#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৫
দেখতে দেখতে দুটো দিন পেরিয়ে গেছে। আজ সোমবার। বাহিরে তপ্ত রোদ। সূর্যের ক্ষোভ, রাগ যেন ধরণীতে তাপদাহ সৃষ্টি করছে। কিছুক্ষণ ছাতা বা ছাউনি ছাড়া দাঁড়ালে মনে হবে শ*রীরের চা*ম*ড়া ঝ*ল*সে যাচ্ছে। মীরা সবে মাত্র ভার্সিটিতে এসে পৌঁছেছে। আর আধঘণ্টা পরেই তার ক্লাস। সে ডিপার্টমেন্টের করিডোরে গিয়ে নিজের অফিস রুমের কাছে যেতেই খুব পরিচিত এক চেহারা দেখে যথাস্থানে থেমে যায়। ব্যাক্তিটি যে তার কর্মক্ষেত্র পর্যন্ত পৌঁছে যাবে, এতটাও কল্পনা করেনি। ব্যাক্তিটি এগিয়ে এসে ঠিক তার মুখোমুখি দাঁড়ায়। শুধায়,
“কেমন আছো, মীরু?”
মীরা জবাবের পরিবর্তে প্রশ্ন ছুড়লো,
“আপনি এখানে কেন এসেছেন?”
“তোমার সাথে দেখা করতে, মীরু। তুমি তো আমার নাম্বার বারবার ব্লক করে দিচ্ছ। তারপর তো তোমার নাম্বারে কলও ঢুকছে না।”
মীরা আশেপাশে চোখ বুলালো। দুই-একজন স্টুডেন্ট টিচারদের জন্য অপেক্ষা করছে বা এমনিতে দাঁড়ানো। লোক সমাগম কম হলেও এখানটায় প্রতিটা টিচারদের বিচরণ থাকে। তাই বাহিরে বাকবিতণ্ডা না করে নিজের অফিস রুমের লক খুলে প্রবেশ করলো। সাথে বর্ণও! মীরার অন্য দুই কলিগ এখন রুমে নেই। একজন ক্লাসে আছে। আরেকজনের আজকে ক্লাস আরও পরে তাই আরেকটু পর আসবে। মীরা দরজা লক করে নিজের চেয়ারে বসে বলল,
“দেখুন প্লিজ, এটা আমার কর্মক্ষেত্র। এখানে ঝামেলা করবেন না। আপনার সাথে কথা বাড়াতে আমি ইচ্ছুক না। আপনার নাম্বার বারবার ব্লক করছি কেন? কেন নিজের নাম্বার বন্ধ করে রেখেছি? নিশ্চয়ই আমি চাইছি না, আপনার সাথে কথা বলতে। তারপরও কেন আমার পেছনে পড়ে আছেন?”
“ভালোবাসি বলে!”
‘ভালোবাসি’ শব্দটা যেন মীরার কর্ণে উত্তপ্ত লা*ভার ন্যায় শোনালো। তৎক্ষণাৎ নয়নে বারিধারা ভর করলো। ক্ষিপ্ত স্বরে বলল,
“আপনার ওই পিছলে যাওয়া জবানে এই শব্দটা উচ্চারণও করবেন না। আপনার জবান খনিকেই রং বদলায়। অন্তত কাউকে ভালো তো আপনি বাসতেই পারেন না। শুধু নিজেকে ভালোবাসতে পারেন। আপনার ভালোবাসা হচ্ছে চোখের মায়া!”
মীরার চোখে চোখ মেলাতে পারল না বর্ণ। নত মস্তকে মিনতি করে বলে,
“আমি একটা ভুল করে ফেলেছি। আসলে বুঝতে পারিনি। ওখানে গিয়ে আমি টোটালি একা হয়ে পড়েছিলাম, তারপর মিটুসুকোর সাথে পরিচয়। তারপর….”
“থামুন। আপনার প্রেমকাহিনী শুনতে চেয়েছি আমি? আপনি আপনার লাইফে কী করবেন না করবেন আপনার ব্যাপার। আমাকে আর সেসবে দয়া করে টানবেন না। একবার যখন রাস্তা আলাদা হয়েছে, তো হয়েছেই।”
বর্ণ করুণ দৃষ্টিতে চাইলো কিন্তু মীরা সেটাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। বর্ণ ফের বলল,
“শুনলাম বিয়ে করছ?”
