মন দিতে চাই পর্ব-১৫ এবং শেষ পর্ব

0
3878

#মন_দিতে_চাই
#১৫তম_পর্ব(অন্তিম)
#লেখনীতে_সুপ্রিয়া_চক্রবর্তী

মুক্তো ইভানাকে ধা*ক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। পরপর কয়ে’কটা থা*প্পড় বসিয়ে দিল তার গালে। ক্রোধান্বিত হয়ে বলল, তোমার সাহস কি করে হলো ঝিনুকের সাথে এমন করার।

আমি যেন আবার আগের সেই মুক্তোকে দেখতে পারছিলাম আমার সামনে। কিন্তু আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি আর দূর্বল হবো না। উনিও আমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছেন। তাই নিজের কক্ষের দিকে হাটা লাগালাম। কক্ষে এসে কাবার্ড থেকে নিজের সব জামাকাপড় বের করে গুছিয়ে নিলাম। এখানে আর থাকবো না আমি। মুক্তি দেবো মুক্তোকে এই সম্পর্ক থেকে।

আমি সবকিছু গুছিয়ে নিয়ে বের হতে যাব তখনই মুক্তো আমার হাত টেনে ধরল। বলল, এভাবে সবকিছু ছেড়ে যেতে পারো না।

আমি আজ আর কোন পিছুটান রাখতে চাই না। তাই বললাম, আমি থাকবো না আর আপনার সাথে। আপনি আমাকে ভালোবাসেন না। আর এই ভালোবাসাহীন সম্পর্কে আমি থাকতে ইচ্ছুক নেই। জানেন আমি আপনাকে মন দিতে চেয়েছিলাম। মন দিতে তো পেরেছি, কিন্তু আপনার মনে নিজের জন্য স্থান তৈরি করে নিতে পারিনি। তাই আমার আর এখানে থাকা মানায় না। আপনি ভালো থাকুন আপনার প্রেমিকা ইভানার সাথে। আমি আপনার জীবনে আর কখনো ফিরে আসব না, কোন চিন্তা করবেন না। আচ্ছা?

মুক্তো কিছু বলতে পারল না। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি রহিমা খালার কাছে গেলাম। তার থেকে বিদায় নিয়ে নিলাম।

অবশেষে এই বাড়ি থেকে বের হতে পারলাম।

২ বছর পর,
সব পিছুটান ভুলে জীবনে এগিয়ে এসেছি আমি। এখন আমি নিজে একটা শাড়ির ব্যবসা করছি। অনেক সফল হয়েছি নিজের ক্যারিয়ারে। মুক্তোর বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পরেই ডিভোর্সের আবেদন করেছিলাম। আমাদের ডিভোর্সও হয়ে গেছে অনেক আগেই। এখন আমি সম্পূর্ণ মুক্ত। অনেকেই বলেছিল নতুন করে জীবন শুরু করতে। কিন্তু আমি আর সেই সাহস পাইনি। নতুন করে কারো হাত ধরার সাহস পাইনি।

প্রতিদিনকার মতো আজও শাড়ির দোকানে বসে আছি৷ এমন সময় একজন লোক এসে আমার সামনে দাড়ালো। তাকে চিনতে আমার কোন অসুবিধা হলো না। তিনি হলেন মুক্তোর বাবা। আমাকে দেখে উদাস হয়ে বললেন, কেমন আছ ঝিনুক?

আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি?

আমি ভালো নেই ঝিনুক। আমার ছেলেটা যে ধুকে ধুকে শেষ হয়ে যাচ্ছে।

আমার মুক্তোর ব্যাপারে জানার যদিও কোন আগ্রহ নেই। তবুও ওনার খারাপ অবস্থার কথা জেনে একটু খারাপ লাগল। আমি জানতে চাইলাম, কি হয়েছে আপনার ছেলের?

উনি বললেন, মারণ রোগ হয়েছে ওর। ডাক্তার বলে দিয়েছে ওর হাতে আর বেশি সময় নাই। এই রোগের কারণেই নিজের থেকে তোমাকে দূরে সরিয়েছিল ও।

কথাটা শুনে খুব খারাপ লাগলো আমার। চোখের জল বাধা মানতে চাইল না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম, আমি মুক্তোর সাথে দেখা করতে চাই। প্লিজ আমাকে ওনার কাছে নিয়ে চলুন।

মুক্তোর বাবা আমাকে মুক্তোর কাছে নিয়ে গেলেন। মুক্তো আর আগের মুক্তো নেই। তার শরীরের অবস্থা জীর্ণ শীর্ণ। ফর্সা বলিষ্ঠ শরীর কালচে আর শুকনো হয়ে গেছে। তার মলীন মুখ দেখে কান্না পেল আমার। অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে নিলাম আমি।

মুক্তো আমাকে তার কাছে গিয়ে বসতে বলল। আমি তাই করলাম। মুক্তো আমার হাতটা ধরল। তারপর বলল, আমার জন্য অনেক কষ্ট পেয়েছ তুমি। দয়া করে আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি আজও তোমাকে অনেক ভালোবাসি ঝিনুক। আমার সবটুকু জুড়ে রয়েছ তুমি।

প্লিজ এভাবে বলবেন না। আপনার কিচ্ছু হবে না।

আমি জানি আমার হাতে আর বেশি সময় নেই। তোমাকে দেখার জন্য আমি এতদিন বেঁচে ছিলাম। সৃষ্টিকর্তার কাছে আমার শুধু একটাই শেষ ইচ্ছা ছিল যেন মৃত্যুর আগে একবার অন্তত তোমাকে দেখতে পাই। আমার সেই ইচ্ছা পূরণ হয়েছে। এখন আমি শান্তিতে মরতেও পারব।

কথাটা বলে মুক্তো অস্থির হয়ে উঠল। তার শ্বাস দ্রুত পড়ছিল। আমার হাত ধরে বলল, #মন_দিতে_চাই তোমাকে শুধু তোমাকে।

আমি কান্নাজড়ানো গলায় বললাম, আমার মন তো আপনাকে অনেক আগেই দিয়ে দিয়েছি। আপনার মনেও আমি আছি। এটা জেনে আজ আমি খুব খুশি। দয়া করে আমায় ছেড়ে যাবেন না।

মুক্তো আর কিছু বলল না। তার শ্বাস প্রশ্বাস থেমে গেল। আমি বুঝলাম মুক্তো আর আমাদের মাঝে নেই। মুক্তোর বাবা-মা সবাই কাঁদছে। কিন্তু আমার চোখে জল নেই। মুক্তোর মৃত্যুটা আমি মেনে নিতে পারছি না। অধিক শোকে পাথর হয়ে গেছি।

❤️
★প্রাণ দিতে চাই, মন দিতে চাই
সবটুকু ধ্যান সারাক্ষন দিতে চাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

স্বপ্ন সাজাই, নিজেকে হারাই
দুটি নিয়নে রোজ নিয়ে শুতে যাই
তোমাকে, ও.. তোমাকে।

জেনেও তোমার আঁখি চুপ করে থাকে
রোজ দুইফোঁটা যেন আরও ভালো লাগে
গানে, অভিসারে, চাই শুধু বারেবারে
তোমাকে, ও.. তোমাকে।
যেদিন কানে কানে সব বলবো তোমাকে
বুকের মাঝে জাপটে জড়িয়ে ধরবো তোমাকে।

পথ চেয়ে রই, দেরি করোনা যতই
আর ভোলা যাবেনা জীবনে কখনোই,
তোমাকে, ও.. তোমাকে।★

গানগুলো বলে কাঁদছিলাম আমি। গানের প্রতিটা কথা আমার হৃদয়কে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিল। সত্যি আজও আমি মুক্তোর পথ চেয়ে বসে আছি। জানি সে আর কখনো ফিরবে না তবুও আমি আছি তার পথ চেয়ে। কি করবো? তাকে যে কখনো ভোলা যাবে না। আমার মনের মাঝে যে ক্ষত সে তৈরি করে গেছে তা আজও রয়ে গেছে। মুক্তো আমার মনে রয়ে গেছে। যাকে আমি মন দিতে চেয়েছি আজ সে আমার মনে চিরস্থায়ী প্রভাব রেখে গেছে।

জীবনের ষাটটি বছর আমি পার করে ফেলেছি। বর্তমানে আমার বয়স ৬১। মুক্তোকে হারিয়ে জীবন নতুন করে আর শুরু করার কথা ভাবিনি। তাই তো আজও আমি একা, সম্পূর্ণ একা।

হাতে একটি এলবাম নিয়ে বসে আছি আমি। মুক্তোর ছবির উপর হাত বুলিয়ে নিচ্ছি। এক বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ল ছবির উপর।

পিছন থেকে কেউ ডেকে উঠল, ছোট দাদি তুমি কি করছ?

আমি তাকিয়ে দেখলাম স্নিগ্ধা আপির একমাত্র নাতিকে। জীবনের শেষ দিনগুলো বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে চাইলেও স্নিগ্ধা আপি আমাকে তার বাড়িতে নিয়ে এসেছে।

আমি কোলে তুলে নিলাম ছেলেটাকে। ছেলেটা বড্ড আদুরে। স্নিগ্ধা আপির ভাগ্য খুব ভালো। তার একমাত্র ছেলে একদম সোনার টুকরো হয়েছে। ছেলের বউও যথেষ্ট ভালো। তাই তো যখন ছেলেরা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে আসে সেইরকম সময় তার ছেলে আর বৌমা তার এত যত্ন নেয়। তার উপর আমিও আশ্রয় পেয়েছি।

আজ রাতের খাবার শেষ করে ঘুমাতে গেলাম আমি। হঠাৎ বুকে খুব ব্যাথা অনুভব হলো। আমি বুঝতে পারলাম আমার সময় হয়তো ঘনিয়ে আসছে।

একটু পরেই দেখলাম, মুক্তো আমার সামনে। আমাকে মৃদু হেসে বলল, আমার মনের রাণীকে নিজের সাথে নিয়ে যেতে এসেছি। আসো তুমি আমার সাথে।

আমিও নিজের হাত বাড়িয়ে দিলাম। ব্যাস সাথে সাথেই পৃথিবীর বুকে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম!

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে