মন ফড়িং ৩৪.
সন্ধ্যায় কন্যার গায়ে হলুদের প্রস্তুতি চলছে। রীতার তাতে একদমই মন নেই তারপরও করতে হচ্ছে। রশীদ সাহেবের ছোটো মেয়ের নাম ফাহি। মেয়েটা বেশ চুপচাপ বসে আছে ড্রয়িংরুমের সোফায়। হলুদের অনুষ্ঠানের জন্য ফাহি পার্লারে যেতে চাচ্ছিলো কিন্তু তার মা রাজি হননি। বেশ কড়া গলায় বলেছেন
– এতো টাকা তোমার বাপের নাই। তোমার বড় মামীই তোমাকে সাজিয়ে দিবেন।
– একটু সুন্দর করে যদি না সাজি তাহলে কেমন হয়?
– পাত্র তোমাকে নাকি ভালোবাসে? যদি ভালোবেসে থাকে তাহলে মেকাপ ছাড়াই বাসবে।
এরপর ফাহির আর কিছু বলার থাকেনা। বড় মামী নিজেই তো সেজে কূল পাননা ওকে কখন সাজাবেন!
বড় মামী দিলারা বেগম তার হলুদের শাড়িটা আজকে পড়েছেন। সাজতে সাজতে এমন অবস্থা হলো যে, ঠোঁটে একাধিক লিপস্টিক ব্যবহার করলেন নিজেরই অজান্তে!
ফাহির কথা মনে পড়তেই নিজেই ড্রয়িংরুমে এসে ফাহিকে প্রায় জোর করে সাজাতে নিয়ে গেলেন।
রাতে অদ্রির পাশে রীতা থাকবেন, নাজমুল সাহেবকে বলেছেন। বাসায় অন্য দুজন কাজের লোক আছে তারপরও একজন বিশ্বস্ত লোক থাকা প্রয়োজন। আসমা জামানের ফাহিকে বেশ ভালো লেগেছে। মেয়েটাকে যদি নিদ্রের বউ করতে পারতেন তাহলে মনে মনে স্বস্তি পেতেন। কিন্তু নিদ্রের তো বিয়ে হয়েই গেছে আর এই মেয়েরও দুদিন পর বিয়ে।
অদ্রিটা যদি গতকাল মরতো তাহলেও একটা চান্স ছিলো। না, ওই মেয়ের প্রাণ হচ্ছে কৈ মাছের প্রাণের মতো!
নিদ্র সেই কখন হাসপাতালে গেছে এখনো বাসায় আসেনি। দুপুরে কী না কী খেয়েছে কে জানে! হলুদের অনুষ্ঠানে আসলে ওর খারাপ লাগাটা কমতো। আসমা জামান ভাবলেন, রশীদ কে দিয়ে নিদ্রকে ডেকে আনতে। কিন্তু আর সাহস পেলেননা।
অদ্রির জ্ঞান ফিরল রাত ৯ টায়। অদ্রির বিছানার পাশে টুল নিয়ে বসে ছিলো নিদ্র। জ্ঞান ফেরার পরে অপলক দৃষ্টিতে অদ্রির দিকে তাকিয়ে ছিলো। নিদ্রকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অদ্রি চোখ বন্ধ করে ফেললো।
গতকাল রাতে সে যে কাজটা করেছে, মোটেও সেটা করা ঠিক হয়নি। নিদ্র যে কতটা কষ্ট পেয়েছে, চোখের চাহনিতে বুঝতে পারছে অদ্রি। তার তো আর কিছুই করার ছিলোনা। সে নিজেও নিদ্রকে ছাড়তে পারছেনা আবার নিদ্রও তাকে ছাড়বেনা। নিদ্রকে ভালো রাখার এ-ই একটাই উপায় ছিলো তার। কিন্তু সেটাও কাজ হলোনা।
নিদ্র ডাক্তার ডেকে আনলো। চেকাপ করে মেডিসিন দিয়ে ডাক্তার চলে যাবার পর। নিদ্র বলল
– আমাকে যদি আপনার সহ্য না হয় সরাসরি বলবেন কিন্তু এই ধরনের কাজ কখনো করবেননা।
নিদ্রের কণ্ঠ শান্ত শোনাচ্ছিলো। নিদ্র রেগে নেই কিন্তু এতোটা শান্ত থাকার কারণও অদ্রি বুঝতে পারছেনা। অদ্রি ধীরে ধীরে বললো
– ব্যাপারটা ওরকম না।
– তাহলে কীরকম?
– আমি আপনাকে ছাড়তে পারছিনা। এদিকে উনি আপনার ক্ষতি করে বসতে পারে। তাই ভাবলাম যেহেতু আমিই সবকিছুর মূলে তাই আরকি…..
– আমি কি আপনাকে ভালোবাসিনা?
– হ্যাঁ, বাসেন।
– তাহলে আমার একটা কথা শুনবেন?
– শোনার মতো হলে শুনবো।
– একজন ডাক্তারের সন্ধান আমরা পেয়েছি। আপনি তার কাছে যেতে অস্বীকার করবেননা তো?
– না, অস্বীকার করবোনা।
দুদিন পর বিয়ের দিনে অদ্রিকে বাসায় নিয়ে আসা হলো। অদ্রি উপর দিয়ে নিদ্রকে বুঝানোর চেষ্টা করে যে, সে ভালো আছে। কিন্তু ভিতরে ভিতরে সে পুরোপুরিভাবে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ইখলাস সাহেবের চিন্তাটা মাথা থেকে সরাতেই পারছেনা।
বিয়ের দিন বর যাত্রী আসার সময় নিদ্রের উপর দায়িত্ব পড়লো পাত্রপক্ষকে স্বাগত জানানোর। সাথে কয়েকজন অল্পবয়সী ছেলে মেয়ে আছে। নিদ্রের মন পড়ে আছে অদ্রির কাছে। অদ্রি ওর রুমেই জানালার পাশে টুল নিয়ে বসে আছে।
বর যাত্রীকে স্বাগত জানানোর পর তাদের নির্দিষ্ট স্থানে বসতে দিয়ে নিদ্র দোতলায় পা বাড়াবে তখন পেছন থেকে নারী কণ্ঠ বলে উঠলো
– এই এই আপনি কই যাচ্ছেন?
নিদ্র পেছনে ফিরে মেয়েটাকে দেখে অবাক হলো। বরপক্ষের সাথে মেয়েটা এসেছে কিন্তু নিদ্রের তো ওর সাথে কোনী কথা হয়নি। তাহলে এভাবে কথা বলছে কেনো? এই বলে তো পরিচিত বা খুব কাছের লোককে ডাকা যায় কিন্তু সম্পূর্ণ অপরিচিত কে এভাবে ডাকা যায় না।
নিদ্র বিনয়ের স্বরে বললো
– কিছু বলবেন?
মেয়েটা মুচকি হেসে বলল
– আপনি বিয়ের আসর ছেড়ে উপরে কোথায় যাচ্ছেন?
মেয়েটা বেশ সুন্দরী। মুচকি হাসাতে আরও বেশি সুন্দরী লাগছে। নিদ্র মেয়েটার উপর থেকে চোখ সরিয়ে বললো
– আমার একটু কাজ আছে।
নিদ্র কথা না বাড়িয়ে দোতলায় দ্রুত উঠে গেলো।
মেয়েটা রাগ হজম করে মনে মনে বললো
– কী ভাব!
সুন্দরী মেয়েরা কখনো কোনো পুরুষের অবহেলা সহ্য করতে পারেনা। নীলিমা নামের মেয়েটার ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হলোনা।
নিদ্র, অদ্রির হাত ধরে জিজ্ঞেস করলো
– স্যুপ খাবে? আমি নিজ হাতে রান্না করে আনি?
অদ্রি হাসার চেষ্টা করে বললো
– এমনিতেই আপনার অনেক খাটুনি হয়েছে। এখন একটু রেস্ট নিন।
এই কদিনে অদ্রির চোখের নিচে আবারও কালো দাগ জমতে শুরু করেছে। নিদ্র বললো
– আচ্ছা আমি রেস্ট নিবো। তার আগে আমার একটা আবদার আছে।
নিদ্রের কপালে চুমু দিয়ে অদ্রি বললো
– কী আবদার শুনি?
– আবদার বলার আগেই তো আপনি পূরণ করে দিলেন।
অদ্রি হাসি চেপে রেখে বললো
– আপনার পুরোটা বুঝতে শিখছি মনে হয়।
– কিন্তু আমি তো পারছিনা।
– যেকোনো একজন পারলেই হলো। দুজনেই যদি বুঝতে পারে তাহলে আবার মহাসমস্যা!
– অদ্রি আমি স্যুপ রান্না করে আনি। আমার নিজেরও খেতে ইচ্ছে করছে।
অদ্রি আর কিছুই বললো না।
নিদ্রের হাত ধরে টেনে জাপটে ধরলো শক্ত করে।
নিদ্র, অদ্রির চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে বললো
– খুব খারাপ লাগছে?
– হুম।
– তাহলে চলুন ছাদে যাই।
– না।
– তাহলে কী করবেন বলুন!
– আমাকে এভাবে জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ থাকলেই ভালো লাগবে।
নিদ্র শক্ত করে অদ্রিকে জড়িয়ে ধরলো। চোখের কিনারাটা ভিজে উঠছে বারবার অদ্রির।
হয়তোবা এই মুহুর্ত টা আর বেশিদিন পাবেনা সে। তাই পুরো মুহূর্তের স্বাদ সে প্রাণভরে নিতে চায়। যেন মৃত্যুর সময় কোনো কিছু না পাওয়ার আফসোস না থাকে!
চলবে……
© Maria Kabir