মীরা জবাব দিতে না চাইলেও দিলো। কারণ বর্ণকে বোঝাতে হবে সে অতীতে আটকে নেই।
“হ্যাঁ।”
“শেহজাদ স্যারকে?”
মীরা কপাল কুঁচকে তাকালো। ফের বলল,
“সব তো তবেই জেনেই এসেছেন। তাহলে প্রশ্ন করে নিজের ও আমার সময় নষ্ট করছেন কেন?”
“মীরা, উনি তোমার স্যার হয়।”
“হুম তো?”
“মীরা, উনার একটা বাচ্চাও আছে। পাঁচ বছরের।”
বর্ণ যতটা বিস্ময় নিয়ে কথাটা বলেছে, মীরা ঠিক ততোটাই সরল কণ্ঠে জবাব দিলো।
“হ্যাঁ জানিতো।”
“তুমি তাও বিয়ে করবে?”
“আমি তো বাচ্চাটার জন্যই বিয়ে করছি। সো প্লিজ, এভাবে বাচ্চা আছে বলে ভয় দেখানোর কোনো মানেই হয় না।”
“ওকে ফাইন। তুমি বাচ্চার জন্য বিয়ে করছ তো? তাহলে প্লিজ আমার লাইফে ব্যাক করো। আমার বাচ্চা তো আরও ছোটো। মাত্র ছয় মাস। ওর মা ও-কে ছেড়ে চলে গেছে।”
মীরার মুখশ্রী তৎক্ষণাৎ কঠোরে রূপ নিলো। এতক্ষণ কিছুটা হলেও শান্ত হয়ে বিতৃষ্ণা নিয়ে জবাব দিচ্ছিলো। কিন্তু এবারে! চোখ বন্ধ করে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণে এনে বলে,
“আপনার মতো গি*র*গি*টির কাছে ফিরব আমি? স্বপ্নেও না। আমার তো মনে হয়, আপনার স্ত্রীও আপনার ফিদরত বুঝে গেছে। আপনার সুন্দর মুখশ্রী ও যত্নশীল ব্যবহারের আড়ালে লুকানো মানুষটাকে চিনে গেছে। আপনার মনে আছে? আপনি কী কী করতেন? কতোটা পজেসিভ, কেয়ারিং ছিলেন আমার প্রতি! তখন যে কেউ দেখলে বলতো, এমন ভালোবাসা বিরল। আমি তো এতেই আটকে গিয়েছিলাম। যেই বর্ণ আমাকে সামান্যতম স্যাড ফেইসে দেখতে পারতো না, সেই বর্ণ আমাকে দুঃখের সাগরে ধা*ক্কা দিয়ে নিজে সুখে থাকতে চলে গেছিল। ভুলিনি আমি। শিক্ষা হয়েছে। আমি কিন্তু আপনাকে তখনও কোনো অভিযোগ করে কাঠগড়াতে দাঁড়া করাইনি। সবসময় চঞ্চল আমি, শুধু নিরব হয়েছি। ভালোবাসতে শিখিয়েছিলেনও আপনি, সেটাকে ভেঙেছেনও আপনি। আমি কোথায়? শুধু তাল মিলিয়েছিলাম। সেসময় কোনো মেয়ে আপনার ডেস্পারেট ভালোবাসাতে তাল না মিলিয়ে থাকতে পারতো বলে আমার মনে হয় না। কারণ মেয়েরা তেমন লাইফ পার্টনারই তো চায়। আমার সব শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। আমি গতানুগতিক রিলেশন চাইনি, তাও মেনে নিয়েছিলেন। আমি অসুস্থ হলে রাত-বিরেতে হোস্টেলের বাহিরে এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন মনে আছে?
এখন বুঝতে পারছেন? কতোটা গভীর ভাবে আপনি আমায় ভেঙেছেন? যার প্রতিক্রিয়াতে আমি নিরবতা বেছে নিয়েছি।”
“মীরা, অ্যাই অ্যাম সরি। প্লিজ মীরা। একটা সুযোগ দাও। আমি কখোনো তোমাকে কষ্ট দিবো না।”
মীরার মাথার নিউরন গুলো ধপধপ করছে। তার ক্লাসের আর ১০ মিনিট আছে। কলিগের ক্লাসের সময় শেষ। এখনি হয়তো চলে আসবেন। মীরা অনুনয় করে বলল,
“প্লিজ, চলে যান। আমাকে আমার মতো ছেড়ে দিন। খুব খুব ভালো আছি আমি। আজ আপনার প্রস্তাবে রাজি হলে, আমি এটুকুও ভালো থাকব না। যেই আমি চোখ বন্ধ করে আপনাকে ট্রাস্ট করতাম, সেই আমি আপনাকে বিন্দু পরিমানও ট্রাস্ট করতে পারব না। এর কষ্ট বোঝেন? আমি হাত জোড় করে অনুরোধ করছি। আপনার জন্য দোয়া করব যেন সত্যি সত্যি কাউকে মৃত্যু পর্যন্ত আগলে রাখার মতো ভালোবাসতে পারেন এবং তার থেকেও তেমন অপার ভালোবাসা পান। সেই কেউ টা আমি নই, বর্ণ!”
বর্ণ একদৃষ্টিতে মীরার পানে চেয়ে থেকে শান্ত কণ্ঠে বলে,
“একটা রিকুয়েস্ট রাখবে?”
“বলুন।”
“একটা গান গাও না। শুধু একবার। লাস্টবার। আমি চলে যাব। আর আসব না।”
মীরা কয়েক সেকেন্ড নিরুত্তর চেয়ে থেকে একটা গানের কলি ধরলো,
“কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
কেন মেঘ আসে হৃদয় আকাশে,
তোমারে দেখিতে দেয় না।
মোহ মেঘে তোমারে দেখিতে দেয় না,
মোহ মেঘে তোমারে অন্ধ করে রাখে
তোমারে দেখিতে দেয় না,”
“গাইলাম। এবার প্লিজ… আমার কলিগ চলে আসবে।’
বর্ণ উঠে দাঁড়ালো। মলিন হেসে বলল,
“ভালো থেকো, মীরু। আমার মতো ভাঙতে তোমার জীবনে কেউ না আসুক।”
মীরা মুচকি হাসলো। বর্ণও দরজা খুলে বেরোবে তখনি মীরার কলিগ কনক ম্যাম রুমে প্রবেশ করলেন। অফিস রুমে অপরিচিত পুরুষকে দেখে মীরাকে প্রশ্ন করলেন,
“মীরা, কে উনি?”
মীরা ততক্ষণে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিয়েছে। কৃতিম হেসে বলে,
“আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। আমরা সেম ফ্যাকাল্টির আন্ডারে রিসার্চ করেছি। ভাইয়া, কয়েকদিন আগে জাপান থেকে ছুটিতে এসেছেন। ওখানে পিএইচডি করছেন তো। যখন শুনলেন আমি এখানে জয়েন করেছি, তখন দেখা করতে আসলেন।”
“ওহ আচ্ছা। পিএইচডি করে কি দেশে ফিরবেন?”
(বর্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন)
বর্ণ কৃতিম হেসে প্রত্যুত্তর করে,
“এখনও শিউর না। দেখি জীবন কোথায় নিয়ে যায়।”
“বেস্ট অফ লাক। ভালো থাকবেন।”
বর্ণ এরপর সৌজন্য দেখিয়ে চলে যায়। মীরাও নিজের ক্লাসে যাওয়ার জন্য সব গুছিয়ে নেয়। মাথাব্যাথার দ্রুত কার্যকরের একটা টা*ফ-নিল খেয়ে নিলো। অতঃপর ক্লাসের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে যায়।
_________
শেহজাদ নিজের অফিস রুমে বসে পিসিতে কিছু কাজ করছে। হঠাৎ হোয়াটসএপে মেসেজ আসে। মেসেজ টোন বেজে উঠলে হাতের কাজটা শেষ করে চেক করে। অপরিচিত নাম্বার থেকে মেসেজ। সেখানে কিছু স্ক্রিনশট। কারও কথোপকথনের স্ক্রিনশট। শেহজাদ খুলে দেখলো না। ফোন সাইলেন্ট করে ক্লাসের জন্য চলে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৬
ক্লাস থেকে ফিরে শেহজাদ, ফোন চেক করে দেখলো ওই একই নাম্বার থেকে কিছু মেসেজও। মেসেজগুলোতে নিজেকে শুভাকাঙ্ক্ষী বলে সম্ভোধিত। খানিক কৌতুহলের বসেই শেহজাদ স্ক্রিনশট গুলো চেক করলো। চেক করে বুঝলো মীরার সাথে কারও কনভার্সেশন। এতে মীরার চরিত্রে দা*গ লাগবে এমন কিছু। শেহজাদ সবগুলো পড়লো। অতঃপর কিঞ্চিত ভেবে সবগুলো ছবি মীরাকে ফরোয়ার্ড করে দিলো। মীরারও তখন ক্লাস ব্রেক। লাঞ্চ বক্স বের করেছে সবে। রুমে তার কলিগ কনক ম্যাম নেই। উনার এখন ক্লাস। আরেক কলিগ সাবিহা ম্যাম আছেন। মীরা, সাবিহা ম্যামের সাথে টুকটাক কথা ও হাসি বিনিময় করে বক্স খুলেছে খাবে তখনি মোবাইলে টুং শব্দ হয়। স্ক্রিণে শেহজাদের মেসেজ ভেসে উঠতে দেখে কিঞ্চিত চিন্তিত হয়। শেহজাদ স্যার তো তাকে মেসেজ করে না। রাতের বেলা শুধু ফ্রিশার সাথে কথা বলার জন্য কল করে। মীরা বক্সটা বন্ধ করে মেসেজটা আগে দেখে। সবগুলো স্ক্রিনশট দেখে তার চক্ষু চড়কগাছ! কারণ মেসেজ গুলোর ৬০% এডিটেড। এসব রাদিবের সাথে মেসেজিং। মীরা বিহ্বল দৃষ্টিতে মোবাইলের স্ক্রিণের পানে নিরন্তর চেয়ে রইল। সাবিহা ফোনে একটা নিউজ দেখে মীরাকে মৃদু স্বরে ডেকেও সাড়া না পেয়ে উঠে আসে। সাবিহা, মীরার কাঁধে হাত রাখলে মীরা চমকে উঠে। আকস্মিক মীরাকে হকচকিয়ে উঠতে দেখে সাবিহা সন্দিহান হয়ে শুধায়,
“কী হলো? হোয়াই আর ইউ স্কেয়ার্ড?”
মীরা দ্রুত নিজেকে সামলে বলে,
“নাথিং। আমি একটু বাহিরে থেকে আসছি।”
“খাবে না?”
“তুমি খেয়ে নাও। আমার একটা ইম্পরট্যান্ট কল করতে হবে।”
“ওকে।”
মীরা রুম থেকে বেরিয়ে লিফটে উঠলো। অতঃপর ছাদে গেল। সেখানে গিয়ে খানিক ফাঁকা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে শেহজাদকে কল লাগায়। শেহজাদও ফ্রি ছিল। সে রিসিভ করতেই মীরা সালাম দিয়ে বিরামহীন বলতে লাগে,
“দেখুন স্যার, ওসব মেসেজিং, স্ক্রিনশট সব এডিটেড। আমার নরমাল কথা-বার্তাকে এভাবে এডিট করেছে। ইয়েস, অ্যাই এগ্রি, রাদিব নামের লোকটার সাথে আমার পরিচয় ছিল। এমনকি কথাও হতো। লেট নাইট কথাও হতো। সে নিজেই কল করতো, নিজেই নক করতো। আমি বাধ্য হয়ে কথা বলতাম কারণ তার সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু সে আমার মেসেজ গুলোকে যেভাবে এডিট করেছে সেসব কিছুই না। আপনি চাইলে নিজে আমার হোয়াটসআপ চেক করতে পারেন।”
শেহজাদ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে হালকা হাসে। মীরার অস্থিরতা সম্পর্কে তার ধারনা আছে। নিজের সম্পর্কে মিথ্যা কিছু জানতে পারলে সে অস্থির হয়। আরও অনেক কিছুতে সে অস্থির হয়। শেহজাদ বলে,
“রিল্যাক্স। আজ দেখা করে সব ক্লিয়ার করা যাবে। হাইপার হওয়ার কিছু নেই।”
মীরা চোখ বন্ধ করে অস্বস্তিকর নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। তারপর আকাশের পানে চেয়ে বলে,
“থ্যাংক ইউ স্যার। কোথায় দেখা করব?”
