মন খারাপের ডায়েরি (৪)
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি
সমস্ত রাত তরীর দু’চোখের পাতা এক হলো না। একপ্রকার নিঃশব্দে কেঁদে কেঁদেই কাটলো। ভোরের সময় তরী উঠে পড়ল। ওজু করে সেজদায় লুটিয়ে পড়ল। মোনাজাতের সময় উচ্চারিত হলো না একটি শব্দও। চোখের জলে ভাসিয়ে দিলো গাল,চিবুক,হাতের তালু। আকাশে শুভ্র রঙ ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করলে নামায শেষ করে উঠে দাঁড়াল তরী। বারান্দায় গিয়ে রেলিংয়ে হেলান দিয়ে হালকা মেঘের নীলাক্ত অন্তরীক্ষকে পর্যবেক্ষণ করতে শুরু করল। ওই দূর নীলাচলের কোথাও না কোথাও আল্লাহ রয়েছেন। নিশ্চয়ই তাকে দেখছেন, তার কষ্ট দেখছেন। উপলব্ধি করতে পারছেন। তরী অস্ফুটস্বরে উচ্চারণ করল, ‘আমাকে মুক্তি দাও মালিক।’
_
হালিমা বেগম চিন্তায় চিন্তায় রাতে ঠিকভাবে ঘুমাতে পারেননি। সামান্য কারণে যাচাই বাছাই না করেই স্ত্রীর গায়ে হাত তুলেছে আয়মান! এর মানে ওদের ভেতরের সম্পর্ক ভালো নেই, মজবুত নেই। অথচ তরী কখনো তা প্রকাশ করেনি! তার চেহারা দেখেও বোঝা যায়নি কিছু৷ মেয়েটা মনের অন্তরালে সব চাপা দিয়ে দিয়েছে। ওদের ভেতরের সমস্যাটা কী,সেটা বের করে সমাধান না করলে এই সংসার হবে মৃত। না থাকবে কোনো সুখ, না থাকবে অনুভূতির জোয়ার। দায়িত্বের চাপে পড়ে দু’জনেই নিরবে সংসার সংসার নাটক করে যাবে। হালিমা বেগম চপল পায়ে উঠে পড়লেন। রান্নাঘরের দিকে এলে আটা মাখাতে ব্যস্ত তরীকে চোখে পড়ল। হালিমা বেগমের কেন যেন বুকটা ভার হয়ে এলো। এত মিষ্টি আর লক্ষী একটা মেয়ে! অথচ বুকের ভেতর পাহাড় সমান কষ্ট বোঝাই…
‘তরী মা..’ ডাকলেন হালিমা বেগম। তরী সামান্যই চমকে উঠল। পরমুহূর্তেই নিজেকে ধাতস্থ করে স্মিতহাস্যে বলল, ‘জি মা।’
‘আজ এত সকালে উঠে পড়লে যে?’
‘এমনিই মা। ঘুম ভেঙে গেল।’
‘আজকাল তো সবার নয়টা দশটার আগে চোখ খোলে না। আর তুমি রোজ ভোরে উঠো।’
‘সবাই কী এক মা?’
‘তা ঠিক।’
তরী কথা বলতে বলতেই রুটি বেলতে বসল। দুটো রুটি বেলা হলে হালিমা বেগম ভাজতে শুরু করলেন। তরী একবার বলল, আমিই পারব করতে। কিন্তু হালিমা বেগম শুনলেন না। ওদের দু’জনকে চমকে দিয়ে বিভাও সেই মুহূর্তে রান্নাঘরে এসে উপস্থিত হলো। হালিমা বেগমের হাত থেকে খুন্তি কেড়ে নিয়ে তাকে বিশ্রাম নিতে বলল। হালিমা বেগম গাল ভরে হাসলেন। ‘আজ এত সকাল সকাল উঠলি যে..’
