#মন_দিয়েছি_তোমার_নামে
#পর্বঃ৪
#লেখিকাঃদিশা_মনি
সময় এবং নদীর স্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করে না। বয়ে চলে নিজের আপন গতিতে।
৬ টি মাস যেন চোখের পলকেই বয়ে গেল। কেউ বুঝতেও পারল না।
আসমানী বেগম এখন অনেকটাই সুস্থ। সফল অ’স্ত্রপাচারের পর তাকে এখন হাসপাতাল থেকে বাড়িতে এনে রাখা হয়েছে। ছেলে-মেয়ে এবং বৌমার সহিত তিনি এখন ভালোই আছেন।
প্লবতার মধ্যেও এখন অনেক পরিবর্তন এসেছে। কথায় আছে, সৎ সঙে স্বর্গবাস, অসৎ সঙে সর্বনাশ। প্লবতার জন্য প্রথমটি ঘটেছে। মিতুর সংস্পর্শে এসে এখন তার মধ্যে আমুল পরিবর্তন এসেছে।
প্লবতা আগে নামাজ কালাম করত না, পর্দার তো কোন বালাই ছিল না, কিন্তু এখন সে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে। পর্দার বিধানও পুরোপুরি মেনে চলে। নিজের এই পরিবর্তনে সবথেকে বেশি খুশি সে নিজেই হয়েছে। কিন্তু খুশির পাশাপাশি তার মনে কিছু দ্বন্দও রয়ে গেছে। আর সেটা হলো ধীরাজের সাথে তার সম্পর্কটা। তাদের মধ্যকার সম্পর্ক যেন মরীচিকাই রয়ে গেছে। এক আকাশের নিচে থেকেও যেন তারা একে অপরের সম্পূর্ণ অচেনা। এই দূরত্ব আত্মিক দূরত্ব।
স্বামী স্ত্রীর মধ্যকার কথা অন্য কারো সাথে বলা সমীচীন নয় জন্য প্লবতা এই বিষয়ে কাউকে জানায় নি। তবে আজ সে ঠিক করেই নিয়ে একটা হেস্তনেস্ত করে তবেই সে দম নেবে।
ভাবনা অনুযায়ী কাজ করার সিদ্ধান্ত নিলো সে। সন্ধ্যার দিকে ধীরাজ ঘরে ফিরতেই প্লবতা তাকে বলল,
‘আপনার সাথে কিছু জরুরি কথা ছিল।’
‘হুম বলুন।’
‘আপনি কি আমাকে স্ত্রী মনে করেন না? আমার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দেবেন। আপনার ব্যবহার প্রমাণ করে দেয় আপনি মন থেকে আমায় মেনে নিতে পারেন নি। কিন্তু এর কারণ কি প্লিজ বলবেন আমায়? আমার অপরাধটা ঠিক কি সেটাই আমি উপলব্ধি করতে পারছি না। আমি তো সব সময় এই চেষ্টাই করেছি যাতে আপনার মন জুগিয়ে চলতে পারি কিন্তু আপনি…’
ধীরাজ দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে বলে,
‘কালকের জন্য অপেক্ষা করুন। আপনার সব প্রশ্নের উত্তর আপনি কালকে পেয়ে যাবেন।’
‘অপেক্ষায় থাকব সত্যটা জানার।’
প্লবতা মন খারাপ করে বাইরে বেরিয়ে গেল। ধীরাজ অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল তার যাওয়ার পানে। তারও তো মন চায় প্লবতাকে আপন করে নিতে। কিন্তু তার হাত পা যে পুরো বাধা পড়ে গেছে।
★★
প্লবতা অনেকক্ষণ ধরে মিতুর ঘরে বসে আছে। তাকে এভাবে দেখে মিতু প্রশ্ন করে,
‘কি হয়েছে ভাবি? আপনাকে এমন লাগছে কেন? মন খারাপ নাকি?’
‘কিছু দ্বিধার মধ্যে আছি।’
‘এসব দ্বিধা দ্বন্দ ভুলে যান। আপনি শান্ত মনে আল্লাহকে ডাকুন। দেখবেন সব অস্থিরতা মুহুর্তের মাঝেই দূর হয়ে যাবে।’
প্লবতা মৃদু হাসে। অতঃপর মিতুর কক্ষ থেকে বেরিয়ে নিজের কক্ষের দিকে অগ্রসর হন।
পরের দিন সকালে উঠেই সব কাজ শেষে ধীরাজের মুখোমুখি হয় প্লবতা। অতঃপর শান্ত স্বরে তাকে প্রশ্ন করে,
‘আপনি কাল বলে ছিলেন আমায় আজ সব সত্য জানাবেন। এখন আপনার কথা রাখার পালা এসে গেছে। আমাকে সত্যটা বলবেন কি এখন?’
‘অবশ্যই বলব। আপনি নিজের সব ব্যাগপত্র গুছিয়ে নিন।’
‘জ্বি, কেন?’
‘আপনি যদি নিজের সকল প্রশ্নের জবাব চান তাহলে দয়া করে আর কোন প্রশ্ন করবেন না। আমি যা বলছি দয়া করে সেটাই করুন৷ তাহলে আপনার সব প্রশ্নের জবাব নিজে থেকেই এসে আপনার কাছে ধরা দিবে ‘
প্লবতা আর কথা বাড়ালো না। ধীরাজের কথা অনুযায়ী কাজ করল৷ নিজের সমস্ত জামা কাপড় গুছিয়ে নিল। অতঃপর রওনা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত দিল। আসমানী বেগম তাদের দেখে বললেন,
‘এত সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছিস তোরা?’
ধীরাজ বলল,
‘কিছু জরুরি কাজে যাচ্ছি আম্মু।’
‘আচ্ছা তাড়াতাড়ি ফিরে আসিস। আর সাবধানে যাস।’
প্লবতা ও ধীরাজ রওনা দিলো। পুরো রাস্তা প্লবতার কাঁটল অস্থিরতার মধ্যে। এত অস্থিরতার মধ্য দিয়ে তাকে কখনো যেতে হয়নি।
শেষমেষ প্লবতাকে নিয়ে কাঙখিত গন্তব্যে পৌঁছে গেল ধীরাজ। নিজে রিক্সা থেকে নেমে প্লবতাকে রিকশা থেকে নামতে বলল। প্লবতা রিকশা থেকে নেমে অবাক হয়ে গেল। বলল,
‘এটা তো আমার বাবার বাড়ি৷ এখানে কেন নিয়ে এসেছেন আমায়?’
‘আপনাকে নিজের আসল ঠিকানায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য।’
‘এসব কি বলছেন আপনি? আমি আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না ‘
‘মানেটা খুবই সহজ প্লবতা। আপনি আমার কাছে এই ৬ মাস আমানত হিসেবে ছিলেন। যেই আমানতের কোন খেয়ানত করা ছাড়াই আমি আপনাকে আবার আপনার পিতার কাছে ফিরিয়ে দিচ্ছি।’
ধীরাজের কথা গুলো শুনে প্লবতার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিচ্ছিল। সব কিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল তার কাছে। এরমধ্যে তাকে আরো বেশি বিব্রত করার জন্য মাহিন হোসেনের আগমন ঘটল। মাহিন হোসেনকে দেখে প্লবতা অস্ফুটস্বরে বলল,
‘আব্বু…’
মাহিন হোসেন এগিয়ে এসে ধীরাজের পিঠ চাপড়ে বললেন,
‘তুমি আমার বিশ্বাসের মর্যাদা রেখেছ ধীরাজ। আমি তোমার উপর খুব খুশি হয়েছি।’
ধীরাজ কিছু বলল না। মাহিন হোসেন এরপর প্লবতার কাছে এসে বলল,
‘আমার সাথে এসো প্লবতা। তোমার বাড়িতে পুনরায় তোমাকে স্বাগতম জানাই।’
মাহিন হোসেন প্লবতাকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য হাত বাড়াতেই সে বলে উঠলো,
‘আমি তোমার সাথে কোথাও যাবো না। আপনি প্লিজ আমাকে ফিরিয়ে নিয়ে চলুন(ধীরাজকে উদ্দ্যেশ করে।)’
ধীরাজ বলল,
‘আপনি আপনার বাবার সাথে যান প্লবতা। আমি আর আপনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাবো না। কারণ আজ আমি আপনাকে আপনার বাড়িতে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই এসেছিলাম।’
‘এসব কি বলছেন আপনি? আমি আপনার স্ত্রী হই। আপনি আমাকে এভাবে ত্যাগ করতে পারেন না!’
মাহিন হোসেন বলেন,
‘প্লবতা আমার কথা শোনো। আমি তোমাকে শোধরানোর জন্য ধীরাজের সাথে চুক্তি করেছিলাম। তুমি যাতে জীবনের আসল মানে উপলব্ধি করতে পারো তাই এমনটা করা। এই চুক্তি অনুযায়ী ৬ মাসের জন্য ধীরাজের সাথে তুমি ওর বউ হয়ে থাকবে। এই চুক্তির বিনিময়ে আমি ধীরাজের মায়ের অপারেশনের সব টাকা দিয়েছিলাম। আর আজ ৬ মাস পূর্ণ হলো,তোমার মাঝেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। তাই চুক্তিও শেষ। এখন তোমাদের ডিভোর্স হয়ে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা চুক্তি অনুসারে।’
প্লবতা একদম স্থির হয়ে গেল। কোন রকমে কান্না আটকে বলল,
‘আমি মানি না কোন চুক্তি। আমার অনুমতি ব্যতীত আমার জীবন নিয়ে এমন চুক্তিপত্র করার অধিকার আপনাদের কে দিয়েছে? আমি ধীরাজকে ভালোবাসি আর ওনার সাথেই আজীবন থাকতে চাই।’
মাহিন হোসেন শক্ত করে প্লবতার হাত ধরে বলল,
‘তুমি আমার সাথে ভেতরে চলো। ধীরাজ তোমাকে আর ফিরিয়ে নেবে না।’
প্লবতা মাহিন হোসেনের হাত ছাড়িয়ে ধ্রুবর কাছে এসে কান্নাভেজা গলায় বলে,
‘প্লিজ আমাকে ছেড়ে যাবেন না। আমি আপনাকে অনেক ভালোবেসে ফেলেছি। আপনাকে ছাড়া নিজের জীবন কল্পনাও করতে পারব না। আমাকে সাথে করে নিয়ে যান।’
‘ক্ষমা করবেন প্লবতা। কিন্তু আমি আপনাকে আর ফিরিয়ে নিতে পারবোনা।’
প্লবতা ধীরাজের পায়ের কাছে বসে পড়ল। ঠিক যেভাবে ৬ মাস আগে নিজের বাবার পায়ের কাছে বসে সে বলেছিল সে ধীরাজকে বিয়ে করবে না ঠিক সেই একইভাবে ধীরাজের পায়ের কাছে বসে বলল,
‘প্লিজ আমায় ছেড়ে যাবেন না ধীরাজ।’
ধীরাজ কঠিন হৃদয়ের পরিচয় দিয়ে প্লবতাকে রেখে চলে গেল। প্লবতা চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। প্লবতার মা, ফুফু, খালা সবাই মিলে এসে জোরপূর্বক তাকে ঘরে টেনে নিয়ে গেল।
চলবে ইনশাআল্লাহ