মন ফড়িং ❤
১৫.
অদ্রির কথাগুলো রিতার কাছে ঠিক ভালো লাগলো না। রিতা বুঝতে পারছেনা অদ্রি ওর স্বামী সম্পর্কে বলছে নাকি অনু কাউকে নিয়ে?
এই মেয়েকে বুঝতে তার এতো সময় কেনো লাগছে? যেকোনো মানুষকে বুঝতে তার ১ সপ্তাহের বেশি সময় লাগেনা কিন্তু এই মেয়ের ক্ষেত্রে সময়টা শুধু বাড়ছেই, কমছে না। আসলেই এই পৃথিবীতে কিছু মানুষ থাকে, কিছু না খুব কম মানুষ থাকে যাদের ভেতরের খোঁজ পাওয়াই দায়! অদ্রি তাদের মধ্যেকার একজন। রিতার মনে প্রশ্ন জেগেছে কাকে নিয়ে বলছে? প্রশ্নটা করতেও দ্বিধা হচ্ছে। রিতাকে চুপ করে থাকতে দেখে অদ্রি বললো
– কীসব আবোলতাবোল বলছি আমি। বিয়ে উপলক্ষে আপনার কিছু কেনাকাটা করতে ইচ্ছে হচ্ছেনা?
রিতা বললেন
– বয়স হয়েছে আমার। এখন কি আর আগের মতো সখ আছে নাকি?
– কী যে বলেন? বয়সের সাথে তারুণ্যের কোনো সম্পর্ক নেই। তারুণ্যকে সবসময় নিজের মধ্যে ধরে রাখতে হয় তাতে বয়স বাঁধা দেয়ার ক্ষমতা রাখেনা।
– তাহলে তুমি কেনো এভাবে বুড়ির মতো থাকো? নিজের গায়ের থ্রিপিসের দিকে তাকাও তো।
অদ্রির গায়ে সাদা রঙের থ্রিপিস। বেশ কয়েকদিন অবশ্য রঙিন পোশাক পড়া শুরু করেছিলো কিন্তু নিদ্রের এভাবে হুট করে উধাও হয়ে যাওয়ার পর থেকে আবার আগের মতোই হয়ে গেছে। তবে পুরোপুরি না। ভয়ংকর একটা স্বপ্ন তার পিছু ছেড়েছে।
এখনো মনে পড়লে অসহ্য যন্ত্রণা হতে থাকে শরীর ও মনে।
অদ্রি মুচকি হেসে বললো
– বাদ দিন আমার কথা। আমি তো বিধবা মহিলা। আমার আবার সাজগোজ বলতে কিছু আছে নাকি?
রিতা বললেন
– তোমার বয়স অল্প। এখনো বিয়ের বয়স আছে।
– তা আছে বৈকি। রশীদ চাচা এসেছেন?
রিতা বললেন
– নাহ, তবে চলে আসবে মনে হয়।
– দুপুরে আজকে আমি রান্না করবো। অনেকদিন রান্না করা হয়না।
– তুমি ভালোভাবে সুস্থ হও তারপর দেখা যাবে।
– হঠাৎ মনে হলো রান্না করলে ভালো লাগবে। খালা মনি আমি শুটকি টা ভালো রান্না করতে পারি। খাবেন?
– তাহলে করো। তবে সব আমি গুছিয়ে দিবো।
– না, তা হবেনা। আজকে আপনি রেস্ট নিবেন। আমি সব রান্না করবো। আপনি একটা কাজ করতে পারেন। মেহমান দের জন্য কোন দিন কী কী রান্না করবেন লিস্ট করে ফেলুন।
– লিস্ট করবো কিন্তু আমাকে সাহায্য করতে দিতে হবে।
– না, সব আমি একাই করবো।
রশীদ সাহেব ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন সকাল ১১ টায়। নাজমুল কে সে এয়ারপোর্ট থেকে সোজা তার এখানে নিয়ে আসবেন। যদিও তার বাসায় থাকার মতো জায়গা নেই। অদ্রির বিশাল বাড়ি তো পরেই আছে। নো চিন্তা!
ঢাকায় তার পৌঁছাতে বেশ কম সময় লাগলো কারণ রাস্তায় জ্যাম কম ছিলো।
প্ল্যাকার্ডে বড় বড় অক্ষরে নাজমুল লিখে এনেছেন। যাতে সহজেই তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। কতো বছর পর দেখা হচ্ছে কেউ কাউকে প্রথম দেখায় না চেনার কথা।
নাজমুল সাহেব বেশ অস্বস্তি বোধ করছেন। তার পাশের সিটে যে বসেছে তার শরীর দিয়ে খুব বিশ্রী একটা গন্ধ আসছে।গন্ধটা কোনোভাবেই দূর করা যাচ্ছেনা। পারফিউমের বোতল অর্ধেকটা খালি হয়ে গেছে। কেউই তার কথা বিশ্বাস করছেনা। যাকেই বলছে
– শোনেন ভাই, এই লোকটার গায়ের গন্ধটা কি বাজে!
সেই বিরক্তি নিয়ে উত্তর দিচ্ছে
– আমি তো পাচ্ছিনা।
শেষ পর্যন্ত নিদ্রের সিটে নাজমুল সাহেব বসলেন এবং নিদ্রকে বাবার সিটে বসতে হলো। পাশের লোকটা খুব একটা সুবিধার না। কেমন যেন লাগছে নিদ্রের। লোকটার চাহনিতে, কথায় বাজে কিছু আছে। কিন্তু বাজে জিনিসটা সে ধরতে পারছেনা।
এয়ারপোর্টের বাইরে প্ল্যাকার্ডে নিজের নাম দেখে নাজমুল সাহেব নিদ্রকে বললেন
– দ্যাখ আমার দোস্ত, আমার জন্য এখানে এসে দাঁড়িয়ে আছে।
আসমা জামান বললেন
– রশীদ ছাড়া আর কেউই আসবেনা তোর জন্য।
– ক্যান ক্যান মা?
– তুই বন্ধুদের খোঁজ খবর রাখিস নাকি? রশীদ তো সহজ সরল সোজা মানুষ। তাই তোর জন্য এখানে দাঁড়িয়ে আছে।
– মা এইটা তুমি কিছু বললা?
– যা সঠিক তাই বলেছি।
দুজনের মধ্যে ঝগড়া লেগে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে ভেবেই নিদ্র বললো
– তাহলে তোমার দোস্তের কাছে যাওয়া যাক, বাবা।
নাজমুল সাহেব আসমা জামানকে অবাক করে বললেন
– ওর মেয়ের বিয়ের খরচ আমি দিবো অর্ধেকটা।
আসমা জামান বললেন
– হেহ, ব্যাংকে ইঁদুর দৌড়ে কূল কিনারা পাচ্ছেনা সে,আবার অন্যের মেয়ের বিয়ের খরচ দিবে।
নিদ্র দাদীকে অনুনয় করে বললো
– প্লিজ দাদী, চুপ করো না। এখন ঝগড়া করার সময় না।
রশীদ সাহেব চার সিটের গাড়ি ভাড়া করে রেখেছিলেন। গাড়ি খোঁজার ঝামেলাটা অন্ততপক্ষে কমে গেলো।
গাড়ির সিটে হেলান দিতেই নিদ্র ঘুমিয়ে পড়লো।
আসমা জামানও হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলেন। নাজমুল সাহেব আর রশীদ সাহেব বেশ জমিয়ে গল্প শুরু করলেন।
ঢাকার জ্যামে আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে বলেই রশীদ সাহেব একটু চিন্তিত ছিলেন। পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেলে সমস্যার শুরু হবে। অদ্রিকে বলাও হয়নি নাজমুলের কথা। মোবাইলের ব্যাটারি লো হয়ে বন্ধ হয়ে গেছে। মাথার মধ্যে টেনশন ঘুরপাক খাচ্ছে। টেনশন গেড়ে বসলো যখন বিশাল লম্বা জ্যামে আটকে গেলেন।
নাজমুল সাহেব ভ্রুকুটি করে বললেন
– লও ঠ্যালা সামলান রশীদ সাহেব।
– ঠ্যালা এখানে আটকে যাওয়া প্রত্যেকটা মানুষই সামলাবে।
নাজমুল সাহেব নিদ্রকে দেখিয়ে বললেন
– আমার বাবাজি কী ঘুমটাই না দিচ্ছে।
– এই বয়সেই তো ঘুমাবে নাকি?
– রশীদ তুই এতো সিরিয়াস ভাবে নিচ্ছিস ক্যানো সবকিছু?
– কী করবো বল? সেই ১১ টা থেকে দৌঁড়ের উপর আছি। তার উপর এই জ্যাম।
– মনে কর কোনো জ্যাম নেই। আমরা বেশি গল্প করবো বলেই গাড়ি থামিয়েছি।
বেশ জমিয়ে গল্প করার যায় তাই তো?
– মনে করা যেতো যদি আশেপাশে যানবাহনের প্যা পু শোনা না যেতো।
– রশীদ প্লিজ….
আসমা জামান রশীদ সাহেবকে বললেন
– বাবা, আশেপাশে পানের দোকান আছে নাকি?
– হ্যাঁ অবশ্যই।
– যাও বাবা পান নিয়ে আসো তো। যাতে জ্যামটাকে শান্তিপূর্ণ ভাবে কাটিয়ে দিতে পারি।
রশীদ সাহেব পানের খোঁজে বের হয়ে পড়লেন।
অদ্রির ডান হাতে গরম তেলের ছিটা লেগে ফোসকা পড়ে গেছে। ভুলটা তারই, মাছ গরম তেলে ছাড়ার সময় একটু আস্তে ছাড়তে হয়। কী যেন হলো ওর। জোরে ছাড়ার সাথে সাথেই অনেকটা গরম তেল এসে ডান হাতের কনুই থেকে বেশ খানিকটা নিচে লাগলো। পুরো জায়গাটা পুড়ে কালো হয়ে গেলো আর প্রায় ১ ঘণ্টা পর ফোসকা পড়ে গেলো। রিতা আশেপাশে ছিলো না। অদ্রিরও ইচ্ছা করছিলো না তাকে ডাকতে। একবার বলে যেহেতু ফেলেছে সেহেতু আর না করার উপায় নাই।
ক্লান্ত শরীর নিয়ে গোসলে ঢুকে অদ্রির ঘুম আসছিলো। দ্রুত গোসল সেরে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়লো।
অদ্রি যখন ঘুমালো তখন ঘড়িতে দুপুর ৩ টা বাজে। রিতা লিস্ট করে, গোসল সেরে ঘুমিয়ে ছিলেন।লিলি বাদে পুরো বাসায় কেউই জেগে ছিলোনা। টেবিলে খাবার গোছানই ছিলো কিন্তু কেউই খায়নি। লিলি দুপুরে খাওয়ার জন্য রুম থেকে বের হলো।
৩ টার পরপরই গাড়ি এসে থামলো অদ্রির বাড়ির গেটের সামনে। নাজমুল সাহেব অবাক হয়ে বললেন
– তোর বাড়ি?
– আরেনা আমার এক ভাগ্নীর বাড়ি। পুরো বাসায় মাত্র তিন জন থাকে। এই বাড়িতেই তোদের থাকতে হবে। বিশাল উঠান আছে যখন ইচ্ছা তখন হাঁটাচলা করতে পারবি। এমনকি বাড়ির মধ্যেও পারবি কারণ ও নিজের রুম থেকে সহজে বের হয়না।
– তোর বাড়ি আর তোর ভাগ্নীর বাড়ি কি এক?
– আমার বাসায় তোদের থাকার মতো জায়গা নাই রে।
– তাহলে আমরা হোটেলে উঠি?
নিদ্র গাড়ি থেকে বের হয়ে বললো
– বাবা, এখানে থাকাটাই বেটার।
আসমা জামানও পানের পিক ফেলে বললেন
– রশীদ যা বলে শোন।
নাজমুল সাহেব নিরুপায় হয়ে বললেন
– ঠিক আছে, গণতন্ত্র আমার দিকে রায় না দিলে কী আর করার!
রশীদ সাহেব বললেন
– ব্যাগপত্র বের কর আমি এতোক্ষণে ভিতরে গিয়ে দেখি সব ঠিক আছে কিনা!
রশীদ সাহেব ভিতরে গিয়ে দেখলেন লিলি প্লেটে খাবার বাড়ছে।
– লিলি, অদ্রি কই?
লিলি দাঁত চিবিয়ে চিবিয়ে বললো
– আছে হয়তোবা তার রুমে।
– ঘুমুচ্ছে নাকি?
– তা জানে ক্যাডা?
রিতা তার রুম থেকে বের হয়ে লিলিকে বললেন
– প্লেটে খাবার নিয়ে তোমার রুমে যাও।
রশীদ সাহেব কে বললেন
– অদ্রি ঘুমাচ্ছে মনে হয়। জরুরী কিছু হলে ডেকে দিবো?
– না। শুধু বলো নিচের আর দোতলার রুম গুলো তালা দেয়া নাকি?
– না। আজকেই আমি ওগুলো পরিষ্কার করেছি।
নাজমুল সাহেব, আসমা জামান আর নিদ্র তাদের ব্যাগপত্র নিয়ে ভেতরে ঢুকলো।
রিতা বুঝতে পারলেন মেহমান এসেছে। এখন কিছুই জিজ্ঞেস করাটা ঠিক হবেনা। আপাতত রুমের দরজা খুলে দিতে হবে।
নিচের তলার পাশাপাশি দুটো রুম আসমা জামান আর নাজমুল সাহেব বেছে নিলেন।
নিদ্র কোনটা নিবে জিজ্ঞেস করার আগেই রিতা দেখলেন, ছেলেটা দোতলায় উঠে যাচ্ছে। আর বিশেষ সেই রুমের দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে গেলো।
ওই রুমটাতে অদ্রি কাউকেই থাকতে দেয়না। এমনকি রুমটা নিজে পরিষ্কার করে। এই ছেলে কি জানে বিষয়টি? তার নিজের কি ওকে জানানো উচিৎ না?
রশীদ সাহেবকে আড়ালে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
– ওই ছেলেটা উপরের ওই রুম কেনো বেছে নিলো? অদ্রি তো ওখানে কাউকেই প্রবেশাধিকার দেয়নি। জানতে পারলে ও খুব রেগে যাবে।
রশীদ সাহেব হাসতে হাসতে বললেন
– মোটেও রাগবে না।
– সত্যি?
– হ্যাঁ, খাবার দাবার আছে কিছু নাকি বাইরে থেকে আনতে হবে?
– বাইরে থেকে আনতে হবে না।
চলবে……!
© Maria Kabir
You are awesome writer Maria Apu…..
thanks apuni ❤
werwerwerwe