‘কী করব? পাশে যেই বান্দরনিকে শোয়াইছো। সারারাত যদি একটু ঘুমাতে পারি। হাত-পা নেড়েচেড়ে আমার ঘুমের বারোটা বাজাইছে বারবার।’ বিভা নাক কুঁচকায়। তরী শীতল চোখে তাকাল। হালিমা বেগম হঠাৎ অন্যরকম কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘ও আসলে কী চায়,আমি বুঝে গেছি। আমি আজকে সোনালিকে ডাকাইছি। এসবের একটা বিহিত করা উচিত।’
তরী সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘থাক আম্মা। ওর জন্য আন্টি অপমানিত হবেন শুধু শুধু। যা হওয়ার হয়ে গেছে। আপনি ওকে বুঝিয়ে দিয়েন। আর অনুমতি দিলে একটা কথা বলতে চাই আম্মা।’
‘বলো মা।’ হালিমা বেগম অনুমতি দিলেন।
তরী একটু রয়েসয়ে বলল, ‘ওকে আর এই বাড়িতে আসতে দিয়েন না। আমাকে দেখলেই ওর উল্টাপাল্টা কথার মেশিন শুরু হয়। আমি চাই না সংসারটা ভাঙুক। আর আপনার ছেলেকেও একটু বলবেন আম্মা। অন্যের কথায় না জেনেশুনে আমার উপর এভাবে রিয়েক্ট করা ঠিক হয় নাই। অভ্যাসে পরিণত না হয়ে যায় এই ব্যাপারটা।’
হালিমা বেগম চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘ওর আব্বা তো খুব ভালো লোক ছিল। কখনো অপ্রয়োজনে আমার সাথে উঁচু গলায়ও কথা বলেনাই। আর ও এই স্বভাব কোথাথেকে পেল! আজ উঠুক,ওর সাথে সত্যিই কথা বলা দরকার। বড় হয়ে গেছে ভেবে চুপ থাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু…’
‘চুপ করে থাকবেন না আম্মা। আজ চুপ থাকবেন, কাল অভ্যাসে পরিণত হবে। আমাকেসহ অন্যকে মারতেও দ্বিধা করবে না তখন।’
হালিমা বেগম ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। বিভা চুপচাপ সব শুনে গেল। মাঝ দিয়ে নিজে থেকে কিছু বলল না।
_
সকালের নাশতার সময়ে হালিমা বেগম সানাকে বললেন, ‘তুমি কাল যেটা করেছো,সেটা আমার বোনের কানে আমি নেবো না। আমার বোনকে চেনো ভালো করেই। শরীরের মাংস আলাদা করে ফেলবে।’
সানা ঢোক গিললো। সেই সাথে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। সত্যিই সোনালি বেগম এসব শুনলে ওর কপালে জাহান্নাম লিখে দিতো। হালিমা বেগম পুনরায় বললেন, ‘কিন্তু, তুমি আর এই বাড়িতে আসবে না। আমার বোন আসবে, আমার বোনের জামাই আসবে। তুমি আসবে না।’
আয়মান রুটি ছিঁড়তে যাচ্ছিল, মায়ের এমন কথার প্রত্যুত্তরে ওর হাত থেমে গেল। কপাল, ভ্রু দুটোই কুঁচকে বলল, ‘এসব কেমন ধরনের কথা আম্মা!? ও আসবে না কেন? ও বাচ্চা মানুষ, একটা নাহয় ভুল করেই ফেলছে। তাই বলে এই বাড়িতে আসার নিষেধাজ্ঞা জারি করার কোনো মানে হয় না।’
বিভা বলল, ‘তোমার বউয়ের চেয়েও বড় বয়সে, আর তুমি বাচ্চা বলো ভাইয়া?’
আয়মান ধমক লাগাল, ‘চুপ কর তুই। তোকে বড়দের মধ্যে কথা বলতে বলিনাই। আর আমার বউকে তো আমি নিয়ে আসিনাই। তোমরা মিলে গলায় ঝুলাইছো। এই বাচ্চা কিসিমের বউ আনছো দেখেই কোনো ম্যাচিউরিটি নাই এর মধ্যে। আবেগ,আহ্লাদ দিয়ে ভরা। স্বামীর খেদমত শুধু শারীরিক ভাবেই হয় না,মানসিক ভাবেও করা লাগে,তা বোঝে না।’
তরীর কান ঝাঁ ঝাঁ করে উঠল। চোখ ভরে এলো মুহূর্তেই। হালিমা বেগম নির্বাক চেয়ে রইলেন। রক্ত লাল আয়মান খাবারের প্লেট ঠেলে উঠে দাঁড়াল। চিবিয়ে চিবিয়ে বলল, ‘তোমাদের মাথাটাও ও খাইছে, আমি বুঝছি তো। বারবার বলছিলাম, গ্রামের মেয়ে তার উপর বয়স ছোট, এসব এনো না। আমার একটা স্ট্যাটাস আছে সমাজে। আমার অফিসের কলিগরা প্রতিনিয়ত নানান কথা বলে মজা করে। তাদের ওয়াইফরা কত স্মার্ট, কত বিচক্ষণ! কথাবার্তায় একটা আলাদা ভাব… আর এই মেয়ে দেখো। কিছু বলতে পারলাম না,এখনই কেঁদেকেটে ভাসানো শুরু করছে।’
তরী সত্যিই কাঁদছিল। আয়মানের এহেন কথায় আর গলার স্বর শুনে তার পাজর গুলো ভাঙতে শুরু করল একেক করে। বুকের ভেতর অন্তর্দহনের ঢেউ। সানা মিটিমিটি হাসছে। তরী উঠে নিজের ঘরে চলে গেল না খেয়েই। আয়মান হৈ হৈ করে উঠল, ‘দেখছো? ওর ভেতর একটুও জেদ নাই, কোনো ভাব নাই! মানে কী বলব! ওর সাথে আমার সিরিয়াসলি যাচ্ছে না আম্মা। যত দিন যাচ্ছে,ওতই ওকে অসহ্য লাগছে আমার। এসব আর কতদিন চলবে জানি না। বাট আমি মুক্তি চাই, সিরিয়াসলি আমি মুক্তি চাই।’
আয়মান গটগট করে বেরিয়ে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। রেখে গেল বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যাওয়া দুইটি মুখ,সানা পুলকিত বোধ করছে। তরীকে এভাবে অপমানিত হতে দেখে ভালো লাগছে। একজন বিবাহিতা নারীর শক্তিই তার স্বামী। সেখানে স্বামীই যখন পাশে থাকে না,তখন এর চাইতে ভয়াবহ কষ্টের আর কিছুই হয় না। হালিমা বেগম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সানার দিকে তাকাতেই চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। বললেন, ‘তোমার নাশতা হলে বাসায় যাও।’
সানার চেহারায় নিমিষেই মেদুর রঙের আভা ছড়িয়ে পড়ল। নাকের পাঠা ফুলিয়ে উঠে দাঁড়াল সে এবং সেই অবস্থাতেই ফোনটা সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেল। বিভা ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ‘এসব কী হচ্ছে মা! ভাবীর উপর ভাইয়ার এত রাগ! এত আক্রোশ! কী কারণ?’
‘জানি না আমি।’ দায়সারাভাবে জবাব দিলেন তিনি। বিষিয়ে উঠেছে তার মন। দুশ্চিন্তা হচ্ছে ছেলে-বউয়ের সংসারের জন্যে…
_
ভালোবাসার দহনকে যারা আবেগ বলে তাদের আমি পরোয়া করি না। তাদের কপাল থেকে ভালোবাসা মুছে যাক, তারা শূন্যতা বুকে চেপে বেঁচে থাকুক বছরের পর বছর। আমার কমতি আপনাকে খুঁড়ে খুঁড়ে খাক একদিন। অভিশাপ দিচ্ছি না, কিন্তু মন থেকে এটাই চাই। আপনার প্রাপ্য একদিন আপনি বুঝুন। সেদিন যেন আমার হাসিতে সূর্য লুকিয়ে পড়ে। আর আপনার চোখের পানিতে সমুদ্র হাবুডুবু খায়…
আমি সত্যি আর পারছি না সহ্য করতে,আর না…
আপনি শুধু আমাকে মানসিক ভাবেই না,শারীরিক ভাবেও অসুস্থ করে তুলেছেন। দিনরাত মাথার ব্যথায় নাজেহাল হয়ে থাকি। বলার উপায় নেই, আপনি বলবেন এটাও নাটক! ড্রামা! আমার অপরাধ, আমি আপনাকে অতিমাত্রায় ভালোবেসেছি। আর তার শাস্তি এসব… মাথা পেতে নিলাম সব। মনে রাখবেন, আমি ভাগ্যের উপর শ্রদ্ধাশীল। এটাও মনে রাখবেন, আমি কেয়ামতে আপনাকে আর চাইবো না…
(চলবে)