মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া পর্ব-১৩+১৪

0
625

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৩
নতুন দ্বীপশিখা প্রজ্জ্বলিত হতে শুধু কিছু ধাপ বাকি। বৈঠকের সবার উৎসুক দৃষ্টি মীরার উপর নিবদ্ধ। মীরা এতে যেন দোটানার সাথে অস্বস্তিতেও পড়ে গেছে। কিছুক্ষণ আগেই সে, ড: আকবর রেহমানের সাথে ফোনে কথা বলেছে। জেনেছে, শেহজাদ স্যার মীরার বিষয়ে জানেনা। মীরা তখন অবাক হয়েছিল কিন্তু পরে জানতে পারলো, মেয়ে দেখেছে জানে কিন্তু মেয়েটা কে তা জানেনা। এগুলো রোমন্থন করে মীরার অস্বস্তি লাগছে। শেহজাদ স্যার কী ভাববে তার ব্যাপারে? কেমন এক গুমোট অনুভূতিরা লতার মতো তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে ধরেছে। মীরার বাবা ফের শুধালেন,

“তোমার মতামত বলো। আমার ও তোমার মায়ের আপত্তি নেই। আমি বিশ্বাস করি, তুমি তোমার মায়ের মতোই কোমল।”

মীরা ভেবে চিন্তে সময় নিয়ে বলল,
“ফ্রিশার মা হতে আমার আপত্তি নেই। ও অন্যান্য বাচ্চাদের তুলনায় আলাদা। কিন্তু ওর বাবা! উনি আমার স্যার। আমাদের দুজনের জন্যই ব্যাপারটা অস্বস্তিকর। আমি স্যারের সাথে কথা বলব। উনি যা ভালো মনে করেন। আমি আমার মায়ের অন্য কোনো দিক পেয়েছি কী-না জানিনা কিন্তু এক মা-হারা সন্তানকে আগলানোর গুণ ঠিকই পেয়েছি।”

মীরার বড়ো ভাই মলিন হাসলো। মীরার মা তার আপন মা না। সৎ মা! সম্পর্কে খালাও হয়। রুবেলের যখন তিন বছর বয়স তখন তার জন্মদাত্রী মায়ের আচমকা স্ট্রোকে মৃত্যু হয়েছিল। তারপর কিছুদিন পর তার নানা-নানি নিজেদের নাতির কথা ভেবে তাদের ছোটো মেয়ের সাথে বড়ো মেয়ের স্বামীর আবার বিয়ে দেন। মলি জাহান, রুবেলকে কখোনো নিজের ছেলের চেয়ে কম মনে করেননি। মলি জাহান মীরার পাশে এসে বসলেন। অতঃপর মাথায় হাত রেখে স্নেহের স্বরে বললেন,

“অন্যান্য বাবা-মায়েরা, কখোনো চান না তাদের আদরের মেয়েকে বাচ্চা আছে এমন লোকের সাখে বিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা এখন চাইছি। তোর বড়ো ভাই তো, ভার্সিটিতে গিয়ে তোর ডিপার্টমেন্টের কিছু স্টুডেন্টদের থেকে কৌশলে খবরও নিয়ে এসেছে। তোর স্যার অনেক ভালো মনের মানুষ। তুই বিয়ে করতে রাজি না হলে হয়তো উনারা অন্য কোথাও খুঁজবে। কিন্তু যদি সেই অন্য মেয়ে, ফ্রিশাকে ভালোবাসতে না পারে? আমার তোর উপর ভরসা আছে। কেন জানি বাচ্চাটাকে প্রথমবার দেখেই খুব মায়া কাজ করছিল। ভেবেছিলাম হয়তো মায়ের আদরে বাচ্চাটা এত মায়াবি, এত সুন্দর, এত মিষ্টি। কিন্তু যখন মিসেস শাহিদা বললেন, ওর মা নেই। বুকটা ভীষণ ভার হয়ে গিয়েছিল।”

