মন ফড়িং ♥
১.
সকাল থেকেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হচ্ছে।এই মনে হয় থেমে যাবে কিন্তু থামেনা।এরকম শেষ হবে হবে করেও শেষ হচ্ছেনা খেলাটা অদ্রির কাছে কেমন খাপছাড়া লাগে। প্রকৃতির এই খেলা যেন প্রতিনিয়তই ঘটছে। তার জীবন তার হিসেব মতো চলছে না। আর কবেই বা তার হিসেব মতো চলেছে?
অদ্রির হাসি পেলো নিজের উপরই। আজকাল প্রকৃতির প্রত্যেকটি খেলা তার মনে দাগ কাটে।
এইযে হঠাৎ রোদ ওঠে, আবার হঠাৎ কোথা থেকে কালো মেঘ গুলো উড়ে এসে ভিড় জমায় রোদেলা আকাশে। আবার খুব গরম সকাল থেকে কিন্তু বিকালের দিকে হুট করে ঠান্ডা বাতাস বইতে শুরু করলো।
কুয়াশার কারণে কিছুই দেখা যাচ্ছেনা কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশা উধাও। এটাই প্রকৃতি এবং এরকমই মানুষের জীবন।
ক্ষণে ক্ষণে ক্ষয়ে পরে সময় শুধুমাত্র মানুষ গুলোর রেখে যাওয়া স্মৃতি গুলো ক্ষয়ে যায়না।
অদ্রির এই বৃষ্টিতে বড়সড় ঘুম দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু তার ভেতরের কেউ একজন বলছে জানালার ধারটাতে দাঁড়িয়ে থাকতে। হয়তোবা হুট করে সেই মানুষটা এসে দাঁড়াবে বাগান টাতে। জানালার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলবে
– চলুন আজ ভিজি একসাথে…
অদ্রি এই আবদার অপূর্ণ রাখতে পারবেনা। লোক লজ্জা তখন আর তাকে ছুঁয়ে যাবেনা।
শত বছরের অপেক্ষার পর সেই মানুষের ভেজা হাতে শুকনো হাতটি লুকাতে পারবে, সেটা কি কেউ জানে?
কেউ কি জানে, সেই অনুভূতি কেমন?
কেউ কি জানতে পারবে, অদ্রি কতটা সুখে জড়িয়েছে?
না, সেই কেউ শুধুই একজন বিধবার নতুন করে প্রেমে পড়ার রঙিন গল্প আটবে।
বিধবার চরিত্রের ওপর কালোর ছাপ দেয়ার প্রচেষ্টায় থাকবে।
সেই কেউই কখনও তাকে নতুন সুখে সুখী হতে দেখতে চাইবেনা।
থাকুক তাদের কথা, তাতে কী?
নিজের ভেতরে পুড়ে মরার থেকে, একবারেই মরা ভালো।
অদ্রির রুমের দরজা খোলা ছিলো। লিলি তাড়াহুড়ো করে ঢুকে বলল
– আপা, দেখোতো কোন নামটা সুন্দর?
অদ্রি পেছন ফিরে দেখলো লিলি ডান হাতে একটা কাগজ তার দিকে এগিয়ে দিয়েছে।
অদ্রি কাগজ টা হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বুঝতে পারলো। মেয়েদের নাম লেখা, বেশ মডার্ন নাম। লিলি আজকাল তার নাম পরিবর্তন করার চেষ্টায় আছে। কয়েক দিন পরপর কোথা থেকে যেন নামের লিস্ট নিয়ে আসে। সারাদিন সেই নাম বাছাই নিয়ে হইহল্লা। তারপর কোনো নাম পছন্দ না হওয়ায় নামের লিস্ট পাশের ডোবায় ফেলে দেয়।
প্রতিবারের মতো অদ্রি নাম গুলো মনযোগ দিয়ে পড়ে একটা নাম বাছাই করে বলল
– তুই লামিয়া রাখতে পারিস।
লিলি কী যেন একটা ভেবে বলল
– না, বেশ বড় নাম। এমন নাম হবে যা ২ সেকেন্ডের মধ্যে উচ্চারণ করা যাবে।
অদ্রি কাগজ টা ফেরত দিয়ে বলল
– তুই নিজেই পছন্দ কর।
নাজমুল সাহেব বেশ চিন্তিত। তার মা কয়েকদিন যাবত কিছুই খাচ্ছেন না। তবে এটা তার সামনে বলছেন। বাস্তবে সে লুকিয়ে লুকিয়ে খাবার খাচ্ছেন। তারপরও তার মা বিষন্নতায় ভুগছেন। মাকে সে এই জীবনে অনেকভাবেই কষ্ট দিয়েছেন। নিদ্রকে সে প্রায় আধা ঘণ্টা হয়েছে ডেকে পাঠিয়েছেন কিন্তু এখনও তার খোঁজ নেই।
নিদ্র কফির মগ হাতে নিয়েই বাবার সামনে এসে দাঁড়ালো। নিদ্র কফির মগে চুমুক দিয়ে বলল
– বাবা আমাকে ডেকেছো?
নাজমুল সাহেব বললেন
– হ্যাঁ, আম্মার খবর কী?
– আগের মতোই। সে তার বিষন্নতা কাটাবেন না।
ভ্রুকুঞ্চন করে নাজমুল সাহেব বললেন
– এই বয়সেও কেউ বাচ্চাদের মতো আবদার করে?
নিদ্র বলল
– age is just a number বাবা।
ধমকের সুরে নাজমুল সাহেব বললেন
– রাখো তোমার নীতি বাক্য। দাদীর সাথে সেও যেন রুখে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের কোন এক ভুইতা গ্রামে তার বাপের বাড়ি, সেখানে যাবেন। তিনি জানেন ভালোভাবেই যে, ওই পরিবার থেকে তাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে। তারপরও সে এরকম আবদার কেনো করলেন?
কথাটা মনে পড়াতে নাজমুল সাহেবের নিজেরই উপর রাগ হতে লাগলো। একমাত্র তার কারণেই তার মাকে ত্যাজ্য করা হয়েছে। খ্রিস্টান মেয়ে বিয়ে করেছিলেন। সেই এক ভুলে তার জীবন টা আজ….. থাক।
বুড়ো মায়ের আবদার টা তার না মেনে উপায় নেই।
নিদ্র তার দাদীর পাশে বসে বলল
– দাদী, আপনি কেমন আছেন?
নিদ্রের দাদী আসমা জামান বিরক্ত হয়ে বললেন
– খুব আয়েসে আছি। ফরেইনার বউ আমার সুন্দর যুবক রেখে গেছেন। তার জ্বালায় মরছি।
নিদ্র হাসতে হাসতে বলল
– কেনো আমি আবার কী করলাম?
নিদ্রের দাদী নিদ্রের গাল ধরে টেনে বলল
– পীরিতের জ্বালা উঠেছে তার।
– আহা! এক মাত্র নাতীর জন্য এটুকু অভিনয় তো করতেই পারো।
– আমার কইলজার টুকরা ছেলের সাথে কথা না বলে থাকা কতো কষ্ট তুই জানিস?
– জানবো ক্যামনে? আমি তো কোনোদিন কোনোভাবেই মা হতে পারবো না।
নিদ্র হা হা হা করে হেসে উঠলো।
আসমা জামান আরো বেশি বিরক্ত হয়ে বললেন
– বাবা তো হবি?
– যদি তাহাকে পাই।
– কেনো না পেলে দেবদাস হবি?
– না, আমি দেবদাসের মতো সেই বিশাল ভুলটা ভুলেও করবোনা।
কথাটা বলে নিদ্র দাদীর রুম থেকে নিজের রুমে দিকে পা বাড়ালো। হঠাৎ করেই তার মন খারাপ হয়ে গেলো। কারণ হয়তোবা সেই বিধবা।
নাজমুল সাহেব কী যেন ভাবছিলেন, সেই ভাবনার মধ্যে উদ্ভট ভাবনা উঁকি দিলো। নিদ্র আজকাল তাকে তুমি করে বলে। আগে তো আপনি করে বলতো। নাকি আগেও তুমি বলতো এখনও তুমি বলে। নাকি আগেই তুমি বলতো এখন আপনি বলে। তুমি না আপনি সম্বোধন করে বলে? কোনটা? সমস্যার সমাধান তার চাই। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না।
নিদ্রকে কি সে ডেকে জিজ্ঞেস করবে? নাকি সে নিজেই নিদ্রের রুমে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে?
কোনটা? নাকি সে টস করবে? নাকি করবেনা?
তার মন আর মাথায় আজকাল শুধু হ্যাঁ, না এর প্রশ্নের প্যাচ পাকে।
এই প্যাচ আর কোনোভাবেই খুলতে সে পারেনা। একটা সময় বিরক্ত হয়ে ঘুমের মেডিসিন খেয়ে ঘুমিয়ে থাকেন।
এই একটা সমাধান।
নিদ্রের মোবাইলের স্ক্রিনে সাদামাটা অদ্রির ছবিটা স্থির হয়ে আছে। আসলে স্থির ছবি তো স্থিরই থাকবে।
তার খুব ভয় হয় অদ্রির কাছে আসতে। দূর থেকে কেউ বলে, হারিয়ে ফেলবি খুব কাছে তার নিশ্বাসে নিশ্বাস জমাতে গিয়ে।
হারিয়ে ফেলবি, খুব কাছে থেকে পেয়েও!
চলবে……..!
© Maria Kabir