মন বিনিময় পর্ব-২৮+২৯

0
690

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৮
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

হলুদের সকালের ব্যস্ততায় ঘেরা পরিবেশ। বাড়ির ছাদে স্টেজ সাজানোর কাজ চলছে৷ বরাবরের ন্যায় নানিবাড়ির দিকের বড় ছেলে হিসেবে এসব তদারকির দায়িত্ব পালন করছে স্বপ্নিল। দীপ্তকে ফুলের ডালা নিয়ে আসতে বলেছিলো, ডেকোরেশনের লোকগুলো অপেক্ষা করছে কিন্তু ছেলেট নিচে গিয়ে যে কোথায় হাওয়া হয়ে গেছে স্বপ্নিল বুঝতে পারছেনা। মিনিট দশেক অপেক্ষার মাঝেই লোকগুলো ফুলের জন্য আবার তাগিদ দিলে। স্বপ্নিল নিজেই নিচে যায় দীপ্তকে খুজতে। বেশিক্ষণ খুজতে হয়না ওর, তার আগেই ফুলের ডালা হাতে সিড়ির দিকে হেটে আসা হাস্যোজ্জ্বল দীপ্তকে চোখে পড়ে ওর। দীপ্তকে দেখে গম্ভীরমুখে দাঁড়িয়ে যায় স্বপ্নিল। চোখ পাকিয়ে প্রশ্ন করে,

—এতক্ষণ কোথায় ছিলি তুই? কতক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিলাম উপরে তোর জন্য। ডেকোরেশনের লোকগুলোও যে এ ফুলের জন্য কাজ করতে পারছেনা সেদিকে হুশ আছে তোর?

—সরি ভাইয়া, আসলে আমার একটু কাজ..

স্বপ্নিলকে রাগতে দেখে খানিকটা ঘাবড়ে যায় দীপ্ত। আমতা আমতা করে নিজের পক্ষে কিছু বলবে এমন সময় স্বপ্নিল আবারো বলে,

—তোর কোনো কাজ থাকলে সেটা ফুলগুলো দিয়ে গিয়ে তারপর করতি। মানা তো করিনি তাইনা? আজ সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান, এখন কথা না বলে তাড়াতাড়ি ছাদে যা। অলরেডি সময় নস্ট হয়েছে, আর করিস না।

ভাইয়ের কথায় মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি সিড়ি বেয়ে উপরে গেলো দীপ্ত। স্বপ্নিলের থেকে ছাড়া পেয়ে যেন হাফ ছেড়ে বাচলো সে সেভাবে শ্বাস ফেললো।

“স্বপ্নিল ভাই এমনিতে খুব চিল, কিন্তু রেগে গেলে এমন ফা’য়া’র হয়ে যায় যে দেখলেই ভয় লাগে”

মনে মনে কথাগুলো বলে দ্রুতপায়ে ছাদে চললো দীপ্ত, পাছে যদি আবার দেরি হয়? তবে তো আবার স্বপ্নিলের বকা খেতে হবে! বলা তো যায়না। এদিকে স্বপ্নিল নিচে নেমে রাহিতাকে খুজে, দুপুরের পর তো ওকে আর পাওয়া যাবেনা। বাড়ির মেয়েদের সাথে সাজগোজ করতে ব্যস্ত হয়ে যাবে নির্ঘাত। পরমুহুর্তেই নিজের মনের চিন্তাভাবনায় নিজেই অবাক হয় স্বপ্নিল, থেমে যায় তার চলতে থাকা কদম! রাহিতার দেখা পাওয়া না পাওয়া ওকে ভাবাতে শুরু করেছে কবে থেকে? মনের প্রশ্ন মনেই থেকে যায়, উত্তর খুজে পায়না স্বপ্নিল। ওর ভাবনার মাঝেই পেছন থেকে চিরচেনা মিস্টি কণ্ঠস্বর ডেকে উঠে,

—শুনছেন?

রাহিতার কণ্ঠ কর্ণগোচর হওয়া মাত্র সূক্ষ্ম হাসি খেলে যায় স্বপ্নিলের ঠোঁটে। যেন এতক্ষণ এ ডাকেরই অপেক্ষায় ছিলো সেভাবেই পেছন ফিরে তাকায় অর্ধাঙ্গিনীর দিকে। হাসিমুখে বলে,

—তুমি বললেই শুনবো!

—সামিরাকে দেখেছেন? ওকে খুজছি তখন থেকে কিন্তু পাচ্ছিনা কোথাও। কই যে গেলো মেয়েটা!

—না, ওকে তো দেখিনি। কেন? কোনো দরকার ছিলো তোমার?

—হ্যাঁ

উত্তর দেয় রাহিতা। ওর কথায় কৌতুহলের সহিত স্বপ্নিল প্রশ্ন করে,

—কি কাজ বলো? ওকে পেলে বলবোনি।

—আসলে আমার শাড়ির সাথে চুড়ি আনতে ভুলে গিয়েছি। যেই স্বর্ণের চুড়ি আছে সেটা বিয়ের শাড়ির সাথে পড়বো। তাই মা বললো সামিরার কাছে যেতে, ওর কাছে থাকতে পারে। এজন্যই খুজছিলাম ওকে।

সব শুনে স্বপ্নিল কিছুক্ষণ ভেবে বুঝদারের ন্যায় মাথা নাড়ে। তারপর বলে,

—ঠিক আছে। আমি সামিরাকে দেখলে ওকে বলে দেবো। চিন্তা করোনা।

—আচ্ছা। আমি তাহলে যাই?

প্রশ্ন করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে রাহিতা। স্বপ্নিল উত্তর না দেওয়ায় সে নিজেই প্রস্থান করে। এক কদম এগোতেই কবজিতে টান পড়ায় থেমে যায় রাহিতা। পেছন ফিরে আড়চোখে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। জিজ্ঞেস করে,

—কিছু বলবেন?

স্বপ্নিল এবারো উত্তর দেয়না। চুপচাপ শক্তভাবে রাহিতার হাতের কবজি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এবার রাহিতা বিরক্ত হয়, প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। খানিকবাদে স্বপ্নিল হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,

—কি? দাঁড়িয়ে আছো কেন? তোমার না কাজ আছে? যাও!

এ কথা বলে রাহিতার আগে সে নিজেই গটগট পায়ে চলে যায় সেখান থেকে। স্বপ্নিলের যাওয়ার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে রাহিতা, ওর আচরণ খুবই সন্দেহজনক লাগে ওর কাছে। মুখ ফুটে বেরোয় “অদ্ভুত লোক!”

__________________

বউ পার্লারে গেছে সাজতে। তাকে পার্লার থেকে আনতে গেছে সামিরা ও হিয়া। ওদের সাজা শেষ, ওরা একটু আগেই বের হলো বাসায় থেকে। মেয়েদের সাথে তাল মিলিয়ে সাজছিলো রাহিতা নিজেও। যদিও তার খানিকটা মন খারাপ কারণ সামিরার কাছে ওর শাড়ির সাথে ম্যাচিং কোনো চুড়ি নেই। তবুও শাড়ি পড়া শেষ করে, হালকা মেকাপ করে চোখে কাজল লাগিয়ে লিপস্টিক দিচ্ছিলো সে। এমন সময় রুমের বাহিরে দরজায় নক পড়ে। সেদিকে তাকিয়ে রিয়ার উদ্দেশ্যে রাহিতা বলে,

—রিয়া, একটু দেখবে কে এসেছে? আমি লিপস্টিক দিচ্ছি তো!

—দেখছি ভাবী, দাঁড়াও!

রিয়া দরজা খুলে উকি দিয়ে দেখে স্বপ্নিল দাঁড়িয়ে রুমের বাহিরে। ওকে দেখে দুস্টু হেসে রিয়া বলে,

—কি ব্যাপার, ভাইয়া? তুমি এ সময় মেয়েদের রুমের সামনে কি করছো হুম?

—বেশি কথা না বলে সর তো সামনে থেকে। রাহিতা আছে না ভেতরে? ওকে ডাক। এই রাহি?

মাত্র চুল আচড়ানো শুরু করেছে রাহিতা, এমন সময় হঠাৎ স্বপ্নিলের ডাকে চমকে উঠে সে। রিয়া সরলে দরজার কাছে দাড়াতেই স্বপ্নিল বলে,

—আমার পাঞ্জাবি কোথায় রেখেছো? খুজে পাচ্ছিনা তো। তাড়াতাড়ি আসো।

—আচ্ছা আপনি যান, আমি আসছি। এক মিনিট দিন আমায়!

কথাটা বলেই দরজা পুনরায় লাগিয়ে দেয় রাহিতা। দ্রুতবেগে আয়নার কাছে গিয়ে স্ট্রেট করা চুল আচড়ানো শুরু করে, এটা করলেই ওর সাজগোজ কমপ্লিট। স্বপ্নিল বিরক্ত হয়ে রুমের দিকে হাটা দেয়। মনে মনে বিড়বিড় করে,

“যত সময়ই দাও না কেন, মেয়ে মানুষের সাজগোজ তাও শেষ হবেনা!”

__________________

রাহিতা রুমে ঢুকতেই বিছানায় বসে থাকা স্বপ্নিলকে দেখতে পায়, একমনে ফোন টিপছে সে। রাহিতা যে এসেছে সেদিকে কোনো খবরই নাই! ওর দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য গলা ঝাড়ে মেয়েটা, এতে কাজ হয়। মুহুর্তে চোখ তুলে তাকায় স্বপ্নিল। এক মিনিট বলে ওকে দশ মিনিট অপেক্ষা করানোর জন্য কিছু শুনাতে যাবে এমন সময় চোখের সামনে পরিপাটি সুশ্রী স্ত্রীকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে যায় সে! অনুভব করে বুকের ভেতর জোরেশোরে বাড়তে থাকা হৃদস্পন্দন। মেরুন রঙের শাড়ি রাহিতার উজ্জ্বল ত্বকে অত্যন্ত মানিয়েছে, একিসাথে কোমড় ছাড়ানো সোজা চুল ও গাঢ় লিপস্টিক মাথা নস্ট করার জন্য যথেষ্ট! স্বপ্নিল দ্রুত চোখ ঘুরায়। ক’দিন ধরে একি হচ্ছে তার সাথে? এমন লাগছে কেন? আগে তো কখনো হয়নি এমন!

এদিকে স্বপ্নিলের এমন দৃষ্টি দেখে মাথা নোয়াই রাহিতা, এমন গভীর দৃষ্টি নিতে পারেনা সে। নিমিষেই রক্তিম আভায় লালিত হয় গাল। দ্রুত কদম চালিয়ে চলে যায় ব্যাগের কাছে, খুজে খুজে বের করে কাংক্ষিত পাঞ্জাবি। এগিয়ে এসে তা স্বপ্নিলের হাতে দিয়ে বলে,

—এই যে আপনার পাঞ্জাবি। আমি তো আমার পছন্দমতো নিয়েছি। আপনার কি ভালো লাগছে? দেখুন তো!

স্বপ্নিল কিছু বলেনা, পাঞ্জাবি পাজামা নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকে যায়। খানিকবাদে বেরিয়ে আসে। ততক্ষণে আয়নায় দাঁড়িয়ে নিজের সাজগোজ আরেকবার পরখ করছিলো রাহিতা। ওর আচরণে স্বপ্নিল হাসে। আয়নার কাছে যেতে যেতে বলে,

—হয়েছে হয়েছে, এতবার আয়না দেখলে নিজের দৃষ্টিতে নিজেই ঝল’সে যাবে তো! এবার থামো!

স্বপ্নিলের কথায় মনক্ষুণ্ণ হয় রাহিতার, চোখ পাকিয়ে তাকায় ওর দিকে। সেদিকে পাত্তা দেয়না স্বপ্নিল। চুপচাপ এগিয়ে যায় সাইড টেবিলের দিকে, ড্রয়ার থেকে বের করে একটি প্যাকেট। সেটা নিয়ে এগিয়ে দেয় রাহিতার দিকে। আগ্রহী চোখে একবার স্বপ্নিলের দিকে একবার প্যাকেটের দিকে তাকায় রাহিতা। জিজ্ঞেস করে,

—কি আছে এর ভেতর?

—খুলে দেখো তাহলেই বুঝবে।

স্বপ্নিলের বলতে দেরি, রাহিতার প্যাকেট খুলতে দেরি হলোনা। মুহুর্তেই হাতের মুঠোয় ডজনখানেক মেরুন রঙের চুড়ি চোখে পড়লো তার। খুশিতে নয়নজোড়া চকচক করে রাহিতার! উল্লাসিত কণ্ঠে বলে উঠে,

—এ চুড়িগুলো কোথায় পেলেন আপনি? কখন এনেছেন? একদম ম্যাচিং হয়েছে আমার শাড়ির সাথে! ওয়াও!

—ম্যাচিং তো হবেই, কে এনেছে দেখতে হবেনা! স্বপ্নিল সব কাজ পারফেক্টলি করে বুঝেছো, মিসেস রাহি?

—হুহ!

মুখ ভেংচি দেয় রাহিতা। পরমুহূর্তেই ওর ঠোঁটের কোণে দেখা যায় বিশাল হাসির রেখা, যে হাসি প্রশান্তি এনে দেয় স্বপ্নিলের অন্তরে। সে নিজেও হেসে বলে,

—এখন হাতটা দাও তো। দেখি তোমার মাপে হয়েছে কিনা?

ঝটপট হাত এগিয়ে দেয় রাহিতা। আলতোভাবে ওর হাত ধরে এক এক করে চুড়ি পড়িয়ে দেয় স্বপ্নিল, যদিও সে জানে এটা রাহিতার হবে কেননা সকালে কব্জি ধরে সে রাহিতার হাতের মাপ নিয়েছিলো। সে অনুযায়ীই চুড়ি কিনেছে। তবু রাহিতাকে নিজ হাতে চুড়ি পড়ানোর জন্য এটা বাহানা মাত্র আরকি!

—বাহ! এটা তো একদম আমার হাতের মাপে ঠিক হয়েছে। আন্দাজে হলেও একদম সঠিক জিনিস এনেছেন আপনি!

“চুড়িগুলো আমি আন্দাজে আনিনি, রাহি। জেনেবুঝেই নিজ হাতে বেছে এনেছি তোমার জন্য”

মনে মনে কথাটা বলে বোকা মেয়েটার এমন খুশি হওয়া দেখে হাসে স্বপ্নিল নিজেও। এদিকে নিজের রেশমি চুড়ির রিনিঝিনি আওয়াজ তুলে দুহাত নাড়িয়ে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে কথা বলছে রাহিতা, কিন্তু স্বপ্নিলের সেদিকে কান নেই। আপাতত ওর সম্পূর্ণ মনোযোগ রাহিতার চুড়িভরা হাতের দিকে।
রাহিতার দুলতে থাকা এলোমেলো চুড়িগুলোর সাথে যেন ওর এলোমেলো হৃদয়-ও যেন কাপছে!

#চলছে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৯
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

হলুদের স্টেজে বসে আছে কনে। ওকে এক-এক করে হলুদ লাগিয়ে দিচ্ছে সবাই। বিবাহিতরা জোড়ায় জোড়ায় আসছে, হলুদ লাগিয়ে কনেকে খাইয়ে দিচ্ছে, একিসাথে ছবি তুলে চলে যাচ্ছে। ব্যতিক্রম হলোনা স্বপ্নিল-রাহিতার সাথেও। দুজন একত্রে, পাশাপাশি স্টেজে উঠে বসলো কনে অর্থাৎ নীতির পাশে। পালাক্রমে হলুদ লাগিয়ে ছবি-টবি তুলে তারপর নামলো স্টেজ থেকে। ওদের পালা শেষ হতে না হতেই সিংগেল কাজিনরা সব চলে এলো স্টেজের কাছে। সবাই মিলে একত্রে হাম’লা করে হলুদ লাগিয়ে দিলো তাদের বোনকে। দীপ্ত যাওয়ার সময় স্বপ্নিলকেও টেনে নিয়ে গেছে। রাহিতাকে যেতে বললে সে হাসিমুখে মানা করে। বরং ওদের সব ভাইবোনের এমন মুহুর্ত দেখে আনন্দ নেওয়াই পছন্দ করলো সে। একেকজন হলুদ লাগিয়ে ভুত বানিয়ে দিয়েছে বউকে, সেই সাথে একে-অপরকে লাগানো তো আছেই! ক্যামেরাম্যানও বেশ উৎসাহ নিয়ে ভিডিও করছিলো সবটা। দূর থেকে এসব থেকে হাসছিলো রাহিতা, হঠাৎ ক্যামেরাম্যানকে দেখে তারও মাথায় এলো মুহুর্তটা ক্যামেরাবন্দী করার! যা ভাবা সেই কাজ, ফোন বের করে সবার ভিডিও করছিলো সে। এরই মাঝে রাহিতার চোখ আটকে গেলো ভাইবোনদের সাথে হাসতে থাকা স্বপ্নিলের দিকে। যে স্বপ্নিলের ঠোঁটে এক মাস আগেও হাসি ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলো, সেই স্বপ্নিলকে এখন প্রায়শই হাসতে দেখা যায়! যে হাসিতে প্রতিনিয়ত মনপ্রাণ জুড়িয়ে যায় রাহিতার। স্বপ্নিলের হাসি দেখে হাসি ছড়িয়ে গেলো রাহিতার ঠোঁটেও! আর সবাইকে ছাড়িয়ে ক্যামেরা জুম করে ছবি তুললো শুধুমাত্র স্বপ্নিলের হাস্যোজ্জ্বল মুখের। আর কেউ দেখার আগেই টুপ করে চুমু দিলো সে ছবির উপর! অতঃপর নিজের কান্ডে নিজেই লাল হলো লজ্জায়! মনে মনে ভাবলো, স্বপ্নিল কি কখনো বুঝবেনা রাহিতার মনে ওর জন্য লুকিয়ে থাকা সুপ্ত অনুভূতির কথা? কেন ওর চোখের দিক তাকিয়ে স্বপ্নিল নিজের জন্য প্রবাহিত ভালোবাসার নদী দেখতে পায়না? কবে বুঝবে সে? কবে আসবে সেইদিন? আর কবে?

____________

হলুদ শেষে বাড়ির মেহমান খাওয়াদাওয়া করে প্রস্থান করলে বাড়ির লোকেরা একসাথে খেতে বসলো। স্বপ্নিলের পাশে রাহিতা বসেছে, ওদের সামনে দিলারা বেগম। দীপ্ত ও তার মা নিজ দায়িত্বে সার্ভ করছে সকলকে। অন্য কাউকে কিছুই কর‍তে দিচ্ছেন না তারা! খাবারদাবাড় নেওয়ার মাঝেই টেবিলের একপ্রান্তে চিংড়ির আইটেম দেখে রাহিতা নিজ দায়িত্বে এভোয়েড করছিলো ওটাকে। বাকি খাবার নিজের মতো নিয়ে এটাসেটা দিয়ে খাচ্ছিলো চুপচাপ। সেদিকে হঠাৎ চোখ পড়লো স্বপ্নিলের মামির। তিনি বেশ কয়েকবার রাহিতাকে সাধলেন, রাহিতা হাসিমুখে এলার্জির কথা বলে মানা করলো। তবুও স্বপ্নিলের মামি দম নিলেন না। ভাবলেন নতুন বউ হয়তো লজ্জা পেয়ে চিংড়ি নিতে চাইছেনা, নয়তো এ সুস্বাদু খাবার কেউ ছাড়ে? তাইতো একগাল হেসে রাহিতার দিকে তাকিয়ে স্নেহমাখা কণ্ঠে বললেন,

—শশুড়বাড়ি বলে কি লজ্জা পাচ্ছো, মা? আরে তোমাদের জন্যই তো রান্না করেছি৷ সামান্য এলার্জিতে কিছু হয়না! সবাই খাচ্ছে দেখো। তাছাড়াও তুমি শুকনো মানুষ, ভালোমতো পেট ভরে খাও। এভাবে খেলে তো মনে হবে নতুন বউকে ঠিকমতো আপ্যায়ন করতে পারছিনা আমরা!

—এসব হলো আজকালকার মেয়েদের ঢং। বুঝলে, ভাবী? আমাদের মনে হয় কোনোদিন এলার্জি হয়নি? আমরা মনে হয় এমন করেছি?

রাহিতাকে খানিকটা খোটা মেরেই স্বপ্নিলের মামির উদ্দেশ্যে কথাটা বললেন সীমা বেগম। স্বপ্নিল চুপচাপ খাচ্ছিলো আর সবার কথা শুনছিলো শুধু। এবার আর চুপ থাকতে পারেনা। মামির উদ্দেশ্যে বলে,

—রাহিতা সত্যিই চিংড়ি খেতে পারেনা, মামি ৷ ওকে দিয়োনা। আমি একদিন না জেনে ওকে খাইয়েছিলাম তারপর এলার্জিতে খারাপ অবস্থা হয়েছিলো ওর। চিংড়ি ছাড়া বাকিসব খাবে তো, আমি দেখছি। তুমি যাও বাকিদের দেখো। এত কিছু ভেবোনা তো!

স্বপ্নিলের কথায় মাথা নাড়িয়ে রাজি হলেন মামি৷ চলে গেলেন অন্যদিকে খাবার সার্ভ করতে। এদিকে মামি যাওয়ার পর স্বপ্নিল নিজের প্লেটে খাবার নিলো। ফের মুরগির মাংসের হাড়ি থেকে ঝোলসহ মাংস নিয়ে রাহিতার প্লেটে তুলে দিলো৷ এতগুলো মাংস দেখে রাহিতা মানা করতে ধরবে এমন সময় স্বপ্নিলের চোখ পাকানো দেখে নাকমুখ কুচকে মুখে কলুপ আটে সে। সামনে থেকে ওদের আচরণ লক্ষ্য করে হাসছিলেন দিলারা বেগম, যে হাসি চোখ এড়ালোনা সীমা বেগমের। রাহিতার সাথে স্বপ্নিলের এমন আচরণ ও দিলারা বেগমের খুশি দেখে তার মনে সৃষ্টি হলো অনাকাঙ্ক্ষিত ইর্ষার জোয়ার! চোখভরা হিংসা নিয়ে মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি এঁকে খানিকটা উচ্চ স্বরে বললেন,

—আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে লজ্জাই নাই দেখছি। সবার সামনেই আদিক্ষ্যেতা শুরু করে দেয়। আশেপাশে বড়রা বসে আছে, তারা যে দেখছে এ বিষয়ে কোনো হুশজ্ঞান নেই! যত্তসব।

উনার কথায় খেতে থাকা হাত থেমে গেলো রাহিতার, এক মুহুর্ত তাকালো তাদের থেকে খানিকটা দূরে টেবিলের অপরপ্রান্তে বসা সীমা বেগমের দিকে। কথাটা যে তিনি পরোক্ষভাবে তাদের দুজনকে মিন করে বলেছেন বুঝতে অসুবিধা হলোনা তার! অতঃপর চোখ ফিরিয়ে তাকালো নিজের পাশে বসা স্বপ্নিলের দিকে, যে আপাতত শক্ত চোয়ালে চুপচাপ খাবার ধরে আছে মুখে৷ স্বপ্নিলের রাগ সম্পর্কে ধারণা থাকায় রাহিতা বুঝলো এ মুহুর্তে ওকে থামানো উচিত নয়তো ভরা টেবিলে মানুষের সামনে একটা বিশ্রি ব্যাপার ঘটে যাবে। স্বপ্নিল কিছু বলবে তার আগেই ওর উরুতে বাম হাত রাখে রাহিতা। কিছুটা থেমে ডান পাশে তাকায় স্বপ্নিল। রাহিতার চোখের ইশারায় অনুনয়, কোনো সিন ক্রিয়েট করতে মানা করে বিনা ভাষায়। স্বপ্নিলের মন গলে। মাথা ঘুরিয়ে সামনে তাকাতেই ফের চোখ পড়ে নিজের মায়ের দিকে। উনিও মাথা নাড়িয়ে কিছু বলতে নিষেধ করছেন ওকে। মনে মনে স্বপ্নিল খানিকটা বিরক্ত হয় মা ও রাহিতার উপর। কেন তারা ওকে থামাতে চাইছে সে বুঝেনা! তাদের তো কোনো দোষ নেই, তবু কেন তারা সব শুনবে? দ্বিধাগ্রস্ত স্বপ্নিল হতাশায় একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। ধীরেসুস্থে নিজের খাওয়া শেষ করে হাত ধুতে চলে যায়।

মায়ের সাথে সবাইকে খাবার সার্ভ করছিলো দীপ্ত। এরই মাঝে সে এসে হুট করে সীমা বেগমের পাতে গরুর মাংস তুলে দেয়। বলাবাহুল্য, উনার হাই কলেস্টেরল থাকায় তিনি বরাবর রেড মিট জাতীয় খাবার এড়িয়ে চলেন। এ ব্যাপারে দীপ্তর মা জানতেন তাই তিনি তাকে মাছ, মুরগি ও অন্যান্য খাবার বেড়ে গেছেন। এ দীপ্তটা কোত্থেকে উড়ে এসে তার পাতে গরুর মাংস দিলো ভেবে পাননা সীমা বেগম, নিমিষেই বেজায় চটে যান দীপ্তর উপর। বাজখাই কণ্ঠে বলেন,

—এটা কি করলি, দীপ্ত? এত বড় দামড়া ছেলে হয়েছিস অথচ এ কান্ডজ্ঞান নেই যে হাই প্রেসারের রোগীকে গরুর মাংস খাওয়াতে চাস? এটা খেলে আমার কি অবস্থা হবে ভাবতে পারছিস একবারো?

—সরি, ফুপি। আমি ভুলেই গেছিলাম তোমার প্রেসারের কথা। কিন্তু একদিন খেলে কি-ই বা হবে? প্রেসার বাড়লে ওষুধ খেয়ে নিয়ো না হয় পরে?

—নিজে থেকে অসুখ বাধিয়ে তারপর ওষুধ খাবো? এই বুদ্ধি দিচ্ছিস আমায়? আশ্চর্য! নিয়ে যা এ খাবার, আমার খাওয়া হয়ে গেছে।

কথাগুলো বলতে বলতে টেবিল গুছিয়ে উঠছিলেন সীমা বেগম। এমন সময় টিস্যু দিয়ে হাত মুছতে মুছতে টেবিলে ফিরে আসে স্বপ্নিল। এক পলক সীমা বেগমের দিকে তাকিয়ে ফের দীপ্তর কাধে হাত দিয়ে তাচ্ছিল্যের সাথে বলে,

—মানুষ বড়ই অদ্ভুত প্রাণী, বুঝেছিস রে দীপ্ত? অন্যের বেলায় যত ভুল খোজে আর নিজের বেলায় সব ষোলআনা! অন্যের অবস্থা ততক্ষণ বুঝেনা যতক্ষণ না নিজের সাথেও তেমন কিছু ঘটে!

স্বপ্নিলের কথার ভাজে লুকিয়ে থাকা পরোক্ষ খোটা বুঝতে অসুবিধা হলোনা সীমা বেগমের। সরু চোখে স্বপ্নিলের দিক চেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,

—তুই কি কথাটা আমাকে বললি, স্বপ্নিল? দিন দিন কি আদব-কায়দা সব শেষ হয়ে গেছে তোর মধ্যে?

উনার কথায় যেন ভারী অবাক হলো স্বপ্নিল, এমন ভংগীতে আকাশ থেকে পড়ার ভান করে বললো,

—যাহ বাবা, আমি আবার কি করলাম! আমি তোমায় কেন কিছু বলবো বলো তো, খালামনি? তুমি কি আমায় এমন কিছু বলেছিলে যে আমি তোমায় কথা শুনাবো? আমি তো দীপ্তকে জীবনের সত্যিটা উপলব্ধি করাচ্ছিলাম। তাই না রে, দীপ্ত?

—হ্যাঁ, স্বপ্নিল ভাই তো আমাকেই বলছিলো। তুমি কি ভাবলে, ফুপি?

স্বপ্নিল ও দীপ্তর কথায় গা জ্ব’লে গেলো সীমা বেগমের। কিছু বলার মতো পরিস্থিতিতে না থাকায় একা একাই গিজগিজ করতে করতে প্রস্থান করলেন সে স্থান হতে। এখন প্রায় ফাকা খাবার টেবিল, বাড়ির মানুষও তেমন নেই বললেই চলে। দিলারা বেগম ও রাহিতাও হাত ধুয়ে চলে এসেছেন ইতিমধ্যে। স্বপ্নিলের কাছে এগিয়ে গিয়ে এক হাত ওর কান টেনে ধরলেন দিলারা বেগম। ছেলের দিকে চোখ পাকিয়ে হতাশ কণ্ঠে বললেন,

—স্বভাব যাবেনা তোর, তাইনা? কেউ কিছু বললেই তাকে কথা শুনাতেই হবে?

—উফ, মা। কান ছাড়ো তো! বিয়েবাড়িতে কান ধরে আমার মানসম্মান রাখবেনা দেখছি। আরে বাবা, তোমরা সবাই এভাবে রিয়েক্ট করছো কেন? আমি কি খালামনিকে কিছু বলেছি?

স্বপ্নিলের অভিনয়ে হেসে ফেললেন দিলারা বেগম, একিসাথে হাসলো তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রাহিতা। ছেলের কান ছেড়ে বাহুতে হালকা চাপড় মেরে মা বললেন,

—বদমাইশ একটা। তুই আর সুধরাবিনা কোনোদিন!

তারপর দীপ্তকে নিয়ে রওনা দিলেন স্বপ্নিলের মামির কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে। তাদের যেতে দেখে এতক্ষণ চুপ থাকা রাহিতাও চলতে নিচ্ছিলো পিছু পিছু। কিছুদূর এগিয়ে যেতেই আঁচলে টান পড়ায় থেমে যায় সে। অবাক চোখে পেছনে ফিরতেই ওর দিকে এগিয়ে আসে স্বপ্নিল। আঁচল ছেড়ে এবার পাশে দাঁড়িয়ে রাহিতার হাত মুঠোয় নিয়ে ওর সাথে হাটতে আরম্ভ করে। এরই ফাঁকে ভ্রু নাচিয়ে সুধায়,

—একা একা কোথায় যাওয়া হচ্ছে, হুম?

—কোথাও না। আমি তো এমনিই হাটছিলাম।

—তাই নাকি?

—হু

বেশি কথা বলেনা রাহিতা। যেন আনমনেই কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত সে। খানিকক্ষণ ওকে পরখ করে স্বপ্নিল প্রশ্ন ছুড়ে,

—কি হয়েছে তোমার? কি ভাবছো এত?

—কিছু হয়নি তো। ভাবছিলাম যে…

—ভাবছিলে যে?

—ভাবছিলাম যে মা ঠিকই বলেছেন! আপনি আসলেই অনেক দুস্টু!

বলতে বলতেই মুখ টিপে হাসে রাহিতা। হাসির মাঝে লক্ষ্যই করলোনা ওর দিকে আড়চোখে গভীরভাবে তাকিয়ে থাকা স্বপ্নিলকে! রাহিতার হাসি উবে যায় সামান্যক্ষণ বাদে যখন আচমকা স্বপ্নিল নিজের দিকে টেনে নেয় ওকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

—আচ্ছা? কিন্তু তোমার সাথে তো আমি কোনো দুস্টুমি করি-ই নি এখনো। তাহলে আগেই কিভাবে বুঝলে?

স্বপ্নিলের কথাটা বোধগম্য হতেই হঠাৎ থমকে যায় রাহিতা, মুহুর্তে বড় হয়ে আসে চোখ। গালের দুপাশে লালিমা ছড়িয়ে পড়ে নিজ দায়িত্বে! সেদিক তাকাতেই আরেকটু গাঢ় হয় স্বপ্নিলের নজর। রাহিতাকে লজ্জা দিতে আগের ন্যায় ফিসফিসিয়েই বলে,

—আরে, কি ব্যাপার? তোমার গাল হঠাৎ লাল হলো কেন? উল্টাপাল্টা কিছু ভাবলে নাকি, রাহি?

এবার আর নিতে পারেনা রাহিতা, ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয় স্বপ্নিলকে নিজের থেকে৷ দ্রুত কদমে চলে যেতে যেতেই বলে,

—আপনি আসলেই খারাপ! ধুর!

সামনে অগ্রসর হয় রাহিতা। হয়তো একবার পেছনে ফিরলে নজরে পড়তো তার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকা এক হাস্যোজ্জ্বল স্বপ্নিলকে!

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে