মন ফড়িং ❤ ৩৬.
নীলিমা অবাক হয়ে নিদ্রের কাণ্ড দেখছিলো। ছেলেটা তার দিকে একবারও তাকালো না। ফাহিকে জিজ্ঞেস করলো
– ভাবী, এরা কারা?
ফাহি কিছুটা বুঝতে পেরেছে, নীলিমার মনে কী চলছে। ছেলেটার দিকে যেভাবে তাকিয়ে ছিলো তাতে নীলিমার মনে ধরেছে কিন্তু মনে ধরে লাভ নেই। ছেলে বিবাহিত এবং স্ত্রীকে যথেষ্ট ভালোবাসে।
ফাহি স্বাভাবিকভাবেই বললো
– ননদিনী, মেয়েটা হচ্ছে এই বাড়ির মালিক আর ছেলেটা ওনার হাজব্যান্ড। অর্থাৎ স্বামী – স্ত্রী এরা। এদের ভেতরের বন্ডিং টা দেখলা?
নীলিমা ভেংচি কেটে বললো
– পুরুষ জাত সম্পর্কে আমার জানা আছে। বউ এর সামনে কেয়ারিং ভাব দেখায় কিন্তু বউয়ের আড়ালে সুন্দরী ললনাদের সাথে রাত কাটিয়ে বেড়ায়। আর এনার বউয়ের চেহারার যে হাল তাতে তো বোঝায় যাচ্ছে কতো সুন্দরীর সাথে সে রাত কাটিয়ে বেড়ায় সে!
রশীদ সাহেবের স্ত্রী নীলিমার কথা শুনে অবাক হচ্ছেন আবার ভয়ও পাচ্ছেন। কোনোভাবে যদি এসব কথা অদ্রির কানে যায় কী হতে পারে তার ধারণার বাইরে! আর রশীদ সাহেবও এসব কথা পছন্দ করবেননা।
রশীদ সাহেবের স্ত্রী নীলিমাকে মিষ্টি স্বরে বললেন
– মা, এভাবে কোনো মানুষ সম্পর্কে পুরোটা না জেনে ধারণা করে কিছু বলতে নাই।
নীলিমা ভেংচি কেটে বললো
– আন্টি ওসব আমার জানা আছে। পুরুষ জাত যে কী……
ফাহি নীলিমার কথার মাঝে তার মাকে বললো
– ওনাদের খাবার দিয়েছো নাকি?
– নিদ্র খেয়েছে কিন্তু অদ্রি খায়নি।
– কেনো?
– শুনলেনা কী বললো? স্যুপ খাবে অদ্রি।
– এতো যত্ন কীভাবে করে? তাও ছেলে হয়ে।
– আসলে মা, আমাদের সমাজে এটা প্রচলিত হয়ে গেছে যে স্ত্রী স্বামীকে সেবা করবে কিন্তু স্বামী, স্ত্রীকে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে হওয়া উচিৎ দুজনকে দুজনের সেবা – যত্ন, সাহায্য করা উচিৎ। যেকোনো সম্পর্ক টিকে থাকার জন্য দুজনেরই অবদান থাকা জরুরি। একজন একটি সম্পর্ককে টেনে বেশি দূর নিয়ে যেতে পারেনা। তুমি শুধু দেখছো নিদ্র খুব যত্ন করছে, এটা করছে ওটা করছে কিন্তু মেয়েটাও করছে, যেটা তুমি আমি দেখতে পারছিনা। মেয়েটা যদি কিছুই না করতো তাহলে নিদ্র কখনো এতোটা যত্ন করতোনা। অদ্রি অনেক অসুস্থ তারপরও সে নিদ্রের সামনে প্রকাশ করতে চাচ্ছেনা।
সম্পর্ক গুলোকে এগিয়ে নিতে দুজনকেই দায়িত্ব পালন করতে হয়। তোমার তো বিয়ে হয়েছে। সংসার জীবন শুরু করবে এই কথাগুলো মনে রেখো কাজে লাগবে।
ফাহি কিছু একটা বলতে যাবে তখনই রশীদ সাহেব রুমে ঢুকে বললেন
– অদ্রি এসেছিলো?
ফাহি বললো
– হ্যাঁ এসেছিলো।
– যাক ভালো। নিদ্র কই? ওকে লাগবে।
রশীদ সাহেবের স্ত্রী বললেন
– ও তো রুমে। ডেকে আনবো?
– থাক আমি যাচ্ছি।
– না। আপনি একটু রেস্ট নিন। আমি যাচ্ছি।
ফাহিকে বিদায় দেবার পর রশীদ সাহেব একদম চুপচাপ হয়ে গেলেন। নীলিমা যাওয়ার আগে বেশ কয়েকবার নিদ্রের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছে কিন্তু নিদ্র খুব একটা পাত্তা দেয়নি।
নীলিমা মনে মনে শপথ করেছে – এই ছেলের অহংকার টা সে মিটাবে, যেমন করেই হোক।
অদ্রি নিদ্রের বুকে মাথা রেখে চোখ বুজে দুপুরের সেই মেয়েটার কথা ভাবছে। মেয়েটা নিদ্রের দিকে তাকিয়ে ছিলো। তাকানোর ভাব দেখে মনে হচ্ছিলো মেয়েটা নিদ্রকে অন্যভাবে চায়। প্রেমিকের রূপে!
– নিদ্র!
– বলুন।
– নীলিমা মেয়েটা আমাকে ঠিক পছন্দ করেনি। আর আপনার দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবছিলো।
অদ্রি কীভাবে বিষয়টা বুঝতে পারলো নিদ্র ভেবে পাচ্ছেনা।
– তাকিয়ে থাকাটা দোষের কিছু না। অচেনা মানুষের দিকে এভাবেই তাকিয়ে থাকে অনেকে।
– কিন্তু আপনার দিকে তার তাকানোর ধরন টা ভিন্ন ছিলো। সে আপনাকে প্রেমিক রূপে চায়।
কথাটা বলার সময় অদ্রির গাল বেয়ে চোখের পানি পরতে শুরু করলো।
নিদ্র আলতো করে অদ্রির কপালে চুমু দিয়ে বললো
– চাইতেই পারে তাতে কী? আমি একসময় আপনার প্রেমিক ছিলাম এখন স্বামী। ব্যাস গল্প শেষ।
– মেয়েটা কিন্তু খুব সুন্দর।
– অদ্রি, একটু ঘুমাবেন?
– উঁহু আপনি যেন কেমন।
– আমি যেমনই হই সেটা পরে ভাবা যাবে। এখন ঘুমান।
– সন্ধ্যার সময় কেউ ঘুমায়?
– আপনি ঘুমাবেন। রাত জেগে পরে গল্প করবো।
– এখন গল্প করি তাহলেই তো হয়।
– না এখন গল্প করলে আপনি আবার ওই মেয়েটার কথা উঠাবেন। আর আমার মেজাজ খারাপ করে দিবেন।
ডাক্তার নীলুফার চেম্বারের সামনের ওয়েটিংরুমে অদ্রি, নিদ্র আর নাজমুল সাহেব বসে আছেন। যদিও আরও অনেক মানুষ এখানে ওয়েটিং এ আছেন। কখন তাদের সিরিয়াল নাম্বার আসবে। ফাহির, স্বামীকে দিয়ে অনেক কষ্টে এতো আগে সিরিয়াল পাওয়া গেছে! অদ্রিকে এখানে নিয়ে আসার আগে নাজমুল সাহেব তাকে ডেকে নিয়ে কিছু কথা বলেছিলেন।
– অদ্রি মা কিছু কথা বলবো মন দিয়ে শুনবে!
– জি বলুন।
– চেয়ারে বসে নাও দাঁড়িয়ে থেকো না।
অদ্রি চেয়ারে বসার পরে অদ্রিকে বললেন
– ডাক্তার আর টিচারের কাছে সব সমস্যা সবসময় খুলে বলতে হয় তা নাহলে কখনো সমস্যার সমাধান হয়না। যার কাছে তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি সে ঢাকার না পুরো বাংলাদেশের নামকরা ১০ জনের অন্যতম একজন সাইক্রিয়াটিস্ট। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তার সিরিয়াল পাওয়া গেছে। আমার রিকুয়েষ্ট তুমি তোমার সব সমস্যা খুলে বলবা।
অদ্রি ঘোমটা ঠিক করে বললো
– ভূত প্রেত কি তাড়াতে পারে এরা?
নাজমুল সাহেব রাগ হজম করে বললেন
– তুমি কি চাও নিদ্র ভালো থাকুক, সুখে থাকুক?
– জি।
– তোমার খারাপ কিছু হয়ে গেলে ও ভালো থাকতে পারবেনা। ওকে দেখা যায় উপর দিয়েই শক্ত কিন্তু ভিতরে ও খুবই নরম। তোমার এই অবস্থাতেই ও কতোটা ভেঙে পড়েছে আমি জানি। তোমার কাছে লুকিয়ে রাখে কিন্তু আমার কাছে তো প্রলাশ করতেই হয়। আমার ছেলেটা ছোটো বেলা থেকেই কষ্ট পেয়ে এসেছে। মা না থাকার কষ্ট সেই বুঝে যার মা থাকেনা। আমিও তেমন সময় দেইনি। যাক সে কথা। নিদ্রকে যদি সত্যি ভালোবেসে থাকো তাহলে তুমি সমাধানের পথ খুঁজে বের করবে আর সাইক্রিয়াটিস্ট কে সব জানাবে। আর যদি তা না করো তাহলে ভাববো তুমি নিদ্রকে ভালোবাসতেই পারোনি!
শেষের কথা গুলো অদ্রির বুকের মধ্যে বিঁধে যাচ্ছিলো কাঁটার মতো! সে কি সত্যিই ভালোবাসতে পারেনি? তাহলে সে সুইসাইড করার চিন্তা মাথায় আনতে পারতোনা। হাসপাতালে নিদ্রের দিকে তাকানোর ক্ষমতা ছিলোনা। এমন বিধ্বস্ত লাগছিলো অদ্রির ইচ্ছা করছিলো মরে যেতে!
নিদ্রকে সে কিছুই দিতে পারেনি, কষ্ট ছাড়া। আর নিদ্র তার বিশ্রী অতীত জেনেও ভালোবেসেছে। ও তো অনেক ভালো মেয়েও পেতো!
– আমি চাই ও ভালো থাকুক। ওর জন্য আমি সবকিছু করতে পারবো। সেখানে ডাক্তারকে অতীত জানাতে পিছু হাঁটার কিছুই নেই!
চলবে…..!
© Maria Kabir