মন ফড়িং ❤
পর্ব – ৯
প্রিয় মানুষের চেহারাটা হয়তোবা কখনো মনে রাখা যায়না। নিদ্রকে সে কোনো ভাবেই কল্পনায় আনতে পারেনা। কিন্তু তার স্বামীর চেহারা ভুলতে পারেনা। যতবার চেষ্টা করে ততবারই সেই চেহারা আরো বেশি স্পষ্ট হয়ে যায়। জীবন তাকে কিছুই দিবেনা। রশীদ চাচার মেয়েটার বিয়ে তার এই বাড়িতে হবে। চোখের সামনে তার মতোই একজন মেয়েকে নতুন জীবনে পা বাড়াতে দেখবে। স্বামীর ভালোবাসায় স্বপ্ন গুলো তার রঙিন হবে। তার সব স্বপ্ন একটি একটি করে পূর্ণতা পাবে। রীতাকে আসতে দেখে অদ্রি স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলো। রীতা নামে এই মায়ের বয়সী মহিলা তাকে খুব বেশি যত্ন করে। টাকা দিয়ে এরকম যত্ন কেনা যায়না। সে তো নিজে কখনো বেশি কথা বলেনি রীতার সাথে। তাহলে কীভাবে বা কী কারণে এতোটা যত্ন সে পায়? রান্নাবান্নার কাজের জন্য তাকে আনা কিন্তু সে ধীরে ধীরে সবকিছুতেই প্রভাব খাটাচ্ছে। অদ্রির রুটিন করা অনিয়মকে খুব সহজেই নিয়মে রূপ দিচ্ছে।
রীতা অদ্রিকে চুপচাপ দেখে বললেন
– আজকে একটু ছাদে যেতে ইচ্ছে করছে।
অদ্রি বললো
– আচ্ছা যাবেন। চাবি আমার কাছ থেকে নিয়ে নিবেন।
– আমার সাথে আপনিও যাবেন। ভালো লাগবে।
– আমার শরীর তেমন ভালো না। ভালো হলেই যাবো। আর আমাকে তুমি করে বলবেন।
– শরীর ভালো করার জন্যই তো বলছি ছাদে যাওয়ার কথা।
– অন্যদিন আমি যাবো।
রীতা বুঝতে পারলেন একে এভাবে বলে নিয়ে যাওয়া যাবেনা।
– আচ্ছা বাদ দাও। আগে খেয়ে নাও
– খাবার রেখে যান। আমি খেয়ে নিবো।
– ওই ভুল অনেক করেছি আর না। আমি এখন থেকে তোমাকে খাইয়ে দিবো।
– আপনাকে কষ্ট করতে হবেনা।
– কষ্ট না। রান্নাবান্না ছাড়া তো আর কোনো কাজই নেই। তোমার যত্নে না হয় কিছু সময় কাটুক। সুস্থ হলে না হয় আর করবোনা।
অদ্রি অনিচ্ছাসত্ত্বেও খেতে হলো। কোনো খাবারই তার ভালো লাগছেনা। কেমন যেন তিক্ত স্বাদের। কিন্তু খুদাও বেশ পেয়েছে। খুদার কারণে তিক্ত স্বাদের খাবার তাকে খেতে হচ্ছে।
রীতা বললেন – তিতা লাগতেছে তাই না?
– হ্যাঁ।
– বোধহয় হালকা জ্বর তোমার শরীরে। পেট ভরে খেয়ে আবার ঘুম দাও ঠিক হয়ে যাবে।
লিলি নদীর পাড়ে বসে আছে। আশেপাশের মানুষ এখন আর তাকে কোনো প্রশ্ন করে না। প্রথম দিকে এখানকার স্থানীয় মানুষের প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে সে রীতিমতো বিরক্ত ছিলো। এখন কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে সে উত্তর দেয়না। লিলির বাসায় থাকতে ভালো লাগেনা। তার যুবক ছেলেদের দেখতে ভালো লাগে। ইচ্ছা করে তাদের মধ্যেকার কেউ একজন তাকে সঙ্গ দিক। কেউ তাকে জিজ্ঞেস করুক
– এভাবে একা বসে থাকো কেনো? মন খারাপ?
না, তাকে কেউই জিজ্ঞেস করবেনা। কারণ সে তো কাজের মেয়ে। আজ পড়াশোনা করলে কোনো স্কুলে থাকলে এর বিপরীত ঘটনা ঘটতো।
তার বয়সী কতো মেয়েকে সে এখানকার ঝোড়ঝাপে লুকিয়ে প্রেম করতে দেখেছে।
শুধু কি এরা প্রেম করে? মনে পড়তেই লিলির পুরো শরীরে কেমন তড়িৎ বয়ে যায়!
নদীতে ঠিক এই সময় ৭-৮ জনের মতো যুবক ছেলেদের দল আসে গোসল করতে। তাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর যে যুবক তাকে লিলির খুব ভালো লাগে। ক’দিন যাবত সেই ছেলেও কীভাবে যেন তাকায় ওর দিকে। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে হাসি ঠাট্টা করে। লিলির খুব ভালো লাগে! ছেলেটাও কি একইরকম ভাবে?
ইশ !
৭-৮ জনের দলটি ইতিমধ্যে এসে গোসলে নেমেছে।
সেই যুবকের দিকে তাকিয়ে আছে লিলি।
সন্ধ্যা হবার কিছুক্ষণ আগেই লিলি বাসায় ফিরেছে। রীতা বললেন
– অদ্রি তোমাকে ডেকেছে। তবে এখন যেয়ো না। ও ঘুমাচ্ছে।
লিলি বেশ বিরক্ত হয়ে বললো
– আমি সেটা বুঝবানি।
– কী বুঝবা না বুঝবা তোমার ব্যাপার কিন্তু অদ্রির ঘুমে যেন ব্যাঘাত না হয়। ও খুব অসুস্থ। বুঝতে পারছো কী বলেছি?
রীতার কঠোর গলায় কথাটা শুনে লিলি কিছুটা ভয় পেলো। কোনো উত্তর না দিয়েই সে তার ঘরে চলে গেলো।
দরজা আটকে দিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখছে। সে কি সত্যি খুব সুন্দর? তাহলে ওই যুবক কেনো তার দিকে ওভাবে তাকিয়ে থাকে?
এই বয়সের মেয়েরা পুরুষের লোলুপ দৃষ্টি কে ভালোবাসা ভেবে নেয় বুঝি। তা না হলে লিলি ওই যুবকের তাকানোর অর্থ বুঝতে পারতো।
নিদ্রের ঘুম ভাঙলো তখন রাত ৩ টা বেজে ৪৫ মিনিট। অন্ধকারে ঘড়ির কাটা জ্বলজ্বল করছে।
সকাল ৮ তাকে যেতে বলেছে। রঙের কাজ এখনো কিছু বাকি আছে। তার স্ত্রী নাকি সকাল ১০ টার দিকে আসবেন। এতো সহজে কি সে পেয়েছে? তাকে জিজ্ঞেস করলে বলবে কিছু?
মিস্টার ব্রন্ড আবার তাকে খারাপ ভাব্বে না তো? ভাবলে ভাবুক।
ঘুম আসছে না নিদ্রের। কী করবে? নতুন কোনো নকশা তৈরি করার চেষ্টা করবে? নাকি তার কাজে কী কী পরিবর্তন করা যায় সেটা নিয়ে বসবে? দাদীর সাথেও তো আজ তেমন কথাই হয়নি। একটু দেখে আসা যাক কী করছেন আসমা জামান?
নিশ্চয়ই দাদার ছবি হাতে নিয়ে নীরবে চোখ ভেজাচ্ছেন। দেখে ফেললে, স্বীকার করতেই চাইবেনা।
নিদ্র দাদীর রুমের দরজার কাছে যেতেই বুঝতে পারলো, দাদী জেগে আছেন এবং দাদার ছবি হাতে নিয়ে নীরবে কাঁদছেন! নিদ্র দাদীর কাছে বিছানার উপর বসলো। আসমা জামান ছবিটা উপর করে রেখে চোখ মুছে বললেন
– ঘুম আসছে না?
– তা তো দেখতেই পাচ্ছো।
– মেয়েটাকে আমার খুব দেখতে ইচ্ছা করছে। ছবি আছে তোর কাছে?
– আছে। তবে আমি চাই তুমি সামনাসামনি ওকে দেখবে। ছবিতে তোমার ওকে একদমই ভালো লাগবেনা।
– কবে যাবি?
– টাকাই তো জোগাড় হচ্ছে না। আর দুই একটা কাজ করলে যাওয়ার মতো অবস্থা হবে।
– ওই মেয়ের যদি বিয়ে হয়ে যায় তখন?
– তখন আর কী? ভাবতে হবে আল্লাহ তায়ালা আমার ভাগ্যে ওর নামটা লিখে দেয়নি।
– জীবনটা এভাবেই কাটিয়ে দিবি?
– আসলে দাদী, আমি অনেক চেষ্টা করেছি ভুলে থাকার। বাংলাদেশ ছেড়ে চলে এসেছি ওকে না জানিয়ে। এখানে এসেও কোনো যোগাযোগ করিনি। ও চিঠি পাঠিয়েছে কিন্তু আমি তার প্রতিউত্তর দেইনি। তারপরও আমি পারছিনা। ক্লাবে, বারে গিয়ে কতো সুন্দরী মেয়েদের সাথে মেশার ঘনিষ্ট হওয়ার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। তাই আমি চাচ্ছি একটা শেষ চেষ্টা করবো। মনে করো যদি একটু বুঝতে পারি, আমার জন্য অল্প একটু ফিলিংস আছে। তাহলেও আমি ওকে…..
নিদ্রের গলার কাছে কথাটা আটকে গেলো। বিছানা ছেড়ে উঠে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো নিদ্র।
আসমা জামান, নিদ্রের চলে যাওয়ার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো।
নাজমুল সাহেব ডান হাতে দুটো টিকিট নিয়ে বসে আছেন। আরেক হাতে এলকোহলের বোতল। আজকে আর গ্লাসে নিয়ে খাচ্ছেন না। নাজমুল সাহেব বোতল রেখে তার মায়ের রুমের দিকে গেলেন। দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অনুমতি চাইলেন। আসমা জামান বললেন
– আয়। ঘুমাস নাই?
– না, ঘুমাতে ইচ্ছা করছেনা।
– নাকি ঘুম আসছে না?
– ওই একই কথা?
ছেলের হাতের টিকিট দেখে জিজ্ঞেস করলেন
– কীসের টিকিট রে বাপ?
– তোমাদের বাংলাদেশ যাওয়ার টিকিট। আর যাওয়ার সময় মনে করো কিছু টাকা রেখেছি। তা না হলে ভুলে যাবো।
– বাপ তুই আরেকটা বিয়ে কর।
নাজমুল সাহেব হো হো হো করে হাসতে শুরু করলেন। হাসি থামিয়ে বললেন
– এখন ছেলের বিয়ের বয়স আর যদি আমি করি তাহলে ব্যাপারটা একটু কেমন হয়ে যায়না?
– বিয়ের কোনো বয়স নাই বাপ।
– তারপরও আমার আর ওতে মন নেই। মা, আমি যাই নেশাটা বেশি হয়ে গেছে মনে হয়। মাথাটা কেমন যেন লাগছে।
নাজমুল সাহেব টিকিট মায়ের হাতে দিয়ে বললেন
– মা, আমাকে পারলে মাফ কইরো। অনেক কষ্ট দিয়ে ফেলেছি তোমাকে আর নিদ্রকে। বেচারাকে আমি মনে হয় কখনো ভালোবাসতে পারিনি।
বাবা হতে পারিনি আমি, মা। আমি পারিনি!
চলবে…..!
© Maria Kabir