মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-২১+২২

0
633

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২১
শেহজাদরা মীরাকে নিয়ে ফিরতে ফিরতে অনেক রাত হয়ে গেছে। ফ্রিশা গাড়িতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। ফ্রিশার মাথা মীরার কোলে আর পা শেহজাদের কোলে। গাড়ি শেহজাদদের বাড়ির গেইটে ঢুকতেই শেহজাদ বলে,

“ও-কে এবার কোলে নিতে হবে। তুমি একটু ও-কে ধরে বসিয়ে দাও।”

মীরা খুব নমনীয় ভাবে ধীরে ধীরে ফ্রিশাকে সিটে হেলান দিয়ে বসায়। গাড়ি থামলে শেহজাদ আগে নেমে তারপর ফ্রিশাকে নামিয়ে কোলে নেয়। অতঃপর মীরাকে বলে,
“তুমি ভেতরে আসো, আমি ফ্রিশাকে ওর রুমে রেখে আসি।”

মীরা মৃদু হেসে ইশারায় সম্মতি দেয়। শেহজাদ যেতেই মিসেস শাহিদা এসে মীরার পাশে দাঁড়ান। তারপর নরম স্বরে বলেন,
“তুমি কিছু মনে করো না।”

মীরা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলো,
“কী মনে করব, আন্টি?”

“এইযে শেহজাদ তোমার সাথে বাড়ির ভেতর ঢুকলো না। নতুন বর-কনে তো একসাথে প্রথমবার বাড়িতে প্রবেশ করে।”

মীরা হেসে মিসেস শাহিদাকে প্রত্যুত্তর করে,
“এটা কোন কারণ হলো? হ্যাঁ তবে আপনার কনসার্ন আমি বুঝতে পারছি। নববিবাহিতা তার স্বামীর হাত ধরেই নতুন ঘরে প্রবেশ করে। সাথে থাকে নতুন পরিবেশ, নতুন সংসার, নতুন মানুষদের নিয়ে একরাশ ভয় ও আশা। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে তো সেটা আলাদা। আমি আপনাদের খুব ভালো করে জানি। তাছাড়া বিয়েটা করেছিও ওই বাচ্চাটার জন্য, যাকে ঘুমন্ত অবস্থায় স্যার ভেতরে নিয়ে গেলেন। এখন এখানে যদি আমি কিছু মনে করে বসে থাকি, তা তো শোভনীয় না।”

মিসেস শাহিদা হেসে একবার স্বামীর দিকে দেখে নিয়ে বলেন,
“তোমার স্যার ঠিক কথাই বলেছিলেন। তুমি খুব বুদ্ধিমতি ও বুঝদার মেয়ে। এসো ভেতরে এসো।”

মীরা মুচকি হেসে মিসেস শাহিদা ও ড: আকবর রেহমান এর সাথে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।

_______
কিছুক্ষণ গল্প ও ভিডিও কলে ড: আকবর রেহমানের ভাই-বোনের পরিবারের সাথে পরিচয় পর্ব চলেছে। তারপর মিসেস শাহিদা নিজে মীরাকে শেহজাদের বেডরুমে দিয়ে গেছেন। তারপর তিনি সার্ভেন্টকে দিয়ে মীরার সুটকেস ও খাবার পাঠিয়ে দিয়েছেন । মীরা রুমের মাঝ বরাবর দাঁড়িয়ে পুরো ঘরটা সূক্ষ্ণ ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। ঘরটা বড়ো ও বেশ ছিমছাম। আজ তাদের বিয়ের রাত হিসবে সাজানোও নেই। শুধু ঘরে থাকা ২-৩টা ফুলদানিতে তাজা ফুল রাখা। ঘরটার ব্যালকনি দক্ষিণমুখী, সেইসাথে জানালাও। উত্তর পাশে ওয়াশরুম, ড্রেসিংটেবিল ও কাঠের আলমারি। ওয়াশরুমের সাথে পূর্ব পাশে দুই সিটের সোফা ও ছোটো টেবিল রাখা। পশ্চিম পাশে স্টাডি ডেস্ক ও বুকশেলফ। ঘরের এক জায়গায় একটা ইজি চেয়ারও রাখা। পূর্ব পাশের দেয়ালে বিশাল জায়গা করে সাদা শিফন পর্দা লাগানো। মীরার কৌতুহল হলো। কারণ ঘরের এমন স্থানে পর্দা থাকার তো কথা না। কারণ জানালাতো দক্ষিণ দিকে। মীরা সেদিকে এগুতে নিলে দরজার নব ঘুরানোর শব্দে পেছনে ফিরে। শেহজাদকে দেখে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে। হঠাৎই তার মাঝে যেন ইতস্তততার পসরা এসে হাজির। কোনোরকমে সালাম দিয়ে নিরব থাকে। শেহজাদও সালামের জবাব দেয়। অতঃপর নিজের মনোযোগ রুমের চারিপাশে ঘুরিয়ে বলে,

“খাবার রাখা আছে। ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও। ওখানে তো সবার মাঝে খেতে পারোনি।”

মীরা মাথা নেড়ে কিয়ৎ মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলে,
“আপনি খাবেন না?”

“আমি তো সেখানে খেয়েছি। সবাই একে একে খাওয়াতে খাওয়াতে প্রয়োজনের তুলনায় বেশি খেয়েছি। তুমি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে নাও।”

এই বলে শেহজাদ বুকশেলফের দিকে এগোলো। মীরা লক্ষ্য করলো শেহজাদ ফ্রেশ হয়েই এসেছে। মীরা নিজের সুটকেস থেকে থ্রিপিস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।

প্রায় আধঘণ্টা পর মাথায় তাওয়াল পেঁচিয়ে ওয়াশরুম থেকে ফিরে মীরা দেখে শেহজাদ স্টাডি ডেস্কে বসে বই পড়ছে। মীরার রুমে আসার শব্দে শেহজাদ বই থেকে নজর সরায়। মীরার দিকে চেয়ে শুধায়,

“এই রাতে শাওয়ার নিয়েছ?”

মীরার ধিমি স্বরে জবাব,
“জি স্যার। টায়ার্ড লাগছিল।”

“ভালো করেছ। তবে হেয়ার ড্রায়ারটা ফ্রিশার বেডরুমে। ওয়েট অ্যা মিনিট। আমি এনে দিচ্ছি।”

মীরা মাথা নাড়ে। শেহজাদ রুম থেকে বের হয়ে গেলে মীরা চুল থেকে তাওয়াল খুলে ভালো করে চুল ঝেড়ে নেয়। তারপর খাবারের ঢাকনা খুলে দেখে নেয়। ইতোমধ্যে শেহজাদ ফিরে আসে।

“এইযে হেয়ার ড্রায়ার। তারপর খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো। আমি ঘুমাতে যাচ্ছি।”

“আচ্ছা।”

মীরা হেয়ার ড্রায়ারটা নেয়। শেহজাদও গিয়ে বিছানার এক পাশে শুয়ে পড়ে। মীরা সময় নিয়ে চুল শুকিয়ে নেয়। অতঃপর খেয়ে নামাজ পড়ে নিজেও বিছানার আরেক কোনায় শুয়ে পড়ে।

________

বেশ সকাল সকাল মীরার ঘুম ভেঙে যায়। দেখে শেহজাদ তার পাশে বসে কফি খাচ্ছে আর ফোন স্ক্রল করছে। শেহজাদের ভাবসাব দেখে মীরা ভেবে বসলো, সে হয়তো খুব লেট করে ঘুম থেকে ঘুম থেকে উঠেছে। তারপর তাড়াহুড়ো করে উঠে বসে সামনের দেয়ালে ঘড়ির দিকে চেয়ে দেখে এখনও ছয়টাও বাজেনি। অতঃপর স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। শেহজাদ মীরার ছটফটে ও তাড়াহুড়ো করে উঠে বসার দৃশ্য ঠিকি লক্ষ্য করেছে। সে নিরবে হেসে মীরাকে ডেকে বলে,

“মীরা, তুমি লেইট করে ঘুম থেকে উঠোনি। অ্যাই ওয়েক আপ আর্লি এভরি মর্নিং। নাউ গো এন্ড ফ্রেশেন আপ।”

মীরা উঠে যায়। ফ্রেশ হয়ে এসে নামাজ পড়ে বিছানায় বসে। শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে বলে,

“স্যার, আপনি প্রতিদিন যে সময় উঠবেন, আমাকেও প্লিজ ডেকে দিবেন।”

“ইয়ার অফকোর্স। আজকেই দিতাম বাট দেন অ্যাই থট ইউ ওয়ার টায়ার্ড। কাল থেকে তোমাকেও আর্লি মর্নিং উঠতে হবে।”

মীরা হালকা হেসে আয়নার সামনে গিয়ে চুল ঠিক করে রুম থেকে বেরিয়ে যায়। গতকাল রাতে মিসেস শাহিদা তাকে বলেছিলেন, কোনটা কার রুম। সেই অনুসারে ফ্রিশার রুমে গিয়ে দেখে ফ্রিশা বড়ো টেডিকে জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। মীরা মুচকি হেসে ফ্রিশার পাশে বসে। তারপর ওর মাথায় হাত বুলায়। পুরো রুমটা হালকা গোলাপি রঙের। দেখতেও সুন্দর। খেলনা, টেডি সব সাজানো। মীরা দেখলো ফ্রিশা নড়ে ওঠেছে। সে তৎপর হয়ে নিজের হাত সরিয়ে নেয়। তারপর সেখান থেকে উঠে রান্নাঘরে যাওয়ার মনস্থির করে। সে শুনেছে, এই বাড়ির রান্নাবান্না সব সার্ভেন্ট দেখাশোনা করে। কিন্তু আজ তার এই বাড়িতে প্রথম দিন। তাই ভাবলো, সবার জন্য কিছু না কিছু স্পেশাল রান্না তো করতেই পারে। যা ভাবা সেই কাজ। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলো সবকিছু খুব সাজানো। কোন কন্টিনারে কী রাখা, সব গোছানো। এতে মীরা বেশ খুশিও হয়ে গেছে। অতি সহজেই হাতের কাছে সব পেয়ে গেছে। প্রথমেই বানালো পায়েশ। তারপর কী বানাবে ভাবতে ভাবতে সার্ভেন্ট এসে হাজির হয়। সার্ভেন্ট অবাক হয়ে বলে,

“ম্যাডাম, আপনি এখানে? কিছু লাগবে?”

মীরা নিজের ভাবনার সমাধান পেয়ে গিয়ে অত্যন্ত খুশি হয়ে বলে,
“হ্যাঁ। আপনি একটু আমাকে বলুন তো, এই বাড়ির সবাই ব্রেকফাস্টে কী খায়?”

“পাউরুটির সাথে ডিম মাঝে দিয়ে খায় আর ফলের সাথে ওটস। সাথো ফলের জুসও।”

“ওহ। প্রতিদিন এগুলোই?”

“জি। বড়ো স্যার ও ম্যাডামের ডায়াবেটিস আছে তো। আর ছোটো স্যার ও ফ্রিশামনিরও এগুলাই পছন্দ। ছোটো স্যার তো বিদেশে ছিল আবার ফ্রিশামনির মা মানে ছোটো স্যারের প্রথম পক্ষের বউও তো বিদেশের। উনারা সকালে ভাত-রুটি খায় না।”

সার্ভেন্টটার কথা শুনে মীরা হাসার চেষ্টা করে বলল,
“আচ্ছা ঠিক আছে। আজকের নাস্তা আমি বানাব।”

সার্ভেন্ট অবাক হয়ে মুখে হাত দিয়ে বলে,
“কী বলেন ম্যাডাম! আমরা থাকতে আপনি কেন করবেন? আপনি কালকেই এখানে নতুন আসলেন। আপনি ঘরে গিয়ে রেস্ট করুন, ম্যাডাম।”

“আজকে আমিই নাস্তা বানাব। উনারা যা পছন্দ করে তাই বানাব। প্লিজ। আপনি বাধা দিবেন না।”

“কিন্তু ম্যাডাম…”

“কোনো কিন্তু না। প্লিজ। আমি সবসময় এই সময়ও পাব না। প্রতিদিন তো আপনারাই করবেন।”

সার্ভেন্ট রাজি হয়। তারপর সে রান্নাঘরেই দাঁড়িয়ে মীরার কাজ দেখতে থাকে। মাঝেমধ্যে কিছু লাগলে এগিয়েও দিচ্ছে।

__________

খাবার টেবিলে সবাই একসাথে বসেছে। মীরা এখনও কাউকে জানায়নি যে রান্না আজ সে করেছে। কিন্তু হঠাৎ করেই একটা দুর্ঘটনা ঘটলো….

চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_২২
ব্রেকফাস্ট টেবিলে সবাই যখন হাসি-খুশি ভাবে খাচ্ছে, তখন হঠাৎই ফ্রিশার হাঁচি শুরু হয়ে গেলো! লাগাতার হাঁচি দিয়েই যাচ্ছে সে। আচমকা এমন হওয়াতে উপস্থিত সকলে ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে। খাওয়া রেখে শেহজাদ উচ্চস্বরে সার্ভেন্টকে ডাকে। সার্ভেন্ট ছুটে এসে ভয়ার্ত স্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিলে শেহজাদ ক্রুদ্ধ স্বরে শুধায়,

“খাবারে পিনাট ছিল? তুমি জানোনা? ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি?”

সার্ভেন্ট কেঁপে ওঠলো। ভীরু দৃষ্টিতে মীরার দিকে একবার চেয়ে মাথা নিচু করে রাখে। মীরা ভড়কে গেলেও তার জন্য আরেকজন দোষ না করে দোষী হবে, তা তো মানতে পারে না। সে অনুতপ্ত স্বরে বলল,
“আজকের খাবার আমি বানিয়েছি। সরি, আমি জানতাম না যে ফ্রিশার পিনাটে এলার্জি। জানলে আমি সত্যি দিতাম না।”

শেহজাদ দাঁতে দাঁত চেপে নিজের ক্রোধ আয়ত্তে আনার প্রয়াস করে। কিন্তু তার মনে হচ্ছে সে ব্যার্থ হবে! অতঃপর কিছু না বলে কালক্ষেপণ না করে ফ্রিশাকে কোলে করে নিয়ে উপরে ফ্রিশার রুমে চলে যায়।
শেহজাদ, ক্রন্দনরত ফ্রিশাকে নিয়ে চলে গেলে মীরা পিছু যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ও-কে আটকায়। তিনি বলেন,
“তুমি এখনি যেয়ো না। শেহজাদ রেগে আছে। পিনাটে ফ্রিশার এলা*র্জি আছে। শরীরে র‍্যাশে ভরে যায়। অনেক ইচিং হয়। রাতে ঠিকমতো ঘুমাতেও পারে না।”

মীরার খুব খারাপ লাগে। তার জন্য এতটুকু বাচ্চা কতো কষ্ট পাচ্ছে। মীরা ক্লেশবোধ নিয়ে বলে,
“আমি জানলে সত্যি পায়েসে পিনাট দিতাম না। আমি তো পায়েসটা আরও সুস্বাদু করার জন্য বাদামের পেস্ট করে দিয়েছিলাম। আমার মা আমার জন্য এভাবে দেয়। এই টেস্টটা আমার পছন্দে বলে ভেবেছিলাম আপনাদের জন্যও বানাই। কিন্তু এরকম যে হবে তা কল্পনাও করতে পারিনি।”

মিসেস শাহিদা, মীরার দিকটা বুঝলেন। তিনি মীরার মাথায় হাত বুলিয়ে নমনীয় স্বরে বললেন,
“আমি বুঝতে পারছি। তুমি জানলে অবশ্যই করতে না। ফ্রিশার স্পেসিফিকলি কাজুতে এলা*র্জি বেশি। কাঠবাদামে অল্প। খুব বেশি পরিমানে কাঠবাদাম খেলে তাহলে ই*চিং হয়। কিন্তু কাজুতে অনেক বেশি।”

“আমি এরপর থেকে খেয়াল রাখব। ওর আর কীসে কীসে এলা*র্জি সব আপনার কাছ থেকে জেনে নিব। এখন একটু যাই প্লিজ। দরজার বাহির থেকেই দেখব কী অবস্থা।”

“আচ্ছা যাও। তবে বলবো যে কথা বলো না। শেহজাদের রাগ সম্পর্কে তোমার কিছুটা হলেও ধারণা থাকার কথা।”

“হুম।”

মীরা দ্রুতপদে ফ্রিশার ঘরের দিকে অগ্রসর হলো। মিসেস শাহিদা মনে মনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেললেন। বিয়ের একদিন না পেরোতেই এমনটা হতে হলো! শেহজাদের মনে এ নিয়ে কোনো পরিবর্তন না হয়!

_____

পাঁচ মিনিটের বেশি সময় যাবত মীরা দরজার বাহিরে দাঁড়ানো। শেহজাদ ফ্রিশাকে একটা ইন*জেক*শন পুশ করে এখন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। হাতের কিছু স্থানে লাল লাল র‍্যাশ দেখা যাচ্ছে। ফ্রিশা কিছুক্ষণ অস্থির হয়ে চুলকিয়ে আস্তে আস্তে ঘুমে নেতিয়ে পড়েছে। মীরা দেখলো ফুলের মতো বাচ্চাটার অশ্রুভেজা পাঁপড়ি ও গালের অংশ। কতোটা কষ্ট পেয়েছে সে! মীরার নয়নযুগলে এবার বর্ষা নামলো। মা হওয়ার প্রথম দিনেই তার জন্য বাচ্চাটাকে এতো কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। সামনে কী সে পারবে? ভেবেই মনে ভয়ে-ভীতিরা মাকরশার জালের মতো ছড়াতে শুরু করলো। নিজের ভাবনা-চিন্তার মাঝে এতোটাই ডুবে আছে যে শেহজাদ তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে তার খেয়ালই নেই! শেহজাদ কিয়ৎক্ষণ আনমনা মীরাকে পর্যবেক্ষণ করে হাতের চুটকি বাজিয়ে মীরার মনোযোগ ফেরায়। মীরা থতমত খেয়ে তাকালে শেহজাদ শান্ত স্বরে বলে,

“ও এখন ঘুমাচ্ছে। আমি ইন*জেক*শন দিয়ে দিয়েছি।”

কথাটা বলে শেহজাদ যত্র দাঁড়িয়ে রইলো। মীরা আড়ষ্টতা ভেঙে বলল,
“বিশ্বাস করুন, আমি জানলে কখোনো করতাম না। আমার পিনাট খুব পছন্দ তাই দিয়েছিলাম। সরি।”

শেহজাদ গম্ভীর স্বরে জবাব দেয়,
“নেক্সট টাইম খেয়াল রেখো।”

অতঃপর দ্রুত প্রস্থান করে। মীরা গুটিগুটি পায়ে ফ্রিশার রুমে গিয়ে ওর মাথার কাছে বসে। তারপর ওর এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিয়ে, র‍্যাশের জায়গাগুলোতে লাগানোর জন্য মলম আনতে সার্ভেন্টকে পাঠায়।

________

সন্ধ্যাবেলা। ধূসর মেঘের আড়ালে অর্ধচন্দ্রমা লুকোচুরি খেলছে। মৃদু জোৎস্না ব্যালকনির গ্রিল গলে অন্ধাকারাচ্ছন্ন স্থানে আসছে। শেহজাদ মেয়ের ঘরে এসে দেখে মীরা সেখানে বসেই বই পড়ছে। দুপুর থেকে শেহজাদ মীরাকে নিজের আশেপাশে কোথাও দেখেনি। খাবার টেবিলেও না। এমনকি দুপুরে যখন ফ্রিশার সাথে দেখা করতে এসেছিল, তখনও মীরা ছিল না। এরপর তো সে একটা কাজে বাহিরে গিয়েছিল। শেহজাদ হালকা কাঁশির আওয়াজ করে, যার দরুণ মীরা বই থেকে মনোযোগ সরিয়ে সম্মুখে তাকায়। শেহজাদকে দেখে ফ্রিশাও বলে ওঠে,

“বাবা, দেখো আমি ড্রয়িং করছি।”

শেহজাদ হালকা হাসি দিয়ে এগিয়ে এলো।
“খুব সুন্দর হয়েছে। তোমার শরীর এখন কেমন লাগছে, মা?”

“অ্যাই অ্যাম ফাইন, বাবা। ফেইরিমাম্মাম আমাকে আবার পায়েস করে খাইয়েছে। এবার কোনো ই*চিং হয়নি। সি, অ্যাই অ্যাম ফাইন।”

শেহজাদ প্রশান্তচিত্তে হাসলো। মেয়ের মাথায় চু*মু এঁকে শুধালো,
“এখন কি র‍্যাশে ই*চিং হচ্ছে?”

“না, বাবা। দাদুমনি বলল, তুমি নাকি ফেইরিমাম্মামের সাথে রাগ করেছ? ফেইরিমাম্মাম তো জানতো না। তাই না?”

শেহজাদ মীরার পানে এক পলক চেয়ে নিরুত্তর রইল। ফ্রিশা পুনরায় বলল,
“ফেইরিমাম্মামকে সরি বলো, বাবা।”

মীরা অবাক হয়ে ফ্রিশাকে দেখে। দ্রুত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“না না, ফ্রিশামনি। এটার কোনো দরকার নেই। উনার তো কোনো দোষ নেই। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে ভয় পেয়েছিল, বাচ্চা।”

ফ্রিশা নিজের কথায় অটল। মীরার কথা সে শুনবে না।
“সরি বলো, বাবা। নাহলে আমি তোমার সাথে কথা বলব না।”

ফ্রিশার জেদ তো তার বাবাকে মানতেই হবে। শেহজাদ মীরার চোখের দিকে আরও একবার তাকায়। অতঃপর ধীর কণ্ঠে সরি বলে সেখান থেকে উঠে যায়। ফ্রিশা উচ্ছাসিত হয়ে মীরাকে জড়িয়ে ধরে গালে চু*মু দিয়ে আবার আঁকতে বসে।

_________

প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর মীরা ফ্রিশার সাথে খেলা করে, মিসেস শাহিদার সাথে গল্প করে ও নিজের মা-ভাবিদের সাথে ফোনে কথা বলে এখন তার ও শেহজাদের বেডরুমে যায়। মিসেস শাহিদা বলেছেন, শেহজাদকে খাওয়ার জন্য ডেকে আনতে। মীরা গিয়ে বলল,
“ফুফিআন্টি আপনাকে ডাকছেন।”

শেহজাদ ল্যাপটপ থেকে নজর সরিয়ে মীরাকে দেখলো। তারপর বলল,
“এখানে এসে বসো।”

“কোথায়?”

মীরার প্রশ্নটা যে কতোটা অবান্তর তা মীরা পরক্ষণেই বুঝতে পারলো যখন শেহজাদ তার দিকে শিতল দৃষ্টিতে তাকায়। এরপর মীরা শেহজাদের পাশে গিয়ে বসলে শেহজাদ মীরার দিকে ঘুরে বসে। তারপর জিজ্ঞাসা করে,

“তুমি কি আমাকে ভয় পাচ্ছ?”

মীরা হতচকিত হয়ে তাকায়। তারপর আস্তে করে বলে,
“ভয় না, স্যার। প্রথমদিন আমার অজানায় এমন একটা দুর্ঘ*টনা ঘটে যাবে তা আমি ভাবতেও পারিনি। আমার নিজের কাছেই খুব খারাপ লাগছে।”

“ফ্রিশা কিন্তু তোমাকে নিয়ে খারাপ কিছু ভাবেনি। আমি তখন একটু রেগে ছিলাম কিন্তু পরে তোমার দিক থেকে বুঝলাম, তুমি জানলে এমনটা করতে না।”

কথাটা বলে শেহজাদ হালকা হাসলো। সেই সাথে মীরাও। মীরা প্রশ্ন করলো,
“ফ্রিশার এই মিষ্টি দিকটা ওর মায়ের দিক থেকে পেয়েছে, তাই না?”

“না! ওর দাদী ও ফুফির দিক থেকে। ওর মা বিয়ের আগে অন্যরকম ছিল। বিয়ের পর ও বদলেছে।”

মীরা জানার আগ্রহ থেকে জিজ্ঞাসা করলো,
“কেমন ছিলেন তিনি?”

“ডিনার করে এসে বলব। তোমাকে ফুফিজান কেন পাঠিয়েছে তাই তো ভুলে গেছ!”

মীরা জলদি জিভ কা*ম*ড়ে বলে,
“ইশ সরি! খেয়ালই ছিল না। চলুন।”

বলে মীরা উঠে দাঁড়ায়। শেহজাদ কিঞ্চিত হেসে মীরার সাথে ডাইনিংয়ে যায়।

________

খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে ফ্রিশার বায়না, তার বাবা ও ফেইরিমাম্মাম দুজনে তাকে ঘুম পারাবে। মেয়ের এমন আদুরে বায়না দুজনের কেউই ফেলতে পারলেন না। অতঃপর শেহজাদ ও মীরা ফ্রিশার হাত ধরে সিঁড়ি দিয়ে উঠে ফ্রিশার ঘরে যায়। যদিও ফ্রিশা কোলে উঠতে চাইছিল কিন্তু শেহজাদ রাজি না। রাতে খাওয়ার পর একটু হাঁটাহাঁটি করতে তো হয়। তাই এই পন্থা।
ঘুমোনোর আগে ফ্রিশাকে ঔষুধ খাইয়ে দেয় শেহজাদ। অতঃপর সে মেয়েকে ইংলিশ কবিতা শোনায়। শেহজাদের কণ্ঠে ইংলিশ কবিতা শুনে মীরা কোনোরকমে হাসি আটকে রেখেছিল। এই লোক যে কবিতাও শোনাতে পারে তা তার ধারনারও বাহিরে ছিল। ঔষুধের প্রভাবে ফ্রিশা জলদিই ঘুমিয়ে পড়ে। ফ্রিশা ঘুমানোর পর শেহজাদ মীরাকে বলে,

“কফি করে নিয়ে এসো। তোমাকে আজ একটা স্টোরি শোনাব।”

“আপনার ও ফিওনা আপুর?”

“হ্যাঁ।”

মীরা মুচকি হেসে কফি বানাতে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে