মন বিনিময় পর্ব-০১

0
1079

#মন_বিনিময়
#সূচনা পর্ব
#লেখনীতে- তাসফিয়া হাসান তুরফা

“আমার প্রাক্তন মারা যাওয়ার এক সপ্তাহ পেরোলো না অথচ তোমরা দিব্যি ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে কেন আমার ঘাড়ে অন্য একজনকে চাপিয়ে দিলে, মা? নিজেদের খুশিটাই শুধু দেখলে, আমারটা দেখলে না?”

আচমকা ছেলের প্রশ্ন শুনে ঘাবড়ে গেলেন দিলারা বেগম। নতুন বউয়ের কাছে যাওয়ার আগে ছেলেকে মাঝপথে রুখে ক’টা ভালো-মন্দ পরামর্শ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ছেলে যে হঠাৎ এহেন কথাবার্তা বলবে তার মাথায় ছিলোনা। তিনি জানেন ভুলটা তার-ই তবুও ছেলেকে বুঝানোর জন্য আমতা আমতা করে কিছু বলতে যাবেন এমন সময় পুনরায় স্বপ্নিল বলে উঠে,

—তোমাদের কথা তাও বাদ দিলাম, কিন্তু ওই মেয়েটা? সে-ই বা কি করে সব জেনেশুনে এরকম একজনের সাথে সংসার করতে রাজি হয়ে গেলো যে কখনোই তাকে ভালোবাসতে পারবেনা?

—বাবা, এখন এসব কথা থাক না? মাত্র বিয়ে হয়েছে তোর। কেউ শুনলে কি মনে করবে বল? তাছাড়াও বউয়ের সামনে এগুলো বলিস না। বেচারি যে কিছুই…

কথাটা পুরোপুরি শেষ করতে পারলেন না দিলারা বেগম। তার আগেই স্বপ্নিলের কাজিনরা এসে হৈচৈ করে নিয়ে গেলো তাকে। নতুন বউ যে তার ছেলে বা তার অতীতের ব্যাপারে কিছুই জানেনা এ কথাটা ছেলেকে বলার সুযোগ মিললোনা তার! একিসাথে মনে চেপে এলো ভয়। যদি তার ছেলে এখন বউয়ের সাথে খারাপ আচরণ করে? তবে তিনি কি করবেন? মেয়েটা স্বপ্নিলের বাবার বন্ধুর কন্যা। তাকে ভালো রাখার কথা দিয়ে তো ঠিকই নিয়ে এসেছেন তার পরিবারের কাছে থেকে। এখন সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে না তো? মনে ঢুকে গেলো ভয়। তবুও একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলে এক বুক সমান আশা নিয়ে সৃষ্টিকর্তার কাছে নিজের ছেলে ও ছেলেবউ এর সাংসারিক জীবনের সুখ কামনা করলেন তিনি।

বাসর ঘরে বসে আছে রাহিতা। দুরুদুরু বুকে কয়েক ঘণ্টা আগে কবুল বলে নিজের হওয়া মানুষটার অপেক্ষায় লাজুকবরণে অপেক্ষারত সে। রুমের বাহিরে কথাবার্তা শুনে স্বপ্নিল যে এসে গেছে, বুঝতে বেগ পেতে হলোনা তার! কাজিনদের থেকে মুক্তি পেয়ে একপ্রকার নিরসভাবেই কক্ষে প্রবেশ করলো স্বপ্নিল। রুমে ঢুকেই বিছানার মাঝখানে মাথায় আঁচল দিয়ে বসে থাকা নিজের নববধূকে দেখে বুকের মাঝের চিনচিনে ব্যথা পুনরায় জাগ্রত হলো তার। না সে পারছে এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেতে, না সে পারছে এই বিয়েকে মেনে নিতে। উভয়সংকটে পড়ে একপ্রকার দিশেহারার মতোই কাপড় নিয়ে সোজা ওয়াশরুমে ঢুকে গেলো সে। এদিকে স্বপ্নিলকে কোনো কথা না বলে এভাবে চলে যেতে দেখে কিঞ্চিৎ অবাকই হলো রাহিতা। মাথার আঁচল ফেলে সেভাবেই অপেক্ষা করতে লাগলো স্বপ্নিলের।

—আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?

ফ্রেশ হয়ে আসামাত্রই রাহিতার মুখে এ প্রশ্ন শুনে থেমে গেলো স্বপ্নিল। সামান্য চমকে গেলেও প্রকাশ করলোনা বাহির থেকে। উত্তর না দিয়ে চুপচাপ বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়তেই পুনরায় কানে এলো চিন্তিত রাহিতার নম্র কণ্ঠস্বর,

—শুনছেন? কথা বলছেন না কেন? আপনার কি খুব বেশি খারাপ লাগছে?

খানিকটা চিন্তা নিয়েই প্রশ্ন করেছিলো মেয়েটা কিন্তু গতবারের ন্যায় এবারো তার আশায় গুড়েবালি দিয়ে চুপচাপ অপর পাশ ফিরে বালিশে মুখ গুজে পড়ে রইলো স্বপ্নিল। এবার চিন্তা বাদ দিয়ে রাহিতা প্রচন্ড বিস্মিত হলো। বলাবাহুল্য, সে যে এমন ঠান্ডা প্রত্যাখ্যান মোটেও আশা করেনি সদ্য বিবাহিত স্বামীর থেকে। তবে কি স্বপ্নিল এ বিয়েতে খুশি নয়? সে কি তাকে পছন্দ করে না? এমন হাজারো প্রশ্নে নিমিষেই প্রশ্নবিদ্ধ হলো হৃদয়! কিন্তু এমন হলে স্বপ্নিল বা তার পরিবারের কেউ একদিনও তাদের বললোনা কেন? স্বপ্নিলের পরিবার তো নিজ থেকেই প্রস্তাব দিয়েছিলো তার জন্য। যেখানে দু পরিবারের মধ্যে এত ভালো সম্পর্ক সেখানে ছেলে রাজি না থাকলে তো এমনি এমনি আর এতদূর এগোতোনা সবকিছু, তাই না? এসব ভেবেই নিজ মনকে সান্ত্বনা দিলো রাহিতা৷ অতঃপর বেশ ধীরেসুস্থে ঝুকে গেলো বিছানার বাঁ পাশে যেখানে চোখ বন্ধ করে গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে স্বপ্নিল। আস্তে করে ওর কপালে হাত রাখতেই ওর কোমল হাতের স্পর্শে আচমকা খুলে গেলো স্বপ্নিলের চোখজোড়া।

সেই ঈষৎ র’ক্তিম চোখজোড়া যেন অনেককিছু বলতে চাইছে রাহিতাকে। মুহুর্তেই এক অজানা ভয়ে ঢোক গিলে সে, অতঃপর কিছু বুঝে উঠার আগেই এক ঝটকায় তার হাত সরিয়ে দেয় স্বপ্নিল। বহুকস্টে নিজেকে আটকে রাখা এতক্ষণের চাপা ক্ষো’ভ যেন স্বমহিমায় সামনে আসে! নিজেকে নিয়ন্ত্রণ না করে ক্রো’ধান্বিত স্বরে চে’চিয়ে উঠে,

—আর কত বেহায়া হবে তুমি? দেখছোনা আমি কথা বলতে চাইছিনা তোমার সাথে, এভোয়েড করছি তোমায়? এতকিছুর পরেও তুমি আবারো আমার গায়ে হাত দিচ্ছো? কি চাই তোমার? স্ত্রীর অধিকার নিতে চাও নাকি? আমার টাকা দেখে বিয়ে করে নিজের স্বার্থ হাসিল হয়নি?

হঠাৎ এমন প্রশ্নে লজ্জায় অপমানে হতভম্ব হয়ে পড়ে রাহিতা! এ কোন স্বপ্নিলকে দেখছে সে? আজ পর্যন্ত তো কখনোই তাকে এভাবে কারও সাথে কথা বলতে দেখেনি! হ্যাঁ, ওদের পরিবার স্বপ্নিলদের চেয়ে সামান্য কম স্বচ্ছল কিন্তু তবুও আজ পর্যন্ত কখনোই ওর সাথে বা ওর পরিবারের কারও সাথে দেখা হলে কোনোরুপ খারাপ আচরণ করেনি ছেলেটা। সবসময় হাসিমুখে ভালো আচরণই করেছে। এখন হঠাৎ করে বিয়ের পর চেনা স্বপ্নিলের এ অচেনা পরিবর্তন দেখে কস্টে বিস্ময়ে রাহিতার অক্ষিদ্বয় কোটর হতে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে যেন! হৃদপিন্ড দুমড়েমুচড়ে যেতে চাইছে কস্টে। নিজেকে সামলে কোনোমতে কম্পিত কণ্ঠে সে উত্তর দিলো,

—আপনি এভাবে কথা বলছেন কেন? কি করেছি আমি? আপনি কি এ বিয়েতে রাজি ছিলেন না?

—ওহ! তুমি মনে হয় জানতে না, তাই না? মাই গড, এত নিখুত অভিনয় কিভাবে করছো, রাহিতা? তোমাকে তো এই মুহুর্তে অস্কার দিতে মন চাইছে আমার। তোমার মুখ দেখলে কেউ দেখলে বিশ্বাসই করবেনা কারও অভিনয় এতটা বাস্তব হয়!

তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললো স্বপ্নিল। ওর কথায় রাহিতার বড় বড় অক্ষিপল্লব ভর করে গড়িয়ে পড়লো দু ফোটা অশ্রু। তবুও নিজেকে সামলে কিছুটা সময় নিয়ে তপ্ত সুরে পাল্টা প্রশ্ন করলো সে,

—যদি বিয়েতে রাজি ছিলেন-ই না তবে কেন এ বিয়ে করলেন, স্বপ্নিল? আমার জীবনটাকে কি ছেলেখেলা মনে হয়েছিলো আপনার কাছে? একটাবার কেন বললেন না আপনি আমায় পছন্দ করেন না, অথবা এ বিয়ে করবেন না? নিজেরাই সেধে বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে নিজেই এভাবে বাসররাতে অপমান করার তো কোনো মানে হয়না, তাই না? টাকা নিয়ে কথা বলে আমার উপর যখন প্রশ্ন তুললেন-ই, তখন নিজের এই রঙ বদলানো স্বভাবের কথা মনে পড়লোনা?

রাহিতার ব্যঙ্গাত্বক প্রশ্নে ও তাচ্ছিল্যে এতক্ষণের জ্বলন্ত ক্ষোভে যেন ঘি পড়লো। মুহুর্তেই এগিয়ে এসে রাহিতার দু’বাহু ধরে দাঁতে দাঁত চেপে স্বপ্নিল চেচিয়ে বললো,

—তোমার কি মনে হয় আমি শখের বশে তোমায় বিয়ে করেছি? যদি এমনটা ভেবে থাকো তবে ভুল ধারণা এখনি মাথায় থেকে বের করে দেও। কারণ আমি তোমাকে পছন্দ করিনা, তোমায় বিয়ে করলেও কখনো ভালোবাসতে পারবোনা। কারণ আমি আমার মন অলরেডি একজনকে দিয়ে ফেলেছি। সেখান থেকে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তোমাকে এ বিষয়ে আমি আগেই বলতে চেয়েছিলাম, বিয়েটা ভাঙতেও চেয়েছি কিন্তু নেহাৎই মা এর মুখের দিক তাকিয়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছি। নিজের শত কস্ট হোক, তবু মা বলে কথা। তার কথার বিরুদ্ধে যাওয়ার স্পর্ধা আমার নেই।

কিছুক্ষণ পর থেমে বলে,

—তুমি শুধু আমার নামের স্ত্রী, নিজেকে এর বেশি কিছুই ভাবার প্রয়োজন নেই। বুঝেছো?

জোরে দু’বাহু চেপে ধরায় হাতে ব্যাথা অনুভব করছিলো রাহিতা। চোখ বন্ধ থাকা অবস্থায় স্বপ্নিলের কথা শুনে হাত সরানোর জন্য ছটফট করতে থাকা রাহিতার চোখ বেয়ে আরেক ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। এতক্ষণ ক্রোধের বশে থাকলেও হঠাৎ সেই বন্ধ চোখের টলমলে স্বচ্ছ অশ্রুজল দেখে স্বপ্নিলের ভেতর কি যেন হয়, হুট করেই হাতের বন্ধন নিজ থেকেই হালকা হয়ে যায়। স্বপ্নিল হাত ছেড়ে দেওয়ায় হাফ ছেড়ে বাচে রাহিতা। হাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেলেও মনের যন্ত্রণা থামানো দায়! এ যেন সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে ক্ষণে ক্ষণে।

রাহিতাকে ছেড়ে দিয়ে দু’হাতে নিজের মাথা চেপে ধরে স্বপ্নিল। ঘাড় সমান ছাটা চুলগুলো খামচে ধরে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেস্টা করে যেন! একদিকে নিজের ক্ষতবিক্ষত মন, অন্যদিকে মায়ের চাপ দুটো সামলাতেই বিগত সাতদিন হিমশিম খাচ্ছিলো সে। তার মধ্যে এখন কোত্থেকে যেন রাহিতা এসে জুড়ে বসলো কপালে! জীবন কোথায় নিয়ে যাচ্ছে তাকে? কি হবে তার? সব মিলিয়ে ওর নিজেকে উন্মাদ উন্মাদ মনে হচ্ছে! রাহিতা চুপচাপ বসে বসে দেখছিলো স্বপ্নিলের কান্ডকারখানা। স্তব্ধ হলেও শান্ত মাথায় ভাবছিলো তার জীবনের পরিণতির কথা। ঠান্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে হুট করে বিছানা থেকে নেমে গেলো সে।

দরজা খোলার শব্দ হওয়ায় বদ্ধ চোখজোড়া খুলে সেদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বপ্নিল। দরজার কাছে রাহিতাকে দেখে সে নিজেও বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায়। সবে দরজা খুলে বাহিরে বের হওয়ার জন্য পা এগিয়েছিলো রাহিতা। বেরোনোর আগ মুহুর্তে স্বপ্নিলের ভরাট গলার প্রশ্নে সে থমকে দাঁড়ায়,

—কোথায় যাচ্ছো?

স্বপ্নিলকে এগিয়ে এসে প্রশ্ন করতে দেখে কিছুটা অবাক হলেও রাহিতা মাথা ঘামায় না। যেভাবে বেড়িয়েছিলো সেভাবেই যেতে যেতে বলে,

—যার কারণে আজ আপনার আমার দুজনের জীবনের এই অসম পরিণতি তার কাছেই যাই।

—ভনিতা করোনা। তুমি তো সব জেনেশুনেই বিয়ে করেছিলে না? তাহলে আবার হঠাৎ এ সময় মায়ের কাছে যাচ্ছো কেন? আমায় বিয়ে করার আগে এটা মাথায় ছিলোনা?

ফুসে উঠে বলে সে। তার কথায় চোখে পানি নিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে রাহিতা। হাত দিয়ে চোখ মুছে ব্যঙ্গাত্বকভাবেই বলে,

—আপনি যেমনটা ভাবছেন সবসময় যে সেটাই সত্যি হবে এমন কোনো কারণ নেই, মিস্টার স্বপ্নিল আহমেদ। আমি আমার দিক থেকে একটাও মিথ্যা কথা বলিনি। আমি যদি জানতাম আপনার এ বিয়ে নিয়ে কি মতামত তবে বিশ্বাস করুন আমি জীবনেও আপনার জীবনে আসতাম না। এখন যিনি আমায় আপনার জীবনে এনেছেন তার থেকেই তো জবাবটা নিতে হবে, তাই না?

কথাগুলো বলে শাশুড়ির রুমের উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলো রাহিতা। পেছনে ফেলে গেলো এক বিস্মিত স্বপ্নিলকে। মেয়েটার কথা শুনে ও সাহস দেখে মনে মনে বেশ চমকে গেলো স্বপ্নিল। কিভাবে বুকভরা সাহস নিয়ে দিব্যি তার মায়ের কাছে চলে যাচ্ছে ব্যাপারটা বেশ ভাবালো তাকে। আনমনে প্রশ্ন এলো, রাহিতা কি তবে সত্যি বলছিলো তার মানে? ও কি তার অতীতের ব্যাপারে আসলেই কিছুই জানতোনা? এ কেমন ধোঁয়াশার মধ্যে ফেসে গেলো সে?

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে