মন ফড়িং ❤
১৭.
গলার কাছে মনে হচ্ছে কথা গুলো আটকে আছে। অদ্রি চেষ্টা করছে বলতে কিন্তু পারছেনা। খুব অসহ্য লাগছে অদ্রির। চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার চোখের চাহনি আগের মতো নেই।প্রিয় মানুষকেও কোনো একসময় অচেনা কেউ মনে হয়।
অদ্রিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিদ্র হকচকিয়ে গেলো। কী বলবে বুঝতে না পেরে, জিজ্ঞেস করলো
– কিছু বলবেন?
অদ্রি চোখের দৃষ্টি নামিয়ে প্রশ্নের উত্তর না দিয়েই চলে গেলো।
তার বলা কথা গুলো অদ্রির ভালো লাগেনি? নাকি এই মেয়ে তাকে বিরক্তিকর পাব্লিক হিসেবে দেখছে? তার মনে হয় এভাবে হুট করে চলে আসাটা ঠিক হয়নি। মেয়েটা তাকে সত্যি পছন্দ করেনা। পছন্দ করলে তো অন্ততপক্ষে তাকে এভাবে দেখে চোখেমুখে আনন্দের ছিটেফোঁটা ছাড়া থাকতো না।
দরজা আটকে দিয়ে নিদ্র জানালার পাশে দাঁড়িয়ে রইলো।
আসলেই তার আসাটা ঠিক হয়নি। সকালেই চলে যাবো। এভাবে কারো বিরক্তিকর পাব্লিক হিসেবে থাকা যায়না।
এতোদিনের স্বপ্ন, আশা সব এক পলকের ব্যবধানে হারিয়ে ফেললাম।
এই পৃথিবীতে প্রিয় মানুষকে ক’জনই বা নিজের করে পায়?
ওর মতো মেয়ে আমাকে কেনো ভালোবাসবে? তাকে ভালোবাসার মতো কোনো কারণই নেই।
বিছানায় উপর হয়ে শুয়ে অদ্রি কাঁদতে শুরু করলো। কান্নার শব্দ যেন কেউ শুনতে না পারে তাই উপর হয়ে মুখ চেপে কাঁদছে। তার এরকম ব্যবহার করা মোটেও ঠিক হয়নি। নিদ্র কী না কী মনে করেছে কে জানে!
নিদ্রকে জাপটে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। এতোদিনের দূরত্বটা তাতে যদি একটু হলেও ঘুচতো। এতোদিনের পোড়া ঘায়ে শান্তির ছোঁয়া পাওয়া যেতো।
মন চাচ্ছে ছুটে গিয়ে জাপটে ধরে পড়ে থাকতে কিন্তু মস্তিষ্ক বলছে উল্টো।এতো কাছে এসেও, কতোটা দূরে!
নাজমুল সাহেব উঠোনে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাচ্ছিলেন। একটু আড়ালে দাঁড়িয়ে খাচ্ছেন। অন্য কেউ দেখে ফেললে লজ্জায় পড়বেন। সামনাসামনি কিছু না বললেও আড়ালে ঠিকই বলবে
– বুড়ো হয়েছে কিন্তু বাজে অভ্যাস ছাড়লো না। ক’দিন পর যাবে কবরে এখনো শয়তানি ছাড়লো না।
বিশেষ করে রিতা নামের ওই ভদ্র মহিলা তাকে ভালো চোখে দেখছেন না। কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকায়। তার উপর যদি এভাবে সিগারেট খেতে দেখে, তাহলে তো মহাঝামেলায় পড়বেন।
পাঁচ নম্বর সিগারেট ধরিয়ে নাজমুল সাহেব বিপদে পড়লেন। রিতা এদিকেই এগিয়ে আসছে কিছু একটা বলতে বলতে।
রিতা বাড়ির মূল দরজা খোলা দেখে আটকাতে এসে খেয়াল করলেন উঠোনের আড়ালে যেখানে একটু অন্ধকার ঠিক সেখানেই কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছেন।
রিতার ভয়ভীতি কম। একাই হাতে শক্ত লাঠি নিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন।
– এই কেরে ওখানে? একদম পিটিয়ে তক্তা বানিয়ে ফেলবো। সাহস কতো বড় হ্যাঁ?
নাজমুল সাহেব তাড়াতাড়ি করে সিগারেট ফেলে দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন।
রিতা কাছে আসতেই নাজমুল সাহেবকে দেখে হাতের লাঠি পিছনে লুকিয়ে ফেলে বললেন
– এতো রাতে এখানে কী করছেন?
নাজমুল সাহেব বললেন
– ইয়ে মানে আরকি রুমের মধ্যে দম আটকে আসছিলো…..
– এখানে চোরের অভাব নেই। দেখা গেলো দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে কোনো ক্ষতি করে বসতে পারে। আপনার বাইরে আসার ইচ্ছা হলে আমাকে বলবেন বা অন্য কাউকে বলবেন। দরজা আটকে দিবে।
– আমি আসলে ভাবলাম কাউকে বিরক্ত করা ঠিক হবেনা। তাই আরকি।
– আচ্ছা যাইহোক এখন থেকে কথাটা মনে রাখবেন।
নাজমুল সাহেব রিতার চলে যাওয়ার সময় অবাক হলেন। এই মহিলা হাতে বেশ ভালো চোর মারার লাঠি নিয়ে এসেছিলেন। ভাগ্যিস তিনি আগে থেকে কিছুটা বুঝতে পেরেছিলেন তা না হলে আজকে তার খবর ছিলো। বহুত ডেঞ্জারাস মহিলা দেখছি। সাবধানে থাকতে হবে।
এতো দিন পর এলাম আর মাটির চুলার রান্না খাবো না, তা কি হয়? মোটেও না। যেভাবেই হোক মাটির চুলার রান্না তার খেতেই হবে। রশীদকে বলে দেখতে হবে।
পানের ব্যাগে পানও ফুরিয়ে গেছে। রশীদও বাসায় চলে গেছে। কী করা যায়?
রিতাকে বলবো? না, এভাবে অচেনা কাউকে কিছু বলা যায়না।
ফ্লাক্সে চা বানিয়ে রাখতে বলেছিলো অদ্রি। হঠাৎ এতো চা দিয়ে কী কাজ সেটা বুঝতে পেরেছেন কিন্তু ওকে খুব চিন্তিত মনে হচ্ছে। চোখ মুখ ফোলা দেখে জিজ্ঞেস করেছিলেন, শরীর খারাপ কিনা?
উত্তরে ডান হাত দেখিয়ে বললো হাতের ব্যথা। কিন্তু বিশ্বাস করতে পারেননি।
সারাক্ষণ এই মেয়েটার চিন্তা তার মাথায় ঘুরে বেড়ায়।
রাতের জন্য রান্না করতে হবে তাকে। লিলি ওর রুমে আরামে ঘুমিয়ে আছে বোধ হয়।
লিলির রুমের দরজায় বেশ কয়েকবার টোকা দেয়ার পর বিরক্তি নিয়ে দরজা খুলে বললো
– বিরক্ত করছেন কেনো?
– রাতের জন্য রান্না করতে হবে।
– তো আমি কী করবো শুনি?
– আমার হেল্পার হতে হবে তোমাকে অদ্রি বলেছে। কথা কানে গেছে?
– আমি পারবোনা।
রিতা রেগে গিয়ে লিলির ডান গালে খুব জোরে চড় বসিয়ে দিয়ে বললো
– আমি অদ্রি না যেয়ে তোমার বেয়াদবিকে আশকারা দিবো। ৫ মিনিটের মধ্যে রান্নাঘরে আসবা তা না হলে তোমাকে সোজা করার উপায় আমার জানা আছে। বেয়াদব মেয়ে কোথাকার। ডানা মেলেছো না? ডানা দুটো কেটে হাতে ধরিয়ে দিবো।
দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে দিলো।
অদ্রি বললো
– ভেতরে আসা যাবে?
নিদ্র মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বললো।
অদ্রি নিজের সাথে প্রায় যুদ্ধ করেই আবার নিদ্রের কাছে এসেছে। সন্ধ্যার দিকের ব্যবহারের জন্য স্যরি বলবে।
নিদ্র বিছানার উপর বসে পড়লো। অদ্রি দেয়াল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বললো
– সন্ধ্যার ওরকম ব্যবহারের জন্য আমি দুঃখিত। আসলে ভাবতে পারিনি আপনি আসবেন।
– আমি আগামীকাল সকালেই চলে যাবো। আপনার বিরক্তির কারণ হতে চাচ্ছি না।
অদ্রি মাথার ঘোমটা ঠিক করে বললো
– আমি মোটেও বিরক্ত হইনি।
– তা তো আপনার ব্যবহারেই বুঝতে পারলাম। এতোগুলা কথা বললাম আর আপনি কোনো উত্তর না দিয়েই চলে গেলেন।
– আমি তো বললামই আমি অবাক হয়েছিলাম। আপনার প্রশ্নের উত্তর কী দিবো ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই….
– হয়েছে আর অজুহাত দিতে হবেনা।
– আমি অজুহাত দিচ্ছি না, সত্যিটা বলছি।
নিদ্র দরজা আটকে দিতে বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ালো। দরজা আটকে দেয়ার সময় অদ্রি জিজ্ঞেস করলো
– আমি চলে যাই তারপর দরজা আটকাবেন।
দরজা আটকে দিয়ে অদ্রির দিকে এগিয়ে গেলো।
অদ্রি আর তার মধ্যে ব্যবধান রইলো মাত্র কয়েজ ইঞ্চি। মাথার ঘোমটা নামিয়ে দিয়ে এলোমেলো চুলে আঙুল চালিয়ে দিয়ে বললো
– চুলগুলোর তো অন্ততপক্ষে যত্ন করতে পারেন।
নিদ্র এতোটা কাছে এভাবে আসতে পারে ভাবতেই পারছেনা অদ্রি। উষ্ণ নিশ্বাস অদ্রির মুখের উপর সুমধুর ছন্দে আছড়ে পড়ছে।
নিদ্র নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেনা। অদ্রির কোমর বাম হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আরো কাছে টেনে নিলো। ডান হাত দিয়ে ঘাড়ের ওপর থেকে চুল গুলো সরিয়ে দিয়ে ঠোঁট দিয়ে আলতো করে চুমু এঁকে দিলো।
অদ্রির কেমন যেন ঘোর ঘোর লাগছে। ঘাড়ের ওই অংশটুকু থেকে পুরো শরীরে বিদ্যুত বয়ে যাচ্ছে। নিজেকে সামলে নেয়ার জন্য দেয়াল ঠেসে দাঁড়ালো।
দুজনের মধ্যে একে অপরকে পাওয়ার জন্য তোলপাড় শুরু হয়েছে।
চাতকী নিজেকে উজাড় করার অপেক্ষায় ছিলো আর চাতক সব লুটে নিজের করে নেয়ার অপেক্ষায়।
অদ্রির কপোলে চুমু দিয়ে, ডান গালে তারপর বাম গালে যেন পথিক পাগলের মতো তার জীবনের সবচেয়ে দামী পথ খুঁজে বেড়াচ্ছে।
নর – নারীর মাঝের সবচেয়ে সুন্দর আর দামী এক মুহূর্ত তারা পার করছে।
সময় আটকে আছে তাদের দুজনের মাঝে। দুজনেই আজ মহাব্যস্ত ভালোবাসা নামক অনুভূতি প্রকাশে!
চলবে……!
© Maria Kabir
আপু আপনার গল্প পড়ে মাঝে মাঝে আমার হার্ট-এটাক এসে যায়। এ এক অসম্ভব ভালোলাগা।™®