মন ফড়িং ৩২.
নাজমুল সাহেব বিরক্ত হয়ে বললেন
– আধা ঘণ্টা ধরে আমাকে বসিয়ে রেখেছিস কী একটা কথা বলবি বলে! কিন্তু কিছুই বলছিস না। ঘরের এক কোণা থেকে অন্য কোণা হেঁটে বেড়াচ্ছিস।
নিদ্র ভ্রু কুঁচকে বললো
– আসলে কীভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিনা।
– বউমাকে নিয়ে?
– হ্যাঁ।
– নাস্তা দেয়ার সময় বউমাকে খুব চিন্তিত লাগছিলো। আমি অবশ্য জিজ্ঞেস করেছিলাম কিন্তু স্বীকার করলোনা।
– বাবা, তুমি তো জানো ওর আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। ওর আগের হাজবেন্ড তেমন সুবিধার ছিলোনা। ওকে মানসিকভাবে নির্যাতন করেছে জীবিত থাকা অবস্থায়। এমনকি সুইসাইড করার আগে এমন প্ল্যান করে গেছে যে অদ্রি প্রায় ২ বছরের বেশি সময় অমানুষিক কষ্ট পেয়েছে। ও মনে করতো ওর কারণেই ইখলাস সাহেব সুইসাইড করেছেন। এজন্য নিজেকে কষ্ট দিতো।
– তুই তো সেটার সমাধান করেছিস। তাহলে সমস্যা কোথায়?
– আমি তো ভেবেছিলাম সমাধান হয়ে গেছে কিন্তু আসলে সমাধান তো হয়ই নেই উল্টো আরো বিপত্তি হয়েছে!
– মানে?
– গতকাল রাতে হঠাৎ করে বলতেছে, ইখলাস সাহেব নাকি আমার পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। আর তিনি চাননা আমরা সুখে থাকি। বাসর রাতে যদি বউ এ ধরনের কথা বলে তখন কেমন লাগে?
নাজমুল সাহেব নিদ্রের কথা গুলো শুনে আঁতকে উঠলেন। বউমা তো মজা করার মানুষ না। আর মজা করলেও তো নিদ্র ধরতে পারবে।
– আর কিছু বলছে নাকি ওটুকুই?
– হ্যাঁ বলছে। বলে আমাদের মেয়ে হবে। ওর মতো দেখতে হবে। কারণ ও মেয়ে রেখে মারা যাবে।
– কী?
– হ্যাঁ তাই তো বললো।
– সকালে কিছু জিজ্ঞেস করেছিলি?
– বিষয়টাকে এড়িয়ে গেলো।
– এড়াতে দেয়া যাবেনা। মানসিক অবস্থা ভালো মনে হচ্ছে না। আমি জিজ্ঞেস করলে ও তো বলবেই না উল্টো লজ্জা পাবে। তুই ওকে ঠান্ডা মাথায় জিজ্ঞেস করবি। বলতে চাইবে না কিন্তু মাথা ঠান্ডা করে জিজ্ঞেস করবি।
– দেখি।
– দেখলে তো হবেনা!
– মনে করো ও পুরোপুরিভাবে সব জানালো তখন কী করবো?
– সিরিয়াস হলে সাইক্রিয়াটিস্ট দেখাতে হবে। এভাবে তো ফেলে রাখা যায়না।
– ও রাজি হবে?
– রাজি করানোর দায়িত্ব তোর। ভালো যদি থাকতে চাস তাহলে রাজি করাতেই হবে।
রাত ১০ টা বেজে ১৫ মিনিট নিদ্র ঘড়ির কাটার দিকে তাকিয়ে সময়টা অদ্রিকে জানালো। অদ্রি হাসার চেষ্টা করে বললো
– কফি বা চা খাবেন?
– না। চলেন একটু ছাদে যাই।
– এই রাতে?
– কাপলদের রাতেই ছাদে যেতে হয়। তাহলে রোমান্স করতে সুবিধা হয়।
– আপনি না কীসব বলেন!
অদ্রির হাত ধরে নিদ্র বললো
– আমি ঠিকই বলি। চলুন যাওয়া যাক।
ছাদের চাবি হাতে নিয়ে অদ্রি বললো
– ঠিকাছে আপনার কথাই রাখলাম।
ছাদটা বেস অযত্নে, অবহেলায় তার নিজস্ব সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলেছে। ছাদ গুলোকে ফুলের টব, ছোটো খাটো সবজি বাগান বা এক কোণায় চেয়ার টেবিল থাকবে। ছাদে আসতেই তখন মন প্রাণ ভরে যাবে। কিন্তু এই বাড়ির ছাদের কোনো সৌন্দর্য নেই।
ছাদের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে নিদ্র বললো
– আপনি গতকাল রাতে যা যা বলেছিলেন সব কি সত্য ছিলো?
– আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছেনা কেনো?
– অদ্রি প্রসঙ্গ বদলানোর চেষ্টা করবেননা।
– হ্যাঁ সত্যি ছিলো।
– আপনি কি এখনো তাকে আশেপাশে দেখছেন?
– হ্যাঁ। আপনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে।
নিদ্রের ভয় লাগলো এই ভেবে যে, একজন মৃত মানুষের আত্না তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে ভেবে। কিন্তু ভয়টাকে প্রকাশ না করে দৃঢ় কণ্ঠে বললো
– আপনার ভুল।
– না ভুল না। উনি যা যা বলেছেন সব সত্য হবার পরে আপনি আমাকে বিশ্বাস করবেন।
– কী কী বলেছেন বলুন তো শুনি?
– গতকাল রাতে যা যা বলেছি সব সত্যি হবে দেখবেন।
– ইখলাস সাহেব এর থেকে পরিত্রাণের উপায় বলেছেন?
– হ্যাঁ।
– বলে ফেলুন।
– আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়াটাই পরিত্রাণের উপায়।
– তাহলে আলাদা হয়ে যাই। অন্ততপক্ষে আপনি বেঁচে থাকবেন।
নিদ্রকে জড়িয়ে ধরে অদ্রি বললো
– পারবোনা আমি। আপনার সাথে থেকে মরতে আমি রাজি কিন্তু আপনাকে ছাড়া সম্ভব না একা বেঁচে থাকার।
– অবশ্যই সম্ভব। একসময় আপনার সবকিছু সহ্য হয়ে যাবে।
– না, মোটেও না।
– তাহলে আমি যা বলবো, করবেন তো?
– করবো।
– আচ্ছা। এখন চলুন ঘুমাবেন।
সকালে নাজমুল সাহেব সব কথা শুনে বললেন
– ঢাকা ছাড়া তো এখানে ভালো সাইক্রিয়াটিস্ট পাওয়া যাবেনা।
– তাহলে ঢাকায় দেখাই।
– এতো সহজ না নিদ্র। যত অভিজ্ঞ ডাক্তার তার সিরিয়াল পাওয়া ততই কঠিন। আমি চাচ্ছি অভিজ্ঞ কাউকে দেখাতে।
– তোমার তো অনেক চেনাজানা এখানে। তুমি পারবে চেষ্টা করলে।
– চেনাজানা একসময় ছিলো। যোগাযোগ না রাখলে চেনাজানাও থাকেনা। তবে চেষ্টা করে দেখতে পারি।
রশীদ সাহেব মেহমানদের জন্য বাজার করে আনলেন। দু’জন মধ্যবয়সী মহিলা আনলেন কাজ করার জন্য। লিলির ঘরটাতে তাদের থাকতে দেয়া হলো। রীতা রান্না নিয়ে অনেক ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। আসমা জামানের টুকটাক দরকারে অদ্রি সাহায্য করতে লাগলো। আসমা জামান হাসি মুখে ঠিকই কথা বললেন কিন্তু মনে মনে বিরক্ত হচ্ছিলেন। নিদ্র বাড়ির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো কিন্তু মন থেকে চিন্তাটা বাদ দিতে পারলোনা।
নাজমুল সাহেবের কাছে থাকা পুরাতন কন্ট্যাক্ট নাম্বারে কল দিয়ে চেষ্টা করছিলেন খোঁজ নেয়ার। প্রায় সবগুলোই বন্ধ আর যেগুলো খোলা ছিলো তারা কেউই সাইক্রিয়াটিস্ট এর খোঁজ দিতে পারলোনা।
অদ্রি যেখানেই যায় সেখানেই ইখলাস সাহেবকে দেখেন বিকট হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। অদ্রির তখন ইচ্ছা করে জোরে চিৎকার করে কাঁদতে কিন্তু নিদ্রের জন্যই পারেনা। আর অন্যরাও কী ভাববে তাকে? পাগল ভাববে। আর নিদ্রের দাদী নিদ্রকে পাগল বিয়ে করেছিস বলে খোঁটা তো দিবেই।
নিদ্রের তখন অবশ্যই খারাপ লাগবে।
নাজমুল সাহেব শেষ পর্যন্ত কোনো কিনারা করতে না পেরে রশীদ সাহেবকে ব্যাপারটা জানালেন।
রশীদ সাহেব বললেন
– ফকির দেখালেই তো হয়।
– তোকে যা বলেছি, করতে পারবি কিনা বল?
– পারবো না কেনো?
– তাহলে কীভাবে করবি বল।
– আমার ছোটো মেয়েটার হবু বরকে জিজ্ঞেস করলে হবে। ঢাকায় ওর চেনাজানা অনেক।
– বিষয়টা গোপন রাখতে হবে। কারণ তো জানিসই। সাইক্রিয়াটিস্ট দেখানো মানেই মফস্বলের লোক ভাবে পাগল। এমনিতেই বউমা মানসিক চাপে আছে।
– আজকের মধ্যে খোঁজ লাগবে। সমস্যাটাকে বাড়তে দেয়া যাবেনা। তাহলে আরো বিপদ। নিদ্রকে আমার মতো কষ্ট পেতে হবে আজীবন!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়েই কথাটা বললেন নাজমুল সাহেব!
চলবে…….!
© Maria Kabir