#মন পায়রা
#মাশফিয়াত_সুইটি(ছদ্মনাম)
পর্ব:১৫
‘সাবিহা রেডি হতে দেরি হয় কারো? তোর জন্য তো এবার ফ্লাইট মিস হয়ে যাবে।’
– আপু আরেকটু অপেক্ষা কর লিপস্টিকটা দিয়ে নেই।
– এমন ভাবে সাজুগুজু করছিস মনে হচ্ছে ওখানে তোর জন্য পাত্রপক্ষ দাঁড়িয়ে আছে।
– কোথাও গেলে একটু সাজতে হয় নে চল এবার আমি রেডি।
– হুম চল।
বাড়ির সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে পায়রা আর সাবিহা এয়ারপোর্টে চলে গেল পলাশ শেখ নিজেই এগিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু পায়রা বাঁধা দিয়েছে।
নাম এনাউন্স করতেই সবাই গিয়ে ফ্লাইটে উঠে গেল কিছুক্ষণ পরেই ছেড়ে দিলো। পায়রা জানালার পাশে বসে আছে আর সাবিহা পায়রার পাশে বসে মোবাইলে কারো সঙ্গে চেটিং করছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। পায়রা ব্রু উঁচিয়ে,
– আচ্ছা সাবিহা সত্যিই কি তোর আর ইনান ভাইয়ার ব্রেকাপ হয়ে গেছে।
সাবিহা সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে,
– এর আগেও অনেকবার বলেছি হ্যা ব্রেকাপ হয়েছে তাহলে আবার কেন প্রশ্ন করছিস?
– তোরা তো দু’জন দু’জনকে অনেক ভালোবাসতি তারপরেও কেন?
– ইফাত ভাইয়াও তো তোকে ভালোবাসতো তুইও বাসিস তাহলে তোদের কেন এত দুরত্ব?
– তুই সবটা জানিস কত বড় ভুল বোঝাবুঝি…
– তোদের এই ভুল বোঝাবুঝির কারণে আমাদের সম্পর্কটাও নষ্ট হয়ে গেছে।
পায়রা অবাক হয়ে,
– আমার জন্য?
– হ্যা তোর জন্য, তোর জন্য দুই পরিবারের সম্পর্ক নষ্ট হয়েছে তাই ইনান চায়নি সম্পর্কটা রাখতে তার ধারণা তার মা আমাদের সম্পর্ক মানবে না।
পায়রা পুনরায় জানালার দিকে তাকালো বলার মতো কিছুই নেই তার। এখন পায়রা খুব করে উপলব্ধি করছে তার জন্য শুধু ইফাত নয় বরং নিজের বোন আর ইনানও অনেক কষ্ট পেয়েছে।
প্রায় পনেরো ঘন্টা জার্নির পর অবশেষে আমেরিকায় পা রাখলো পায়রা আর সাবিহা। তাদের সঙ্গে অফিসের দু’জন স্টাফ এসেছে। এয়ারপোর্টে আসতেই একজন লোক পায়রার কাছে এসে ইংরেজিতে বলল,
– আমেরিকায় আপনাদের স্বাগতম স্যার আপনাদের হোটেলে নিয়ে যাওয়ার জন্য আমাকে পাঠিয়েছেন।
– শুধুই কি আমাদের?
– না ম্যাম সবার জন্যই এই ব্যবস্থা তবে আপনাদের জন্য আমাকে।
– ওহ।
লোকটির সঙ্গে তার গাড়িতে করে হোটেলে চলে গেল। লোকটি তাদের রুম দেখিয়ে চলে গেল এবং বলে গেল কিছু দরকার হলে যেন তাকে বলে।
পায়রা চেয়েছিল দুই বোন এক রুমেই থাকতে কিন্তু সাবিহা আচমকা না করে দিলো সে নাকি আলাদা রুমে থাকবে পায়রা আর জোর করেনি। পায়রা পোশাক পাল্টে ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
_________________
মিটিং আরও দু’দিন পরে হবে এই দু’দিন সিইও নিজের পক্ষ থেকে তাদের ঘুরার খরচ বহন করবে এতে পায়রার প্রথমে আপত্তি থাকলেও বাধ্য হয়ে রাজি হতে হয়েছে তবে এখনও সে সিইও কে দেখেনি।
যে যার যার মতো ইনজয় করছে শুধু পায়রা বাদে এখন আর সঙ্গ ভালো লাগে না নিঃসঙ্গ থাকতেই ভালো লাগে। আগের থেকে পায়রা অনেক বদলে গেছে সবার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই কথা বলে সবার সাথে,হাসিটাও এখন আর মন থেকে আসে না শুধু লোক দেখানো হাসি।
সাবিহা এখন ভার্সিটিতে পড়ে আগের থেকে বেশ ফর্সা হয়েছে চুল গুলোও পায়রার মতোই কোমর ছেড়েছে ব্যবহার চাল চলন আগের মতোই আছে।
সময় খুব দ্রুত চলে যায়,দু’দিন কেটে গেছে আজ মিটিং শুরু হবে দশটায়। সাদা জিন্স,কালো শার্ট আর উপরে সাদা রঙের কোর্ট পরিধান করেছে পায়রা, চুলগুলো সুন্দর করে খোঁপা করা দেখতে পুরো বিজনেসওমেন লাগছে।
সাবিহা পলকহীন দৃষ্টিতে পায়রার পানে তাকিয়ে আছে পায়রা খেয়াল করতেই সাবিহাকে প্রশ্ন করল,
– এভাবে কি দেখছিস?
– তোমাকে আপু।
– আগে কখনও দেখিসনি?
– দেখেছি তবে এমন করে নয় আজ তোকে অনেক সুন্দর লাগছে।
– থ্যাঙ্কিউ।
– আমাকেও তোর সঙ্গে নিয়ে যা না।
– ভেতরে কি তোকে ঢুকতে দিবে।
– সমস্যা নেই আমি বাইরে বসে থাকব তারপরেও নিয়ে যা একা একা এখানে বোরিং লাগবে।
– আচ্ছা চল।
সাবিহা খুশি হয়ে পায়রার সঙ্গে বের হলো।সাবিহা আগেই রেডি হয়ে নিয়েছিল আর তারপর পায়রাকে রাজি করালো।
অনেক বড় অফিস নিচে বড় বড় গাড়ি পার্কিং করা অনেক সিকিউরিটির ব্যবস্থা আছে। ভেতরে জনমানবে পরিপূর্ণ যে যার যার কাজে ব্যস্ত অন্যদিকে তাকানোর ইচ্ছে যেন তাদের মধ্যে নেই। পায়রা বাইরে খেয়াল করেছে বড় একটা সাইনবোর্ডে কোম্পানির নাম লেখা ই.এম প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিটি কোম্পানির সিইও শুধু মিটিং রুমে প্রবেশ করতে পারবে তাই পায়রা সব কাগজপত্র গুছিয়ে নিয়ে সাবিহা আর তার দু’জন স্টাফকে বাহিরে রেখে ভেতরে প্রবেশ করলো।
ভেতরটা অনেক বড় লম্বা একটা টেবিল তার দুইপাশে সাড়ি করে টেবিল রাখা টেবিলের শেষ মাথায় একটা বড় চেয়ার হয়তো ওই চেয়ারেই সিইও বসবে ঠিক সামনে বড় একটা পর্দা।যে যার যার চেয়ারে বসে আছে পায়রা ভেতরে প্রবেশ করতেই একটা মধ্য বয়স্ক লোক একটা চেয়ার টেনে পায়রাকে বসতে বললো পায়রা বসলো।
একটা লোক ইতোমধ্যে এসে বলে গেছে তাদের স্যার আসছেন। পায়রার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে অনেক নার্ভাস হয়ে গেছে এর আগেও অনেক মিটিং এ উপস্থিত ছিল কিন্তু আজকের মতো একা নয় হয় বাবা সঙ্গে ছিল নয় অফিসের কেউ না কেউ ছিল।
সব অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ই.এম কোম্পানির সিইও ভেতরে প্রবেশ করলেন সবাই দাঁড়িয়ে গেল। পায়রা পূর্বের ন্যায় বসে আছে লোকটাকে দেখার জন্য পেছনে ঘুরতেই চমকে গেল। সিইও এসে নিজের চেয়ারে বসে পড়লো কিন্তু পায়রার দৃষ্টি তার দিকে স্থির ভেতরে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে মাথা ঝিমঝিম করছে লোকটি হেসে হেসে সবার সঙ্গে কুশল বিনিময় করছে এবার সে পায়রার দিকে তাকালো পায়রার সেদিকে খেয়াল নেই পায়রা তো তাকে দেখতে ব্যস্ত।
লোকটি পায়রার সামনে তুড়ি বাজিয়ে,
– আর ইউ ওকে?
