#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_১২
মীরার বাবা-মা ও ভাই-ভাবিরা স্তব্ধ হয়ে গেল। তারা একে-অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে। মীরার ছোটো ভাই মারুফ বলল,
“স্যার, আমি আপনাকে যথেষ্ঠ সম্মান করি। আপনার কাছে কি প্রস্তাবটা একটু অন্যরকম মনে হচ্ছে না?”
“প্রস্তাবটা অন্যরকম সেটা আমিও মানি। কারণ, অন্যকারও স্বামীর স্ত্রী হওয়া সহজ কিন্তু অন্যকারও বাচ্চার মা হওয়া সহজ না। মাকে মমতাময়ী হতে হয়। বাঙালি মেয়েরা নিজের সন্তানের প্রতি মমতাময়ী হলেও স্বামীর পূর্বের স্ত্রীর সন্তানের প্রতি মমতাময়ী হতে পারে না। কিন্তু তাও আমি প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। কারণ মীরাকে আমার অন্যরকম মনে হয়েছে। সে গতানুগতিক ধারার না।”
ড: আকবর খানিক থামলেন। ফের কিছু বলবে তার আগে মীরার বাবা বলেন,
“দেখেন স্যার, মীরা যেহেতু আমার মেয়ে। সেইক্ষেত্রে মেয়ের জন্য ভালো কিছু দেখা আমার কর্তব্য। আমার মেয়েকে বিবাহিত ছেলের সাথে কীভাবে…! তাছাড়া মীরাকে আপনার অন্যরকম লাগলেই কি ও কারও সৎমা হিসেবে ভালো হবে? আমাদের সমাজে অনেক মেয়ে আছে যারা সৎমায়েদের কার্যক্রম শুনে কষ্ট পায়। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ওরাই কারও সৎমা হয় তখন সেম কাজটাই করে।”
ড: আকবর রেহমান করুণ নয়নে চাইলেন। অতঃপর মলিন স্বরে বললেন,
“জানিনা, আমার কেন মনে হয়েছে। কিন্তু সেদিন ও-কে দেখার পর সত্যি মনে হয়েছিল। আমি সাথে সাথে প্রস্তাবও দিয়ে ফেলেছিলাম। এইতো কিছুদিন আগেও মীরা ভার্সিটিতে গিয়েছিল, কাজ শেষে ফ্রিশার সাথে কিছু কোয়ালিটি টাইম কাটিয়ে এসেছে।”
এবার রফিক তালুকদার ভ্রুকুঞ্চন করলেন। সতর্ক হয়ে শুধালেন,
“কোনদিন?”
“কিছুদিন আগে। জব ইন্টার্ভিউর জন্য এসেছিল তখন।”
মীরার বাবা এবার ভাবনায় পড়ে গেলেন। বিগত দিনগুলোর সব ঘটনা একে একে তার মস্তিষ্কে জড়ো হচ্ছে। দুইয়ে দুইয়ে চার মেলানোর প্রচেষ্টায় ফের একবার হতাশ হলেন। ভাবলেন, মেয়ের এখানেই পছন্দ। তাইতো ওসব কথা বলেছিল। এখন মেয়ের সাথে অমত করলে বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। মীরার বাবা বললেন,
“মীরা রাজি হলে আমরাও রাজি।”
কিন্তু আপত্তি করল মীরার ছোটো ভাই মারুফ। সে বলল,
“কিন্তু বাবা? হতেও তো পারে মীরা বাচ্চা ভালোবাসে বলে ওই বাচ্চা মেয়েটাকে আদর করে। অন্যকারও বাচ্চার মা হওয়া সহজ কাজ নয়।”
মারুফকে জবাব দিল রুবেল। সে মলি জাহানের দিকে চেয়ে বলে,
“মীরা পারবে। ও ঠিক মায়ের মতো আগলাতে জানে।”
দৃষ্টি করুণ হলো রুবেলের। অক্ষিপল্লব ভারি হলো। সেইসাথে মলি জাহানেরও। রুবেল উঠে যেতেই মলি জাহানও আড়ালে চলে গেলেন। রফিক তালুকদার, উনার স্ত্রী ও বড়ো ছেলেকে উঠে যেতে দেখে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এরপর ড: আকবর রেহমান ও রফিক তালুকদার আসরের নামাজ পড়তে মসজিদে গেলেন।
রুবেল ঘরে গিয়ে মীরাকে হোয়াটসএপে কল করে। মীরাকে সে নিজ থেকে অনুরোধ করবে। নিজের ঘরে আসার পথে মৃদুলার সাথে ফ্রিশাকে খেলতে দেখে খুব কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। বাচ্চাটা তো মৃদুলারই বয়সি হবে। তাহলে আরও ছোটো বয়সে মাকে হারিয়েছে।
মীরা ল্যাবে কাজ করছে। ইন্ডিয়ার সময়ে এখন বিকেল সাড়ে চারটা ছুঁইছুঁই আর বাংলাদেশের সময়তে পাঁচটা বাজতে চলল। কে*মি*কেল রি*য়াকশনের প্রসেসিং চলছে তাই মীরা অপেক্ষা করছিল। হঠাৎ বড়ো ভাইয়ের কল আসাতে রাইমাকে বলে ফোন হাতে ল্যাব থেকে বেরোয়। মীরা বলে,
“হ্যাঁ ভাইয়া, বলো।”
রুবেল নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“ওই ছোটো বাচ্চাটার মা হবি?”
“কোন বাচ্চা?”
ভাইয়ের মুখে হঠাৎ বাচ্চার কথা শুনে মীরা বুঝতে পারল না।
“ওই যে ফ্রিশা। ফুলের মতো বাচ্চাটার জীবনে মায়ের ভালোবাসা নিয়ে যেতে পারবি?”
মীরার বুক ধ্বক করে ওঠে। তার বড়ো ভাই এসব কীভাবে জানলো? প্রশ্নরা ঘুরপাক খাচ্ছে ভীষণ। জিভ দিয়ে নিজের শুষ্ক ওষ্ঠদ্বয় ভিজিয়ে নিয়ে ফের শুধায়,
“তোমাকে এসব কে বলেছে?”
“তোর ডিপার্টমেন্টের চেয়ারপার্সন। স্যার আজকে আমাদের বাসায় এসেছেন।”
মীরা অবাক হয়ে গেল। কিয়ৎ মুহূর্ত কিছু বলতে পারলো না। রুবেল অস্থির হয়ে বলে,
“রাজি হয়ে যা মীরু! ফুলের মতো বাচ্চাটাকে নিজের আঁচলে আগলে নে। অন্য যেসব পাত্র আসছে তাদের থেকে ওই বাচ্চার বাবা অন্য সবদিকে এগিয়ে। কিন্তু পিছিয়ে একদিকেই, যে সে বিপত্নীক এবং এক বাচ্চার বাবা। আমি তোকে এই পিছিয়ে থাকা দিকটার জন্যই বলব। বল মীরু?”
“ভাইয়া, আমি পড়ে কথা বলছি। দেশে এসে কথা বলছি। বাবা-মাকে বলে দিও, আমার জব হয়ে গেছে। আমি সামনের সপ্তাহে দেশে ফিরব। ”
শেষোক্ত কথাটা শুনে রুবেল বেশ খুশি হয়। কিন্তু বোনের অস্বস্তি আন্দাজ করতে পেরে আর কথা না বাড়িয়ে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন কে*টে দিলো। তারপর বাড়ির সবাইকে খবরটা জানাতে যায়।
ফোন ডিসকানেক্ট হওয়ার পর মীরা কী করবে বুঝতে পারছে না। একবার মনে হচ্ছে হ্যাঁ বলে দিক। ফের পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, শেহজাদ স্যার কী ভাববেন! অস্বস্তিতে পড়ে যাচ্ছে নিমিষেই। তারপর নিজেকে শান্ত করতে ব্রিথ ইন ব্রিথ আউট টেকনিকটা প্রয়োগ করে নিজের কাজে গেল।
বাড়ির সবাই সহ ড: আকবর ও তার স্ত্রী মীরার জবের খবর শুনে খুব খুশি হয়। মীরা নিজে না জানানোতে মিসেস মলি জাহান একটু কষ্ট তো পেলেনই। কিন্তু তার মনে হলো, অন্যের মিথ্যে কথায় প্রভাবিত হয়ে তিনি মেয়েকে এত কিছু না বললেও পারতেন।
খেলতে খেলতে নিহান ফ্রিশাকে কা*ম*ড় দিয়ে বসলো। ফ্রিশার তারস্বরে চিৎকারে মিসেস শাহিদা সহ মলি জাহান, শারমিন, নিধি ছুটে গেল। নিধি তো বুঝেই গেছে এ তার বাঁ*দ*র ছেলের কাজ। ছেলেকে টেনে এনে দুয়েক ঘা ইতোমধ্যে লাগিয়েও দিয়েছে। নিহানও এখন চিৎকার করে কাঁদছে। মিসেস শাহিদা ও শারমিন টেনে ছাড়িয়ে নিয়েছে ওদের। মিসেস শাহিদা বলেন,
“ও কি বুঝে? এতটুকুন বাচ্চা। তুমি মা*র*লে কী-ভাবে?”
“ওর বাজে স্বভাব হয়ে গেছে। সবাইকে কা*ম*ড়াবে ও মা*রবে। বাবা, দাদা-দাদী ও বড়োমা-বড়োবাবার আহ্লাদে আরও বে*য়া*দব হচ্ছে। সিয়াম তো কী সুন্দর ভদ্র হয়ে থাকে।”
মলি জাহান ধ*ম*ক দিলো নিধিকে।
“থামো তুমি। ফ্রিশার হাতে স্যাভলন লাগিয়ে দাও। র*ক্তের ছাঁপ দেখা যাচ্ছে।”
নিধি দ্রুত ফ্রিশাকে নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে স্যাভলন বের করে তুলোতে নিয়ে আস্তে আস্তে লাগাতে থাকে। স্যাভলনের জ্বা*লাপো*ড়ার কারণে ফ্রিশা নিজেই কাতর হয়ে হাতে ফুঁ দিচ্ছে। নিধি আদুরে কণ্ঠে বলে,
“সরি বাচ্চা। আমি ওই বাঁ*দ*রকে আজ আচ্ছামতো বকে দিব।”
ফ্রিশা তার মিষ্টি কণ্ঠে বলে,
“নো আন্টি। হি ইজ সো কিউট। আমি ওর গাল টি*পে দেওয়াতে ও কা*ম*ড় দিয়েছে। ইট ওয়াজ মাই ফল্ট।”
নিধি কয়েক সেকেন্ড ফ্রিশার পানে নিরন্তর চেয়ে থাকে। তারপর ফ্রিশা চোখের সামনে হাত নাড়ালে দ্রুত দৃষ্টি হটিয়ে হেসে তুলোটা ফেলে দেয়।
________
শেহজাদ আমেরিকা থেকে ফিরে সব বাড়িতে ঢুকতেই ফ্রিশা ছুটে যায়। শেহজাদও মেয়েকে পরম আদরে কোলে তুলে নেয়। তারপর শুরু হয় ফ্রিশার কথা। কথায় কথায় সে বলে ফেলে,
“জানো বাবা, নতুন মাম্মামের বাসায় কতো মানুষ। সবাই আমাকে অনেক আদর করেছে। আমার মতো একটা কিউট গার্ল ও দুইটা কিউট বেবি বয়ও আছে। একটা বেবি বয় আমার হাতে ব্যাথা দিয়েছিল। এই দেখো (হাত দেখিয়ে)। তারপর বেবিটার আম্মু ও-কে মে-রে*ছেও! বেবিটাতো গালে হাত দেওয়াতে রেগে গিয়েছিল বলো। তারপর বেবিটার আম্মুটা আমার হাতে মেডিসিন লাগিয়ে দিয়েছে।”
শেহজাদ মেয়ের কথা শুনে খুব অবাক হয়। তার অনুপুস্থিতিতে সবাই এতো দূর এগিয়ে গেছে! ফ্রিশার মধ্যেও বেশ উৎসাহ দেখা যাচ্ছে। সে কী আদৌ বুঝে, নতুন মাম্মাম মানে কী? শেহজাদ হতাশ হয়। তারপর তার ফুফিকে ডাকে।
“ফুফিজান!”
মিসেস শাহিদা, উনার ছেলের ঘরে ছিলেন। শেহজাদের ডাক শুনে সেখানে আসেন।
“তুমি এখনও এখানে দাঁড়িয়ে? ঘরে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট করো। আর ফ্রিশা, তোমার বাবা এখন টায়ার্ড না? কোল থেকে নেমে পড়তে বসো। কয়েকদিন পর পরীক্ষা তোমার। আমি কিন্তু তোমার লেখা চেক করব।”
“যাচ্ছি দাদুমনি। বাবাকে স্টোরি বললাম। বাবা, গো এন্ড রেস্ট।”
এই বলে ফ্রিশা কোল থেকে নেমে ছুটে চলে যায়। ফ্রিশা যেতেই শেহজাদ ক্লান্ত কণ্ঠে শুধায়,
“কাল আপনারা কোথায় গিয়েছিলেন?”
মিসেস শাহিদা খানিক ঘাবড়ালেন। অতঃপর কণ্ঠে স্বাভাবিকতা প্রকাশ করে বললেন,
“তোমার ফুফা, যেই মেয়ের কথা বলেছিল, সেই মেয়ের বাড়িতে।”
“কেন? কী লাভ?”
“তুমি অযথা হতাশ হচ্ছো শেহজাদ। সেই মেয়েটির পরিবার কিন্তু অনেকটাই রাজি। এখন মেয়ে দেশে ফিরলে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে। আমার কিন্তু শতভাগ মনে হচ্ছে, মেয়েটি রাজি হয়ে যাবে। ফ্রিশাকে তো পছন্দ করে মেয়েটা।”
“আপনারা কার কথা বলছেন?”
শেহজাদের কণ্ঠে সন্দেহের সুর। মিসেস শাহিদা কথা কা*টাতে চাইলেন।
“সেটা তুমি পরে ঠিকই জানতে পারবে। আগে তাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাক। এখন যাও গিয়ে ফ্রেস হয়ে রেস্ট করো।”
এটা বলেই আর কালক্ষেপণ না করে মিসেস শাহিদা দ্রুত স্থান ত্যাগ করলেন। শেহজাদ পিছু ডাকলেও ফিরলেন না। অতঃপর শেহজাদ ঘন নিঃশ্বাস ছেড়ে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হয়। যাওয়ার আগে সার্ভেন্টকে ডেকে দশ মিনিট পর কড়া করে কফি বানিয়ে পাঠাতে বলে। এখন সে এসব নিয়ে ভাবতে নারাজ। যা হবে পড়ে দেখা যাবে।
_________
মীরা ও রাইমা কফি নিয়ে ব্যালকনির ফ্লোরে ম্যাট বিছিয়ে বসে কাচের থাই গ্লাসে পিঠ ঠেকিয়ে রেখেছে। দুজনের নিরন্তর দৃষ্টি আকাশের ওই থালার মতো শুভ্র রঙের পূর্ণ চন্দ্রের দিকে। সব লাইট বন্ধ করে চাঁদের জোৎস্না উপভোগ করছে দুই বান্ধবী। পাশে সাউন্ড বক্সে সফট মিউজিক টোন বাজছে। নীরবতার সুতা কে*টে রাইমা ভাবলেশহীন কণ্ঠে শুধায়,
“আমাদের আর দেখা হবে না। তাই না?”
মীরা রাইমার দিকে ফিরলো। কাল সন্ধ্যায় তার ফ্লাইট। রাইমার নীরবতাই তাকে ওর কষ্টটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। মেয়েটা তো নীরব থাকার মতোই না! মীরা বলে,
“হবে। দূরত্বে কী বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায়? তুই সারাজীবন আমার প্রিয় রাই হয়ে থাকবি। আমিও মাঝেমাঝে তোকে দেখতে না বলে চলে আসব।”
“সত্যি আসবি?”
“হুম।”
আবারও নীরবতা। মীরা ঝাপসা দৃষ্টিতে ফের আলোকিত চাঁদকে দেখতে থাকে। রাইমার চোখ থেকে দুই ফোঁটা অশ্রুজল তার কফির মগে টুপ করে পড়লো।
চলবে ইনশাআল্লাহ,
ভুল ত্রুটি থাকলে ক্ষমা করবেন। কপি নিষিদ্ধ।