মীরা অপলক তার মায়ের মুখের আদলে চেয়ে আছে। তার খারাপও লাগছে কারণ মাঝে সে এই মায়ের, বাবার উপরই খুব অভিমান করেছিল। মীরা বুঝতে পারে, উনাদের দিক দিয়ে উনারা ঠিক। ভুল যদি কেউ হয় সেটা যারা ক্ষতি করতে চায় এবং পরিস্থিতি। মীরা হুট করে মৃদু হেসে মাকে জড়িয়ে ধরে। তারপর বলে,
“অ্যাই অ্যাম লাকি টু হ্যাভ ইউ গাইজ।”

রুবেল ও মারুফ, তাদের মায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়ে পাশ থেকে আগলে নেয়। রফিক তালুকদার পাশ ফিরে কনিষ্ঠ আঙুলির দ্বারা নেত্রকোনে জমে উঠা জলবিন্দুদের মুছে নেয়। শারমিন ও নিধি একে-অপরের দিকে চেয়ে মুচকি হাসে।

________

শেহজাদ একটা রেস্টুরেন্টে বসে আছে। বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত ক্লাস নিয়ে সে বেরিয়েছিল। এখন ঘড়িতে পাঁচটা বিশ বাজে। বসে বসে সে বারবার হাতঘড়িতে সময় দেখছে। তার হাবভাবে দেখে মনে হচ্ছে যেন সে ঘণ্টা যাবত কারও জন্য অস্থির হয়ে অপেক্ষা করছে। কিন্তু বাস্তবে কিন্তু তা না। মিনিট দশেক হয়েছে এসেছে। বাহিরে তুমুল বৃষ্টি। গাড়ি থেকে নামতেই সে খানিক ভিজেছে। এখন এসির বাতাসে টেনেও গেছে। তার অস্থিরতার কারণ হচ্ছে যার সাথে দেখা করতে এসেছে সে। শেহজাদের অস্থিরতা দেখে ওয়েটার দ্বিতীয় দফায় আসলো।

“স্যার, কিছু অর্ডার করবেন? চা অর কফি?”

শেহজাদ ভাবলো। তারপর বলল,
“ইয়াহ। ওয়ান কাপ অফ স্ট্রং কফি উইথ লেস সুগার।”

ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যায়। শেহজাদ ফের দরজার দিকে এবং ঘড়ি দেখছে। ফোনটাও চেক করছে।

এদিকে মীরা অনেকটা সময় উবারের জন্য অপেক্ষা করে একটু আগে উবারে উঠেছে। বৃষ্টির কারনে রাস্তায় জ্যাম। বৈশাখ মাসে তেমন একটা বৃষ্টি না হলেও দুইদিন যাবত হচ্ছে। গতকাল খুব অল্প হয়েছিল। আজও দুপুর অবধি আকাশ রোদে ঝলমল করছিল। হুট করে বৃষ্টি নামলো। লাগাতার আধাঘণ্টা যাবত বৃষ্টি হচ্ছে। জামা ও পাজামার নিচের অংশ একটু ভেজা। গুগোল ম্যাপে দেখল, আর পাঁচ মিনিট লাগবে গন্তব্যে পৌঁছাতে। আজ তার ভার্সিটিতে ক্লাস নেওয়ার তৃতীয় দিন ছিল। নতুন নতুন চাকরির পরিবেশ। আবার যাচ্ছেও নিজের ইউনিভার্সিটির টিচারের সাথে দেখা করতে। অস্বস্তির পারদ সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে গেছে। মীরা দেখল জ্যাম ছুটেছে। আর পাঁচ মিনিটে পৌঁছে যাবে। সেখানে গিয়ে কী কী বলবে, মনে মনে তারই হিসাব কষে নিচ্ছে।

শেহজাদ কফি শেষ করে ওয়েটারকে ডেকে কফির বিলটা দিয়ে দিল। কারও জন্য অপেক্ষা করার মধ্যে কিছু খেয়েছে তা না বুঝানোই ভালো। মীরা রেস্টুরেন্টের কাচের দরজা খুলে ঢুকলো। হন্তদন্ত হয়ে ঢোকার কারণে দরজার সাথের চেয়ারের সাথে পায়ের কনিষ্ঠ আঙুলে লেগে গেছে। চোখ-মুখ খিঁচে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়ালো তারপর ব্যাথাতুর নিঃশ্বাস ছেড়ে সামনে অগ্রসর হলো। শেহজাদ চেয়ারের শব্দেই সেদিকে তাকিয়েছিল। তারপর মীরা এদিকে আসতেই টেবিলের দিকে নজর ফেরালো। মীরা এসেই প্রথমে সালাম দেয়। শেহজাদও সালামের উত্তর দিয়ে জোরপূর্বক হাসে। দুজনেরই ওষ্ঠকোণে কৃতিম হাসি। মীরা বলল,

“এক্সট্রেমলি সরি, স্যার। হঠাৎ বৃষ্টি তারউপর জ্যামে আটকা পড়ে লেইট হয়ে গেছে।”
“ইটস অকে। কফি?”
“হ্যাঁ?”
“কফি নিবে?”
মীরা প্রথমে বুঝতে পারেনি। যখন বুঝলো সে বোকার মতো প্রশ্ন করেছে তখন ভীষণ লজ্জিত হলো। কিন্তু তার কফি পান করতে ইচ্ছে করছে না। ভার্সিটিতে সকাল থেকে তিন কাপ কফি সে অলরেডি খেয়েছে। তাই ইতস্তত করে বলল,

“চা হলে ভালো হতো। কফিও চলবে।”

শেহজাদ ওয়েটারকে ডেকে দুই কাপ চা সাথে চিকেন কর্ন সূপ ও চিকেন মাশরুম সালাদ অর্ডার করলো। মীরা কোলের উপর দুই হাত চেপে বসে আছে। এতক্ষণ যা প্র্যাকটিস করছিল, এখন সব ভুলে গেছে। শেহজাদ মীরাকে দেখে বুঝলো, মীরা অস্বস্তিতে আছে। নিজেই শুধালো,

“স্যার ও ফুফিজান আমাকে সব বলেছে। আমি নিজেও বিয়ে করতে চাইনি। ইভেন আমি তোমার ব্যাপারে থ্রি ডেইস হলো জেনেছি। রিসেন্টলি ফ্রিশাকে প্রতিমাসের রুটিন চেকআপ করার পর ভার্সিটিরই এক সাইকোলজিস্টের কনসাল্ট করেছিলাম। উনার সাজেশনে বেসিক্যালি আমি বিয়েতে মত দিয়েছি। বাট স্যার যে তোমাকে চুজ করেছে জানতাম না। স্যার বলল, ফ্রিশা তোমাকে অনেক পছন্দ করে। ফ্রিশাও বলেছে। বাট ইউ হ্যাভ চয়েজ। ইফ ইউ ওয়ান্ট দেন…!”

মীরা নিজের শুষ্ক ঠোঁট জোড়াকে জিহ্বার সাহায্যে অতি সন্তপর্ণে ভিজিয়ে নিয়ে মৃদু কণ্ঠে বলে,
“আমার অন্য কোথাও চয়েজ নেই। ফ্রিশাকে আমার ফ্যামিলিও পছন্দ করেছে। আমার ফ্যামিলির এতে সায় আছে।”

শেহজাদ ঘাড় নাড়লো। ততক্ষণে ওদের অর্ডারকৃত খাবার চলে এসেছে। চা টা পরে আসবে। শেহজাদ ইশারায় মীরাকে নিতে বলল। খাওয়ার সময়টাতে দুজনে কথা বলল না। খেতে খেতে ওরা নিজেদের কথা গুছাচ্ছে। খাওয়া শেষে চা আসলে শেহজাদ শুধালো,

“ফ্রাস্ট টিচিং এক্সপেরিয়ান্স কেমন লাগছে?”
মীরা মৃদু হেসে বলে,
“কোয়াইট গুড। আপনাদের স্ট্রাগলটা বুঝতে পারছি।”

খানিক হাসির পরিবেশ সৃষ্টি হলো।
“তোমার রেজাল্ট তো অনেক ভালো দেখলাম। আমাদের ভার্সিটিতেও হতে পারতো। এজ অ্যা এক্স স্টুডেন্ট সিজিপিএ ৩.৮ হলেই এনাফ।”
“এখানে হওয়ার পর মনে মনে হলেও চেয়েছিলাম। কিন্তু এখন সার্কুলার ছিল না।”
“হুম। চাইলে পরেরবার ট্রাই করতে পারবে। এখন এক্সপেরিয়ান্স গেদার করো। নিজের ভার্সিটিতে টিচিং করা আরও চ্যালেঞ্জিং।”
“জি স্যার।”

কথা বলতে বলতে চা পান করাও শেষ। শেহজাদ বলে,
“ওকে চলো। সন্ধ্যা হয়ে আসবে। বৃষ্টিও থেমে গেছে।”
“জি স্যার।”

মীরা উবারে কল করতে চাইলে শেহজাদ বলে,
“উবার আসতে সময় লাগবে। এমনিতেও বৃষ্টি হয়েছে। আমি তোমাকে কিছুদূর ড্রপ করে দিচ্ছি।”
মীরা ফের দোটানাতে পড়লো। তাকে ভাবতে দেখে শেহজাদ ফের বলে,
“যেখানে বিয়ে হচ্ছে, সেখানে সামান্য ড্রপ করা নিয়ে না ভাবাই ভালো।”

এই কথার পর মীরার কি কিছু বলার থাকে? সে ইশারায় হ্যাঁ বলে শেহজাদের সাথে চলতে থাকে।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১৪
দুইদিন পর, মীরা ফ্রিশার সাথে ফোনে কথা বলছে। প্রায় ঘণ্টা খানেক হতে চলল তাদের কথোপকথন। তখন অন্য এক অচেনা নাম্বার থেকে বারবার বিরামহীন কল আসছে। মীরা তা দেখে বিরক্ত হয়ে আবার ফ্রিশার কথা বলছে। এদিকে ফ্রিশার চোখে ঘুম চলে এসেছে। কথন বলার এক পর্যায়ে তার কোনো আওয়াজ না পেয়ে মীরা হালকা হেসে ফোন রেখে দেয়। অতঃপর কফি বানাতে যায়। লাইট কফির সাথে মধু মিশিয়ে খেলে তার ঘুম ভালো হয়। ঘড়িতে এখন রাত এগারোটা। মীরার বড়ো ভাবি, খাবারগুলো ফ্রিজে রাখছে। সে মীরাকে বলে,

“মীরু, তোমার ভাইয়ার জিজ্ঞাসা করছিল, কাল তো শুক্রবার। তাহলে কথা বলে কালকেই আংটি বদল এগুলো হয়ে যাক। তারপর সামনের শুক্রবার বিয়ে…!”

মীরা কিঞ্চিত ভাবলো। জবাবে বলল,
“এখন না। এখন ভার্সিটিতে এড-ড্রপের কার্যক্রম চলছে। তারপর ক্লাস রিসিডিউলিং। এগুলো চলছে। আমার নিজেরও একটা ক্লাসের ক্লাস টাইম চেঞ্জ হয়েছে। আরও হয় কী-না! তাছাড়া আমি ফ্রিশার মনের কথাও বুঝতে চাই। আমার সাথে টাইম স্পেন্ড করতে পছন্দ করে বলেই যে মায়ের জায়গা দিয়ে দিবে, এমনটা তো না। হতেও পারে আন্টি হিসেবে পছন্দ করে। কিন্তু মায়ের জায়গাটা খুব সেনসিটিভ। এক সপ্তাহে যদি মনে হয়। তাহলেই বাকি সব। বিয়ের পরও কিন্তু দিনের ১০ ঘণ্টা আমি ওর সাথে থাকতে পারব না। এটাও তো বুঝতে হবে।”

“আচ্ছা। আমি তোমার ভাইকে বলব। এখন যে কফি খাচ্ছ, ঘুম হবে? তোমার তো কাল ছুটি।”

“তুমি তো জানোই, আমি মধু দিয়ে কফি খেলে ঘুম আরও ঝেঁকে আসে।”
“তা ঠিক। আচ্ছা খাও তবে। সিয়াম এখনও ঘুমাচ্ছে না। তোমার ভাইয়ের সাথে জেগে জেগে ফোন দেখছে।”