“ওয়েলকাম। ভার্সিটি শেষে সেদিনকার সেম রেস্টুরেন্টে।”
“ওকে স্যার।”
মীরা কল কেটে ছাদে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে রাদিবের মেসেজ গুলো দেখে তাচ্ছিল্য হাসলো। এই রাদিব তার পেছনে আঠার মতো পড়েছে তো পড়েছেই!
________
রেস্টুরেন্টে মুখোমুখি বসে আছে শেহজাদ ও মীরা। খাবার অর্ডার করা হয়েছে। শেহজাদ লক্ষ্য করলো মীরা কেমন উদাসীন। সে জিজ্ঞাসা করে,
“হোয়াট হ্যাপেন্ড, মীরা?”
মীরা পূর্ণদৃষ্টিতে তাকালো। তার সামনে বসে থাকা ব্যাক্তিটিকে নিগূঢ় দৃষ্টিতে অবলোকন করে ভাবতে লাগলো, এই লোকটা তাকে বিশ্বাস করেছে। তার মুখের কথাতেই মেনে নিয়েছে। একটা সম্পর্কে বিশ্বাসটাই মূল ভিত্তি। পরক্ষণেই তার মনে পড়লো, বর্ণও তো তাকে বিশ্বাস করতো! এবং বিশ্বাসটা তো বর্ণ নিজেই ভেঙেছে। এসব মনে পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো মীরা। তারপর বলল,
“আপনি নিজে আমার হোয়াটসআপ চেক করে দেখুন।’
“ইটস নট নিডেড, মীরা। অ্যাই ট্রাস্ট ইউ।”
নিজের অজান্তেই ঈষৎ কেঁপে উঠলো মীরা। শেষ তিনটা শব্দ অতি সাধারণ হলেও এর তীব্রতা বেশ অসাধারণ। মীরা টেবিলে রাখা পানির বোতল থেকে এক ঢোক পানি খেয়ে বলে,
“প্লিজ স্যার। অ্যাই ইনসিস্ট। আপনি চেক করলে আমি শান্তি পাব।”
শেহজাদ ঈষৎ শব্দ করে হাসলো। তারপর বলল,
“মীরা, তোমার মনে আছে? একবার তুমি আমার সাবজেক্টের মিড পরীক্ষাতে নাম্বার কম পেয়েছিলে? আসলে ওটা আমার টিএ এর গোনায় ভুল ছিল। তোমার ৪ নাম্বার বেড়েছিল। তুমি এসে বলাতে আমি চেক না করেই নাম্বার বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু নাম্বার বাড়ানোর পরেও তুমি যাচ্ছিলে না। কারণ, আমি চেক করিনি। অস্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলে। বারবার বলছিলে চেক করে দেখতে। আমিও বারবার বলছিলাম, ইটস নট নিডেড। বাট ইউ আর সো স্টাবর্ন। আফটার দ্যাট, অ্যাই চেইকড ইট। আমি কিন্তু জানতাম তুমি অতো কম মার্কস পাবে না। খাতা তো আমিই চেক করেছিলাম।”
মীরা লাজুক হাসলো। শেহজাদ মীরার ফোন নিয়ে রাদিবের সাথে মেসেজ গুলো চেক করলো। পাশাপাশি রাদিবের মেসেজ এডিট করার কারণটা মীরা তাকে বলতে লাগলো। সব শুনে শেহজাদ বুঝলো রাদিব মীরাকে নিচু করতে চায়। সে ফের শুধালো,
“রাদিব বলল, তুমি আজ বর্ণর সাথে দেখা করেছ। বর্ণ দেশে ফিরেছে?”
অবাক হয় মীরা। বর্ণর দেশে আসার কথা রাদিব কীভাবে জানলো? আর আজ দেখা হয়েছে সেটাই বা কীভাবে? মীরা বলল,
“জি স্যার। বর্ণ কিছুদিন আগেই দেশে ফিরেছে। বৃহস্পতিবার রাত থেকে সে বিভিন্ন নাম্বার থেকে বারবার আমাকে কল করছিল। আমি ব্লক করতে করতে পরে সিমকার্ডটাই খুলে ফেলেছি। আজ তো ভার্সিটিতে চলে এসেছিল। তারপর সবকিছু ভালো ভাবে শেষ করে তাকে বিদায় জানিয়েছি। কিন্তু এগুলো রাদিব কীভাবে জানে?”
“দ্যাটস মাই কোশ্চেন। মেবি বর্ণর হঠাৎ দেশে আসাতেও রাদিবের হাত আছে। ইউ শুড আস্ক হিম।”
“বর্ণকে?”
“ইয়াহ।”
মীরা বর্ণর নাম্বারের ব্লক খুলে কল করলো। প্রথমবার রিং হতেই বর্ণ রিসিভ করে খুশিমনে বলতে শুরু করে,
“মীরা, তুমি কল করেছ? তুমি আমাকে….”
মাঝপথেই থামায় মীরা। ফোন লাউডে দেওয়া। বর্ণর সব কথা শেহজাদও শুনতে পাবে। মীরা প্রশ্ন ছুড়ে,
“আপনি রাদিবকে চিনেন?”
বর্ণ হতাশ হয়। অতঃপর মলিন স্বরে উত্তর করে,
“হুম। ওয়ান উইক এগো, হি নকড মি। অ্যাই ডোন্ট নো, হাউ হি নো মি এন্ড ম্যানেজ মাই ফেসবুক একাউন্ট। হি ইন্ট্রোডিউস হিম এজ মাই ওয়েল উইশার এন্ড হি টোল্ড মি দ্যাট ইউ আর ম্যারিং শেহজাদ স্যার।”
মীরা শেহজাদের দিকে তাকায়। শেহজাদও তাকায়। মীরা বর্ণের উদ্দেশ্যে বলে,
“রাদিবের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছিল। কিন্তু তার কুকীর্তি আমার সামনে চলে আসাতে, আমি বিয়েটা ভেঙে দিয়েছি। তারপর থেকে সে নানাভাবে চেষ্টা করছে আমার ক্ষতি করতে। আমার ফ্যামিলির কাছে এসেও আমার নামে মিথ্যা কথা রটিয়ে গিয়েছিল। স্টে এওয়ে ফর্ম হিম। ইট উইল বি বেটার ফর ইউ। গুড লাক, বর্ণ!”
বর্ণকে কোন প্রত্যুত্তর করার সুযোগ না দিয়ে মীরা কল কেটে দেয়। বর্ণ কিছু বলতে চাচ্ছিলো। কল কেটে যাওয়াতে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যালকনির ইজিচেয়ারা শরীর এলিয়ে দেয়।
মীরা শেহজাদকে বলে,
“সব ক্লিয়ার, স্যার। রাদিব আমাকে খারাপ প্রুভ করতে চাইছে।”
“এর ব্যবস্থাও করা হবে। মানহা*নি করতে চেয়েছে সে। রিল্যাক্স। এখন খাবার চলে আসবে। গরম গরম খেয়ে নাউ।”
মীরা স্বস্তির হাসি হাসে, সাথে শেহজাদও।
________
বাড়ি ফিরে মীরা আরেক দফা অবাক হয়। তার ঘরে ফ্রিশা ঘুমিয়ে আছে। মীরা অবাক হয়ে তার বড়ো ভাবিকে ডাকে। মীরার ডাকে ফ্রিশা কিঞ্চিত নড়ে ওঠে। শারমিন এসে বলে,
“আস্তে কথা বলো। ফ্রিশা গাড়িতেই ঘুমিয়ে গিয়েছিল। তোমার ভাই ও-কে কোলে করে এনে শুইয়ে দিয়েছে।”
ভাবির কথা যেন মীরার মাথার উপর দিয়ে গিয়েছে। সে সন্দিগ্ধ প্রশ্ন ছুড়ে।
“ভাইয়া, ফ্রিশাকে নিয়ে এসেছে মানে?”
এর জবাব দিলো মিসেস শাহিদা রেহমান। তিনি এসে হাসি মুখে বলেন,
“হঠাৎই আমার কাছে ফোন আসলো, আমি যেন ফ্রিশাকে নিয়ে জলদি তোমাদের বাসায় চলে আসি। আমিও তাই করলাম। গাড়িতে আসতে আসতে ফ্রিশা ঘুমিয়ে গেছে।”
মীরা মিসেস শাহিদাকে দেখে ও তার কথা শুনে আরো অবাক হয়। সে সালাম দিয়ে ফের শুধায়,
“আমি বুঝতে পারিনি, আন্টি। কিছু হয়েছে?”
নিধি এসে হাস্যজ্জ্বল কন্ঠে বলে,
“হবে গো ননদিনী। যাও জলদি এই লাল শাড়িখানা পড়ে আসোতো (হাতে তার লাল জামদানী শাড়ি)।”
হঠাৎ কী হচ্ছে মীরা বুঝতে পারছে না। এতো রাতে শাড়িই বা পড়বে কেন? আর ফ্রিশা ও মিসেস শাহিদাই বা কেন এসেছে? মীরার মনে প্রশ্নদের অস্থির পদচারণা। মীরাকে এভাবে প্রশ্নাত্মক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে শারমিন হেসে বলে,
“তোমার এইনগেজমেন্ট হবে আজ।”
চমকে উঠে মীরা! বিস্ময়ে কিয়ৎক্ষণ বাকরুদ্ধ থাকে। ফের হড়বড়িয়ে শুধায়,
“আজ! মানে এটা কখন সিদ্ধান্ত হলো? আমি তো কিছুই জানতাম না। শুক্রবার না বলা হয়েছিল?”
“বলা হয়েছিল কিন্তু তোমার মেয়ের বাবা ঘণ্টা খানেক আগে কল করে বলল যেন আমরা এখানে আসি। সে ও তার ফুফা একসাথে আসবে।”
মিসেস শাহিদার কথাগুলো মীরা মিলাতে পারলো না। ঘণ্টা খানেক আগেই তো ফ্রিশার বাবা মানে শেহজাদ স্যার তাকে উবার ডেকে উঠিয়ে দিলো। বলেছিল, আজ কাজ আছে বলে এগিয়ে দিতে পারছে না! তাহলে এখন? এসব সে কী শুনছে? ধীরে বিছানায় বসলো সে। পাশ ফিরে ঘুমন্ত ফ্রিশাকে দেখলো। তার বিছানায় এক প*রীর বাচ্চা আদুরে ভঙ্গিতে ঘুমিয়ে আছে। মীরা পলকহীন বাচ্চাটার দিকে চেয়ে থাকলো। আচমকা তার মস্তিষ্ক তাকে জানান দিলো, মিসেস শাহিদা শেহজাদকে “তোমার মেয়ের বাবা” বলে সম্বোধন করেছে। তৎক্ষণাৎ তার লোমকূপ পর্যন্ত কেঁপে উঠলো। হৃদযন্ত্র তার স্বাভাবিকের তুলনায় কিছুটা বেশি পাম্প করছে। দ্রুত নিজেকে সামলাতে উঠে গিয়ে বেড সাইড টেবিলে রাখা পানির বোটল থেকে পানি পান করে।
মীরার এই অস্থির অবস্থা দেখে মিসেস শাহিদা, শারমিন, নিধি মুচকি হাসছে। পেছনে সদ্য আসা মীরার মা মিসেস মলি জাহান নিজ ওড়নার কোনা দিয়ে খুশিমিশ্রিত অশ্রুজল মোছেন।
চলবে ইনশাআল্লাহ,