Monday, October 6, 2025







মন বিনিময় পর্ব-৩০+৩১

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩০
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

রঙ-বেরঙের মরিচ বাতির আলোয় সজ্জিত বিয়েবাড়ি। চারদিকে মানুষের ভীড়, দম ফেলার বিন্দুমাত্র অবকাশ নেই যেন কোথাও! একটু পরেই শুরু হবে বিয়ের অনুষ্ঠান, বর‍যাত্রী এসে যাবে যেকোনো মুহুর্তে। শেষ মুহুর্তে সবকিছুর তদারকিতে ব্যস্ত গুরুজনেরা, পাছে কোনোকিছুর কমতি না রয়ে যায় কোথাও! মেহমানদের সাথে আসা ছোট বাচ্চারা এদিক-সেদিক দৌড়াদৌড়ি করছে, বড়দের ব্যস্ততায় তাদের যেন কোনোই হেলদোল নেই। এরই মাঝে একজোড়া চোখ এত ভীড়ের মধ্যেও ক্লান্তিহীনভাবে খুজে চলছে কাউকে। স্বপ্নিলের মেজাজ তীক্ষ্ম, কিন্তু কেন তা সে জানেনা৷ হঠাৎ করেই ভীষণ বিরক্ত লাগছে ওর, এত হইচই, চারদিকে সাউন্ডবক্সে গান বাজছে সব মিলিয়ে মাথা ধরার উপক্রম। তার মধ্যে সকাল থেকে রাহিতার দেখা পাওয়া যাচ্ছেনা, যা মন-মেজাজ আরও বি’ষিয়ে দিয়েছে স্বপ্নিলের। মেয়েটা কোথায় যে গেছে, রেডি হয়েছে কিনা তাও জানেনা স্বপ্নিল। সেদিন তো পাঞ্জাবির বাহানায় তাও দেখা মিলেছিলো কিন্তু আজ সেটাও করা যায়নি! বলতে গেলে এমনটা করার সুযোগই পায়নি স্বপ্নিল কেননা রুমে ঢুকতেই বিছানার উপর স্যুট-প্যান্ট দেখে স্বপ্নিল বুঝে এটা রাহিতার কারসাজি৷ তাই চুপচাপ হতাশ মুখে রেডি হয়ে বাইরে চলে আসে। এরপর সবার সাথে এ কাজ সে কাজ দেখতে দেখতেই বাকি সময় কেটে যায়। সবমিলিয়ে বিরক্তিতে স্বপ্নিলের মেজাজ যখন তুঙ্গে ঠিক তখনি একটি হাত পেছন থেকে কাধে হাত রাখে ওর। মেয়েলি স্পর্শ অনুভব করায় এটা কে হবে অনুমান করে মুহুর্তেই স্বপ্নিলের চেহারায় বিরক্তির রেখা সরে গিয়ে হাসির দেখা মিলে, সেভাবেই পেছন ঘুরতে সামনে দাঁড়ানো মানুষটাকে দেখে ও চমকে যায়!

রাহিতা নয়, স্বপ্নিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আমিরা, যে সম্পর্কে স্বপ্নিলের খালাতো বোন। যার আরেকটি পরিচয়, সে আনিকার ছোট বোন। আমিরাকে হঠাৎ করে এতদিন পর দেখে স্বপ্নিল বিস্ময় প্রকাশ করে বলে,

—কিরে, তুই এতদিন পর এখানে? কখন এসেছিস? হলুদে আসিস নাই কেন?

—আমি একটু আগেই এসেছি, ভাইয়া। একবার ভেবেছিলাম আসবোনা, পরে কাল হঠাৎ মনে হলো অনেকদিন বিয়ে খাইনা, আসা উচিত আমার।
তাই সকালের বাস ধরে চলে এসেছি একবারে৷ আসতে যেহেতু লেট হয়ে যাবে তাই একবারে পার্লার থেকে সেজেই এসেছি বিয়েবাড়িতে। এজন্য বেশি দেরি হলো। কেমন আছো?

—আছি, খারাপ না।

—এখনো মনমরা হয়ে থাকো নাকি? অবশ্য তোমায় দেখে তো সেটা মনে হচ্ছেনা! লাস্ট যেদিন দেখেছিলাম তার চেয়ে অনেকটাই ফ্রেশ ও হাসিখুশি লাগছে তোমায়৷

আগ্রহভরে বলে উঠলো আমিরা। ওর কথার বিপরীতে স্বপ্নিল মাথা নাড়িয়ে বলে,

—তা অবশ্য ভুল বলিসনি। আমি যেমনটা থাকবো ভেবেছিলাম, তার চেয়ে তো অনেক ভালো আছি এখন আলহামদুলিল্লাহ!

মুচকি হেসে বলে স্বপ্নিল। সে হাসি লক্ষ্য করে অন্তরে এক প্রকার প্রশান্তি অনুভব করে আমিরা। কেননা সে নিজেই দেখেছিলো তার বোনের মৃত্যুর পর স্বপ্নিলের কেমন অবস্থা হয়, কতটা ভেঙে পড়ে সে। তাইতো বিবেকবান আমিরা নিজ থেকে সিদ্ধান্ত নিয়ে স্বপ্নিলের বিয়ের পর ওর অফিস যেয়ে আনিকার ডায়েরি দেখায় ওকে। বোনের অতীত সম্পর্কে সবকিছু স্বপ্নিলকে বলে দেওয়ার কাজটা সে এজন্যই করে যাতে স্বপ্নিল জীবনে মুভ অন করতে পারে, নিজের অতীত ভুলে বর্তমানকে সাদরে গ্রহণ করতে পারে! তাই আজ স্বপ্নিলের কথায় ও স্বাভাবিক আচরণে ভীষণ খুশি হয় আমিরা৷ উচ্ছাসিত গলায় বলে,

—যাক! শুনে খুব খুশি হলাম। এভাবেই ভালো থাকো সারাজীবন। তা তোমার বউ কোথায়? মা-র জন্য তোমার বিয়েতেও তো যেতে পারিনি, আবার ছবিও তো দেখিনি ভাবীর।

—জানিনা। ও যে কই আছে, কি করছে কিছুই জানিনা আমি!

হতাশ মুখে বলে স্বপ্নিল। তা শুনে সরু চোখে চেয়ে আমিরা প্রশ্ন করে,

—ওমা, তা কেন? এখন আবার এটা বলোনা যে ভাবীর সাথে তোমার সম্পর্ক এখনো স্বাভাবিক হয়নি? কামঅন ভাইয়া, মাস পার হয়েছে তোমাদের বিয়ের। যথেষ্ট সময় এটা মুভঅন করার…

—আরে ধুর, তুই অযথাই ভুল বুঝছিস। এমন কিছুই না। আমাদের মধ্যে সব পুরোপুরি ঠিক না থাকলেও যথেষ্ট স্বাভাবিক আমরা, দুজন একে-অপরের সাথে বেশ কম্ফোর্টেবল এখন। আমি তো এজন্য বলছিলাম কারণ কাজের চাপে সকাল থেকে আমি ও রাহি কেউ কারও চেহারা দেখারও সুযোগ পাইনি।

—ইশ রে! আচ্ছা পরে দেখা হবে সমস্যা নেই। আপাতত ছবি দেখাও ভাবীর! দেখি তো কে সেই লাকি মেয়ে যে আমাদের স্বপ্নিল ভাইকে পেলো?

আমিরার কথায় হাসতে হাসতে রাহিতার ছবি দেখানোর জন্য পকেট থেকে ফোন বের করছিলো স্বপ্নিল। পরক্ষণেই ওর হাসিমুখ মিলিয়ে গেলো যখন পুরো ফোন ঘেটেও রাহিতার একটা ছবিও পেলোনা। না নিজের সাথে, না ওর একার৷ হুট করেই স্বপ্নিল অনুভব করলো বিয়ের এতদিনেও রাহিতার সাথে একটা সিংগেল কাপল পিক নেই ওর কাছে, এমনকি রাহিতার কোনো সিংগেল ছবিও তার সংগ্রহে নেই। বিষয়টা কেন যেন খারাপ লাগলো স্বপ্নিলের। সে এতদিন এটা খেয়াল করেনি কেন? আশ্চর্য!

__________________

বরযাত্রী মিনিট পাচেক এর মধ্যে চলে আসবে বাসায়। তা শুনে সকলের ব্যস্ততা কয়েকশো গুণ বাড়লো। এদিকে গাঢ় নীল রঙের শাড়ি পড়ে সেজেগুজে রেডি হওয়া রাহিতা অবশেষে বউয়ের রুম থেকে বের হতে পারলো। এতক্ষণ শাশুড়ি ও বাড়ির মেয়েদের সাথে বাড়ির বউ হিসেবে কনের সাথে বসেছিলো রাহিতা। মনে মনে স্বপ্নিলের সাথে দেখা করার ইচ্ছা থাকলেও মুখফুটে এটা সে বলতে পারেনি কাউকে, না-ই বের হতে পেরেছে রুম থেকে। তাই অবশেষে সুযোগ মিলায় রাহিতা যেন হাফ ছেড়ে বাচলো! আশেপাশে তাকিয়ে বাড়ির মেইন ফটকের দিকে এগোতেই স্বপ্নিলকে চোখে পড়লো তার। শুধু স্বপ্নিলকে দেখলো বললে ভুল হবে, অচেনা এক মেয়ের সাথে হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলকে দেখলো। যা দৃষ্টিগোচর হতেই চলন্ত কদম নিজ থেকেই থেমে গেলো রাহিতার। ভ্রুযুগলে ভাজ ফেলে সেদিক কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো সে, পরপর এগিয়ে গেলো তাদের দিকে। ধীরে ধীরে স্বপ্নিলের পেছনে এসে দাড়ালো রাহিতা। এদিকে স্বপ্নিল নিজের কথায় ধ্যানমগ্ন থাকায় ওর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকা নিশ্চুপ রাহিতার উপস্থিতি অনুভব করতে পারেনি, যা আরেকটু কস্ট দিলো রাহিতার ঈর্ষান্বিত মনকে! স্বপ্নিল ওর উপস্থিতিও টের পেলোনা তাই বলে? কি এমন ব্যস্ত সে অন্য মেয়েটার সাথে! সারাটা দিন যে তাদের দেখা হয়নি সেটার কোনো প্রভাব পড়েছে লোকটার উপর? পড়েনি! এজন্যই ওকে ভুলে ঠিকই অন্য মেয়ের সাথে খোশগল্পে মেতে উঠেছে!
মনে মনে ফুসে উঠে রাহিতা।

পরক্ষণেই গলা ঝেড়ে নিজের উপস্থিতির জানান দেয় খানিকটা ক্রু’দ্ধ ভাবেই! আওয়াজ পেয়ে পেছনে তাকাতেই গোমড়া মুখের রাহিতাকে নজরে পড়ে স্বপ্নিলের। সাথে সাথেই মুখের হাসি আরেকটু বেড়ে যায়। রাহিতাকে পেছন থেকে টেনে নিজের পাশে নিয়ে এসে বলে,

—সারাদিন পর তোমার দেখা পেলাম। এতক্ষণে সময় হলো বুঝি?

—হুম

রাহিতার ঠান্ডা উত্তরে স্বপ্নিল খানিকটা চমকে যায়। পরক্ষনেই মাথা না ঘামিয়ে সামনে দাঁড়ানো আমিরার সাথে ওকে দেখা করিয়ে দিতে বলে,

—রাহি, এটা আমিরা, আমার খালাতো বোন। সীমা খালামনির ছোট মেয়ে। আমিরা, ও রাহিতা। আমার বউ।

—হুম তা তো দেখেই বুঝেছি, ভাইয়া। ভাবী কেমন আছো? এই প্রথম তোমার সাথে দেখা হলো।

—ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন? আপনার সাথে দেখা হয়ে ভালো লাগলো, আপু।

—আমি ভালো আছি। সবাইকে সারপ্রাইজ দিতে এ সময় হুট করে চলে এলাম বিয়েতে। মা-ও জানেনা বুঝেছো? এখন দেখে চমকে উঠবে নির্ঘাত! তবে ভাবী, তুমি কিন্তু খুব সুন্দর। স্বপ্নিল ভাইয়ার সাথে বেশ মানিয়েছে।

—তাই? তুই বললি আর বিশ্বাস করতাম?

আমিরার কথার বিপরীতে বলে উঠে স্বপ্নিল। ওর কথায় সে বলে,

—উফফ! তুমিও না ভাইয়া। আগের মতোই ফাজলামি করো শুধু। আচ্ছা, দাড়াও তোমাদের একটা ছবি তুলে দিই তারপর দেখো।

আমিরার কথায় স্বপ্নিল মনে মনে কু’টিল হাসে৷ সূক্ষ্মভাবে করা তার কৌশল কাজে লেগে গেলো। মূহুর্ত বিলম্ব না করে স্বপ্নিল নিজের ফোন এগিয়ে দিলো আমিরার দিকে। রাহিতা নীরবে সবকিছু দেখছিলো শুধু৷ পোজ দেওয়ার জন্য স্বপ্নিল রাহিতার দিক তাকালেও, সে নিজের জায়গায় দাঁড়িয়ে আগেকার ন্যায় ভো’তা মুখে দাঁড়িয়ে আছে সামনের দিকে। এবার স্বপ্নিল হুট করে রাহিতার বাহু টেনে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কিঞ্চিৎ বিস্ময়ে রাহিতা তাকাতেই বললো,

—কি? এভাবে তাকাচ্ছো কেন? ছবি তো মানুষ এভাবেই তুলে। তুমি এত দূরে দাঁড়িয়ে থাকলে তো এক ফ্রেমেই আটবোনা আমরা! কাছে আসো, বোকা মেয়ে।

স্বপ্নিলের কথায় হতভম্ব রাহিতা কি রিয়েকশন দিবে ভেবে পাচ্ছেনা। মানুষের সামনে এরকম নির্লজ্জ কথাবার্তা কে বলে? অদ্ভুত! রাহিতার চেহারা দেখে ও স্বপ্নিলের কথায় হেসে ফেললো সামনে দাঁড়িয়ে থাকা আমিরা। হাসতে হাসতেই বললো,

—ভাইয়া, তুমি আর বদলাবে না তাইতো? ইশ, রাহিতা ভাবী লজ্জা পাচ্ছে দেখো!

—তোর ভাবীর প্রতিদিনের রুটিন বিনাকারণে লজ্জা পাওয়া। এটা নতুন কিছু না।

—এই আপনি চুপ করবেন?

দাতে দাত চেপে বলে রাহিতা। ওর মনে স্বপ্নিলের প্রতি একটা চাপা রা’গ রয়েই গেলো এতক্ষণ একবারো ওর খোজ না নেওয়ার জন্য, যা এ মুহুর্তে আমিরার সামনে প্রকাশ করলোনা সে। এদিকে রাহিতার কথায় হেসে ফেলে স্বপ্নিল ও আমিরা।

অতঃপর স্বপ্নিল ভদ্রছেলের ন্যায় রাহিতাকে কাছে নিয়ে ওকে ধরে পোজ দেয়। রাহিতাও ছবির খাতিরে হাসিমুখে ক্যামেরায় তাকায়। দুজন হাসিমুখে দুজনের দিকে তাকিয়ে, ঠিক যেন একটা পারফেক্ট কাপল মনে হচ্ছে তাদের। আমিরাও সুযোগ বুঝে ক্যামেরায় ক্লিক করে ফটাফট। মুহুর্তেই ক্যামেরাবন্দী হয় কিছু দুজনার একত্রে কিছু ছবি। ফোন হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দুজনের ছবি দেখে আমিরা হঠাৎ আবেগপ্রবণ কণ্ঠে বলে,

—আসলেই তোমাদের মেড ফর ইচ আদার মনে হচ্ছে৷ হয়তো তোমার সাথে স্বপ্নিল ভাইয়ার জুটি লেখা ছিলো এজন্যই এভাবে তুমি ভাইয়াকে পেলে, ভাবী। যে জায়গায় আজ আমার বোনের থাকার কথা ছিলো কিন্তু সে জায়গা কখনো তার ছিলোনা। এজন্যই তার হওয়ার আগে সে আমাদের ছেড়ে চলে গেলো!

ওর কথায় খানিকটা খারাপ লাগে রাহিতার৷ মেয়েটার হয়তো কস্ট লাগছে নিজের বোনের কথা মনে হওয়ায়। কিন্তু একিসাথে আমিরার প্রতি মুগ্ধ হয় সে, কতটা সাবলীলভাবেই না সে ভাগ্যকে মেনে নিয়েছে নির্দ্বিধায় যেটা তার মা, সীমা বেগম করতে পারেননি। মা-মেয়ে তবু তাদের মধ্যে কত পার্থক্য!

ভাবুক রাহিতা মুখ খুলে আর কিছু বলবে, সে মুহুর্তে বরপক্ষ চলে আসায় ওর কথা অপূর্ণ থেকে গেলো। সে চটজলদি আর সবার সাথে গেটের দিকে চললো। স্বপ্নিলও রাহিতার পিছু পিছু যাবে এমন সময় আমিরা পেছন থেকে বললো,

—ভাবীর কি কোনোকিছু নিয়ে মন খারাপ, ভাইয়া? দেখে মনে হলো কেন জানি।

—তোরও মনে হয়েছে? আমিও তাই ভাবছিলাম। কি যে হলো ওর হঠাৎ বুঝলাম না! কথা বলতে হবে রাহিতার সাথে। কিন্তু সুযোগই পাচ্ছিনা খুব একটা, এটাই হলো কথা!

—আচ্ছা। একটা কথা, মা কি এখানে কোনো সিন ক্রিয়েট করেছে? ভাবীকে বা তোমায় কোন কথা শুনিয়েছে?

আমিরার কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে স্বপ্নিল। মাথা নাড়িয়ে বিষাদ সুরে বলে,

—খালামনিকে তুই চিনিস না? সে কি ছেড়ে দিবে? আমাকে বললে না হয় আমি শুনতাম কিন্তু রাহিতার তো দোষ নেই কোথাও তবুও তিনি রাহিতাকেই সুযোগ পেলে খোটা দেয়।

স্বপ্নিলের কথা শুনে শ্বাস ফেলে আমিরা। সে জানতো নির্ঘাত তার মা এমন কিছু করবে। মূলত এজন্যই সে এসেছিলো এখানে কি হচ্ছে তা দেখতে। আর স্বপ্নিল-রাহিতাকে দেখে যা বুঝার সে বুঝে গেছে। এখন থেকে মায়ের উপর খেয়াল রাখবে সে। ওর ভাবনার মাঝেই স্বপ্নিল চলে যেতে যেতে বলে,

—তোর সাথে পরে কথা বলবো। এখন বরযাত্রীদের আপ্যায়ন করতে হবে। আয়!

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ৩১
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

বরপক্ষের আপ্যায়নে কোনো কমতি রাখা হয়নি। সবকিছু সুন্দরভাবে পরিচালনা হয়েছে। বিয়ে পড়ানো ও খাওয়া-দাওয়ার কার্যক্রম শেষে এখন বিদাইয়ের প্রস্তুতি চলছে। স্বপ্নিল ভীষণ ব্যস্ত, এদিক সেদিক ফোন নিয়ে ছুটছে মামাদের সাথে। কাজের ব্যস্ততায় রাহিতা নিজেও স্বপ্নিলের জন্য মনে চেপে রাখা সূক্ষ্ম রাগ ভুলে গিয়ে ছুটতে লাগলো! তেমনিভাবে বাপের বাড়ি থেকে ফোন আসায় সে চলে গেলো বাড়ির পেছনের দিকটাই। যেখানে কোলাহল নেই একদমই, সবাই বাসার ভেতরেই ব্যস্ত। কথা শেষ করে কয়েক কদম এগোতেই হঠাৎ সীমা বেগমের কণ্ঠ কানে এলো তার।

—এই মেয়ে শুনো।

—আমায় বলছিলেন, খালামনি?

—তুমি ছাড়া এখানে আর কেউ আছে যাকে বলবো? আজব মেয়ে তো!

চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে সীমা বেগম। তার কথার বিপরীতে রাহিতা মুচকি হেসে বলে,

—আমার নাম রাহিতা৷ নাম ধরে না ডাকলে কিভাবে বুঝবো কাকে ডাকছিলেন? তাই বললাম!

রাহিতার কথায় চোখ সরু হয়ে আসে সীমা বেগমের। তার মতে ‘উড়ে এসে জুড়ে বসা’ মেয়েটার এত স্পর্ধা দেখে নিমিষেই রাগে কেপে উঠে তনুমন! হিসহিসিয়ে বলেন,

—এই মেয়ে, তোমার কি লজ্জা করেনা এতকিছুর পরেও এভাবে আমার সাথে কথা বলতে? অবশ্য আমিও বা কাকে বলছি! লজ্জা থাকলে তুমি এভাবে চলাফেরা করতেই না। সবকিছু জেনেশুনেও আমার সামনে এমন দাম্ভিকতা দেখাতেনা!

মহিলার এহেন কথায় মনে মনে বেশ কস্ট পায় রাহিতা। একটা মানুষ কি করে নিজ শোকে এতটাই পাগল হয় যে বারবার সামনের জনকে অপমান করার জন্য মুখিয়ে থাকে? রাহিতা ভেবে পায়না। কস্টে দুচোখে পানি আসতে চায়, কিন্তু সে আসতে দেয়না। ভাবে এবার তাকে একটা উচিত জবাব দিতেই হবে। নয়তো আর যে ক’টা দিন আছে এখানে, শান্তিতে থাকতে পারবেনা সে। দ্বিধা ছেড়ে রাহিতা এবার বলে,

—খালামনি আপনি আমার শাশুড়ি মায়ের বোন বলেই আপনার সম্মানার্থে কিছু বলিনি এ কয়দিন। তবুও যদি আপনার কাছে মনে হয় আমি আপনাকে দাম্ভিকতা দেখাচ্ছি তবে আমার কিছুই বলার নেই। এখানে আসার পর থেকে একই বিষয় নিয়ে পড়ে আছেন আপনি। আমি জানি আপনার কস্ট হয় আমায় দেখলে, হয়তো আমায় যতবার দেখেন ততবারই নিজের মেয়ের কথা মনে হয়ে খারাপ লাগে আপনার। কিন্তু তাই বলে বারবার এভাবে আমায় কথা শুনানোর কি মানে হয়? আমি তো আপনার কোনো ক্ষতি করিনি তাইনা? আনিকা আপুর সাথে যেটা হয়েছে সেটা একটা এক্সি’ডেন্ট ছিল, এটাতে আমার কোনো হাত ছিলো কি? আমি তো তার যাওয়ার পরেই স্বপ্নিলের জীবনে এসেছি।

এটুকু বলে থেমে গেলো রাহিতা। এক পলক চেয়ে দেখলো সীমা বেগমের মুখভঙ্গি। অথচ তার মুখ নির্বিকার। একটু নিশ্বাস নিয়ে সে আবারো বলে,

—আর একটা কথা হচ্ছে, উনাকে বিয়ের আগে আমি জানতামও না তার জীবনে কোনো অতীত ছিলো, আনিকা আপুর মৃত্যুর ব্যাপারটাও আমাদের বিয়ের পরেই জানতে পারি। সব শুনে আমার নিজেরও ভীষণ খারাপ লাগে কিন্তু জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকেনা তাইনা, খালামনি? আমার জায়গায় যদি আজ আনিকা আপু হতো তবে কি আপনি তার সাথেও এভাবে বিহেভ করতেন যেটা আমার সাথে করছেন? আমার জায়গায় একবার নিজের মেয়েকে ভেবেই দেখুন…

—শাট আপ। চুপ করো তুমি মেয়ে। একদম নিজের সাথে আমার মেয়ের তুলনা দেবেনা তুমি!

এতক্ষণ চুপচাপ রাহিতার সব কথা শুনে গেলেও হঠাৎ আনিকার নাম নেওয়ায় পুরনো রাগ ফিরে আসায় আবার গর্জে উঠেন সীমা বেগম। এবার রাহিতা মনে মনে ভীষণই হতাশ হয়। সে বুঝে ইনাকে ইহকালেও আর বুঝানো যাবে কোনোকিছু। যে মুহুর্তে রাহিতা হাল ছেড়ে দিলো ঠিক তখনি হঠাৎ কোথা থেকে যেন তার পাশে এসে দাড়ালো আমিরা। মায়ের দিক তাকিয়ে বেশ শান্তভাবে প্রশ্ন করলো,

—তুমি রাহিতা ভাবীর সাথে এভাবে কথা বলছো কেন, আম্মু? কি সমস্যা তোমার?

মেয়ের কথায় যারপরনাই অবাক হয়ে তিনি বললেন,

—আমার সমস্যা কি মানে? এখানে এসে তোরও মাথা গেছে নাকি?

—আমার মাথা কেন যাবে? আমি যা-সব শুনলাম সেটার উপর ভিত্তি করেই বলছি। তুমি ভাবীর সাথে এইরকম বিহেভ করছো কেন? কি করেছে সে?

—বাহ! এখন দেখি আমার মেয়েও আমায় প্রশ্ন করছে, বিয়েবাড়িতে আসতে না আসতেই তোকেও নিজের দিকে করে নিলো না মেয়েটা? আমি তো আর এমনি বলিনি যে এই মেয়েই সব সমস্যার মূল!

মায়ের কথায় বিরক্ত হলেও মোটেও বিচলিত হলোনা আমিরা। কেননা স্বপ্নিল ইতোমধ্যে তাকে বলেছে সীমা বেগমের রাহিতার সাথে করা ব্যবহারের কথা। তা শুনেই মূলত সে মা-কে খুজছিলো কথা বলার জন্য এবং পথিমধ্যে এ নির্জন দিকটাই এসে দুজনকে একসাথে দেখতে পায়। উপরন্তু তাদের কথা শুনার জন্য এতক্ষণ আড়াল থেকেই দুজনকে লক্ষ্য করছিলো সে। কিন্তু এতকিছুর পরেও নিজ জননীর একগুঁয়ে কথায় মেজাজ হারিয়ে সে নিজেই চলে আসে দুজনের কথার মাঝে। আমিরাকে ওর জন্য নিজ মায়ের সাথে এভাবে কথা বলতে দেখে রাহিতার সরল মন কস্ট পায়। সে আমিরার হাত টেনে ধরে বলে,

—বাদ দাও, আপু। আমরা এমনিতেও আর বেশিদিন নেই এখানে, অযথা বিয়েবাড়িতে কোনো সিনক্রিয়েট করার দরকার নেই। আমি চলে যাচ্ছি, দেখি বাকিরা কি করে।

—বাহ। এভাবেই কথার জালে স্বপ্নিল, দিলারা আপার পাশাপশি আমিরাকেও একদিনে পটিয়ে ফেলেছো তাইনা? খুব চালু মেয়ে তো তুমি!

উনার কথায় বিরক্তবোধ করলেও আর তর্ক করার রুচি নেই রাহিতার। যে বুঝতে চাইবেনা তাকে হাজারবার চেস্টা করলেও বুঝানো যাবেনা এ কথাটা যেন সীমা বেগমকে দেখেই উপলব্ধি করেছে সে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে রাহিতা চলে যেতে ধরতেই ওকে থামিয়ে দেয় আমিরা। মায়ের কথায় অতীষ্ঠ হয়ে শেষমেশ বলে,

—আল্লাহর ওয়াস্তে চুপ করো, আম্মু। আর কত শুনাবে এই মেয়েটাকে? নেহাত ভালো মেয়ে বলে তোমায় ভদ্রভাবে হ্যান্ডেল করছিলো রাহিতা। নয়তো অন্যকেউ হলে বিনা অপরাধে এতকিছু শুনে কোনোদিনও এত ভালোভাবে কথা বলতোনা, ত্যাড়াভাবেই উত্তর দিতো তোমায়। আর আমি বুঝিনা…

—তুই আমাকে চুপ করতে বলছিস, আমিরা? আমাকে? এই মেয়ে যে এভাবে নিজের মাসুম ইমেজ তৈরি করে তোদের ব্রেইনওয়াশ করছে সেটা কেন বুঝছিস না তোরা? স্বপ্নিলের কথা না হয় বাদ-ই দিলাম! পুরুষমানুষ এমনই হয়, দুদিনও লাগেনা তাদের মন এদিক সেদিক হতে। কিন্তু তুই কি করে এত সহজে সব মেনে নিতে পারিস? আমি ভেবে পাইনা!

—কারও জীবন তো আর আমার বা তোমার অনুমানের উপর ভিত্তি করে থেমে থাকবেনা, আম্মু। আজ হোক, কাল হোক আপু যাওয়ার পর স্বপ্নিল ভাইয়া তো বিয়ে করতোই। সেটা এখন করা নিয়ে তোমার কিসের এত মাথাব্যথা আমায় বুঝাও একটু!

—এত সিম্পল বিষয় বুঝতে পারছিস না? আরে স্বপ্নিল কখনো আনিকাকে ভালোবাসেনি বুঝেছিস? আরে, ও এতদিন আনিকাকে ভালোবাসার নাটক করছিলো নয়তো এত বছরের সম্পর্ক শেষ হতে না হতেই কেউ এত তাড়াতাড়ি বউকে নিয়ে সুখে থাকতে পারে? এক মাস না যেতেই সংসার করতে পারে? এগুলো তো বুঝবিনা তোরা। সবাইকে নিজের মতোই ভাবিস দেখেই এ ভুল করিস। তোর বোনও এ কাজ করেছিলো, স্বপ্নিলকে বিশ্বাস করে ভালোবেসেছিল। কিন্তু সে যদি জানতো স্বপ্নিল ওকে এভাবে ধোকা দিবে তবে হয়তো কখনোই ভালোবাসতে পারতোনা! মরার আগেই ওর প্রতি সব অনুভূতি শেষ করে মরতো!

মেয়ের সাথে তর্কের মাঝে মনের সকল কস্ট-অভিযোগ নিংড়ে ফেলেন সীমা বেগম, একিসাথে আক্রোশের অশ্রু ঝড়ে তার চোখ থেকে। মা-কে এভাবে দেখে অশ্রু জমে আমিরার চোখের কোটরেও! তবু নিজেকে সামলে নেয় সে। আজকে সবকিছুর খোলাসা করতেই হবে, মা-কে সবকিছু জানাতেই হবে। নয়তো তিনি এই ভুল ধারণা নিয়ে সারাজীবন এভাবেই ঘৃণা করে যাবেন স্বপ্নিল ও রাহিতাকে। তাই মায়ের দিকে শান্ত চোখে চেয়ে আমিরা অত্যন্ত ধীর কণ্ঠে প্রশ্ন ছু’ড়লো,

—যদি তুমি কখনো জানো যে স্বপ্নিল ভাই আপুকে কোনো ধোকা দেয়নি, উলটো সে নিজেই ধোকার শি’কার হয়েছে তবে তোমার অনুভূতি কিরকম হবে, আম্মু? তখন কি তুমি নিজের মতামত পাল্টাবে?

মেয়ের হঠাৎ এমন প্রশ্নে অতিকায় থমকে যান সীমা বেগম। বিস্ময়ে হহতবিহ্বল তিনি পালটা প্রশ্ন করারও সাহস পান না যেন। ভাঙা কণ্ঠে কোনোমতে শুধান,

—ম, মানে? কিসব যা-তা বলছিস? মাথা ঠিক আছে তোর?

মায়ের ভাবভঙ্গি দেখে শীতল হাসি দেখা গেলো আমিরার ঠোঁটে। খানিকটা সময় নিয়ে বেশ ধীরস্থির ভাবেই সে বলে,

—তুমি এইমাত্র যা শুনেছো সেটাই সঠিক, আম্মু। স্বপ্নিল ভাই আপুকে ভালোবাসার নাটক করেনি। বরং আপুই ইউকে যেয়ে অন্য একজনের সাথে রিলেশনে গিয়েছিলো। তোমাদের চাপে দেশে ফিরে বিয়ের কথা চললেও প্রকৃত অর্থে ওর মন সুদূর লন্ডনেই পড়ে ছিলো। কিন্তু তোমার ও আব্বুর ভয়ে আপু এ কথাটা কাউকে বলতে পারেনি। এমনকি স্বপ্নিল ভাইকেও না! কারণ আপু জানতো স্বপ্নিল ভাই ভালো মানুষ, সে যদি বিয়ের আগে সত্যিটা জেনে যায় তখন নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে হলেও আপুর খুশির জন্য নিজের বিয়ে ভাঙতো। কিন্তু এমনটা হলে তোমরা সত্যিটা জেনে যেতে ও সবার সামনে অপমানিত হতে। এই ভয়েই আপু কখনো কাউকে এ কথাটা বলে। মনের কথা মনে চেপে রেখেই অসুস্থ শরীরে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত লড়াই করেছে আমার বোন। এভাবেই ধুকে ধুকে মরে একদিন আমাদের ছেড়ে চলে গেলো হুট করেই!

কথার মাঝে বহুবার গলা ধরে আসছিলো আমিরার তবুও আজ সে থামেনি আজ। আজকে যদি মাকে সবকিছু না জানায় তবে স্বপ্নিল ও রাহিতার সাথে চরম অন্যায় করা হবে! এদিকে সামনে দাঁড়ানো সীমা বেগম সব শুনে মিনিট কয়েকের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেলেন যেন! অবাক শব্দটাও যেন নেহাৎ ক্ষুদ্র ঠেকবে তার বি’স্ফো’রিত মুখভঙ্গির সামনে! বারকয়েক কথা বলার চেস্টা করেও যেন পারলেন না! যেন বুঝার চেস্টা করছেন কি থেকে কি হলো! তাকে সামলে নেওয়ার সময় দেয় আমিরা। একিসাথে এক এক করে সবকিছু খুলে বলে মৃত্যুর আগে ওর কাছে দেওয়া আনিকার ডায়েরির কথা, এরপর স্বপ্নিলের অবস্থা দেখে ওর সেটা স্বপ্নিলকে দেখানোর কথা। অবশেষে স্বপ্নিলের সব ভুলে মুভ অন করার কথা! কোনোকিছুই আজ বাদ রাখেনা সে। স্বপ্নিল ও রাহিতা যা এতদিন বলেনি, তা আজ হুট করে নিজের আপন মেয়ের কাছে শুনে বাকশক্তি যেন হারিয়ে ফেলেছেন সীমা বেগম। একদিনে এত ধাক্কা নেওয়ার সক্ষমতা হচ্ছেনা উনার যেন! তার এ অবস্থা দেখে পাশে দাঁড়ানো রাহিতা দ্রুত এগিয়ে গিয়ে একটি চেয়ার নিয়ে আসে এবং সযত্নে তাতে বসিয়ে দেয় সীমা বেগমকে। স্তম্ভিত উনি চেয়ারে বসে একদৃষ্টে রাহিতার দিকে চেয়ে থাকলেন কিছুক্ষণ। অতঃপর বহুক্ষণ প্রচেস্টার পর আমিরাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

—এতকিছু যদি হয়েই থাকে তবে আমায় কেউ জানায়নি কেন? এ কথাটা তোরা সবাই জানতি? শুধু আমি জানতাম না?

মায়ের প্রশ্নে আমিরা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

—এতদিন আমি, স্বপ্নিল ভাই ও রাহিতা ছাড়া কেউ জানতোনা। এমনকি দিলারা খালামনিও জানেনা। আজকে তুমি জানলে শুধু। মূলত স্বপ্নিল ভাইয়াই আমায় নিষেধ করেছিলেন আর কাউকে জানাতে! তাই তোমায় বলিনি এতদিন!

মেয়ের কথায় মা অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন ওর দিকে কিছুক্ষণ। আমিরা ফের বলে,

—তুমি যার বিরুদ্ধে আপুকে ভালোবাসার নাটক করার অভিযোগ করছিলে, আপুকে ধো’কা দেওয়ার অভিযোগ করছিলে আসলে ভি’ক্টি’ম সে নিজেই। কিন্তু আমার মরা বোনের প্রতি সম্মান রেখে সে চায়নি কেউ তাকে ঘৃণাভরা স্মৃতিতে স্মরণ করুক, কেউ তাকে নিয়ে কটুক্তি করুক এজন্যই স্বপ্নিল ভাই কাউকে কিছু বলেননি কখনো। নীরবে নিজেই সয়ে গেছেন সব এবং অনেকটা সময় ধরে নিজেকে সামলে নিয়ে রাহিতা ভাবীর সাথে জীবনকে নতুনভাবে উপভোগ করার সুযোগ খুজছেন। এবার তুমি বলো স্বপ্নিল ভাই কি ভুল করছেন? তিনি কি সঠিক সিদ্ধান্ত নেন নি?

মেয়ের কথায় চোখ দিয়ে আরেকদফা নোনাজল গড়িয়ে পড়ে সীমা বেগমের। এসব কথা যে তার অজান্তে ছিলো তিনি কস্মিনকালেও ভাবেননি কখনো! আজ একসাথে সত্যিটা উপলব্ধি করে যেন কাউকে কোনোকিছু বলার মতো অবস্থায় নেই তিনি আর। বেশ খানিকটা সময় নিয়ে উঠে দাড়ালেন চেয়ার হতে। বাহিরে থেকে হইচই আওয়াজ আসছে ভীষণ, এমন সময় রাহিতার হাতে থাকা মুঠোফোন বেজে উঠলো। স্বপ্নিল ফোন দিয়েছে। সে রিসিভ কর‍তেই স্বপ্নিল বললো,

—রাহি, কোথায় তুমি? নীতিকে বিদাই দিবো আমরা এখন। তাড়াতাড়ি গেটের কাছে আসো, খুজে পাচ্ছিনা তোমায়।

—এইতো আসছি, পাচ মিনিট দিন!

বলে ফোন কেটে দেয় রাহিতা। তাকে বলার প্রয়োজন হয়না কে ফোন দিয়েছে, সামনে থাকা দুজন মানুষ নিজ হতেই বুঝে নেয়। আমিরা বলে,

—ভাইয়া ফোন দিয়েছে তাইনা? বিদাইয়ের সময় হয়ে যাচ্ছে হয়তো। সবাই খুজছে আমাদের না? চলো যাই!

এরপর মায়ের দিক তাকিয়ে নির্দ্বিধায় শুধালো,

—এখনো কি স্বপ্নিল ভাই বা রাহিতা ভাবীর প্রতি তোমার কোনো অভিযোগ আছে, আম্মু?

মেয়ের প্রশ্নের কোনো জবাব দিলেন না সীমা বেগম। হতাশ ভংগিতে রাহিতার দিক চেয়ে মাথা নুইয়ে ফেললো আমিরা। রাহিতাও মন খারাপ করে বিনাবাক্য ব্যয়ে চলে যাচ্ছিলো সেখান থেকে। ঠিক এমন সময় হঠাৎ রাহিতার হাত চেপে ধরেন সীমা বেগম। চমকে উঠে তার দিক তাকায় রাহিতা। কোনো কিছু না বলে শুধু আলতোভাবে রাহিতার মাথায় হাত বুলিয়ে দেন সীমা বেগম। ব্যস! তাতেই যার যা বুঝার ছিলো, বুঝা হয়ে গেছে! আমিরার মুখে বিশ্বজয়ের হাসি, রাহিতার ঠোঁটের কোণেও মুচকি হাসির রেখা! অতঃপর সব ঝামেলার অবসান ঘটিয়ে তিনজন মিলে চলে যায় বিদাই মেহফিলে প্রধান ফটকের কাছে!

______________

মাত্র কিছুক্ষণ হলো বউয়ের বিদাই পর্ব শেষ হয়েছে। কেদেকেটে সকলের অবস্থা খারাপ। সবাইকে এভাবে কাদতে দেখে নিজের বিদাইয়ের কথা স্মরণ হয়ে কান্না জমলো রাহিতার চোখের কোণেও! হাতে থাকা টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে মুছতেই সেটা নস্ট হয়ে গেলো কিছুক্ষণের মাঝে। বিরক্ত হয়ে সেটা ফেলে দিতেই চোখের সামনে রুমাল ধরলো কেউ। পাশে তাকাতেই ওর দিক তাকিয়ে থাকা স্বপ্নিলের দেখা পায় রাহিতা। নিজ হাতে রাহিতার মুখ ধরে থুতনি উচু করে নিজের দিক তুললো স্বপ্নিল, অতঃপর বেশ ধীরে খুব যত্নসহকারে মুছে দিলো অর্ধাঙ্গিনীর চোখের পানি। মোছা শেষে রাহিতার মাথায় বাকা হয়ে যাওয়া টিকলিটা সোজা করে দিয়ে নিজ বুকের কাছে হাত বেধে স্বপ্নিল বললো,

—তুমি এত কাদছো কেন, হুম? তোমায় তো আর বিদাই দিচ্ছিনা ওর সাথে!

—আপনি বললেই যাবো নাকি?

আড়চোখে চেয়ে বলে রাহিতা। সে ভেবেছিলো স্বপ্নিল হয়তো বলবে “তোমায় কোনোদিন যেতেই দিবোনা আমি” অথবা কোন সুন্দর কিছু বলবে এর বিপরীতে! কিন্তু স্বপ্নিল তো স্বপ্নিল-ই! তাই রাহিতাকে ভুল প্রমাণ করে সে বললো,

—তা অবশ্য ঠিক! তুমি তো সারাজীবনের জন্য আমার ঘাড়ে চড়ে বসে আছো! ওখান থেকে আর নামবেনা বোধ হয়!

ওর কথায় চোখ পাকিয়ে তাকায় রাহিতা। রে’গে কিছু না বলেই খানিকটা জোরে মা’রে ফা’জিল স্বপ্নিলের বাহুতে। ওকে মা’রতে দেখে শব্দ করে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। হাসতে হাসতেই বলে,

—এই রাহি, এটা কিন্তু একদমই ঠিক না! এভাবে ভরা বিয়েবাড়িতে বরকে মা’রতে লজ্জা করেনা? কেউ দেখলে কি ভাববে বলো তো? এভাবে মে’রে সবার সামনে আমায় নি’র্যা’তিত পুরুষ প্রমাণ করতে চাইছো নাকি তুমি?

—উফ! আপনার শুধু ফাজলামো! অসহ্য!

বিরক্তিকর কণ্ঠে বলে রাহিতা। অতঃপর স্বপ্নিলের দিক চেয়ে সে নিজেও হেসে ফেলে কিছুক্ষণের মাঝে! দুজনের অগোচরেই দূর থেকে তাদের খুনসুটি দেখছিলো একজোড়া চোখ। যে চোখে এতদিন দুজনের প্রতি শুধু তাচ্ছিল্য ও রা’গ ছিলো আজ সে চোখে বিস্ময়। কিছুক্ষণ দুজনকে পর্যবেক্ষণ করার মাঝেই যেন সীমা বেগম উপলব্ধি করলেন জীবনে যা কিছুই হয় না কেন সবকিছুতেই ভাগ্যের অনেক বড় হাত থাকে! আমরা যেভাবেই জীবনটাকে সাজাইনা কেন শেষ মুহুর্তে সেটাই হয় যেটা বিধাতা তার কলমে লিখে রাখেন। স্বপ্নিল ও রাহিতার মন দুটিও যেন একে-অপরের কাছে বিনিময় হওয়ার জন্যই তৈরি করেছিলেন তিনি। ঠিক এ কারণেই এতকিছুর পরেও তারা ঠিকই এক হয়েছে। কেউ তাদের থামাতে পারেনি। দুজন যে নিজেদের অজান্তেই নিজেদের মায়ায় জড়িয়ে গেছে এটা তারা না বুঝলেও সীমা বেগমের অভিজ্ঞ চোখের বুঝতে ভুল হলোনা। দূর থেকে ওদের জন্য দোয়া করলেন তিনি। খানিকটা অস্ফুট স্বরেই তার মুখ থেকে দুজনের উদ্দেশ্যে নিঃসৃত হলো দুটি সুন্দর শব্দ!

“সুখে থেকো”

#চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