Monday, October 6, 2025







মন বিনিময় পর্ব-৪৩+৪৪

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪৩
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

নিজরুমে একা একা পায়চারি করছে স্বপ্নিল। মায়ের বলা একটা কথাই সারা মাথাজুড়ে ঘুরপাক খাচ্ছে। “রাহিতা চলে গেছে” এই একটা বাক্যই যেন স্বপ্নিলের ধ্যান-জ্ঞান, শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাতে যথেষ্ট! ব্যস্ত পায়ে ঘরে এসে রাহিতার নাম্বারে ডায়াল করে স্বপ্নিল। বেশ কয়েকবার ফোন দেওয়ার পরেও যখন রাহিতা ফোন ধরলোনা তখন স্বপ্নিল চিন্তায় পড়ে যায়। মেয়েটা ওর ফোন ধরছেনা কেন? আগে কখনো তো এমন হয়নি! দুশ্চিন্তার রেখা কপালে নিয়ে অস্থির স্বপ্নিল দ্রুতপায়ে হেটে যায় দিলারা বেগমের রুমে। তখন খাবার টেবিল থেকে নিঃশব্দে উঠে গেছেন তিনি, স্বপ্নিলকে জবাব দেননি। কিন্তু এবার স্বপ্নিল নাছোড়বান্দা। প্রসঙ্গ যখন রাহিতার, তখন জবাব তো ওকে নিতেই হবে!

দিলারা বেগম বিছানায় বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। রুমের দরজা ঠেলে শব্দ করে স্বপ্নিল ভেতরে এলে এক পলক চোখ তুলে ওর দিক তাকিয়ে পুনরায় পেপার পড়ায় মনোযোগ দিলেন তিনি। মায়ের সামনে এসে স্বপ্নিল বেশ ক’বার ডাকলেও দিলারা বেগম বিশেষ সাড়া দিলেন না। এমন ভান করলেন যেন স্বপ্নিলকে দেখেও তিনি দেখেননি। মায়ের এহেন ঠান্ডা আচরণে স্বপ্নিল মেজা’জ হা’রালো। কণ্ঠ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

—রাহিতা কোথায় গেছে, মা?

—আমি কি করে জানবো?

নির্বিকারভাবে উত্তর দিলেন দিলারা বেগম। তার এত গা-ছাড়া কথা স্বপ্নিলের মোটেও পছন্দ হলোনা। কোমড়ে হাত রেখে সে বললো,

—তুমি কি মজা করছো আমার সাথে? দেখো মা, আমি এখন মোটেও মজা করার মুডে নেই। প্লিজ বলো না রাহি কই গেছে। আমার টেনশন হচ্ছে!

—কিসের টেনশন?

—এই যে, এভাবে হঠাৎ না বলে চলে গেলো! আগে তো কখনো এমন করেনি। তবে আজ ওর কি হলো? সব ঠিক আছে তো? আমি জানি ও নিশ্চয়ই তোমায় না বলে কোথাও যায়নি। গেলে তুমি এতটা স্বাভাবিক থাকতে না!

—ওহ!

দিলারা বেগম এতক্ষণ মনোযোগ দিয়ে স্বপ্নিলের কথা শুনে পুনরায় পেপার পড়া শুরু করতেই স্বপ্নিল এগিয়ে গিয়ে পেপার কে’ড়ে নিলো তার হাত থেকে! ছেলের আচরণে বিরক্ত দৃষ্টিতে তাকালেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিল সেদিকে পাত্তা না দিয়ে মায়ের সামনে হাটুগেড়ে বসে বললো,

—এমন করছো কেন, মা? কেন বলছোনা রাহিতার ব্যাপারে? আমার অবস্থা কি তুমি বুঝতে পারছোনা?

এবার দিলারা বেগম মুখ খুললেন। এতক্ষণ চেপে রাখা কথা বের করে বেশ শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলেন,

—তোর অবস্থা কেন বুঝবো? তুই কখনো রাহিতার অবস্থা বুঝার চেস্টা করেছিস?

স্বপ্নিল অবুঝের ন্যায় তাকিয়ে থাকে মায়ের দিকে। থেমে থেমে শুধায়,

—মানে?

—মানেটা খুব সহজ, স্বপ্নিল। মেয়েটা এতদিন অপেক্ষায় ছিলো তোর ভালোবাসার, তোর থেকে স্ত্রীর যোগ্য মর্যাদার কিন্তু তুই তো ওকে সেভাবে মূল্যই দিতি না! এখন রাহিতা গেলেও তোর কি, আর থাকলেই বা কি!

মায়ের কথায় স্বপ্নিল কয়েক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। জবাব দেওয়ার ভা’ষা হারিয়ে ফেলে যেন! নিজেকে সামলে তে’জী কণ্ঠে উত্তর দেয়,

—মা, তুমি কি আদৌ জানো তুমি কি বলছো? তুমি যা বলছো তা অনেক আগের কাহিনি। আমাদের বিয়ের শুরুটা কিভাবে হয়েছিলো, কোন পরিস্থিতিতে হয়েছিলো, আমার মানসিক অবস্থা তখন কেমন ছিলো সবটাই তুমি জানো। আমাদের সম্পর্কের পারিপার্শ্বিকতাও তোমার থেকে লুকায়িত নয়। এখন দিন বদলেছে, আমি পাল্টেছি। রাহিতার প্রতি, আমাদের দুজনের সম্পর্কের প্রতি আমার দৃষ্টিভংগিও বদলে গেছে। তবুও তুমি এখন এসব কথা কেন বলছো আমি তো সেটাই বুঝতে পারছিনা!

এক নাগাড়ে সবগুলো কথা বলে স্বপ্নিল থামে। মায়ের উত্তরের অপেক্ষায় তার মুখের দিক চেয়ে রয় অনিমেষ। স্বপ্নিলের কথায় দিলারা বেগম তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন। ব্যঙ্গাত্বক কণ্ঠে শুধান,

—তাই নাকি? রাহিতাকে কখনো বলেছিস এসব? নাকি নিজের মনেই সব ঠিক করে কল্পনার জগতে বাস করছিস?

মায়ের কথায় স্বপ্নিলের চোয়াল শক্ত হয়। শীতল চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

—রাহিতা এসব বলেছে তোমায়?

স্বপ্নিলের প্রশ্নে দিলারা বেগমের রা’গ হয়। গর্দ’ভটা এখনো রাহিতাকেই ভুল ভাবছে?
দাতে দাত চেপে তিনি বললেন,

—রাহিতা কখনো কিছু বলে? এটা আমার চেয়েও ভালো তুই জানিস যে, রাহি কখনোই নিজের কস্ট অন্যকে বলার মতো মেয়ে নয়। তোদের দুজনের মধ্যে কি হয়েছে তা আমাকে বলেনি, অন্য কাউকে তো মোটেও না! বরং আমিই তোদের দুজনের মাঝের শিথিল হওয়া সম্পর্কের একটা সমাধান করতে ওর সাথে আলাপ করেছিলাম।

—কিসের আলাপ?

ভ্রু তুলে প্রশ্ন করে স্বপ্নিল। মায়ের কথাবার্তা খুব একটা সুবিধার ঠেকছেনা ওর কাছে৷ স্বপ্নিলের প্রশ্নে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে দিলারা বেগম সব খুলে বলেন। স্বপ্নিল বিদেশ থেকে ফিরে আসার পর সেদিন রাহিতাকে ডেকে এনে কি বলেছিলেন তা বিস্তারিত বলতেই স্বপ্নিলের চোখেমুখে আত’ঙ্কের রশ্মি উকি দেয়। আলাদা হওয়ার কথা কানে আসতেই এতক্ষণ ঢিপঢিপ করা হৃদপিণ্ড বক্ষপিঞ্জরের বাইরে আসতে ধরে!
নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ স্বপ্নিল চে’চিয়ে উঠে বলে,

—এসব কি বলছো, মা? কিসের ডি’ভোর্স? আমাদের দুজনের মধ্যে এমন কিছুই হয়নি যাতে বিষয়টা ডি’ভোর্স পর্যন্ত গড়ায়! আমরা দুজন কখনো আলাদা হবোনা! আমি রাহি-কে আমার থেকে আলাদা হতেই দিবোনা।

স্বপ্নিলের কথায় সরু চোখে ওর দিক তাকিয়ে থাকলেন দিলারা বেগম। স্বপ্নিলের ক্রো’ধা’ন্বিত অন’লে ঘি ঢেলে বলেন,

—এখন যে বড্ড দেরি হয়ে গেছে রে, বাপ। তুই যখন রাহিতাকে মেনে নিতে চাসনি, আমি তখনি রাহিতাকে কথা দিয়েছিলাম ও যদি কোনোদিন এ সম্পর্ক ছি’ন্ন করতে চায়, আমি ওকে সাপোর্ট করবো। কোনো বাধা দিবোনা। স্বেচ্ছায় ওকে যেতে দিবো। এখন তুই চাইলেও…

—আমি চাইলেও মানে? সবকিছু কি তোমাদের ইচ্ছেমতোই চলবে নাকি? আমার ইচ্ছের কোনো দাম নেই তোমার কাছে?

মায়ের কথা শেষ না হতেই ফু’সে উঠে বলে স্বপ্নিল। ওর চোখমুখ টগবগ করছে রা’গে৷ কি মনে করেছে এরা শাশুড়ী-বউমা? সব সময় নিজেদের মর্জি ওর উপর চাপিয়ে দিবে আর সে চুপচাপ মেনে নিবে?
অবশ্যই না! স্বপ্নিল আহমেদ নিজের বউকে কিছুতেই হাতছাড়া করতে পারবেনা! অসম্ভব!

মনে মনে এসব ভেবে মায়ের উদ্দেশ্যে দৃঢ়কণ্ঠে স্বপ্নিল বলে উঠে,

—দেখো, মা। অনেক হয়েছে এসব। আমি আর তোমাদের কথা মানতে পারবোনা। মগের মুল্লুক পেয়েছো নাকি? যখন মন চাইলো আমার বিয়ে করিয়ে দিলে আবার যখন মন চাইলো বউকে সরিয়ে দিলে? আমার দিকটা দেখি কেউ ভাবেইনা! আশ্চর্য!

একটু থেমে বলে,

—তবে অনেক হয়েছে, আর নয়। তোমার কথা তো বাদই দিলাম। রাহিতার বেশি সাহস বেড়েছে দেখছি! আমায় না বলে বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে? স্বপ্নিলের জীবন থেকে চলে যাওয়া কি এতই সহজ?

—ও হয়তো আসবেনা, স্বপ্নিল। জোর করবিনা ওকে। মেয়েটা এমনিতেই অনেক কস্টে আছে!

—আসবেনা মানে? ও আসবেনা, ওর ঘাড় আসবে! কোথায় গেছে বলো? নিশ্চয়ই বাপের বাড়ি, তাইনা? আর যাবেই না কোথায়! তাই তো! আমিও কেন যে বোকার মতো এতক্ষণ টাইম ওয়েস্ট করছিলাম! এক্ষণি যাচ্ছি ওর মাথা থেকে সব ভূত বের করতে! আর তোমার সাথে তো এসে কথা বলছি! খবরদার আটকানোর চেষ্টা করবেনা আমায়। আগে তোমার বউমাকে নিয়ে আসি। না আসতে চাইলে তুলে আনবো ওকে! বেশি আহ্লাদী হয়ে গেছে!

রা’গে গজগজ করতে করতে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো স্বপ্নিল। দিলারা বেগম ওকে বেশ কয়েকবার ডাকার পরেও সাড়া দিলোনা কোনো! ঝড়ের বেগে রুমে যেয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে শশুড়বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলো সে।

এদিকে স্বপ্নিলকে রে’গেমে’গে বাড়ি থেকে বের হতে দেখে তার অগোচরেই হেসে উঠলেন দিলারা বেগম। ছেলে তার ভালোই ক্ষে’পেছে। রাহিতার যাবার কথা শুনে কি পাগলামিটাই না করলো! হওয়ার পর থেকে আজ অব্দি কখনো তার সাথে উচু স্বরে কথা বলেনি স্বপ্নিল। আর আজ সে রাহিতার জন্য এরকম করলো! যাক, অবশেষে ছেলে তার ভালোবাসার জা’লে পা দিয়েছে ঠিকি। যে ভবিষ্যতের আশায় দুজনের জুটি বেধেছিলেন সেদিন আজ এলো ঠিকই! মনে মনে এসব ভেবে সন্তুষ্ট হলেন দিলারা বেগম! রাহিতা যে তার পিছে ঘটে যাওয়া এসবের কিছুই জানেনা। স্বপ্নিলকে হঠাৎ দেখে নিশ্চয়ই চমকে যাবে সে! স্বপ্নিল কি কি পাগলামি করতে পারে ভেবে নিজে নিজে হেসে আরেকদফা কুটি কুটি হলেন দিলারা বেগম। ঠিক সে সময় রুমে এলো সামিরা। মা-কে এভাবে একা একা হাসতে দেখে বেশ অবাক-ই হলো বটে! বিস্মিত সুরে জিজ্ঞেস করলো,

—কি ব্যাপার, মা? তুমি একা একা এভাবে হাসছো কেন?

আচমকক মেয়েকে আসতে দেখে নিজেকে সামলে নিলেন দিলারা বেগম। মেয়েকে উত্তর না দিয়ে চোখের চশমা ঠিক করে স্বপ্নিলের মাটিতে ফেলে রেখে যাওয়া নিউজপেপার তুলে নিয়ে গম্ভীর মুখে পড়তে লাগলেন। সামিরা সেদিকে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। অতঃপর প্রসঙ্গ পালটিয়ে কৌতুহলী কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,

—আচ্ছা মা, ভাইয়ের কি হয়েছে? উপর থেকে জিনিস ভা’ঙার আওয়াজ আসছিলো। খুব রে’গে আছে মনে হয়! আবার ঝড়ের বেগে কই যেন বের হয়ে গেলো! ওর কি হয়েছে তুমি কিছু জানো?

মেয়ের প্রশ্নে কিছুক্ষণ ওর দিক চেয়ে রইলেন দিলারা বেগম। মুখ ঠেলে বেরিয়ে আসা হাসিকে সাবধানে ঠেলে দিয়ে অবাক হওয়ার ভান করে বললেন,

—তাই নাকি! এই ছেলেটার যে মাঝেমধ্যে কি হয়? কে জানে!

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৪৪
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বাপের বাড়িতে নিজ রুমের বারান্দায় একা একা বসে আছে রাহিতা। ফোনটা বিছানার উপরে রাখা, বারকয়েক রিং হয়ে ওখানেই গড়াগড়ি খাচ্ছে। রাহিতা জানে এ সময় এতবার কে ফোন দিচ্ছে, কিন্তু স্বপ্নিলের ফোন ধরার ইচ্ছে-আকুলতা কোনোটাই এ মুহুর্তে ওর মাঝে নেই। রাহিতা বুঝেনা এ ছেলেটার সমস্যা কি! কাছে থাকলে তো কখনোই ভালোবাসার কথা বলেনা, তবে দূরে গেলে কেন এত ব্যাকুল হয়? একটু শান্তিতে ক’দিন একা থাকার জন্য রাহিতা এসেছে এ বাসায়। এখন স্বপ্নিলের সাথে কথা বলে সে শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটাবেনা সে আর! রাহিতার ভাবনার মাঝেই রুমে আসেন ওর মা। ওকে বারান্দায় একা বসে থাকতে দেখে ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলেন,

—কি রে, একা বসে আছিস কেন এভাবে?

—কিছুনা, মা। এমনিতেই বসে আছি। তুমি এখানে যে? রান্নাবান্না সব শেষ? কিছু হেল্প লাগবে আমার?

—হ্যাঁ। তুই একটু ডেজার্ট বানিয়ে দে তো, রাহি। আমি পোলাও রোস্ট সব বানিয়ে রেখেছি। এত কাজ সব ঠিকঠাক মিটে গেলেই হলো!

—ঠিক আছে। তুমি চলো, আমি আসছি।

মায়ের সাথে কথাবার্তা বলতে বলতে রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে চলে যায় রাহিতা। এক ফাকে উঁকি মারে বোনের রুমে। মূলত ওর ছোটবোন রিদিতাকে দেখতে আজ ছেলেপক্ষ আসবে বাসায়। প্রেমের সম্পর্ক ছিলো দুজনের, ছেলেরা অন্য শহরে থাকে। এ বছর সে বিদেশ চলে যাচ্ছে মাস্টার্স করতে তাই দেখা-সাক্ষাৎ করে সময়-ক্ষণ ঠিক করে সবার সম্মতিতে আকদ পড়িয়ে রাখতে চায় দুটো পরিবার। এজন্যই আজ ছেলেপক্ষকে লাঞ্চের দাওয়াত দিয়েছে রাহিতাদের বাড়ি থেকে। যার দরুন এত আয়োজন! রিদিতাকে নতুন জামাকাপড় পড়তে দেখে হাসিমুখে এগিয়ে যায় রাহিতা। আয়নার সামনে দাঁড়ানো বোনের পাশে দাঁড়িয়ে ওর কাধে হাত রেখে বলে,

—রেডি হওয়া শুরু করিসনি কেন এখনো? তোর শশুড়বাড়ির লোকেরা তো একটু পরেই আসবে।

—এইতো শুরু করবো এখন। ওর সাথে তো বেশিরভাগ সময় অনলাইনেই কথা হয়েছে, আপু। সামনাসামনি দু-তিন বার দেখা হয়েছে। তাই আজ পরিবার নিয়ে বিয়ের কথা বলতে আসছে দেখে বেশ নার্ভাস লাগছে।

রাহিতার হাত ধরে বলে রিদিতা। বোনের কথা শুনে আনমনেই হাসে রাহিতা। নিজের বিয়ের সময় এমন পরিস্থিতি সে পার করে এসেছে। যদিও স্বপ্নিল ও ফাহিম (রিদিতার হবু স্বামী) দুজনের মধ্যে পার্থক্য আছে। স্বপ্নিল এসেছিলো অনিচ্ছায়। আর ফাহিম আসছে স্বেচ্ছায়, নিজের ভালোবাসার মানুষকে নিজের করে পাওয়ার জন্য। তাই বোনকে অভয় দিতে রাহিতা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,

—এ সময় এমনটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক, রিদি। তবে তুই একদমই টেনশন করিস না। ফাহিমকে তো তুই চিনিসই, তাইনা? ওর পরিবারও ঠিকি তোকে পছন্দ করবে দেখিস। বাকিটা আমরা সামলে নেবো সবাই মিলে। এখন এসব ভাবা বাদ দিয়ে জলদি রেডি হ। আমি মা-কে হেল্প করি। খালামনি, মা দুজন মিলেই রান্না করছে। আমায় ডেজার্ট বানাতে বললো। যাই আমি? তোর কোনো হেল্প লাগলে ডাক দিস!

ঘড়ির কাটা পেরিয়ে দুপুরের ২টো বাজলো মাত্র। ফাহিম ফোন করেছে রিদিতাকে, বাসা সঠিক খুজে পাচ্ছেনা ওরা। রওনক অফিস থেকে এখনো বাড়ি পৌছায়নি বিধায় রাহিতার মা ওকে বললেন,

—তুই একটু এগিয়ে গিয়ে ওদের বাসা চিনিয়ে দিবি, রাহি? তোর বাবা তো মিস্টি আনতে বেরিয়েছে একটু আগে এখনো এলোনা। এদিকে ছেলেরা প্রায় পৌছেই গেছে। দাঁড়িয়ে রাখাটা ঠিক হবেনা।

—আচ্ছা, আমি যাচ্ছি। কোনো সমস্যা নেই। তুমি রিদিকে বলো ফাহিমের নাম্বার আমায় পাঠিয়ে দিতে। ওরা কোথায় আছে কথা বলে নিয়ে আসছি বাসায়।

রাহিতা বেরিয়ে যাওয়ার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে। এদিকে রাহিতাদের বাসা গলির শেষপ্রান্তে হওয়ায় গলির সামনে গাড়ি সাইড করে রেখে আগেই নেমে গিয়েছে ফাহিম। উদ্দেশ্য বাড়ির এক্সাক্ট ঠিকানা শুনে সেই দিকে গাড়ি নিয়ে যাওয়া। সরু গলিতে একবার ভুল দিকে গাড়ি ঢুকিয়ে ফেললে পরে দিক ঘুরাতে ঝামেলা পোহাতে হয়। কিছুক্ষণ গলির ভেতর হেটে যেতেই একটি গাড়ি চোখে পড়ে ওর। গাড়িওয়ালাকে এই এলাকার লোক মনে করে তাকে থামিয়ে বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করে ফাহিম।

______________

রা’গের চোটে বের হয়ে শশুড়বাড়িতে আসছিলো স্বপ্নিল। কিন্তু রাহিতাদের বাড়ির ওই গলির সম্মুখে ঢুকতেই একজনের ডাকে গাড়ি থামালো সে। পাশে তাকাতেই একটি শ্যামবর্ণের সুদর্শন পুরুষ নজরে এলো স্বপ্নিলের। স্বপ্নিলকে গাড়ি থামাতে দেখে ছেলেটা জানালার কাছে এগিয়ে এসে হাসিমুখে বললো,

—এখানে আজমল শিকদার সাহেবদের বাসা গলির কোনদিকে আপনি কি বলতে পারেন? আসলে এই এলাকায় নতুন এসেছি তো তাই চিনতে পারছিনা। কোন পাশ দিয়ে যাবো? ডান দিকে না বাম দিকে?

হঠাৎ এক আগন্তুক ছেলের মুখে নিজ শ্বশুরের নাম শুনে স্বপ্নিল খানিকটা অবাক হয়। একবার বাড়ির ঠিকানা বলতে গিয়েও বলেনা পাছে। খানিকটা কৌতুহল নিয়েই জিজ্ঞেস করে,

—হ্যাঁ, চিনি তো। তবে আপনাকে তো চিনলাম না। আপনি কি তাদের আত্মীয়?

স্বপ্নিল বাড়ি চিনে শুনে ফাহিম মনে মনে বেশ খুশি হলো! সেই খুশির রেশ ওর চোখেমুখে খেলা করলো, যেদিকে ভ্রু কুচকে চেয়ে রইলো স্বপ্নিল। এরই মাঝে ফাহিম হালকা হেসে বললো,

—জি, এখনো আত্মীয় হইনি। তবে খুব শীঘ্রই হতে যাচ্ছি বৈকি!

—তা কিভাবে?

—আসলে যার বাড়িতে যাবো উনি আমার হবু শ্বশুর মশাই। মেয়ে দেখতে যাচ্ছি তো, প্রথম বার এদিকে আসলাম। তাই রাস্তা চিনছিনা। বাই দ্যা ওয়ে, থ্যাংক ইউ..

ফাহিম কথা বলা শেষ করবে এরই মাঝে ওর ফোনে কল আসায় সে থেমে যায়। স্বপ্নিল তখনো খটকায়! মেয়ে দেখতে আসছে মানে? এসব কি বলছে এই ছেলে? কপালে চিন্তার ভাজ নিয়ে থাকার মাঝে হঠাৎ করে ফাহিমের কথায় স্বপ্নিলের হৃদপিণ্ড থমকে যায়, কান খাড়া হয়, নজর তীর্যক হয়।

—হ্যালো? ওহ! রাহিতা? জি জি, আমি আপনাদের গলির মাথাতেই আছি। এলাকার ফার্মাসির সামনে। না না, আসতে হবেনা।

ফাহিম কথা শেষ করবে এরই মাঝে স্বপ্নিল তড়াক করে দরজা খুলে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে এবং মুহুর্তেই ওর সামনে চলে আসে। কল কেটে সামনে তাকাতেই স্বপ্নিলকে নিজের সামনে দেখে খানিকটা অবাকই হয় ফাহিম। তবু পাশ কাটিয়ে পেছনে নিজেদের গাড়ির দিকে যেতেই স্বপ্নিল ওকে বাধা দেয়। ওর চোখমুখ বেজায় শক্ত। মাথার ভাজে বিবিধ চিন্তার পাক। ফাহিম ওর শশুড়বাসায় মেয়ে দেখতে যাচ্ছে, এর মধ্যে আবার রাহিতার সাথে ফাহিমের কথা। এ সবকিছু কোনদিকে ইংগিত করছে? এজন্যই কি এভাবে চলে এলো রাহিতা? সবকিছু মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত চিন্তায় কপাল ঘামতে শুরু করেছে স্বপ্নিলের। একদিকে ওর মন বলছে – রাহিতা ওর সাথে এমন করতে পারেনা, কিন্তু কাল রাতে রাহিতার ওসব কথা, একিসাথে আজ সকালে মায়ের কথাবার্তা শুনে স্বপ্নিলের অশান্ত মস্তিষ্ক তা মানতে নারাজ! রাহিতা যদি সত্যিই ওকে ছাড়তে চায়?
স্বপ্নিলের হৃদপিণ্ডের ছটফটানি বাড়ে, অসহ্য দহনে বুকের ভেতর কেপে উঠে। অত্যন্ত হিং’স্র অথচ গম্ভীর কণ্ঠে ফাহিমের উদ্দেশ্যে বলে,

—যেখান থেকে এসেছো, সেখানেই চলে যাও!

আচমকা স্বপ্নিলের মুখে এমন কথা শুনে ফাহিম চমকে উঠে। লোকটা কে? আর এটা কেন-ই বা বলছে তাকে? আশ্চর্য তো! তবে স্বপ্নিলের কথাকে সে বিশেষ পাত্তা দেয়না। আগের মতোই নির্বিকারভাবে হেটে চলে যেতে লাগে নিজের গাড়ির দিকে। যা দেখে স্বপ্নিলের রাগ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। ক্রো’ধে দ্বিকবিদিক ভুলে যাওয়া স্বপ্নিল দ্রুতবেগে এগিয়ে এসে ফাহিমের কলার চেপে ধরে। আচমকা এহেন আক্রমণে ফাহিম বেশ অবাক হয়, একিসাথে রে’গেও যায়। স্বপ্নিলের হাত থেকে নিজের কলার ছাড়ানোর চেস্টা করতে করতে বলে,

—কি সমস্যা আপনার? পা’গল নাকি? এভাবে চিনেন না জানেন না এমন মানুষের কলার চে’পে ধরছেন কেন? আজব তো!

ফাহিমের কথায় এতক্ষণ আটকে রাখা মেজাজ নিমিষেই সপ্তাকাশে উঠে স্বপ্নিলের। একপ্রকার চেচিয়ে ওকে ধমক দিয়ে বলে,

—আমি পাগ’ল না? আমার কথা না শুনলে এখন তোর এমন অবস্থা করবো যে তুই নিজেই পা’গল হয়ে যাবি, বুঝেছিস? তোকে ভালোভাবে বলছি যেখান থেকে এসেছিস সেখানেই ফেরত চলে যা। ওই বাসায় মেয়ে দেখতে যেতে হবেনা!

—দেখেন মিস্টার, আপনাকে দেখে যথেষ্ট ভালো পরিবারের মনে হচ্ছে। আমি জানিনা আপনি কেন এরকম গু’ন্ডার মতো বিহেভ করছেন। কিন্তু আমি আপনার কথা মানতে বাধ্য নই। একবার কেন, একশবার মেয়ে দেখতে যাবো। আমার হবু বউকে আমি দেখতে যাচ্ছি, এতে আপনার কি?

—আমার কি মানে? আমারই তো সব! তুই যাকে দেখতে যাচ্ছিস সে আমার! একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ, রাহিতা আমার বউ। ও শুধু আমার। রাহিতার দিকে চোখ দিলে কিভাবে সেই চোখ টে’নে তুল’তে হয় তা স্বপ্নিলের ভালোভাবেই জানা আছে! এজন্যই বলছি ভালোই ভালোই এখান থেকে চলে যা নয়তো…

স্বপ্নিলের মুখে রাহিতার নাম শুনে ফাহিম কিছুটা আন্দাজ করতে পারে কি হচ্ছে এখানে। স্বপ্নিল যে ওকে ভুল ভাবছে তা দিব্যি বুঝতে পারছে সে। তাই নিজেকে সামলে বেশ খানিকটা বল প্রয়োগ করে স্বপ্নিলের হাত থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে বলে,

—হোয়াট? আপনি এসব কি বলছেন? দেখুন, এখানে একটা বড় মিস-আন্ডারস্ট্যান্ডিং হয়েছে। আমি রাহিতাকে না…

ফাহিম কথা বলা শেষ করতে পারেনা। তার আগেই স্বপ্নিল ফুসে উঠে ওর দিকে আংগুল তাক করে হিস’হিসিয়ে বলে,

—খবরদার রাহিতার নাম মুখে নিবিনা। আর কখনো যদি রাহিতার সাথে যোগাযোগ করার চেস্টা করেছিস তবে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা…

স্বপ্নিল কথা শেষ করতে পারেনা কারণ এরই মাঝে রাহিতা সেখানে চলে আসে। ওকে ছুটে আসতে দেখে নিজ হতেই স্বপ্নিলের মুখ থেমে যায়। সারাদিন পর নিজের সামনে প্রেয়সীর দেখা পেয়ে স্বপ্নিলের অন্তর শীতল হয়, গতি মন্থর হয়। এতক্ষণ মনের ভেতর টগ’বগ করতে থাকা অনল নি’ভে যায়।

#চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