– ইফাত!
লোকটি আর কেউ নয় ইফাত। ইফাত পায়রার চোখের সামনে, পায়রা ইফাতকে দেখে অবাক হলেও ইফাতের যেন সেদিকে কোনো হেলদুল নেই মুখে সেই মৃদু হাসি যা দেখে পায়রা বারবার ঘায়েল হয়। ইফাত পায়রার চোখের দিকে তাকিয়ে,
– আমি ই.এম কোম্পানির সিইও ইফাত মির্জা চেনেন আমায়?
পায়রা কোনো উত্তর দিলো না ইফাতের কাছ থেকে আপনি সম্বোধন শুনে ভেতর অস্থিরতা কাজ করছে। পায়রার কাছ থেকে কোনো উত্তর না পেয়ে ইফাত বলল,
– মিস পায়রা….ওয়েট! মিস নাকি মিসেস?
পায়রা বুঝতে পারলো চিনেও না চেনার ভান ধরছে ইফাত সবার সামনে। পায়রা জোরপূর্বক নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে,
– মিস পায়রা শেখ।
– মিস পায়রা তাহলে আপনার প্রেজেন্টেশনটা দিয়েই শুরু করি?
– সিউর।
কিছুটা নার্ভাস লাগলেও এখন পুরোপুরি নার্ভাস হয়ে গেছে পায়রা বিশেষ করে ভেতরে ভেতরে খুব কষ্ট হচ্ছে ইফাতের এমন ব্যবহারে মনে মনে ভাবছে,’উনি কি সত্যি আমায় ভুলে গেছেন? এমন অচেনার মতো কথা বলছে কেন?
ইফাত পায়রাকে ডেকে,
– কি ভাবছেন? তাড়াতাড়ি করুন আমার আরও কাজ আছে।
পায়রা সব ভাবনা ভুলে মনে সাহস সঞ্চয় করে নিজের প্রেজেন্টেশন সবার সামনে উপস্থাপন করলো।
একে একে বাকি কোম্পানির সিইওরা নিজের কোম্পানি উপস্থাপন করলো। ইফাত কাউকে ফোন দিলো দুয়েক মিনিটের মধ্যেই ভেতরে আরাফ প্রবেশ করলো। পায়রা যেন আরেক দফা চমকে গেল, অনেকবার আরাফকে ইফাতের খবর জিজ্ঞেস করার পরেও আরাফ ইফাতের খবর দেয়নি উল্টো বলেছে সে নাকি জানে না অথচ পূর্বের ন্যায় আরাফ ইফাতের সঙ্গেই আছে।
আরাফ ইফাতের কাছে গিয়ে,
– স্যার বলুন।
– উনাদের ফাইল গুলো নিয়ে যাও ডিল কোন কোম্পানি পাবে পরশুর মধ্যে জানিয়ে দিবো।
– ঠিক আছে স্যার।
বলেই আরাফ সবার কাছ থেকে ফাইল গুলো নিয়ে চলে গেল।আরাফও এমন ভাব করলো যেন পায়রাকে চেনেই না।ইফাত সবার উদ্দেশ্যে,
– তো আপনারা ভালো করে ঘুরা ঘুরি করুন সমস্যা হলে আপনাদের জন্য নিয়োজিত লোকদের বলবেন।
সবাই সম্মোলিত ভাবে হ্যা বললো। একজন লোক বলে উঠলেন,
– মি.ইফাত মির্জা আপনার বিয়ের দাওয়াত কিন্তু পেলাম না নাকি দেওয়ার ইচ্ছে নেই।
ইফাত হেসে উওর দিলো,
– আপনারা আমার অতিথি দাওয়াত অবশ্যই পাবেন।
– কবে?
– কাল মেহেদী অনুষ্ঠান হবে ভেবেছিলাম সবাইকে বিকেলেই বলবো এখন যেহেতু কথা উঠলো তাহলে অপেক্ষা করার দরকার কি এখনি দিয়ে দিলাম দাওয়াত।
পায়রা ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে তার মাথায় সবকিছু গুলিয়ে গেছে বুঝতে পারছে না ইফাতের বিয়ে মানে। ইফাত পায়রাকে বলল,
– মিস.পায়রা আপনিও কিন্তু আসবেন কোনো বাহানা শুনবো না।
পায়রার উওরের অপেক্ষা না করে দাঁড়িয়ে পড়লো ইফাত সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। যে যার যার মতো চলে যেতে লাগলো হঠাৎ পায়রার মনে হলো,’এ আমি কি করছি এতদিন পর ইফাতকে কাছে পেয়েও এভাবে চলে যেতে দিচ্ছি না না ইফাতের সঙ্গে আমার কথা বলতেই হবে।’
পায়রা ছুটে বেরিয়ে গেল, সাবিহা পায়রাকে দেখে আপু বলে ডাক দিলো কিন্তু সেদিকে পায়রার কোনো খেয়াল নেই পায়রা কিছুটা দৌড়ে যাচ্ছে। ইফাত গাড়িতে উঠার জন্য দরজা খুললো ভেতরে ঢুকতে যাবে পেছন থেকে পায়রা ডাক দিলো,
– ইফাত।
ইফাত সোজা হয়ে দাঁড়ালো কিন্তু পেছনে ফিরলো না হয়তো বুঝে গেছে কে তাকে ডেকেছে। পায়রা ইফাতের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প্রশ্ন করলো,
– এভাবে আমাকে ইগনোর করছেন কেন? না চেনার ভান কেন করছেন?
– না চেনার ভান কখন করলাম? রেসপেক্ট দিয়েই তো কথা বললাম।
– কোথায় ছিলেন তিন বছর?
– আপনাকে কেন বলবো?
– আপনি করে বলছেন কেন?
– অপরিচিতদের আপনিই বলতে হয়।
– আমি অপরিচিত!
– হুম।
– তাহলে আগে কেন তুমি বলতেন?
– আগের সঙ্গে এখনের অনেক তফাৎ আছে তাই আগের কথা না ভাবাই ভালো।
– সত্যি সত্যি আপনি বিয়ে করছেন?
– হুম বিয়ে না করে আর কতদিন।
পায়রা আর তাকাতে পারছে না চোখ ছলছল করছে দৃষ্টি নিচের দিকে স্থির করেছে। ইফাত গম্ভীর মুখে,
– আপনি বিয়ে করেননি?
– উহু।
– আপনার আবরার কোথায়? ওর সঙ্গে না আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছিল।
– আবরারের…
ইফাতের মোবাইল বেজে উঠলো পায়রা থেমে গেল ইফাত কানে ফোন ধরে,
– কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি আসছি।
ফোনটা প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে,
– আমার কাজ আছে আজ আসি কাল তো দেখা হবেই আসবেন কিন্তু।
ইফাত গাড়িতে উঠতেই ড্রাইভার গাড়ি ছেড়ে দিলো। পায়রা ঠাই দাঁড়িয়ে আছে সাবিহা পায়রার কাঁধে হাত রাখতেই পায়রা কেঁদে দিলো।সাবিহা পায়রাকে শান্তনা দিয়ে,
– কাঁদছিস কেন আপু সবাই দেখছে।
– ইফাত অন্য কাউকে বিয়ে করবে আমাকে আর ভালোবাসে না।
– সব কথা শুনবো আগে হোটেলে যেয়ে নেই তারপর।
সাবিহা অনেক কষ্টে পায়রাকে নিয়ে হোটেলে চলে গেল। পায়রা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে কান্না করছে আর বিলাপ করছে। সাবিহা মাথায় হাত বুলিয়ে,
– এভাবে কাঁদলে অসুস্থ হয়ে যাবি তো।
– অসুস্থ হলে হবো কার কি আমি জানি আমি ভুল করেছি তখন আমার কাছে আমার পরিবারের নিরাপত্তা আমার কাছে সবকিছু ছিল তাই ওসব করেছি কিন্তু সেজন্য তিনটা বছর কত কষ্ট করেছি এমন কোনো দিন বাদ যায়নি আমি ইফাতের জন্য কান্না করিনি সব ভুলে ইফাতকে খুঁজেছি উনার কথা ভেবেছি কিন্তু উনি কি করলেন আমায় ভুলে গেলেন আবার নাকি বিয়েও করবেন হাসি মুখে আমায় ইনভাইট করলেন বাহ।
– আমার সামনে এসব বললে হবে না ইফাত ভাইয়ার সামনে বলতে হবে।
– উনি তো আমার কথা শুনলেন না।
– কাল তো আমরা ওখানে যাবো তখন সুযোগ বুঝে বলে দিবি।
– কাল উনার মেহেদী অনুষ্ঠান।
– আমি আছি তো।
পায়রা বাচ্চাদের মতো সাবিহার কথা মেনে নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো।
________________
বাড়িতে মানুষজনের আনাগোনা জাঁকজমক ভাবে বাড়ি সাজানো হয়েছে। বড় বড় গায়ক-গায়িকাদের আনা হয়েছে গান গাওয়ার জন্য। এনায়েত মির্জার বড় ছেলের বিয়ে বলে কথা তিনদিন ধরে শুধু উৎসব হবে আজ থেকেই শুরু। বড় স্টেজ করা হয়েছে যেখানে নাচ গান হবে আর তার থেকে খানিকটা দূরে। বড় দু’টো সিংহাসনের মতো চেয়ার পাশাপাশি রাখা।
সন্ধ্যার পর সবাই চলে এসেছে। পায়রা আর সাবিহাকে আনার জন্য আরাফ নিজে গিয়েছে। পায়রা আরাফকে অনেক প্রশ্ন করেছে কিন্তু আরাফ শুনেও না শোনার ভান ধরে ছিল।
পায়রা আর সাবিহা একসঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে মুখে হাসি থাকলেও ভেতরটা যেন ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে পায়রার। ইফাত সিঁড়ি দিয়ে নামছে আর তার পাশে একটা মেয়ে ইফাতের হাত ধরে নামছে দু’জনের মুখেই হাসি। দু’জনে গিয়ে ওই চেয়ার দুটিতে বসলো, মেয়েটির মুখের গঠন বেশ ভালো তবে অনেক মেকআপ করা যার দরুন চামড়ার আসল রঙ বুঝা দায়। ইফাতের পরনে কালো একটা পাঞ্জাবী যার উপরে সোনালী রঙের স্টোনের কাজ মেয়েটাও ইফাতের সঙ্গে ম্যাচিং করে একই রঙ এবং কাজের শাড়ি পড়েছে। পায়রা ভাবছে,’ আজ এভাবে ইফাতের পাশে আমার থাকার কথা ছিল তাহলে কেন এমনটা হলো?’
পায়রা আর নিতে পারছে না মনে হচ্ছে এখনি যেন মাথা ঘুরে যাবে সাবিহার হাত আরো শক্ত করে ধরলো। সাবিহা বোনকে শান্তনা দিয়ে,
– আপু নিজেকে শক্ত কর সবার সামনে একদম ভেঙে পরবি না।
ইতি বেগম এনায়েত মির্জাও চলে এলেন এতক্ষণ পর ইনানকে দেখা গেল। ইতি বেগম পায়রাকে দেখে এগিয়ে এসে,
– কেমন আছো পায়রা?
– আলহামদুলিল্লাহ, আপনি কেমন আছেন?
– আলহামদুলিল্লাহ, তোমার পরিবারের সবাই কেমন আছে?
– সবাই ভালো।
– ইফাতের হবু বউকে কেমন লাগছে? দু’জনকে বেশ মানিয়েছে তাই না জানো আমি তুবাকে পছন্দ করেছি ইফাতের জন্য।
এতক্ষণ পর জানা গেল মেয়েটির নাম তুবা কিন্তু ইতি বেগমের কথা যেন পায়রার কাছে কাঁটা ঘায়ে নুনের ছিটার মতো।ইতি বেগম আবারো বলা শুরু করলেন,
– তোমার বিয়ে হয়েছে নিশ্চই তোমার হাজব্যান্ড কোথায়?
– আমি অবিবাহিত।
– কি বলো এখনও বিয়ে হয়নি সেদিন না তোমার বাবা তোমার খালাতো ভাইয়ের সঙ্গে তোমার বিয়ে ঠিক করলো।
– হয়নি বিয়ে।
– ওহ।
ইতি বেগমকে তার ননদ ডাক দিতেই তিনি চলে গেলেন। অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে পায়রা শুধু ইফাতের দিকে তাকিয়ে আছে অনেক কষ্টে কান্না আটকে রেখেছে ইফাতের কোনো হেলেদুল নেই পায়রার দিকে একবারও তাকায়নি সে তো নিজের হবু বউয়ের সঙ্গে অনুষ্ঠান দেখতে ব্যস্ত দু’জনের মুখে কি সুন্দর হাসি।
প্রোগ্ৰাম কিছুক্ষণের জন্য থামানো হয়েছে শোনা যাচ্ছে আজই নাকি দু’জনের বিয়ের রেজিস্ট্রি হবে তারপর মেহেদী পড়ানো হবে পরশু ইসলামিক শরিয়া মোতাবেক বিয়ে হবে।
সবাই উৎসুক হয়ে তাদের ঘিরে রেখেছে একজন কালো কোর্ট পরিহিত লোক কাগজ নিয়ে বসে আছে। ইফাত আর তুবা নামক মেয়েটাও গিয়ে বসেছে, তুবা সেই তখন থেকেই ইফাতের হাত ধরে আছে ছাড়ছেই না পায়রার ভেতর পুড়ছে। লোকটা সাইন করার জন্য একটা কাগজ এগিয়ে দিলো। সাবিহা পায়রাকে ঝাঁকিয়ে,
– আপু তুই এখনও দাঁড়িয়ে আছিস একবার সাইন হয়ে গেলে তোর কিছু করার থাকবে না ইফাত ভাইয়াকে চিরকালের জন্য হারিয়ে ফেলবি।
তুবা ইতোমধ্যে সাইন করে দিয়েছে ইফাতও হাতে কলম তুলে নিলো সাইন করার জন্য যেই সাইন করতে যাবে তৎক্ষণাৎ কেউ তার হাত থেকে কলমটা নিয়ে গেল।ইফাত ব্রু কুঁচকে তাকিয়ে পায়রাকে দেখতে পেল বসা থেকে উঠে,
– কলম কেন নিলেন?
পায়রা সবার সামনেই ইফাতকে জড়িয়ে ধরলো এতে সবাই চমকে গেছে কিন্তু ইফাত চুপ করে আছে। পায়রা কান্না জড়িত কন্ঠে,
– তুমি আমাকে ছেড়ে অন্য কাউকে বিয়ে করতে পারো না আমি তোমাকে ভালোবাসি ইফাত আমি মানছি আমি ভুল করেছি তাই বলে এত বড় শাস্তি দিতে পারো না এই তিনটা বছর কি কম কষ্ট পেয়েছি প্লিজ এমনটা করো না।
তুবা যেন অনেক রেগে গেছে সেও দাঁড়িয়ে গেল মুহুর্তে পায়রাকে এক টানে ইফাতের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে মা’রা’র জন্য উদ্ধত হলো তখনি ইফাত তুবার হাত ধরে ফেলে। ইফাতের চোখের দিকে তাকিয়ে ভয় পেয়ে গেছে তুবা ইফাত ক্ষীণ স্বরে,
– নিজের লিমিটে থাকার চেষ্টা করবে নইলে হাত আর হাতের জায়গায় থাকবে না।
বলেই তুবার হাত ছেড়ে দিয়ে পায়রার দিকে তাকিয়ে,
– যখন আমি বারবার ভালোবাসি বলে তোমার কাছে গিয়েছিলাম তখন অনেক অপমান করেছ তারপরেও ভালোবেসে গেছি তারপর কি করলে সবার সামনে অপমান করলে থাপ্পড় মা’র’লে আর এখন এসেছ ভালোবাসা দেখাতে? সমস্যা থাকতেই পারে তবে উচিত ছিল আমাকে জানানোর তাহলে হয়তো আজ এমন পরিস্থিতিতে আমাদের পরতে হতো না অতীত মনে করতে চাই না তুমি তোমার মতো থাকো আমাকেও আমার মতো থাকতে দাও এই বিয়ে হচ্ছে তোমার ইচ্ছে না হলে তুমি চলে যেতে পারো।
– ইফাত!
– প্লিজ এসব ড্রামা করো না তোমার ড্রামায় আমি গলছি না।
পায়রাকে নিজের থেকে সরিয়ে ইফাত পুনরায় বসে পড়লো তুবাও বসেছে। ইফাত দ্রুত কাগজে সাইন করে দিতেই সবাই করতালি দিয়ে স্বাগতম জানালো। পায়রার চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়ছে দৌড়ে এখান থেকে বেরিয়ে গেল।সাবিহাও আর দেরি না করে পায়রার পেছনে পেছনে গেল তার ভয় হচ্ছে পায়রাকে নিয়ে।
হোটেলে এসে লম্বা একটা শাওয়ার নিয়ে বিছানায় বসলো পায়রা।সাবিহা ভয়ে ভয়ে পায়রার পাশে বসে পায়রাকে পর্যবেক্ষণ করছে কিছুক্ষণ আগে বাচ্চাদের মতো কাঁদলেও এখন চোখে কোনো পানি নেই পুরো শান্ত। পায়রা উঠে গেল আলমারির সামনে কাপড় বের করে ব্যাগ গুছাতে গুছাতে,
– সাবিহা সব গুছিয়ে নে আজ আমরা বাড়ি ফিরবো।
– আজ! কিন্তু আপু আমাদের তো চারদিন পর ফেরার কথা।
– যা বলছি তাই কর।
সাবিহা চুপচাপ গিয়ে সব গুছগাছ শুরু করলো। হোটেল থেকে বের হতে রাত এগারোটা বাজলো বারোটার একটা ফ্লাইট আছে সেটায় করেই তারা বাংলাদেশে ফিরবে।
চলবে…..