মন ফড়িং ২৯.
অদ্রি রুমে ঢুকে দেখলো নিদ্র বিছানায় শুয়ে খবরের কাগজ পড়ছে। অদ্রিকে ঢুকতে দেখে নিদ্র ঠাট্টা করে বললো
– বাসর ঘরে বউ অপেক্ষা করে বরের জন্য আর আমাদের ক্ষেত্রে হচ্ছে উল্টোটা।
অদ্রি লজ্জায় লাল হয়ে গেলো।
নিদ্র বলতে লাগলো
– একটা লাল ওড়না দিবেন?
অদ্রি অবাক হলো। ওড়না দিয়ে কী করবে?
– ওড়না কেনো লাগবে?
– বিছানার উপর মাথায় ঘোমটা দিয়ে বসবো। আপনি ঘোমটা খুলবেন। আমাদের ক্ষেত্রে তো প্রসেসটা তো ভিন্ন।
– তাই বলে তো আপনি মেয়ে সাজতে পারেননা।
– অদ্ভুত বাসর রাত।
– সকালে আপনাকে খুব ভোরে উঠতে হবে। বাড়ির কাজে নিজেদের না থাকলে কোনো কাজই ভালো হয়না।
নিদ্র বিছানার ডান পাশে শুয়ে আছে। অদ্রি বিছানার বামপাশে শুয়ে পড়লো,নিদ্রের দিকে পেছন ফিরে। নিদ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো অদ্রির দিকে।
সে ভেবেছিলো অদ্রি তার কাছে এসে শোবে কিন্তু হলো তার উল্টো। অদ্রির কথাবার্তায় মনে হচ্ছিলো, বেশ বিরক্ত হয়ে আছে। নিদ্রের সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলোনা। নিদ্র সেধে সেধে যতক্ষণ কথা বলেছে ঠিক ততক্ষণই কথা বলেছে।
অদ্রি কি তাকে সহ্য করতে পারছেনা?
কিন্তু কেনো? যদিই সহ্য করতেই না পারে তাহলে ওকে বিয়ে করলো কেনো?
নিদ্রের নিজেকে অসহায় লাগছে। বিয়ে করেছে কি এভাবে পেছন ফিরে ঘুমিয়ে থাকার জন্য?
– অদ্রি।
– বলুন
– আপনি কি জানেন আমি কী করি?
– ঠিক বুঝলাম না।
– প্রত্যেক ছেলেরই তো পেশা থাকে। আমারও তো একটা পেশা আছে। সেটা কি হতে পারে জানেন আপনি?
– না জানিনা। জানার প্রয়োজন বোধ করছিনা।
– আপনি প্রয়োজন বোধ না করলেও আমি করি।
অদ্রি নিদ্রের দিকে ফিরে বললো
– আপনি এমন করছেন কেনো?
– কেমন করছি?
– এতো রাতে হুট করে কীসব কথা শুরু করেছেন।
– কীসব কথা না। আমার যোগ্যতার কথা বলছি।
– আচ্ছা বলুন।
– আমি পড়াশোনা করিনি। আমি যা করি বাংলাদেশে তাকে রংমিস্ত্রি বলে।
– তাও তো কিছু একটা করেন। আমার তাতে সমস্যা নাই।
– আমার তো মনে হয় সমস্যা আছে।
– কী কারণে মনে হচ্ছে?
– আপনি আমার দিকে পেছন ফিরে শুয়ে আছেন। ঠিকমতো কথা বলছেন না। মুখে একটু হাসি পর্যন্ত নেই।
– আমি আসলে আপনার জন্য বা আপনার উপরে বিরক্ত নই।
– তাহলে কারণটা বলুন। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে অদ্রি। একই রুমে একই বিছানায় থেকেও আমি আগের মতো সেই শান্তিটা পাচ্ছিনা।
– কিছু মনে করবেন না তো যদি আসল কারণ টা বলি?
– অবশ্যই না। আমি চাচ্ছি আপনি ভেতরের রাগটা ঝেড়ে ফেলুন। তাহলে আমি আরামে ঘুমাতে পারবো।
অদ্রি বিছানার পাশে ছোটো টেবিলে রাখা পানির জগ থেকে গ্লাসে পানি ঢেলে হাতে নিয়ে কিছু একটা ভাবলো। এক ঢোকে সম্পূর্ণ গ্লাস শেষ করলো।
– আমার আগেও একবার বিয়ে হয়েছিলো। আপনি তো জানেন। যেহেতু বিয়েও হয়েছিলো সেহেতু বাসর রাত হওয়াটা স্বাভাবিক ছিলো। তাই না?
নিদ্র বললো
– আপনি তো বলেছিলেন সে আপনাকে স্পর্শ পর্যন্ত করেনি। আর যদি করেও থাকে তাহলে সেটা তো অবৈধ কিছু হবেনা। কারণ সে আপনার স্বামী ছিলো।
– ব্যাপারটা সেরকম না। যেহেতু তার পুরুষত্ব ছিলোনা তাই আমার কাছে কখনো আসেনি। আজকেও তো আমার বাসর রাত। সে চায়না আমি কারো সাথে জড়াই।
– সে তো মারা গেছে তাই না অদ্রি?
– হ্যাঁ, দেহেই মারা গেছে।
নিদ্র চিন্তিত হয়ে বললো
– মানে?
– সে এখনো আমার পিছু লেগে আছে। আমার আশেপাশেই আছে।
হাত দিয়ে ইশারা করে বিছানার বিপরীতে যে দেয়াল টা আছে সেটাকে নির্দেশ কর অদ্রি বললো
– ওই দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ইখলাস সাহেব।
নিদ্র দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কিছুই দেখতে পেলো না।
– সে মারা গেছে অদ্রি।
– নিদ্র উনি হাসছে। কী বিকট লাগছে দেখতে। নিদ্র উনি আমাকে বাঁচতে দিবেনা।
– অদ্রি কেউই নেই।
– আছে। রুমে ঢোকার সাথে সাথে আমি উনাকে আপনার পাশের দেয়ালে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।
– আপনি আমার কাছে আসলেই উনি আপনার ক্ষতি করবে।
অদ্রির হাত পা কাঁপছে, কপালের উপর বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতে শুরু করেছে। নিদ্র কী করবে, কী বলবে বুঝতে পারছেনা।
অদ্রির দিকে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো
– আপনি ঘুমানোর চেষ্টা করুন। খুব ক্লান্ত আর চিন্তিত আছেন বলেই হ্যালুসিনেশন হচ্ছে।
– নিদ্র আমার থেকে দূরে থাকুন। আপনার ক্ষতি করবে উনি।
– না কিছুই হবেনা।
অদ্রির পিঠে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে নিদ্র। কপালের ঘাম আরেক হাত দিয়ে মুছিয়ে দিয়ে বললো
– অদ্রি ইখলাস সাহেব অনেক আগেই মারা গেছেন। পোস্টমর্টেম করাও হয়েছিলো। জীবিত মানুষের পোস্টমর্টেম করা হয়না।
– উনি জোরে জোরে হাসছেন। আমার কান ফেঁটে যাচ্ছে। হাসতে নিষেধ করুন।
অদ্রিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো নিদ্র। কী করবে বুঝতে পারছেনা সে। এমন পরিস্থিতিতে পড়তে হবে ওর জানা ছিলোনা। আর কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা। পুরো মাথা ফাঁকা হয়ে আছে। অদ্রি কাঁদছে ফুপিয়ে ফুপিয়ে। সেই কান্নার শব্দে নিদ্রের বুকের ভেতরটাও জ্বলে যাচ্ছে। অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হচ্ছে।
অদ্রিকে কোনোভাবে ঘুম পাড়াতে পারলে আপাতত পরিস্থিতি ঠান্ডা করা যেতো। কিন্তু স্বাভাবিকভাবে এখন ও ঘুমাবে না।
নিদ্র অদ্রিকে ছেড়ে দিয়ে বললো
– একটু বসুন আমি আসছি।
অদ্রি নিদ্রের গেঞ্জি খামচে ধরে বললো
– না, না আপনি যাবেন না। ও আমাকে…
– আমি দূরে কোথাও যাচ্ছিনা। আমার ব্যাগে ঘুমের মেডিসিন আছে। আর ব্যাগ এ রুমেই আছে।
অদ্রি ছেড়ে দিলো। নিদ্র ঘুমের মেডিসিন এনে অদ্রিকে জোর করে খাইয়ে দিলো।
বিছানায় আধাশোয়া অবস্থায় অদ্রিকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো
– একটু পরেই ঘুম চলে আসবে। শান্তির ঘুম আসবে। সুন্দর একটা স্বপ্ন আপনি দেখবেন। বলুন তো স্বপ্নে কী কী দেখতে চান?
অদ্রি কান্না জড়িত কণ্ঠে বললো
– স্বপ্নে আমি আর আপনি। আমাদের ছোট্ট একটা ঘর থাকবে। আমাদের ঘরের সাথে ছোট্ট বারান্দা থাকবে। সেই বারান্দায় আপনার পছন্দের ফুল গাছ থাকবে। ফুলগুলো যখন একসাথে ফুটবে তখন আমাদের মেয়ে গুটি গুটি পায়ে দৌঁড়ে এসে বলবে, ” আম্মু, আব্বু দেখো দেখো কত্তো ফুল! “
– আমাদের মেয়ে কার মতো দেখতে হবে?
– আমার মতো।
– কেনো?
– আমি তো থাকবো না। তখন আপনার খুব কষ্ট হবেনা! মেয়ে আমার মতো দেখতে হলে আপনার কষ্ট কিছুটা কমবে।
– আপনি থাকবেন। আপনি, আমি আর আমাদের মেয়ে মিলে অনেক ঘুরবো, আনন্দ করবো।
– নিদ্র আমি থাকবোনা তো। উনি আমাকে এতো সুখ পেতে দিবেনা। এইযে আপনার বুকে মাথা রেখে ঘুমানোর চেষ্টা করছি। এটাতেও অনেক সুখ, অনেক। আপনার গন্ধটা নিশ্বাস জুড়ে আমাকে পাগল করছে, এটাতেও সুখ। আপনি যখন আদর করেন তখনকার মতো সুখী আমি কখনোই নিজেকে ভাবতে পারিনা।
অদ্রির কণ্ঠ জড়িয়ে আসছে ঘুমে। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বলতে লাগলো
– উনি এতো সুখী আমাকে হতে দিবেনা। আপনি……
অদ্রি ঘুমিয়ে পড়েছে। নিশ্বাসের উঠানামাতেই নিদ্র বুঝতে পারছে। এখনকার মতো তো শান্ত করা গেলো কিন্তু আবার যখন এমন হবে তখন???
ভাবতেই পারছেনা।
প্রিয় মানুষকে এতো সহজে পাওয়া যায়না!
চলবে…..!
© Maria Kabir