড়িয়ে বাজে কথা বলতে শুরু করে। মাইকেল চিৎকার করে পার্টির সব গান-বাজনা বন্ধ করিয়ে সবাইকে শুনিয়ে যা মুখে আসে তাই বলে যায়। শেহজাদের এসব সহ্য হয় না। এক পর্যায়ে শেহজাদের সাথে মাইকেলের হা*তা-হা*তি লেগে যায়। ফিওনা ও মাইকেলের গার্লফ্রেন্ড ডায়না খুব কষ্টে ওদেরকে আলাদা করে ছুটিয়ে আনে। ফিওনা কাঁদছে। শেহজাদ হাঁপাতে হাঁপাতে রাগে বলে,

“আই টোল্ড ইউ, লেটস গো হোম। বাট ইউ! ইউ ওয়ার নট লিসেনিং টু মাই ওয়ার্ড।”
(আমি বলেছিলাম, চলো বাড়ি যাই। কিন্তু তুমি! তুমি আমার কথায় কান দিলে না।)

ফিওনা ক্রন্দনরত অবস্থায় শেহজাদকে জড়িয়ে ধরে। শেহজাদ কিছুক্ষণ ফিওনার মাথায় হাত বুলিয়ে এরপর সোফায় বসায়। টেবিলে রাখা জুসের গ্লাসটা তুলে ফিওনাকে সাধলে ফিওনা মাথা নাড়িয়ে খাবে না জানালে শেহজাদ নিজেই একশ্বাসে খেয়ে নেয়। কিন্তু সে জানতো না যে জুসের গ্লাস বদল হয়ে গিয়েছিল! কিছুক্ষণ পর ফিওনা ও শেহজাদ দুজনেই নিজেদের স্বাভাবিক অবস্থায় ছিল না বলে ফিওনা কোনোরকমে ক্লাবে দায়িত্বরত স্টাফদের সাহায্যে রেস্ট করার জন্য রুম বুক করে।

সকালে ঘুম থেকে আগে শেহজাদই উঠে। সে নিজের পাশে ফিওনাকে দেখে বিস্ময়ে হতচকিত হয়ে লাফিয়ে বিছানা থেকে নেমে যায়। অবাক নয়নে আশেপাশে তাকিয়ে বুঝতে পারে তারা অন্যকোথাও আছে। ফিওনার দিকে একবার তাকায়, দেখে জামাকাপড় এলোমেলো। তৎপর দৃষ্টি সরিয়ে শেহজাদ সোফায় মাথায় হাত দিয়ে বসে। রাতের ঘটনা মনে করতে চাইলে মাইকেলের সাথে হা*তা-হা*তির পর সে জুস খায়, তারপরের কিছু তার মনে নেই। নিজের উপর প্রচণ্ড রাগে ও মাথাব্যথা হওয়ার কারণে টেবিলের উপরে থাকা গ্লাস দুটো ফ্লোরে ছু*ড়ে ফেলে। কাঁচভাঙার শব্দে ফিওনার ঘুম ছুটে গেলে সে উঠে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে,

“হোয়াট হ্যাপেন্ড?”

শেহজাদ জবাবে কিছু বলতে চাইলো না। গতকাল সে এখানে আসতে তো চায়নি তারপর আসার পর থেকে এতোবার বলার পর ফিওনা যেতে রাজি হয়নি। ফিওনার উপরও তার অনেক রাগ হচ্ছে। সে নিজের চুল ঠিক করে ফোনটা নিয়ে সেখান থেকে বেরিয়ে পড়ে।

বাড়ি ফেরার পর শেহজাদকে তার বাবা-মায়ের অনেক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় কিন্তু তার কোনো জবাব ছিল না। সে কোনোরকমে ব্যাপারটা সামলে নিজের রুমে চলে আসে। এরপর সারাদিন, এমনকি দুপুরে খাওয়ার জন্যও বের হয় না। নিজের কাছেই নিজেকে খারাপ মনে হচ্ছে তার। তার সেখানে যাওয়াই উচিত হয়নি। ফিওনাকেও সবসময় আশকারা দেওয়াটা তার অনেক বড়ো ভুল ছিল। নিজের এইসব সেল্ফ রিয়েলাইজেশনে সে অনেক অনুতপ্ত।
বিকেলে তার কাছে ফিওনার দুটো মেসেজ আসে। একটা ছবি ও মেসেজে লেখা, “প্লিজ মিট উইথ মি এস সুন এস পসিবল।” শেহজাদ এবার ছবিটা দেখে। তাতে যখন ফিওনা এসে শেহজাদকে জড়িয়ে ধরেছিল সেই সময়ের ছবি। মাইকেলের টুইটার থেকে পোস্ট করা। এখানে মাইকেল ক্যাপশনে লিখেছে, “সি লেফ্ট মি ফর দ্যাট রিজন, এন্ড আই ডিড দ্যা সেম।”

ছবিটা দেখে শেহজাদ মস্তিষ্কের নিউরন গুলো যেন ধপধপ করছে। সে ফোনটা ছুঁ*ড়ে ফেলতে চেয়েও ফেলল না। চোখ বন্ধ করে কয়েক মুহূর্ত বসে থেকে রুম থেকে বেরিয়ে যায়।
ফিওনার বলা স্থানে গিয়ে দেখে ফিওনা বিধ্বস্ত অবস্থায় বসে আছে। শেহজাদ এগিয়ে যেতে চেয়েও গেল না। এসবকিছু ফিওনাদের কালচারে স্বাভাবিক বলেই তো গতকাল রাতে ফিওনা তার কথা মানেনি। এখন নিজেই ভি*ক*টিমের মতো বসে আছে। শেহজাদকে দেখে ফিওনাই এগিয়ে এলো। এসেই হুট করে শেহজাদের পা জড়িয়ে বসে পড়লো। সে আধো বাংলায় বলল,

“আমি ভুল করেছি। প্লিজ ফরগিভ মি। আমি সব ঠিক করব।”

শেহজাদ দ্রুত ফিওনাকে নিজের থেকে সরিয়ে বলে,
“কী ঠিক করবে তুমি? লেট ইট বি।”

“নো শেহজাদ। আই নো ইটস নট অ্যা স্মল থিংস ফর ইউ। সো আই হ্যাভ অ্যা সলিউশন।”

শেহজাদ নিজের দুই হাত দ্বারা মুখমণ্ডল অর্ধেক আবৃত করে হতাশার দৃষ্টিতে অন্যদিকে তাকায়। আচমকা তার কর্ণকুহরে এমন কিছু আসবে তা সে কল্পনাও করেনি। ফিওনা বলে,
“আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্না ম্যারি ইউ। এন্ড আই অ্যাম রেডি টু ডু এভরিথিং টু ম্যারি ইউ। প্লিজ প্লিজ, শেহজাদ। ডোন্ট রিজেক্ট মি। আই লাভ ইউ সো মাচ।”

শেহজাদ তৎক্ষণাৎ ঘাড় ঘুরিয়ে হতবাক নয়নে ফিওনার পানে চেয়ে আছে। ফিওনা অধীর হয়ে অস্থির ভঙ্গিতে শেহজাদের জবাবের অপেক্ষা করছে। কিন্তু শেহজাদ এখনও নিজের অবাক হওয়ার রেশ থেকেই বেরোতে পারেনি। ফিওনা অধৈর্য কণ্ঠে ফের বলে ওঠে,

“অ্যা ফিউ মোমেন্টস এগো, বিফোর ইউ কেইম, আই রিসিভড ইসলাম।”
(কয়েক মুহূর্ত আগে, তুমি আসার আগে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি।)

শেহজাদ যেন এবার অবাক হওয়ার চরম সীমানায়! তার কাছে বিষয়গুলো খুব জটিল লাগছে। কী করবে না করবে সব গু*লিয়ে যাচ্ছে তার।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে