Monday, October 6, 2025







মন বিনিময় পর্ব-২৫+২৬

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৫
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

ড্রয়িংরুমে নীরবতা বিরাজমান। বাড়ির অন্য সদস্যরা যথেষ্ট চেস্টা করেছেন সীমা বেগমকে থামানোর তবুও তিনি কারও কথা শুনেননি। একনাগাড়ে প্রশ্ন করতে লেগে গেছেন রাহিতাকে।

“নাম কি তোমার?”

“রাহিতা”

“বয়স কত?”

“২১ বছর”

“তাহলে তো স্বপ্নিলের চেয়ে অনেক ছোট। তো সংসার কেমন চলছে?”

“মাত্রই তো শুরু করলাম, খালামনি”

বিরক্তিভাব চেপে যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে উত্তর দেয় রাহিতা৷ সীমা বেগমের সাথে কথা শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মাঝেই যেন হাপিয়ে উঠেছে সে৷ কিন্তু সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই মহিলার কারণ উনি এখনো নিজের মতো সেই যে প্রশ্ন করা শুরু করেছেন, থামার নাম যেন নিচ্ছেন না। মুখে রীতিমতো ট্রেন ছুটছে তার। একটু পর যখন থেমে গেলেন, রাহিতা ভাবলো এবার বোধহয় ভাগ্য সহায় হয়েছে কিন্তু ঠিক সে সময় সীমা বেগম দম নিয়ে আবারো অনর্গল প্রশ্ন করা শুরু করলেন। অতঃপর কিছুটা বিরক্ত হয়ে রাহিতা বাধ্য হয়ে বললো,

—এক এক করে প্রশ্ন করুন না, খালামনি? এতগুলোর উত্তর একসাথে কিভাবে দেবো?

কথাটি যথাসম্ভব নম্রভাবে হাসিমুখেই বলে রাহিতা। কিন্তু এতে সীমা বেগমকে খানিকটা খুশি দেখালো। মনে হলো যেন এতক্ষণ এমনকিছু শুনারই অপেক্ষা করছিলেন তিনি। রাহিতার এ কথায় তিনি আকাশ থেকে পড়লেন এমন ভাব ধরে দিলারা বেগমকে উদ্দেশ্য করে বলেন,

—শুনলি তোর ছেলের বউয়ের কথা? বিয়ে হতে না হতেই এভাবে মুখ চলছে, বড়দের সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় জানা নেই। অথচ বাকিদিন তো এখনো পড়েই আছে!

সীমা বেগমের কথা শুনে রাহিতা তাজ্জব বনে গেলো। সামান্য এটুক কথা বলেছে আর উনি সরাসরি বলে দিলেন সে বড়দের সাথে কথা বলার ম্যানার জানেনা? আশ্চর্য! রাহিতা উত্তর দিবে এমন সময় দিলারা বেগম চোখের ইশারায় ওকে থামতে নির্দেশ দিলেন। বোনের দিক চেয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললেন,

—আমার জানামতে রাহিতা তো খারাপ কিছুই বলেনি। তুই একসাথে এতগুলো প্রশ্ন করেছিস বিধায় ও তোকে আস্তেধীরে প্রশ্ন করতে বলেছে, তাও যথেষ্ট বিনয়ের সাথে। তাহলে এতে তোকে অসম্মান করারই বা কি হলো?

—ওহ। এখন তো ছেলের বউয়ের কথাই ঠিক লাগবে তোর। বোনের কথা তো এখন আর ভালো লাগবেনা। আমার মেয়ে যখন বেচে ছিলো তখন তো ঠিকি আমার সাথে খাতির ছিলো তোর। মেয়েটা আমার যাওয়ার বছর না ঘুরতেই তুই আরেকজনকে ঘরে তুলে তার জন্য নিজের বোনকে সবার সামনে এভাবে বলছিস? এত দরদ এই দুইদিনের মেয়ের জন্য?

—মুখ সামলে কথা বল, সীমা। তুই যাকে দুইদিনের মেয়ে বলছিস সে আমার একমাত্র পুত্রবধূ। আমার বাড়ির মেয়ের মতোই দেখি আমি ওকে। আর তোর সাথে আমার সম্পর্ক নস্টের জন্য দায়ী কে ঠিক করে বল তো? আমি না তুই?

এবার দিলারা বেগমের কথায় সীমা বেগম বেজায় চটে গেলেন। এতদিনের চাপা ক্ষো’ভ যেন টগবগিয়ে উপচে পড়লো। খানিকটা উচ্চস্বরেই চিল্লিয়ে বলে উঠলেন,

—তো আমি আর কি করবো বল? নিজের মেয়ে মরার এক মাস না পেরোতেই যদি কেউ হুট করে খবর পায় তার মেয়ের না-হওয়া হবু শাশুড়ি ছেলের বিয়ে দিয়ে ফেলেছে তাহলে তার সাথে কথা বলতে মন চাইবে আমার? তুই আমার জায়গায় থাকলে কি করতি বল? এত সহজে সবকিছু ভুলে মেনে নিতে পারতি? উত্তর দে!

কথা বলার মাঝখানে মৃত মেয়ের স্মরণে আঁচলে মুখ চেপে কেদে ফেলেন সীমা বেগম। তার কথা শুনে এবার দিলারা বেগম খানিকটা নরম হলেন, এ কাজের জন্য তিনি মনে মনে খানিকটা অনুশোচনা বোধ করলেও তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন এ সিদ্ধান্তটা নিয়ে তিনি কোনোরুপ ভুল করেন নি। স্বপ্নিলের সেই সময় যে পরিস্থিতি ছিল তাতে ওকে রাহিতার সাথে বিয়ে দিয়ে তিনি সঠিক কাজ করেছেন। এর জন্য যত কথাই শুনতে হোক তিনি কখনো কিছু মনে করবেন না। এরপর বোনের কাধে হাত দিয়ে নরম সুরে বললেন,

—আমি জানি তোর খারাপ লেগেছে, কস্ট পেয়েছিস তুই। পাওয়াটাই স্বাভাবিক, বরং সব তাড়াতাড়ি মেনে নিলেই অস্বাভাবিক লাগতো। কিন্তু তুই নিজের পরিস্থিতিটাই দেখলি শুধু, একবার আমার দিক থেকেও বিষয়টা ভেবে দেখ? আনিকা যাওয়ার পর স্বপ্নিল কতটা পাগল ছিল তুই কি জানতিনা? মেয়েটা যাওয়ার পর আমার ছেলের কি অবস্থা হয়েছিলো তুই কি জানিস না? তখন মা হয়ে আমি যদি ওর ভালোর কথা চিন্তা করে ওকে বিয়ে দিই এটা কি খারাপ কিছু? জীবন তো কারও জন্য থেমে থাকেনা। স্মৃতিকে আকড়ে ধরে আর কতদিনই বা চলবে কেউ?

দিলারা বেগমের কথায় সীমা বেগম খানিকটা শান্ত হলেও তার আক্ষে’প কমলোনা পুরোপুরি। কাধ থেকে বোনের হাত সরিয়ে দিয়ে বললেন,

—এতকিছু আমি বুঝতে চাইনা। আর কি বলছিলি যেন তুই? আনিকা চলে যাওয়ার পর স্বপ্নিলের কি অবস্থা হয়েছিলো? এসব কথা অন্য কাউকে শুনাতে আসবি। আমাকে নয় বুঝেছিস? আরে ও কখনো আমার মেয়েকে ভালোবাসেনি। যদি বাসতো তবে ওর মরার পর মাসখানেক না পেরোতেই আরেকজনকে ঘরে তুলতোনা!

এতটুকু কথা শেষ করে সীমা বেগম হঠাৎ ফুসে উঠে তেড়ে গেলেন রাহিতার দিকে। অবাক নয়নে এতক্ষণ দু’বোনের ঝগড়া দেখা রাহিতা হুট করে সীমা বেগমকে নিজের দিক আসতে দেখে খানিকটা ভড়কে যায়। সে কিছু বলার আগেই সীমা বেগম রাহিতার দিকে আংগুল তাক করে বলে উঠেন,

—সব দোষ এই মেয়ের। কি এমন আছে এর মধ্যে হ্যাঁ? যে স্বপ্নিল আমার মেয়ের জন্য এতদিন পাগল ছিলো সে হুট করে একে দেখে রাতারাতি মন বদলে ফেললো? এই মেয়ে, কি এমন করেছো তুমি? বলো?

—আমি এসবের মধ্যে কি করে আসলাম, খালামনি? এখানে কি সত্যিই আমার দোষ আছে বলুন?

হতাশ মুখে উত্তর দেয় রাহিতা। সে বুঝেছে সীমা বেগম এখন নিজের হুশে নেই, এতদিন বুকের মধ্যে তিল তিল করে জন্মানো রাগক্ষোভ যখন একসাথে বের হয় তখন মানুষ আর নিজের মাঝে থাকেনা, সে যেন এক অন্য সত্ত্বায় পরিণত হয়। সীমা বেগমের ক্ষেত্রেও বিষয়টা হয়েছে ঠিক তাই! রাহিতার কথা শুনে উনি বিনিময়ে বলেন,

—বাহ, এখনো মুখে মুখে তর্ক করছো? তুমি তো ভারী নির্লজ্জ মেয়ে।

মহিলার কথায় এবার রাগ চাপে রাহিতার অন্তরে। এতক্ষণ সে নতুনবউ হিসেবে ভদ্রতার খাতিরে যথেষ্ট বিচক্ষণভাবে উত্তর দিচ্ছিলো, ভেবেছিল মেয়ের শোকে শোকাহত এক মা তার কস্ট প্রকাশ করছে সবার সামনে তাইতো সে চুপ করে সব শুনে যাচ্ছিলো। কিন্তু এবার তো তিনি নির্দ্বিধায় ওকে নির্লজ্জ বলে দিলেন। এখন যে তাকে যোগ্য উত্তর দিতেই হবে। চোখমুখ শক্ত করে রাহিতা উত্তর দেওয়ার জন্য মুখ খুলছিলো সে সময় নিশ্চুপ কক্ষে স্বপ্নিলের ভারী কণ্ঠের আওয়াজ প্রতিফলিত হয়,

—আমার জানামতে ও নির্লজ্জ রকমের কোনোকিছুই করেনি। বরং তুমিই ওকে অযথা যাচ্ছেতাই বলে অপমান করছো, খালামনি। বাড়িতে নতুন কেউ আসলে কি আমরা তার সাথে এভাবে কথা বলি?

স্বপ্নিলের কথা শুনে সেদিক তাকায় রাহিতা। একিসাথে রুমে থাকা সকলের চোখ ঘুরে যায় সেদিকে। অথচ এতকিছুর পরেও স্বপ্নিল নির্বিকার। অত্যন্ত ধীরস্থিরভাবে পকেটে দু’হাত গলিয়ে রুমে প্রবেশ করে সে। ওকে আসতে দেখে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসেন সীমা বেগম। সেভাবেই বলেন,

—বাব্বাহ! এত অল্প সময়েই বউয়ের প্রতি কি টান! ভাবা যায়? আমি তো অযথাই মেয়ের দোষ দিচ্ছিলাম। আসল সমস্যা দেখি তোর মাঝে আছে!

সীমা বেগমের খোটামূলক কথার পরেও ভাবলেশহীন রয় স্বপ্নিল। বরং তার ঠোঁটের কোণে এক সূক্ষ্ম বাকা হাসির দেখা পাওয়া যায়।

—উহু, ভুল বললে। সমস্যা আমার বা রাহিতা কারও মাঝেই না। আসল সমস্যাটা কার মধ্যে জানো? তোমার মধ্যে। নিজের দৃষ্টিভংগি বদলাও দেখবে আমরা ও আমাদের পরিস্থিতি দুটোই স্বাভাবিক লাগবে তোমার কাছে, খালামনি!

—খুব তো নিজের ও বউয়ের সাফাই গাইছিস। তো কবে থেকে হলো এত পরিবর্তন?

—আমি সত্যিটা বলছি জাস্ট। এটাকে এখন তুমি যদি সাফাই গাওয়া মনে করো তবে আমার কিছু বলার নেই। আর রইলো কথা পরিবর্তনের, বিয়ে যখন করেছি তখন আমার বউয়ের সম্মান রক্ষার দায়িত্বটাও তো আমারই। তাইনা? রাহিতাকে কেউ ভালোমন্দ বলবে এটা আমি সহ্য করবোনা। ও অনেক ভালো একটা মেয়ে, খালামনি। আমার বউ বলে বলছিনা, ক’দিন ওর সাথে মিশে দেখো তুমি নিজেও তোমার মতবাদ বদলাতে বাধ্য হবে!

স্বপ্নিলের কণ্ঠস্বর অনড়। বিন্দুমাত্র কাপছেনা গলা, ওর ভেতর ও বাহিরের স্বচ্ছতা ওর কথা-আচরণে অত্যন্ত স্পষ্ট। এমনকি স্বপ্নিলের এমন স্বতঃস্ফূর্ত আচরণে সীমা বেগমের পাশাপাশি বিস্মিত হয়েছে রাহিতা নিজেও! ঠোঁটের কোণে ভেসে উঠলো এক দীর্ঘ প্রতিক্ষীত হাসি। তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠলো স্বপ্নিলের মায়ের মুখেও। এতক্ষণে সীমা বেগম আরও কিছু বলবেন ততক্ষণে সবার চিল্লানোর আওয়াজে ড্রয়িংরুমে এসে পড়েন স্বপ্নিলের নানি। তাকে দেখে থেমে গেলেন সীমা বেগম। সবার দিক চেয়ে স্বপ্নিলের নানি বলে উঠলো,

—এই, কি শুরু করেছিস তোরা এই রাতের বেলা? এতগুলা মানুষ থাকতেও কিসের ঝগড়া লাগে? তোরা থামাতে পারিস না? এই রাকিব, বাকিদের কথা না হয় বাদ দিলাম, তুইও কি দেখতে বসে ছিলি?

স্বপ্নিলের ছোটমামাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তিনি। বিনিময়ে ছোটমামা মাথা চুলকে বললেন,

—দুই আপা-ই আমার চেয়ে বড়, আম্মা। আমি ছোট হয়ে কিভাবে তাদের থামাই? যদিও চেস্টা করেছি তবু আমার কথা সীমা আপা শুনেনি।

ছেলের কথা শুনে এবার সীমা বেগমের দিকে দৃষ্টি নিক্ষে’প করেন স্বপ্নিলের নানি। এবার চাচির সামনে ধরা পড়ে যাওয়ায় খানিকটা বিব্রতবোধ করেন সীমা বেগম। সেদিক লক্ষ্য করে স্বপ্নিলের নানি শীতল কণ্ঠে বললেন,

—এগুলো কি, সীমা? বিয়ে খেতে আসছিস ভালো করে বিয়ে খা, মজা কর। কেন পুরনো কথা মনে করে নিজেদের মধ্যে সম্পর্ক খারাপ করতে চাইছিস, মা?

এবার চাচির কথা শুনে আর কিছু বলেন না সীমা বেগম। নীরবে প্রস্থান করেন ড্রয়িংরুম থেকে। এদিকে এতকিছু শেষে যেন হাফ ছেড়ে বাচে রাহিতা। এতক্ষণ দমবন্ধ অনুভব হচ্ছিলো তার। সম্পর্কের তিক্ততা এমন এক জিনিস যা কখনো কারও কাম্য নয়। সম্পর্ক টক-ঝাল-মিস্টি থাকলেই মানায়, তেতো নয়। এতকিছু চোখের সামনে ঘটতে দেখে, সবকিছু শুনে ভার হয়ে আসে সরল রাহিতার মন। সেও চুপচাপ চলে আসে নিজেদের রুমে। বেশ কিছুক্ষণ অতিক্রম হয়, অতঃপর স্বপ্নিল আসে। খট করে দরজা লাগিয়ে দিয়ে নিষ্পলক চেয়ে রয় বিছানায় বসে থাকা রাহিতার দিকে। এগিয়ে এসে রুমে থাকা একটা চেয়ার টেনে রাহিতার পাশে বসে। অত্যন্ত শান্ত গলায় রাহিতার চোখের দিক চেয়ে বলে,

“কিছু জরুরি কথা আছে তোমার সাথে!”

#চলবে

#মন_বিনিময়
#পর্বঃ২৬
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

রাহিতার সামনে চেয়ারে গম্ভীরমুখে বসে আছে স্বপ্নিল। তার দিকে মনোযোগী দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাহিতা। যেন ওর এমন মুখভঙ্গি দেখে বুঝার চেস্টা করছে সে কি এমন জরুরি কথা বলতে চাইছে। তবে রাহিতাকে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলোনা, স্বপ্নিল নিজে থেকেই কথা বলা শুরু করলো।

—আমি আসার আগে খালামনি কি কি বলেছে তোমায়?

চমকে গেলো রাহিতা। স্বপ্নিল যে হঠাৎ এমন একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা ভাবেনি সে। ওকে চমকাতে দেখে স্বপ্নিল চেয়ারটা আরেকটু এগিয়ে নেয়। একদম রাহিতা মুখোমুখি, কাছাকাছি বসে। এখন দুজনের মাঝে দূরত্ব নেহাৎ অল্প, একটু হাত বাড়ালেই একে-অপরকে অনায়াসে ছুয়ে দেওয়া যাবে। স্বপ্নিলকে নিজের এত কাছাকাছি দেখে রাহিতা খানিকটা ঘাবড়ে যায়। তবে তা ভয়ে নয়, লজ্জায়। স্বপ্নিলকে এত কাছে এভাবে একদৃষ্টিতে নিজের দিক চেয়ে থাকতে দেখে লজ্জাবতীর ন্যায় আরেকটু নুইয়ে পড়ে মেয়েটা। চোখে চোখ রাখতে পারেনা বেশিক্ষণ, নামিয়ে নেয় মাথা। কিন্তু স্বপ্নিল নির্বিকার, সেটা দেখেও যেন বুঝেনা। সেদিকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে নির্লজ্জের ন্যায় বলে,

—এখন রোমান্স করতে আসিনি যে এত লজ্জা পাচ্ছো তুমি৷ সিরিয়াস কিছু জিজ্ঞেস করেছি, সিরিয়াসলি উত্তর দাও। যখন রোমান্স করতে আসবো, তখন না হয় লজ্জা পেয়ো।

স্বপ্নিলের কথায় চোখ খিচে বন্ধ করে রাহিতা। রক্তিম আভায় লালিত হয় মুখ। মনে মনে কয়েকশ বকা দেয় ওকে। এভাবে না বললে কি হতোনা? এরপর নিজেকে সামলে নিয়ে চোখ পাকিয়ে কটমট করে তাকায় স্বপ্নিলের দিকে। ওকে এভাবে তাকাতে দেখে হেসে ফেলে স্বপ্নিল। মাথা নাড়িয়ে শান্ত গলায় বলে,

—আচ্ছা ঠিক আছে। আর বলবোনা এসব। এখন কিন্তু সিরিয়াসলি জিজ্ঞেস করছি রাহি৷ আমি বাসায় আসার আগে সীমা খালামনি তোমায় কি কি বলেছিলো আমায় সব খুলে বলো। একদম কোনোকিছুই লুকোবেনা।

এবার নিজেকে ধাতস্থ করে রাহিতা। গলা ঝেড়ে এক এক করে সব খুলে বলে। লুকোয়না কোনোকিছু। সব শুনে স্বপ্নিলের গম্ভীর হয়ে থাকা মুখশ্রী আরেকটু থমথমে হয়। ফোস করে এক শ্বাস ফেলে গমগমে গলায় বলে,

—আমি জানতাম! এমন কিছুই হবে। উনি এতদিন মনের মাঝে আমার ও মায়ের উপর যে রাগ পুষে রেখেছিলেন তা আজ সুযোগ বুঝে তোমার উপর ঝেড়েছেন। এজন্যই আমি তোমায় বলেছিলাম তার থেকে দূরে থাকতে, তাকে এভোয়েড করতে। দেখলে তো কেমন তার ব্যবহার? তবুও তুমি শুনোনি কেন আমার কথা?

স্বপ্নিলের কণ্ঠে স্পষ্ট ক্রো’ধ। কপালে পড়েছে ভাজ, যেন রাহিতার সাথে হওয়া এমন আচরণের কারণ সে নিজে। ওকে বিচলিত হতে দেখে নিজেকে তটস্থ করে রাহিতা। বুঝে স্বপ্নিল রেগে আছে, অপরাধবোধে ভুগছে, ওকে ঠান্ডা করতে হবে। অতঃপর আলতোভাবে হাত রাখে ওর সামনে বসে থাকা স্বপ্নিলের কাধে। চোখে চোখ রাখে নির্দ্বিধায়। নরম গলায় বলে,

—আমি জানি আপনি খালামনির থেকে দূরে থাকতে বলেছিলেন। কিন্তু আমি কি করে থাকতাম বলুন? মাত্র এসেছেন তিনি বাসায়। আর আমি নতুন বউ। এখন যদি আমি হুট করে তাকে ইগ্নোর করতাম তবে সেটা কি ভালো দেখাতো, বলুন? সবাই কি ভাবতো?

—সবাই কি ভাবতো সেটা দিয়ে তুমি কি করবে। আমি তো সবারটা চিন্তা করিনি, তোমারটা চিন্তা করেছিলাম বলেই তোমায় আগেভাগে সতর্ক করেছিলাম। যদি তুমি তো তুমিই। সবার কথা ভাবতে যেয়ে নিজে এতগুলো কথা শুনলে। এত ভালো হয়ে কি হবে, রাহি? ভালো মানুষদের সবাই কস্ট দেয়।

—তাই? এ কথা আপনি আমায় বলছেন? তবে আপনি নিজে কি করলেন আগে সেটার ব্যাখা দেন।

—মানে?

চমকে উঠে স্বপ্নিল। ওর চোখে বিস্ময় দেখে মৃদু হেসে রাহিতা বলে,

—আমায় যে ভালো হওয়ার জন্য এত কথা বলছেন, আপনি নিজেও তো একি কাজই করলেন।

—আ,আমি কি করেছি? কিসের কথা বলছো তুমি?

—এই যে আপনি এতকিছু শুনলেন খালামনির থেকে, আপনায় তিনি কতকিছুই না বললেন। তখন তো আপনি চাইলেই তাকে আনিকা আপুর সম্পর্কে সবকিছু সত্যি বলে দিতে পারতেন, তার চোখে আংগুল দিয়ে নিজের মেয়ের বৃত্তান্ত খোলাসা করতে পারতেন। কিন্তু সেটা আপনি করেননি। কেন বলেন তো?

রাহিতার প্রশ্নে স্বপ্নিল চোখ সরায়। ধরা পড়ায় খানিকটা ইতস্তত করে এদিক সেদিক তাকায়। ওর হাবভাবে হেসে রাহিতা বলে,

—কারণ আপনি চাননি রুম ভর্তি মানুষের সামনে তার মেয়ের কীর্তির জন্য তিনি অপমানিত হোক, আপনি চাননি মৃত মেয়ের প্রতি মায়ের অন্তরে কোনো খারাপ অনুভূতির জন্ম হোক। আপনি…

রাহিতা আর কথা বাড়াতে পারেনা। অগ্রসর হওয়ার পূর্বেই ওর ঠোঁটে আংগুল চেপে ধরে স্বপ্নিল। হুট করে ওর এহেন আচরণে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যায় রাহিতা! চোখ বড় বড় করে তাকায় স্বপ্নিলের পানে। সেদিক লক্ষ্য করে স্বপ্নিল বলে,

—কি? এভাবে তাকিয়ে আছো কেন, হ্যাঁ? আমার সবকিছু এত কেন বুঝতে হবে তোমার? এগুলো স্বভাব বাদ দেও, বুঝেছো?

স্বপ্নিলের কথার ধরনে মনে মনে হেসে ফেলে রাহিতা। ওর কথার বিপরীতে মাথা দু’দিকে নাড়িয়ে “না-বোধক” উত্তর দেয়। ওর রিয়েকশন দেখে চোখ ছোট ছোট করে ঠোঁট থেকে হাত সরিয়ে ফেলে স্বপ্নিল। তখনি রাহিতা বলে,

—আচ্ছা, বাদ দিন এসব। যা হওয়ার হয়েছে।

—হু

এবার রাহিতা নিঃশব্দে উঠে যেতে ধরে। ঠিক সে সময় হাতে টান পড়ায় থেমে যেতে বাধ্য হয়। স্বপ্নিলের দিক তাকাতেই সে হঠাৎ কোমল স্বরে সুধায়,

—খারাপ লেগেছে না খালামনির কথায়? কস্ট পেয়েছো খুব?

—না, ঠিকাছি আমি।

—উহু, তুমি বললেই হলো? আমি জানি তো কস্ট পেয়েছো। তার কথা মনে নিয়োনা, কেমন? আজকে যা হয়েছে হয়েছে। এরপর থেকে তাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলবে। তার আবার গ্যারান্টি নেই কখন কি বলে ফেলে। আমি বা মা থাকলে তো সামলে নিবোই। তুমিও সাবধানে চলবে।

—আচ্ছা, ঠিক আছে। কিন্তু আপনি এত চিন্তা করছেন কেন এ সামান্য বিষয়ে সেটাই তো বুঝছিনা। এসব বাদ দিন তো! বললাম না আমি?

হাসতে হাসতে কথাটা বলে রাহিতা। ওর প্রশ্ন শুনে চোখ নামিয়ে নেয় স্বপ্নিল। কোনো উত্তর না দিয়ে আলগোছে নিজ হাতে চেপে ধরে রাখা রাহিতার হাত ছেড়ে দিয়ে চেয়ার টেনে বের হয়ে যেতে নেয় রুম থেকে। রাহিতা একধ্যানে চেয়ে ছিলো ওর যাওয়ার পানে। আচমকা কদম থেমে যায় স্বপ্নিলের। ঘাড় কাত করে পেছন ফিরে তাকায় এক মুহুর্তের জন্য। রাহিতার চাহনি লক্ষ্য করে ধীর স্বরে বলে,

—তোমায় কস্ট দেয় এমন কোনো বিষয়ই আমার কাছে সামান্য নয়, রাহি।

স্বপ্নিল দাঁড়ায় না আর, চলে যায় নিজের মতোন করে। পেছনে ফেলে যায় এক বিমূর্ত রাহিতাকে। স্বপ্নিলের কথা কর্ণগোচর হতেই এক মুহুর্তের জন্য হার্টবিট বেড়ে যায় ওর। স্বপ্নিলের কথায়, ওর আচরণে আজ অন্যকিছু ছিলো যা রাহিতার হৃদয়কে নাড়িয়ে দেয়। যে চোখে রাহিতা এতদিন তাচ্ছিল্য দেখে এসেছিলো, আজকাল সেই চোখেই নাম না জানা সুন্দর অনুভুতিরা স্পষ্ট উকি দেয়!

#চলবে

পূর্ববর্তী নিবন্ধ
পরবর্তী নিবন্ধ
গল্প পোকা
গল্প পোকাhttps://golpopoka.com
গল্পপোকা ডট কম -এ আপনাকে স্বাগতম......
RELATED ARTICLES

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

- Advertisment -

Most Popular

Recent Comments

Md masrur Hasan mahi على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
আমিনুল ইসলাম على প্রয়োজন পর্ব: ৩০ ( অন্তিম)
সাজিবুল ইসলাম على ধর্ষিতাবউ২ ৯ তথা শেষ পর্ব
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
শাহিদুল ইসলাম على জীবন সঙ্গী ১ম পার্ট
Nita Sarkar على স্বপ্নীল ৬৮
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على রহস্য শেষ_পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على অলক্ষ্যে তুমি পর্ব-০৬ এবং শেষ পর্ব
Nazmun Nahar Akhi على Psycho_is_back? part_7
Nazmun Nahar Akhi على Dangerous_Villian_Lover part 2
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على জানালার ওপারে পর্ব-১৭ এবং শেষ পর্ব
শিয়াসা ইসলাম হুরিজিহান على লীলা বোর্ডিং ১২১৫ পর্ব-১১ এবং শেষ পর্ব
মিজানুর রহমান রাহুল على সেই তুমি পর্ব-০১
@feelings على প্রহেলিকা
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Anamika Basu على সে পর্ব-১২
Nusrat jahan على coffee & vanilla Part-10
Pallabi Roy على স্বপ্নীল ৬৮
M.D Mahabub على The_Villain_Lover Part_2
Labani sarkar على Dangerous_Villain_Lover part 23
MD Akas Apc على বিবেক
Tanisha Ahmed على Devil love part-18 
Aius Barmon shorob على নারীর দেহকে নয়
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Chandan roy على স্বপ্নীল ৬৮
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Priya Banerjee على devil love married life last part
Riya Biswas على তুমি রবে ৬০
Riya Biswas على তুমি রবে ৫২
Mohammad Adib على তুমি রবে ৬০
Avni Ayesha على তুমি রবে ২৮
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
সুমিত على তুমি রবে ২৮
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
TANJIBA ZENIFAR على তুমি রবে ৫০
Samiah Begum على তুমি রবে ৫১
biddut das rocky على নর নারী
গল্প পোকা على নষ্ট গলি শেষ পর্ব
Md Jobayer Hossain Shohag على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على দুই অলসের সংসার
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤৪২.
A.J.S Rakib على মন ফড়িং ❤৪২.
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
গল্প পোকা على গল্পঃ ভয়
Samiya noor على গল্পঃ ভয়
Sadikul على গল্পঃ ভয়
Samia Islam على গল্পঃ ভয়
শূন্য মায়া على মন ফড়িং ❤ ৪০.
Sutapa biswas على মন ফড়িং ❤৩৯.
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৮.
sutapa biswas على মন ফড়িং ❤ ৩৭
Foysal Mahmud على My_Mafia_Boss_Husband Part: 16
Siyam على বিবেক
Sudipto Guchhait على My_Mafia_Boss পর্ব-৯
saptami karmakar على devil love married life last part
saptami karmakar على devil love married life last part
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ৩০.
মায়া على মন ফড়িং ২৬.
Shreyashi Dutta على  বিয়ে part 1
Sandipan Biswas على  বিয়ে part 1
Paramita Bhattacharyya على অনুরাগ শেষ পর্ব
জামিয়া পারভীন তানি على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
মায়া على মন ফড়িং  ২২
সুরিয়া মিম على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على মন ফড়িং ২১
গল্প পোকা على নষ্ট গলি পর্ব-৩০
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على Love At 1st Sight Season 3 Part – 69
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
Sahin ssb على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ২১
মায়া على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ২০.
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
গল্প পোকা على খেলাঘর /পর্ব-৪২
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৮. 
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৭.
Jannatul Ferdous على খেলাঘর পর্ব-৩৫
গল্প পোকা على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ফাল্গুনের_ফুল last_part_8
মায়া على মন ফড়িং ❤ ১৬. 
গল্প পোকা على ছাত্রী যখন বউ পাঠঃ ১
গল্প পোকা على বাজির প্রেম পাঠঃ ১
Foujia Khanom Parsha على মা… ?
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৮
HM Ashraful Islam على অবুঝ_বউ পার্ট: ৫
Ibna Al Wadud Shovon على স্বার্থ