মন খারাপের ডায়েরি (৫)
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
আয়মান বাসায় ফিরে এলো সন্ধ্যে নামার পর পর। ক্লান্ত জরাজীর্ণ দেহটাকে বিছানায় এলিয়ে দিলো ফ্রেশ না হয়েই। ক’টি আঙুল চেপে ধরল কপালে। দু’পাশের রগ লাফাচ্ছে। জীবনটা কেমন অসহনীয় হয়ে উঠেছে দিনকে দিন! আগে মনে হতো,বিবাহিত জীবন না জানি কত সুখের! শান্তির! এখন আর মনে হয় না। তরীকে বিরক্ত লাগে। অসহ্য লাগে সবকিছুই। স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করতে ইচ্ছে হয়। কিন্তু চাইলেই কী সব পাওয়া যায়!
অতি কষ্টে দেহটাকে বিছানা থেকে তুলে বাথরুমে ঢুকালো আয়মান। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বাইরে বেরোতেই মা’কে চোখে পড়ল। তরীটার জন্য মায়ের সঙ্গেও খারাপ আচরণ করে ফেলেছে আজ। যেটা ভাবায় আয়মানকে। অনুতপ্ত সে। বিছানার উপর রাখা গামছাটা যে মা গুছিয়ে রেখেছে,জানে আয়মান। স্মিতহাস্যে মুখটা মুছে নিয়ে হালিমা বেগমকে ডেকে উঠলেন, ‘মা।’
উত্তরে হালিমা বেগম কাঠ কাঠ কণ্ঠস্বরে বললেন, ‘তোকে অবশেষে মুক্তি দিয়েছে।’
আয়মান কথার মানে বুঝতে পারল না। ভ্রুযুগল কুঁচকে পাল্টা প্রশ্ন ছোঁড়ে, ‘মানে?’
হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। জবাব না দিয়ে বেরিয়ে গেলেন ঘর ছেড়ে। আয়মানের সব ক্লান্তি যেন এক নিমিষেই চলে গেল। মাথায় এলো,তরী কোথায়? আসার পর থেকে দেখছে না। তবে কী তরী চলে গেছে? একবার দেখতে হচ্ছে ব্যাপারটা। চপল পায়ে পুরো বাড়ি ঘুরেও কোথাও তরীর ছায়াও দেখতে পেল না আয়মান। হতাশ চিত্তে বিভার ঘরের দরজায় পরাপর দুই টোকা মারতেই বিভা বলল, ‘দরজা খোলা ভাইয়া।’
আয়মান চমকিত, ‘তুই জানতিস আমি এসেছি?’
‘তুমি ছাড়া এই মুহূর্তে আর কেইবা আসবে ভাইয়া? নিশ্চয়ই জানতে এসেছো ভাবী কোথায়।’ থমথমে কণ্ঠটি নাড়ায় বিভা।
আয়মান মাথা দোলালো। স্তব্ধ হয়ে বিছানায় গিয়ে বসল। বিভা ভ্রু নাড়িয়ে বলল, ‘ভাবী চলে গেছে।’
‘কই গেছে?’
‘উনার বাড়িতে। যেহেতু তোমার তাকে সহ্য হয় না,তাকে দেখতে পারো না তাহলে কেন থাকবে? দুপুরের আগেই চলে গেছে।’
‘তোরা কেউ আঁটকালি না?’
‘কেন আঁটকাবো? তুমিই তো সংসার করতে চাও না,তাহলে আঁটকে রেখে করব টা কী?’
আয়মান জবাব দিতে পারল না। নির্বাক নয়নে নিষ্পলক চেয়ে রইলো কতক্ষণ। তারপর চাপা কণ্ঠে বলল, ‘গেছে যখন যাক। ভালোই হলো। আমিও ক’দিন আরামে থাকতে পারব।’
বিভা বইয়ের পাতায় চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, ‘আজীবনের জন্যেই আরামে থাকো ভাইয়া। ভাবী বলছে,আর আসবে না।’
আয়মান বেশ অবাক হলো। চোখজোড়া বড় বড় করে বলল, ‘ও এটা বলে গেছে?’
‘হ্যাঁ, এটা বলে গেছে।’
আয়মান একপ্রকার টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল এবং নিজের ঘরে চলে এলো। তরী যে এতবড় একটা স্টেপ নিয়ে নিবে,আয়মান ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি। ও চলে যাওয়ায় শান্তি পাবে ভেবেছিল, কিন্তু তার বদলে অদ্ভুত অশান্তি শুরু হয়েছে বুকের ভেতর। বিছানায় চোখ গেলে আয়মানের বুকটা হু হু করে উঠল। তরী এখন ওই জায়গায় বসে থাকত, তার দিকে চেয়ে থাকত একটু ভালোবাসার আশায়! আয়মান মাথা নাড়লো। সব তার ভ্রম, এসব কিছুই না। তরী ঠিক ফিরে আসবে। গিয়েছে যখন বেড়াক, মন ভালো করে আসুক। আয়মানও একটু স্থির হোক। হঠাৎ চলে যাওয়ায় এমন লাগছে। বাস্তবের উপর নজর দিলে মন সামলাতে দু’মিনিট ও লাগবে না আয়মানের…
আয়মান একটা ভারী নিঃশ্বাস ফেলে বিছানায় এসে বসল। ফোন নিয়ে ফেসবুকে ঢুকল। অনেকক্ষণ মনোনিবেশ করার চেষ্টা করেও করতে পারল না। যখন ভাবছে ফোনটা রেখে দিবে,ঠিক তখনই একটা ম্যাসেজ এলো। ম্যাসেজটা আয়মানের অফিসের কলিগ চৈতীর।
চৈতী লিখেছে, ‘এই সময়ে অনলাইনে কী সাহেব? বউ কই?’
চৈতী সবসময় আয়মানকে সাহেব বলে ডাকে। অন্যদিন পাত্তা না দিলেও আজ কেন যেন এই সাহেব ডাকাটা খুব বেশিই সুইট লাগলো আয়মানের কাছে। সে লিখল, ‘বউ রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গেছে।’
‘বলেন কী! এ তো সর্বনাশের কথা। সত্যি বাপের বাড়ি গেছে তো? (চোখ বড় বড় করা ইমোজি)’
আয়মান উঠে বসল। শুয়ে শুয়ে টাইপ করতে সমস্যা হচ্ছে।
‘আর কোথায় যাবে তরী? ওর আছে তো ওই এক জায়গা।’
‘একা গেছে?’
‘হুম।’
‘তাহলে ভালো মতো খোঁজ খবর নেন সাহেব। আজকালকার কারোই বিশ্বাস নেই। (চিন্তিত ইমোজি)’
আয়মানের কপাল কুঁচকে এলো। প্রসঙ্গটা ভালো লাগছে না বিধায় বলল, ‘ছাড়ো তো এসব। তা তুমি কবে বিয়ে করছো ম্যাডাম। তোমার বিয়েতে ইনভাইট চাই অবশ্যই।’
‘বিয়ে! সাহেব, আমি তো আমার জন্য কোনো সাহেব পাচ্ছি না। তাহলে কীভাবে বিয়ে করি?’
‘খুঁজলে কী না পাওয়া যায়! মন দিয়ে খোঁজেন ম্যাডাম, পেয়ে যাবেন।’
‘পেয়েছি একজনকে অবশ্য। কিন্তু…’
‘কিন্তু কী? (ভ্রু উঁচানো ইমোজি)’
‘কিন্তু তাকে পাব না হয়তো কোনোদিন। সে কখনোই আমার দিকে চোখ তুলে তাকায় না। আমাকে বোঝে না। সে গম্ভীর সেই সঙ্গে সমান নিষ্ঠুর। একজন বিবাহিত লোককে ভালোবাসা কী মহাপাপ সাহেব?’
চৈতীর এমন ম্যাসেজ পেয়ে হতভম্ব আয়মান। স্তম্ভিত হয়ে কী লিখে পাঠাবে জবাবে খুঁজতে লাগল। চৈতী কী আকারে ইঙ্গিতে তাকে পছন্দ করে- এই বিষয়ে কিছু বোঝাতে চাচ্ছে? চাইলেই বা কী? আয়মান বুঝবে কেন? আয়মানের স্ত্রী আছে,বিবাহিতা সে। আয়মান প্রসঙ্গটি মজাদার করার জন্যে লিখলো, ‘হা হা হা.. ভালো মজা করতে পারো চৈতী। রাতে খেয়েছো?’
চৈতী হতাশ হলো। সরাসরি আর কীভাবে বলবে আয়মানকে কতটা পছন্দ তার! যতদূর বোঝা যায়, পারিবারিক জীবন নিয়ে আয়মান সুখী নয়। তবুও কেন বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছে! সব ছেড়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করায় এত বাঁধা কীসের তার? দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে চৈতীর বুকচিঁড়ে। উদাস মনে আঙুল চালায়, ‘খেয়েছি। আপনি?’
‘খাওয়া হয়নি।’
‘বউয়ের শোকে?’
‘তা না.. খাবো একটুপর। কাল অফিসে দেখা হচ্ছে তাহলে।’
চৈতী দ্রুত লিখল, ‘শুনুন।’
‘হ্যাঁ..’
‘ব্যস্ত আপনি?’
‘না,কেন?’
‘আরেকটু কথা বলা যায়?’
আয়মান আবার স্তব্ধ হয়ে গেল। কী লিখবে খুঁজে না পেয়ে কোনোরকমে লিখলো, ‘আম্মা ডাকছে চৈতী। রাখি এখন?’
বলেই নেট অফ করে দিলো। মেয়েটাকে পাত্তা দেওয়া যাবে না একেবারেই। হউফ করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে রাতের খাবার খাওয়ার উদ্দেশ্যে বাহিরে পা বাড়ালো আয়মান।
_
‘তরী…’ সেলিনা বেগম নড়বড়ে ডাক দিলেন। তরী অস্ফুটস্বরে গোঙানির ন্যায় উচ্চারণ করল, ‘হু মা..’
‘খাবি না মা?’
তরী মুখ ঘুরিয়ে নিলো। কিছু বলল না। তার চোখজোড়া ফুলে ঢোলাকৃতির ন্যায় ধারণ করেছে। চেহারা ফ্যাকাশে। সে ভেবেছিল, আয়মান একবার হলেও ফোন করবে। তার সঙ্গে রাগারাগি করবে এভাবে চলে আসার কারণে তাও একা একা! অথচ একটা সামান্য ম্যাসেজ অবধি এলো না! তরী যে ম্যাসেজ পাঠিয়েছে,তাও বোধহয় দেখেনি আয়মান। চেনা মুখগুলো যখন অচেনা হয়ে যায়, তখন যন্ত্রণার সঙ্গে পাল্লা দিয়েও পেরে উঠা যায় না। এত কষ্ট, এত মানসিক অত্যাচার তরী কখনোই সহ্য করেনি। গ্রামের মেয়ে,বাবার অর্থ সম্পদ তত না থাকলেও কোনোদিন চিন্তায় জর্জরিত হতে হয়নি তাকে। বিয়ের আগে শেয়ানা মেয়েকে মুখে লোকমা তুলে ভাত খাইয়ে দিতো বাবা। সেই আদরের মেয়ের চোখের নিচে গাঢ় কালি। বিশ মিনিটের দূরত্বের স্কুলে যে মেয়ে একা যেতে ভয় পেতো, সেই মেয়ে আজ চার ঘন্টার জার্নি করে একা একা বাড়ি এসেছে! কতটা একাকী হয়ে পড়লে মানুষ সবকিছু থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে শুরু করে? ভাবে কেউ? দেহের মৃত্যুর হিসাব রাখা হয়, আত্মার মৃত্যুর হিসাব রাখা হয় না কেন?
কত প্রশ্ন! উত্তর নেই…
সেলিনা বেগম মুখে আঁচল চাপেন। আর কিছু না বলেই বেরিয়ে যান রুম থেকে। তরীর চোখ বেয়ে জল ফোঁটা গড়িয়ে পড়ে। সেই সঙ্গে হঠাৎই মাথার পেছন দিকে তীব্র ব্যথা শুরু হয়। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে ব্যথা এত প্রকট আকার ধারণ করে যে,হকচকিয়ে উঠে তরী। হাত-পায়ে অদ্ভুত কাঁপন অনুভব করে। চিৎকার করে ডেকে উঠে ‘মা’ বলে। দুই সেকেন্ডের ব্যবধানে সেলিনা বেগম রুমে এসে দেখলেন, তার আদরের ধন মাটিতে শুয়ে কাতরাচ্ছে। সেলিনা বেগম চিৎকার করে উঠলেন। বাড়ির পাশেই আম গাছ। একটা প্যাঁচা ঘুমুচ্ছিল। আকস্মিক চিৎকারে তার ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায় সে চেঁচিয়ে উঠল তীক্ষ্ণ স্বরে। কেউ বুঝলো কী, প্যাঁচার এই চেঁচানোর কারণ কোনো আগাম বিপদের বার্তা সংকেত?
(চলবে)