মীরা হাসলো। তারপর কফি করে নিজের ঘরে চলে আসলো। এসে দেখলো আবারও ফোন বাজছে। ওই একই অচেনা নাম্বার থেকে। মীরা ভাবলো, হয়তো কোনো স্টুডেন্ট। কিন্তু এত রাতে! ক্লাসে তো বলাই হয়েছে যে কোনো দরকার হলে অফিস আওয়ারে আসতে। আর যদি অফিস আওয়ারে আসতে না পারে তবে রাত আটটার আগে কল করতে। এখন বাজে এগারোটা। ফার্স্ট সেমিস্টারের স্টুডেন্টরাই এই কাজগুলো বেশি করে। মীরা ফোন রিসিভ করে সালাম দিয়ে প্রশ্ন করলো,

“কে বলছেন?”

অপরপাশ থেকে শোনালো,
“চিনতে পারছ না, মীরা?”

মীরার ভ্রুদ্বয় কুঁচকে এলো। সে সন্দিহান কণ্ঠে বলল,
“হেয়ালী না করে আপনার পরিচয় দিন। এত রাতে একটা মেয়েকে এতবার ফোন করাটা কোন ধরনের ভদ্রতা?”

“তিন বছরে ভুলে গেলে? এখন কণ্ঠও চিনতে পারছ না? ভালোই তো আপডেট হয়েছ! হ্যাঁ?”

মীরা থমকে যায়। তার শ্বাস-প্রশ্বাসের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় বেড়ে গেছে। ফোনটা হাতে নিয়ে আবার চেক করে দেখলো, বাংলাদেশি নাম্বারই। সে তবে বাংলাদেশে এসেছে? অপরপাশ থেকে আবারও শোনালো,

“মনে পড়েছে? নাকি ডিটেইলস ইনট্রো দিতে হবে? তুমি চাইলে দিতেই পারি, মীরু।”

চোখ বন্ধ করে দুই বার বড়ো করে শ্বাস নিয়ে ফের নিঃশ্বাস ছেড়ে কঠোর কণ্ঠে শুধালো,
“হঠাৎ আমাকে মনে পড়লো, ভাইয়া? এতোবার লাগাতার কল করেই যাচ্ছেন! ১২ বার! খুব জরুরী দরকার?”

“বাহ্ বেশ দরকারের কথা বলছ। যেন আমি তোমার অপরিচিত।”

“আমি কি বলেছি, আপনি আমার অপরিচিত? আপনি আমার ভার্সিটির সিনিয়র ভাই। অপরিচিত হতে যাবেন কেন?”

বর্ণ বাঁকা হাসলো। ফের শুধালো,
“শুধু এটুকুই? আর কিছু না?”

মীরা তাচ্ছিল্য হেসে খানিক অভিনয় ধরলো।
“এতটুকুই তো! আর কী থাকবে? আপনি বলুন, কেন কল করেছেন?”

বর্ণর কাছে জবাবটা মনঃপূত হলো না। সে জেনেছিল, মীরা মুভঅন করেছে। সামনে তার বিয়ে। কিন্তু মীরা তো খুব ইমোশনাল ফুল একটা মেয়ে। সে নিশ্চয়ই নিজের এক সময়ের ভালোবাসার মানুষটার কণ্ঠ শুনে আবেগে ভেসে যাবে! এমনটা আশা করেও আশাহত হলো বর্ণ। নিজের আকাঙ্ক্ষাকে খানিক দমন করার বৃথা চেষ্টা করে শুধালো,

“কেমন আছ?”

মীরার এবার স্বতঃস্ফূর্ত জবাব। সেই জবাবে নেই কোনো মলিনতা আর নেই কোনো ঠেকে যাওয়ার ভাব।
“আলহামদুলিল্লাহ্‌। অনেক ভালো আছি, ভাইয়া। আপনি কেমন আছেন?”

বর্ণ থতমত খেয়ে গেলো। সেও কি মীরার মতো এভাবে নির্দ্বিধায় বলতে পারবে? না পারবে না। কারণ সে ভালো নেই। গতকালই সে তার ছয় মাসের শিশুপুত্রকে নিয়ে জাপান থেকে এসেছে। আবার চলে যাবে।
এদিকে বর্ণকে চুপ থাকতে দেখে মীরা তাচ্ছিল্য হাসে। সে মনে মনে বলল, ‘বে*ই*মা*নরা সুখেই থাকে।’ কিন্তু মুখে বলল,

“ভাইয়া, কোনো কথা না থাকলে ফোনটা রাখব। অ্যাই অ্যাম সো টায়ার্ড।”

হুট করে বর্ণ বলে ফেলল,
“অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক, মীরা।”

হকচকাল মীরা। হঠাৎই নিজের কর্ণকুহরে প্রবেশ করা শব্দগুচ্ছ সে শুনেও এর গুরুত্ব ঠাওর করতে পারলো না। বিস্ময়ে হতবুদ্ধি হয়ে শুধালো,

“হোয়াট?”
“ইয়েস, অ্যাই ওয়ান্ট ইউ ব্যাক। প্লিজ মীরা।”
মীরা তৎক্ষণাৎ তেতে ওঠলো। ক্রোধে বিহ্বল হয়ে বলতে লাগলো,
“আর ইউ সি*ক? আর ইউ গন ম্যা*ড? হাউ কুড ইউ বি সো সেইমলেস?”

“দেখো মীরা, ভুল তো মানুষই করে। আমিও করেছি। আসলে আমি….!”

“স্টপ। নো মোর ওয়ার্ডস। আমাকে পুতুল পেয়েছেন না? যখন মন চাইবে খেলবেন, তারপর মন ভরে গেলে ছুড়ে ফেলে দিবেন। ফের আবার খেলতে ইচ্ছে হলে খেলবেন! শুনে রাখুন মিস্টার বর্ণ আহমেদ, এই মীরা কোনো পুতুল নয়। সে এখন আর তিন বছর আগের মীরা নয়। সে বদলেছে। আমূলে বদলেছে। এন্ড থ্যাংকস টু ইউ। আপনার কারণেই আমার এই সুন্দর বদল হয়েছে। ফারদার আমাকে কল করবেন না।”

“মীরা, প্লিজ শুনো… মীরা!”

মীরা এক মুহূর্তও অপেক্ষা না করে কল কে*টে নাম্বার ব্লক করে দেয়। এদিকে বর্ণ বার বার ট্রাই করেও মীরার নাম্বারে কল লাগাতে পারছে না। সে রেগে নিজের ফোনটা ছুড়ে ফেলে। এই শব্দে বর্ণর ছেলে বর্ষণের ঘুম ছুটে যায়। সে কেঁদে উঠলে বর্ণ বিরক্ত হয়ে নিজের মাকে ডাকে।

কল কেটে মীরা মুখ ঢেকে মাথা নিচু করে বসে আছে। না, সে কাঁদছে না। বরং আফসোস হচ্ছে। কষ্ট হচ্ছে। তার জীবনে আবারও কেন অতীতের ছায়া ধেয়ে আসছে? নিজের মত সবকিছু খুব সুন্দর করে গুছিয়েই তো নিয়েছিল। তার ক্যারিয়ার নিয়ে সব স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে। তার পরিবার খুশি। বিয়েও করতে চলেছে এক ভালো মনের মানুষকে। একটা ছোটো বাচ্চার মায়ের পরিচয় পেতে চলেছে। সে উপলব্ধি করলো, তার কপালের রগ গুলো ধপধপ করছে। মাথাব্যথা যে আবারও তাকে নিজের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে নিবে তা বুঝে ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার কফির সাথে একটা মাইল্ড ডো*জের স্লি*পিংপি-ল ও দুটো প্যা*রাসিটে*মল খেয়ে নিলো। টা*ফনি*ল তার পছন্দ না। কারণ টা*ফনি*লের অভ্যাস লেগে গেলে সেটার সাইড এ*ফেক্টও ভুগতে হবে। তারপর সে আলো নিভিয়ে মশারি দিয়ে শুয়ে পড়লো। নিজের ব্রেণকে বর্ণ সম্পর্কিত কিছুই চিন্তা করতে দিলো না।

__________

শেহজাদ, ফ্রিশাকে নিয়ে বাগানে কিছু ছোটো ছোটো চারা গাছ লাগাচ্ছে ও অন্যান্য গাছের মাটি ঠিক করে দিচ্ছে। কিছু ফুল ও ফলের গাছ নার্সারি থেকে কিনে এনেছে। গাছের যত্নের জন্য তাঁরা মালি রাখে না। টাইমপাস হিসেবে গার্ডেনিং বেশ ভালো একটা উপলক্ষ। কিছু গাছ ম*রে গেছিল, তাই সেসবের বিপ্লেসমেন্টে নতুন ও অন্যান্য গাছের চারা এনেছে। ফ্রিশা, পানির পাইপলাইনের ছোটো লিকেজের কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ দুষ্টমি করে শরীরে কাঁদা মাখিয়ে এসেছে। শেহজাদ খানিক রাগ দেখিয়ে ওকে ব*কে,

“তোমাকে নিষেধ করেছিলাম না? তাও ওখানে গিয়েছ কেন?”

“সরি বাবা। আমি তো পাইপের ফুঁটোটা বন্ধ করতে গিয়েছিলাম!”

শেহজাদ আর কী বলবে! ফ্রিশাকে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। মিসেস শাহিদা ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছিলেন। ফ্রিশার অবস্থা দেখে তিনিও রাগ করেন। অতঃপর ওকে ড্রেস চেঞ্জ করতে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলেন। সার্ভেন্টকে ডেকে বললেন ফ্রিশার নোংরা করা কাপড় গুলো পরিষ্কার করে দিতে। শেহজাদ নিজের ঘরের দিকে যেতে নিলে মিসেস শাহিদা ডাক দিলেন।

“শেহজাদ, মীরার ফ্যামিলি জানালো এইনগেজমেন্টের ব্যাপারটার সামনের শুক্রবার করতে। আজ বা কালকের কথা বলাতে মীরা নাকি ভার্সিটির কাজের জন্য পিছিয়েছে।”

“ঠিক আছে সমস্যা নেই। বাকিটা আপনারা বুঝে নিন।”

শেহজাদও ফ্রেশ হতে চলে যায়। বেলা বারোটা বেজে গেছে। নামাজে যেতে হবে।

__________

সারাদিন মীরা ফোনে ফ্লাইট মুড দিয়ে রেখেছিল। ওয়াইফাই অন ছিল তাই জরুরী কিছু থাকলে ইমেইল ও হোয়াটসএপে সেরে নিয়েছে। রাতে ফ্লাইট মুড অফ করতেই প্রায় ঘণ্টা খানেক পর আবারও আরেকটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসা শুরু। মীরা এবার আর ফোন তুলল না। ফের ব্লক করলো।
আজ রাতেও ফ্রিশার সাথে কথা বলছে মীরা। হঠাৎ ফ্রিশা জিজ্ঞাসা করে,

“ফেইরি আন্টি, তোমার মন খারাপ?”

“না তো। কেন বাচ্চা?”

“ঠিক মতো কথা বলছ না।”

শেহজাদ পাশেই বসা ছিল। মেয়ে তো তার ফোন দিয়েই কথা বলছে। সে বলল,
“ফ্রিশা, তুমি এখন ঘুমাতে যাও। কাল আবার কথা বলো। আন্টিরও মেবি ঘুম পাচ্ছে।”

ফ্রিশা তার বাবার কথা শুনে মীরাকে জিজ্ঞাসা করে,
“তোমার ঘুম পাচ্ছে, ফেইরি আন্টি?”

মীরা কী বলবে না বলবে ভেবে শেহজাদের সাথে হ্যাঁ মিলালো। বলল,
“সরি ফ্রিশামনি, আন্টির একটু মাথা ধরেছে। কাল গল্প করব হ্যাঁ?”

“ওকে। টেক রেস্ট, ফেইরি আন্টি। গুড নাইট।”
“গুড নাইট, ফ্রিশামনি।”

মীরা ফোন কে*টে সবার আগে সিমকার্ড খুলে ফেলল। তারপর ফোন বন্ধ করে রাখলো।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে