মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া৷ পর্ব-৩৬+৩৭

0
641

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৬
রাত্রির ১০টা বেজে ১০ মিনিট। মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে প্লেনে চড়ে বসেছে। রাইমার শ্বশুরবাড়ি থেকে কলকাতা এয়ারপোর্ট মাত্র মিনিট বিশেকের দূরত্ব। ফ্রিশার সিটবেল্ট চেক করে মীরা সিটে গা এলিয়ে বসেছে। ভাবতে শুরু করে বিয়ে বাড়ি থেকে বেরোনোর আগে রাইমার সাথে কথোপকথন,

“রাই, শোন না। আমরা এখনই বেরোবো। ১০টা ১৫ তে শিলিগুড়ির ফ্লাইট। দার্জিলিং যাচ্ছি।”

রাইমা খানিক অবাক হয়ে হাসি মুখে শুধায়,
“হঠাৎ দার্জিলিং? এই প্ল্যান কখন হলো?”

“এই সবেমাত্র আমি জানলাম। তোর জিজু হুট করেই সারপ্রাইজ দিলো।”

রাইমা একটু মজা করে আলতো ধা*ক্কা দিয়ে বলল,
“বাহ বাহ। জিজু তবে হানিমুনের সারপ্রাইজও দিলো! সো রোমান্টিক ইয়ার।”

মীরা ওর মাথায় টো*কা দিয়ে বলে,
“আরে না রে। আমি রাগ করেছিলাম। বলেছিলাম তার সাথে ফিরব না। তাই এটা করলো।”

রাইমার চোখ-মুখ উজ্জ্বলতা ভর করলো। সে খানিক গা ঘেঁষে ফিসফিস করে মীরার কানে বলল,
“তুই বলিস আর না বলিস, জিজু তোকে ভালোবাসে। মুখে না বললে কী হবে, কাজে তো বুঝাই যায়।”

মীরা ব্রীড়ামিশ্রিত হেসে পাত্তা না দেওয়ার ভাব ধরে বলে,
“হয়েছে! থাম এবার। আমরা বেরোবো। ভালো থাকিস, ইয়ার।”

রাইমা ও মীরা দুজন-দুজনকে জড়িয়ে ধরলো। তখন সেখানে শেহজাদ ও ফ্রিশা আসে এবং ওরা তিন জন বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

পূর্বে ঘটিত ঘটনার কল্পনার ইতি টেনে মীরা, ফ্রিশার দিকে মনোযোগ দেয়। ফ্রিশা জানালা দিয়ে তাকে রাতের ঝিকিমিকি শহর দেখাচ্ছে। পুরো কোলকাতা শহরটা যেন এক হাতের সমান দেখা যাচ্ছে। এভাবেই ১ ঘণ্টা ১০ মিনিটের জার্নি শেষে শিলিগুড়ির বাগডোগরা বিমানবন্দরে ওরা অবতরন করে। রাত অনেকটা হয়ে যাওয়াতে এয়ারপোর্টের কাছেই হোটেলে রাত্রিযাপনের সিদ্ধান্ত নেয়।

________

শীতের সকাল, ঘন কুয়াশাচ্ছাদিত আবহাওয়া। উলের নরম শাল গায়ে জড়িয়ে জানালার পর্দা সরালো মীরা। শেহজাদ সবেই বাহিরে গেলো গাড়ি ঠিক করতে। ওরা আগে দুধিয়া পাহাড় দেখতে যাবে। তারজন্য শিলিগুড়ি শহরে গিয়ে সেখান থেকে রওনা হবে। শহরটাও খানিক দেখে, সেখানেই নাস্তা সেড়ে নিবে। মীরা মুচকি হেসে ফ্রিশাকে ঘুম থেকে তুলতে বিছানার কোণায় বসে। শীতল পরিবেশ পেয়ে ফ্রিশা বি*ড়ালছা-নার মতো ব্ল্যানকেট জড়িয়ে আরামে ঘুমাচ্ছে। মীরা ওর চুলে হাত বুলিয়ে আলতো স্বরে ডাকে। ফ্রিশা নড়েচড়ে আবারও ঘুমের দেশে তলিয়ে যায়। ফের কয়েকবার ডাকার পর ঘুম ভাঙে ফ্রিশার। আড়মোড়া ভেঙে মায়ের কোলে মাথা দিয়ে আলসেমি করছে। মীরা বলে,

“তোমার বাবা এখুনি চলে আসবে, সোনা। ফার্স্ট ফার্স্ট রেডি হয়ে নাও তো, বাচ্চা। আমরা ঘুরতে বেরোবো।”

“ফেইরিমাম্মাম, আই অ্যাম ফিলিং স্লিপি।”

“উঁহু। গেট আপ। রেডি হতে হবে। আমরা আজকে অনেক জায়গায় ঘুরবো। অনেক কিছু দেখব।”

অগ্যতা ফ্রিশা মুখ কালো করে উঠে ফ্রেশ হয়ে আসলো।

_______

শিলিগুড়িতে নাস্তা-পানি সেড়ে কিছুক্ষণ ঘোরাফেরা করে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি এই উভয় জেলার অংশবিশেষ নিয়ে গড়ে উঠা একটি মহানগর হচ্ছে শিলিগুড়ি। এটি প্রধানত চা, কাষ্ঠ ও পর্যটনকেন্দ্রের জন্য পরিচিত। শহরের উঁচু টিলাতে দাঁড়িয়ের দূরের সবুজ পাহাড় ও চা বাগান যেন নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আভাস দেয়। এখনও কুয়াশা পুরোপুরি কে*টে ওঠেনি। ঘড়িতে সকাল আটটা বাজে বাজে এমন। একটা সিএনজি টাইপ গাড়ি ঠিক করে মীরা, শেহজাদ ও ফ্রিশা উঠে পড়লো দুধিয়ার উদ্দেশ্যে। শিলিগুড়ি শহর থেকে ৪০-৪৫ মিনিট গাড়ির পথ দুধিয়া। দুধিয়ার পাহাড় থেকে নেমে এসেছে বালাসন নদী। আর সেই নদীর পাড়ে সবুজ উপত্যকা। এক দিকে পাহাড় আরেক দিকে চা বাগান। অনেকেই এখানে পিকনিক করতে এসেছে। বেশ পর্যটন প্রিয় জায়গা। নদীর জলের গভীরতা খুব কম হওয়ায়, পা ডুবিয়ে চোখ বন্ধ করে দুই দিকে দুই হাত মেলে লম্বা শ্বাস নিয়ে প্রকৃতির বিশুদ্ধতম সব বায়ু দ্বারা ফুসফুসকে প্রশান্ত করতে ব্যাস্ত মীরা। পেছন থেকে শেহজাদ এটা নিজ ফোনে ক্যাপচার করে নেয়। মীরার দেখাদেখি ফ্রিশাও যায়। দুই মা-মেয়ের একই ভঙ্গিও ক্যামেরায় ধরা পড়ে। সেখানে কিছুক্ষণ থেকে বালাসন ব্রিজে তিনজন ছবি তুলে নেয়। এক পর্যটকের সহায়তা নিয়ে বালাসন ব্রিজে ও বালাসন নদীতে পা ডুবিয়ে তিন জনের দুইটা ফ্যামিলি ফটো উঠিয়ে নেয় আকাশ-পাহাড়ের নীল, সাদা, সবুজ রংকে সাক্ষী রেখে। ফ্রিশাও কিন্তু দারুণ ফটোগ্রাফার! বাবা-মায়ের কাপল ছবিতো সেই তুলে দিয়েছে। ঘণ্টা দুয়েক সেখানে কাটিয়ে রওনা করে “বেঙ্গল সাফারি পার্কের” উদ্দেশ্যে। প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছায় বেঙ্গল সাফারিপার্কে। এই সাফারিপার্কের বৈচিত্র্যময় গাছ-গাছালি, প্রাণীকুল, সবেতে পর্যটক সবুজের অরণ্যে নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বাধ্য। সাফারিপার্কের ভেতরে ঘোরার জন্য গাড়ি ভাড়া করতে হবে। আরও দুয়েকজন একক পরিবার সেখানে থাকাতে একসাথে একটা গাড়ি ভাড়া করে ফেলে। এদের মধ্যে এক দম্পতির ৪ বছরের একটা বাচ্চা ছেলে আছে। আরেক দম্পতির বাচ্চা নেই। ৪ বছরের দিহান ও ফ্রিশার মাঝে অল্প সময়েই সখ্যতা গড়ে ওঠেছে। ওরা গাড়ি পেছনের সিটে বসে জানালা দিয়ে সব দেখছে। দিহানের মা দিশাও খুব মিশুক। আরেকজন নবনী। নবনী ও তার স্বামী প্রদীপ ক্যামেরা আড়ালে ভিডিও করছে। পশু-পাখির সামনে ক্যামেরা আনা ঠিক না। এই সাফারিপার্কে ভ্রমণের মাঝে বিভিন্ন পশু-পাখি দেখে ফ্রিশা ও দিহানের প্রশ্নের কমতি নেই। ওদের প্রশ্নের তোড়ে সবার মাঝে হাসির ফোয়ারাও ছুটেছে কয়েক দফা।

দুপুর গড়িয়ে বিকেলে পড়লে ওদের ঘুরাঘুরি শেষ হয়। একটা রেস্টুরেন্টে দুপুরের খাবার খেয়ে শেহজাদ বলে,
“দার্জিলিং যেতে ট্রেন তো সন্ধ্যা ৬টা ১৫তে। এখন বাজে ৪টা ১০। হাতে দুই ঘণ্টা আছে। আমি চেয়েছিলাম সিপাই ধুরা চা বাগানে একটু ঘুরে আসতাম। যদিও শীতের সময়। খুব দ্রুত সন্ধ্যা নামে।”

মীরা আশংকিত কণ্ঠে শুধায়,
“সেখানে গেলে ট্রেনের টাইম মতো স্টেশনে পৌঁছাতে পারব?”

“ম্যাপে তো দেখলাম এখান থেকে সিপাই ধুরা চা বাগানে যেতে ৫০ মিনিট সময় লাগে। এখন যদি ১ ঘণ্টাও লাগে তবে সন্ধ্যা হয়ে যাবে। ড্রাইভারকে ফার্স্ট ড্রাইভ করতে বলতে হবে। সেখানে ১০-১৫ মিনিট থেকে ফিরে এলাম।”

“আপনি যা ভালো বুঝেন করেন। আমি অতো বুঝি না।”

“আচ্ছা। তোমরা এখানে বসো। আমি গাড়ি ঠিক করে আসি।”

শেহজাদ গাড়ি ঠিক করতে যায়। ফ্রিশা আশেপাশে তাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“আমরা এখন চা বাগনে যাব, ফেইরিমাম্মাম?”

“তোমার বাবা তো তাই বলল, বাচ্চা। জানিনা কী করেন।”

ফ্রিশা আবার চুপ করে বসে আশেপাশে নজর বুলাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর শেহজাদ ফিরে এসে বলে,
“চলো শিলিগুড়ি শহরেই ফিরে যাই। রিক্স নিয়ে কী দরকার? শিলিগুড়ি মার্কেট থেকে হালকা পাতলা কিছু কেনাকাটার ব্যবস্থাও করা যাবে। ”

“আচ্ছা চলুন তবে। ফ্রিশারও টায়ার্ড লাগছে।”

“আমি শিলিগুড়ি শহরে যাওয়ার জন্য গাড়ি ঠিক করে এসেছি। এসো।”

এরপর ওরা তিনজন শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে চড়ে বসে।

_________

সন্ধ্যা ৬টা ১২ মিনিট, দার্জিলিং মেইল ট্রেনে বসে আছে ওরা। ট্রেন এখুনি ছেড়ে দিবে। মানুষজন দ্রুত পায়ে ট্রেনে উঠায় ব্যাস্ত। ফ্রিশা, মীরার কোলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে গেছে। মীরা ট্রেনের জানালাটা সামান্য খোলা রাখলো। ট্রেন ছেড়ে দিলে পুরো বন্ধ করে দিবে। ট্রেন ছাড়লে বেশ হাওয়া আসবে। শীতের রাত। কনকনে ঠান্ডা হাওয়ায় ফ্রিশার ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। সিটে চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে রেখেছে। চিনচিনে ব্যাথাও করছে মাথার সামনের ও ডান পাশের দিকটায়। শেহজাদ জিজ্ঞেসা করে,

“কিছু স্ন্যাকস আনব? এখনও তো ট্রেন ছাড়েনি।”

মীরা চোখ মেলে দ্রুত কণ্ঠে নিষেধ করে বলে,
“না না। দরকার নেই। পড়ে ট্রেন ছেড়ে দিলে কি পিছু দৌঁড়াবেন নাকি? এক-দেড় ঘণ্টার জার্নিতে না খেলে ম-রে টরে যাব না। মেয়ে তো ঘুমাচ্ছেই।”

শেহজাদ হেসে বলে,
“কিছু হবে না। এখনও মানুষ আসছে।”

“দরকার নেই তো। বাই চান্স ছেড়ে দিলো? ৬টা ১৯ বাজে। পরে কি দিল ওয়ালে দুলহানিয়া ও চেন্নাই এক্সপ্রেস মুভির মতো কাজল ও দীপিকার মতো আপনি দৌঁড়াবেন আর আমি শাহরুখের মতো ট্রেনের দরজায় হাত বাড়িয়ে দিব? অতো সিনেম্যাটিক হতে পারব না। আপনার কোথাও যাওয়ার দরকার নেই। চুপ করে বসে থাকুন।”

কথাগুলো বলে মীরা আবারও চোখ বন্ধ করে ধীরে ধীরে ফ্রিশার মাথায় হাত বুলাচ্ছে। পাশ থেকে এক লোক শেহজাদকে উদ্দেশ্য করে খানিক হাস্যরসে বলে,
“দাদা, আপনার ওয়াইফ মনে হচ্ছে একটু বেশি স্ট্রিক্ট। রসকষহীন। আপনার জীবন তো….”

লোকটা নিজের বাক্য সম্পূর্ণ করতেই পারল না, তার আগেই মীরা ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে ওঠে,
“আমার মধ্যে রসকষ আছে কি-না তা জেনে আপনি কী করবেন? মানুষের পারিবারিক কথার মধ্যে আপনি ঢুকতে যান কেন? নিজের মতো থাকেন না।”

মীরাকে হঠাৎই রেগে দিতে দেখে শেহজাদ ওর পাশে বসে ধীরস্বরে বলে,
“কী হয়েছে তোমার? রেগে যাচ্ছ কেন? লোকটা এমনিতেই বলেছে।”

মীরা চোখ-মুখ কুঁচকে ঝাঁঝালো স্বরেই বলল,
“আপনি চুপ করে বসুন। কোথাও যাওয়া লাগবে না। বিরক্ত লাগছে আমার।”

মীরাকে আবারও চোখ বন্ধ করে মাথায় হেলিয়ে বসে থাকতে দেখে শেহজাদ কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে শুধালো,
“তোমার শরীর খারাপ লাগছে?”

হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ায় মীরা।
“মাথাব্যাথা?”

আবারও ইশারাতেই জবাব দেয়। শেহজাদ ব্যাগ থেকে ঔষুধের বক্স থেকে ঔষুধ বের করে পানির বোতলের সিপ খুলে এগিয়ে দিয়ে বলে,
“নাও। এটা খেয়ে নাও।”

মীরা চোখ খুলে ঔষুধ দেখে হাতে নিয়ে খেয়ে নেয়। ফের চুপ করে থাকে। শেহজাদ কপালে লাগানোর বাম বের করে মীরার কপালের দুইপাশে লাগিয়ে আস্তে আস্তে মালিশ করে দেয়। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থাতেই মীরার ওষ্ঠকোণে হাসির রেখা ফুটে ওঠে। এরপর শেহজাদ জানালাটা পুরোপুরি বন্ধ করে পাশের সিটের লোকটাকে নম্রস্বরে বলে,

“কিছু মনে করবেন না। আমার স্ত্রী একটু অসুস্থ। তাই ওভাবে বলেছে।”

“আরে না, দাদা। আমার বউও এমন জানেন? সে প্রচণ্ড রাগী। তাই ভাবলাম আপনার আর আমার অবস্থা একই রকম।”

শেহজাদ হেসে জবাব দেয়,
“আমার ওয়াইফ রাগী না। ওর মাথাব্যাথা শুরু হলে ও শান্ত পরিবেশ চায়। মাথাব্যাথাটা ওর খুব বাজে ভাবে এফেক্ট করে তো।”

“ও আচ্ছা। তাহলে আমরাও আর কথা না বলি। পরে দেখব আপনার স্ত্রী আবার আমার উপর রেগে গেছে!”

বলেই লোকটা প্রাণখোলা হাসলো। শেহজাদ দেখলো কা*লো-মো*টা লোকটার মনের সৌন্দর্য তার ব্যাবহারে। শেহজাদও বিনিময়ে হেসে মীরা ও ফ্রিশা দুজনের মাথায়ই সামান্য হাত বুলিয়ে দিলো।

_________

প্রায় ঘণ্টা দেড়েকের ট্রেন জার্নি শেষে ওরা দার্জিলিং এসে পৌঁছে। রাতের নৈসর্গিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই পাহাড়ি শহরটা যেন মায়ার ডাকে বারংবার ডাকছে। শেহজাদরা আগের থেকে বুকিং করা হোটেলে গিয়ে ওঠে। হোটেল রুমে এসেই কড়া চা অর্ডার করা হলো মীরার জন্য। শেহজাদ ও ফ্রিশা ফ্রেশ হয়ে বেরোনোর পর মীরা একেবারে গোসল সেড়ে বের হয়, মাথাব্যাথার জন্য। অনেকটাই কমে গেছে। চা খেতে খেতে মীরা বলে,

“রাতের খাবার খেয়ে একটু রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করব।”

“মাথব্যাথা কমেছে?”

“হুম অনেকটাই।”

“ওকে। তাহলে চা খেয়ে তৈরি হয়ে নাও।”

ফ্রিশা বলে,
“আমিও চা খাব।”

জবাবে মীরা বলে,
“ডিনারের পর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাব। দার্জিলিংয়ে এসে তো চা টাই খাবে। এখন যাও। তৈরি হয়ে নাও।”

ফ্রিশা খুশি হয়ে নিজের বার্বি সুটকেস খুলে জিন্স-টপস বের করে ওয়াশরুমে চলে যায়।

চলবে ইনশাআল্লাহ,

#copywritealert❌🚫
#মন_মোহনায়_ফাগুন_হাওয়া
#লেখিকা: #নুরুন্নাহার_তিথী
#পর্ব_৩৭
আঁধারে আচ্ছন্ন খোলা আকাশের নিচে দার্জিলিংয়ের রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা পানের বিষয়টা হয়তো খুব সাধারণ। কিন্তু যখন পাশে দাঁড়ানো, আকাশপানে বিভোর হয়ে চা পানে ব্যাস্ত নিজ স্ত্রীর উন্মুক্ত চুলে শীতল হাওয়া দোল খেয়ে যায়! এবং তার নয়নজোড়া অজান্তেই পলক ঝাপটায়! মূহুর্তটা একজন স্বামীর নজরবন্দীতে মুগ্ধতার অপার সীমায় কি না থেকে পারে? উঁহু। একদমই না। মুগ্ধচিত্তে নিজ রমণীর নৈশরূপে মনের ভিতর উঠা প্র*লয়কারী ঝ*ড়কে ভীষণ শা*স*নে রুখে রেখেছে শেহজাদ। ফ্রিশা বেঞ্চে বসে আকাশের চ্যাপ্টাকৃতির চন্দ্রমাকে দেখছে আর বিস্কিট ভিজিয়ে চা খাচ্ছে। শেহজাদ মেয়ের পাশেই দাঁড়ানো। তারই খুব কাছে দাঁড়ানো মীরা। শেহজাদ এক পা পাশ এগিয়ে মীরার পেছনে দাঁড়িয়ে চাঁদের দিকে চেয়ে প্রশ্ন করে,

“ওই চাঁদকে এতো কেন দেখছো?”

মীরা নজর না ফিরিয়েই মুগ্ধ হেসে উত্তর করে,
“মানুষ বলে, চাঁদেরও কলঙ্ক আছে। কিন্তু আমার কাছে তো এই কলঙ্কই মোহ-মায়া। কলঙ্ক বয়েও যে সে উজ্জ্বলতা ছড়াচ্ছে।”

আরও ঘনি*ষ্ঠ হলো শেহজাদ। মাথা সামান্য ঝুঁকিয়ে মীরার একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
“মেঘে মেঘে চাঁদ যে তোমার চাহনিতে মুখ লুকাচ্ছে তা দেখছো না? ”

ঘোর ভাঙে মীরার। শীতল সমীরণ ও প্রিয় মানুষটার শীতলতম কণ্ঠস্বর। হৃদমাঝারে কম্পন ধরানোর জন্য যথেষ্ট। ইতস্তত হয়ে একটু পাশ সরে আমতা আমতা করে মাথা নিচু করে বলে,
“হোটেলে ফিরে চলুন। শীত শীত করছে।”

শেহজাদ মাথা সোজা করে খানিক ঠোঁট বাকিয়ে নিরব হাসে। এই হাসি মীরা দেখলো না। তমসাবৃত অম্বরে কোনো মনু*ষ্য-কূলেরও নজরে এলো না। সে প্রত্যুত্তরে শুধু বলে,
“চলো!”

মীরা ফ্রিশার কাছে এসে বলে,
“ফ্রিশামনি, তোমার চা খাওয়া হয়নি?”

ফ্রিশা আদুরে স্বরে বলে,
“আমার কুকিজই তো আমার চা খেয়ে নিয়েছে, ফেইরিমাম্মা! তাই দাদুটা আরেকটু চা দিয়েছে।”

“জলদি ফিনিশ করো। আমরা হোটেলে ফিরব। ঠান্ডা পড়ছে ভীষণ।”

ফ্রিশা ইতোমধ্যে প্রায় ঠান্ডা হয়ে যাওয়া অবশিষ্ট চা টুকু খেয়ে উঠে দাঁড়ায়। তারপর মীরা ও শেহজাদের হাত ধরে চলতে থাকে।

________

পরদিন খুব ভোরে দার্জিলিংয়ের মনোরোম সূর্যদোয় দেখতে ওরা টাইগার হিলে হাজির হয়েছে। এখানে প্রায় অনেক পর্যটক ভীড় জমিয়েছে তুষারশৃঙ্গের সাথে সূর্যদোয় দেখতে। দূরে পৃথিবীর সর্বোচ্চ শুভ্র পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্টও দৃশ্যমান। হিমালয় পর্বতমালাকে দূর থেকে কতোই না চোখ জুড়ানো লাগছে কিন্তু কাছ থেকে এর উচ্চতা দেখলে রুহু কেঁপে উঠতে বাধ্য। খাড়া খাঁই কোনো দুর্বল হৃদয়ের মানুষের জন্য ভয়ংকর অনুভূতি তো বটেই।
ফ্রিশা সচরাচর দেরি করে ঘুম থেকে উঠে কিন্তু আজ এতো জলদি উঠতে হয়েছে বলে মনটা তার খারাপই ছিল। কিন্তু প্রকৃতির এই অপরূপ চোখ ধাঁধানো সৌন্দর্যে বিভোর হয়ে সে এখন হাসছে, ছবি তুলছে। উৎফুল্ল সে। শেহজাদ, মীরা ও ফ্রিশার সিঙ্গেল, ডাবল সবরকমের ছবি তুলে দিয়ে এখন তিনজনের একসাথে একটা সেলফিই তুলে নিলো। এখানে কাকেই বা বিরক্ত করবে! মীরাও ওদের বাবা-মেয়ের একটা ছবি তুলে দেয়। ফ্রিশা এবার ফোন নিয়ে তার বাবা-মাকে একসাথে দাঁড়াতে বলতে বলতেই হঠাৎই আচমকা ধাক্কায় মীরা একদম রেলিংয়ের উপর আছড়ে পড়ে! শরীরের ভারসাম্য অধিকাংশই রেলিংয়ের বাহিরে যেতে নিলেই শেহজাদ খপ করে মীরার হাতটা ধরে টান দিয়ে নিজের কাছে নিয়ে আসে। আকস্মিক কাণ্ডে মীরা ভয়ে হতবাক হয়ে শেহজাদের বু*কের সাথে একদম মিশে আছে। ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী ফ্রিশার ভয়ার্ত আর্তচিৎকারে আশেপাশের মানুষজন থেমে কৌতুহল দৃষ্টি ওদের দিকেই নিক্ষেপ করে রেখেছে। শেহজাদ সবাইকে হাতের ইশারায় ‘সব ঠিক আছে’ বুঝিয়ে মৃদু স্বরে মীরাকে বলে,

“কাম ডাউন, মীরা। ইউ আর ফাইন। ইউ আর সেইফ।”

মীরার হৃৎস্পন্দন নিজ স্বাভাবিক গতিতে নেই। সময় নিয়ে ধীরে ধীরে তা স্বাভাবিক হয়। ফ্রিশা মীরার ওড়না ধরে গাঁ ঘেঁষে আছে। খানিক স্বাভাবিক হলে শেহজাদ শুধায়,

“তুমি এতো কর্ণারে কীভাবে গেলে?”

মীরা মাথা নাড়ছে। ফ্রিশা জবাবে বলে,
“না, বাবা। ফেইরিমাম্মাম এতোটাও কর্ণারে ছিলো না। সামওয়ান পুসড ফেইরিমাম্মাম।”

শেহজাদ চিন্তিত হয়। কেউ কেন মীরাকে ধা*ক্কা দিবে? হয়তো অনিচ্ছাকৃত লেগে গেছে ভেবে শেহজাদ ওদেরকে নিয়ে সেখান থেকে চলে আসে।

এদিকে আড়াল থেকে একজন রে*গে জোড়ে ভূমিতে আ*ঘা*ত করে আর বলে,
“একটুর জন্য! ওই বাচ্চাটা চিৎকার না করলেই কেউ আজ মীরাকে বাঁচাতে পারতো না। পুচকে মেয়েটাই সব শেষ করে দিলো! ছোটো ম*রিচের ঝা*ল আসলেই বেশি!”

অতঃপর সে স্থান ত্যাগ করে।

_______

নিজেদের স্বাভাবিক করে শেহজাদ, মীরা ও ফ্রিশা একটা খাবারের ধাবা থেকে সকালের নাস্তা খেয়ে নেয়। অতঃপর ওরা দার্জিলিং মিউজিয়াম দেখতে বেরোয়। নেপালি জাতীর স্বাক্ষর বহন করে এই মিউজিয়ামটি। মিউজিয়াম ঘুরে-ফিরে দার্জিলিংয়ের পাহাড়ি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে ওরা ফিরেছে। এই ভাবনা এসেছে মীরার মা*থায়! তার এখন হাঁটতে ইচ্ছে করছে! শেহজাদও আর কী করবে? সাথে চলতে থাকে।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। দুপুরের খাবার শেষে হোটেলে রেস্ট করে এখন ওরা এসেছে ‘হ্যাপি ভ্যালি টি স্টেটে’। এটি দার্জিলিংয়ের দ্বিতীয় প্রাচীন চা বাগান। এই চা বাগান থেকে পুরো দার্জিলিং শহরের প্যানোরোমিক সৌন্দর্য দেখা যায়। এখানে বসে বিখ্যাত ব্লাক টি এর সাথে পুরো শহরের সৌন্দর্য উপভোগ করা যেন মনের জন্য এক কার্যকরি পথ্য হিসেবে কাজ করে। এই সুযোগ তো মিস করা যায় না। শেহজাদ, মীরারাও করলো না। তবে তার আগে পুরো চা বাগানটা ঘুরে তো দেখতে হবে। তারপর সূর্যাস্তের সময়কালে আয়েশ করে চা খাওয়া যাবে। গাইড ঠিক করে ওরা চা বাগান ঘুরছে। চা বাগানের বিষয়ে তথ্যও পেয়েছে। সময়টা ওদের বেশ সুন্দর ও উপভোগ্যই কে*টেছে।
সুবিশাল অম্বরের পশ্চিমাংশে এখন গাড়ো গোধূলি। গোধূলির ঈষৎ লালিমা পুরো আকাশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে। সূর্য ধীরে ধীরে নিজেকে আড়ালে ব্যাস্ত। এখন যে তার ঘুমের সময়! তাইতো পৃথিবীকে আঁধারে নিমজ্জিত করে নিদ্রায় আচ্ছন্ন হতে পাড়ি জমিয়েছে। এই সুন্দরতম দৃশ্য উপভোগ করাটা যদি হয় চা বাগানের মাঝে বসে চায়ের সাথে তাহলে তো কথাই নেই। মীরা ঘোরলাগা স্বরে বলে,

“যদি এই চা বাগানের মাঝে আমার একটা ছোট্টো বাড়ি থাকতো! এই সৌন্দর্য তবে শুধু স্মৃতিপটে না, আজীবনের জন্য জীবন্ত রাখতাম।”

হালকা হাসে শেহজাদ। ফ্রিশা উৎসাহী কণ্ঠে বলে ওঠে,
“চলো একটা বাড়ি বানিয়ে ফেলি।”

ফ্রিশার কথা শুনে শেহজাদ ও মীরক যেন হেসেই খু-*ন! ফ্রিশা কিয়ৎক্ষণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পিটপিট করে এই হাসির কারণ উৎঘাটন করার প্রচেষ্টায় থেকে ব্যার্থ হয়ে নিজেও হাসির রোলে সামিল হয়ে যায়।

______

পরদিন আরও কিছু জায়গা ঘোরাফেরা করে ওরা দার্জিলিং টু জলপাইগুড়ি আসে বাষ্প ইঞ্জিন চালিত ট্রেন ‘টয়ট্রেন’ দিয়ে। পাহাড়ি আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে চলা এই টয়ট্রেনই কিন্তু পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ! ছবির মতো ছুটে চলা প্রকৃতি। এরপর জলপাইগুড়ি থেকে শিলিগুড়ি তারপর বাই এয়ার কোলকাতা এসে একরাত থেকে আবার পরদিন বাই এয়ার বাংলাদেশে চলো আসে। এদিকে কোলকাতার হুগলি নদীর উপর বিখ্যাত হাওড়া ব্রিজ যখন ওরা ঘুরতে গিয়েছিল তখনও আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। কেউ একজন খুব জোড়ে মীরাকে ধা*ক্কা দিয়ে যায়। ভাগ্যক্রমে এবারও মীরা বেঁচে যায়। সেই থেকে শেহজাদ কিছুটা চিন্তিত। একই ঘটনা দুইবার একইভাবে কীভাবে ঘটে? সব কি কোইন্সিডেন্স নাকি অন্যকিছু?

চলবে ইনশাআল্লাহ,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে