মন খারাপের ডায়েরি পর্ব-০২

0
1007

মন খারাপের ডায়েরি (২)
#অলিন্দ্রিয়া_রুহি

_
প্রিয় আয়মান,
আপনাকে এই নিয়ে বাইশবারের বার লিখতে বসেছি। আগের একুশটি চিঠি জীবনকথনের ন্যায় অবহেলায় এই ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ রয়েছে। কিন্তু আফসোস আমার, আপনি কোনোদিনও সেই চিঠিগুলো পড়তে পারবেন না। আমি চাই-ও না, আপনি পড়ুন। ওগুলো পড়লে মুখ লুকোনোর জায়গা যে থাকবে না! আপনি জানেন, কতটা ক্ষতবিক্ষত আমার চিত্ত? জানেন না, আপনি সবসময় নিজের দিকটাই অনুভব করেন। কখনো আমার জায়গায় এসে অনুভব করার চেষ্টা করলে বুঝতেন, আমি দুঃখ লুকিয়ে কী করে হাসতে শিখেছি! বিয়ের পর এতকাল যাবত কোনোদিন একটা দামী উপহার আপনার থেকে পাইনি। বিয়ের নাকফুলটাও আম্মার দেওয়া! তবুও সেসব নিয়ে অভিযোগ, আফসোস- কোনোটিই আমার ছিল না। আমি শুধু আপনাকে চেয়েছি, আপনার ভালোবাসা, আপনার আদর, আপনার সুখ-দুঃখের ভাগিদার হতে চেয়েছি। প্রথম তো সব ঠিক ছিল। তারপর হঠাৎ কেন এত নির্মল হয়ে গেলেন! জানি না। আমি মন থেকে চাই, আমার মৃত্যুর পর এই ডায়েরিটা যেন আপনার হাতে পড়ে। আমি যখন থাকব না, সেদিন আপনি মুখ থুবড়ে কাঁদেন যেন। ওই উপর থেকে আমি দেখব, আর হাসব মিটিমিটি। আমাকে দেওয়া কষ্টের প্রতিশোধ সেদিন নেবো! ভাগ্যে থাকলে, কেয়ামতেও আমি আপনাকে চাইবো। দয়া করে সেদিন ভালোবাসার বদলে অবহেলা দিয়েন না…

_
তরী দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছে। বাদে বাদে ডুকরে উঠছে কান্নার দমকে। ঘরের চারিদিকের চারটি দেয়াল বাদে আর কেউ সেই কান্নার সাক্ষী হলো না। খানিক পর বাথরুকে গিয়ে চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিয়ে বেরিয়ে আসে তরী। এখন মুখে হাসি, দেখলে বোঝাই যাবে না একটু আগেই কেঁদে একাকার হয়ে গিয়েছিল এই মেয়েটি! কী নিখুঁত অভিনয়! এরকম তরীদের অভাব নেই বাস্তবতায়… কয়জন জানে সেটা?

দরজা খুলে বাইরে বেরোতেই হালিমা বেগম প্রশ্নবাণ ছুঁড়লেন, ‘তুমি নাশতা করেছো বউমা?’
তরী না খাওয়া সত্ত্বেও মাথা দোলালো।
‘আপনারা খেয়ে নিন। আপনার ছেলের সঙ্গে বসে খেয়ে নিয়েছি।’
‘বিভাটা এখনো উঠলো না। ওকে একটু উঠাও তো বউমা।’
‘জি আম্মা,যাচ্ছি।’ বলে বিভার ঘরের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো তরী। দরজা ভেজানো, আলতো হাতে দরজাটি খুলতেই কারো ফিসফিসানি চাপা স্বর ভেসে এলো তরীর কানে। তরী কান খাঁড়া করে। স্পষ্ট বুঝতে পারলো কণ্ঠটি বিভার। কাঁথার তলে কথা বলছে ফোন। ঠোঁট টিপে হাসে তরী। ওপর পাশের ছেলেটি যে হাসিব, বুঝতে দেড়ি হয় না। বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে আচমকা বিভাকে চমকে দিতে কাঁথাটা টেনে নেয় তরী। হালিমা বেগম এসেছেন- মনে করে আঁতকে উঠল বিভা। হাতের ফোন ছুঁড়ে ফেলে ধড়মড়িয়ে উঠে বসতেই তরীর খিলখিল হাসির তরঙ্গ কানে ঢোকে।
‘ইশ ভাবী! হার্ট অ্যাটাক করতাম আরেকটু হলে।’
হাসির চোটে চোখে পানি চলে আসে তরীর।
‘সাবধান করলাম ভাই। আম্মা আসতো যদি আমার জায়গায়! দরজা আঁটকে কথা বলো।’
‘এইরে… কী বোকা আমি! থ্যাংকিউ ভাবী।’
বিভা তরীর গাল ছুঁয়ে দেয়। বিনিময়ে মুচকি হাসি ছুঁড়ে বেরিয়ে আসে তরী। হালিমা বেগমকে বলল, ‘উঠছে না আম্মা। থাক ঘুমাক, ভার্সিটি বন্ধ উনার। কী করবে উঠে!’
হালিমা বেগম গজগজ করলেন কতক্ষণ। বিভা ভার্সিটির প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে এইবছর। তরী বিভার চাইতেও ছোট বয়সে, অথচ সম্পর্কের দিক থেকে বড়! বিভাও তরীকে ছোট মনে করে না কখনো। তার প্রাপ্য সম্মানটুকু যথাযথ ভাবে দেওয়ার চেষ্টা করে সবসময়। তরী লোকমুখে শুনেছে, শ্বাশুড়ি, ননদরা সবসময় বউয়ের পেছনে হাত ধুঁয়ে লেগেই থাকে। সেই হিসেবে তরীর ভাগ্য ভালো। তার শ্বাশুড়ি যেন আরেক মা! ননদ যেন বড় বোন! তরীর বুকচিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। আফসোস,স্বামীটা পরিবর্তন হয়ে গেল। নইলে তরীর সুখের সংসার দেখে মানুষ জ্বলতো…

কলিংবেল বাজলে তরীর ধ্যান ভাঙলো। হালিমা বেগম বললেন, ‘ওরা এসে পড়েছে মনে হয়।’
ওরা বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে,তরী বোঝে। তার কপাল কুঁচকে আসে। এই সানা মেয়েটাকে একদম সহ্য হয় না। তার চেয়ে এক বছরের বড় বয়সে। কিন্তু আচরণ খুবই জঘন্য, আর প্রচুর এটিটিউট! মানুষকে দামই দেয় না। তরীকে একদিনও ভাবী বলে ডাকেনি। সবসময় নাম ধরে ডাকে। পারতপক্ষে কথা বলে না এমনিতে। কিন্তু যখনই বলে,খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আয়মান ও তার দাম্পত্য জীবনের ব্যাপারে প্রশ্ন তোলে। প্রথম প্রথম তরী কিছু মনে করত না। কিন্তু এখন বোঝে। সানা মেয়েটা মনে মনে আয়মানকে পছন্দ করে যে,তরী নিশ্চিত এ ব্যাপারে। রাগ হয় তার মাঝে মাঝে খুব!

দরজা খুলে দিতেই সোনালী বেগমকে সালাম দেয় তরী। তারা ভেতরে ঢোকে। সানার ঠোঁটে সবসময় একটা বিদ্রুপ মাখানো হাসি থাকে কেন যেন! তরী তার দিকে ফিরেও তাকাল না। নাশতা সাজাতে রান্নাঘরে চলে এলো। খানিক বাদে সানা রান্নাঘরের দরজায় এসে দাঁড়াল।

‘কী খবর তরী ম্যাডাম? ভালো আছেন?’
তরী কোঁচকানো কপাল নিয়ে তাকাল। মুখে জোরপূর্বক হাসি ধরে বলল, ‘হ্যাঁ, তুমি ভালো আছো আপু?’
‘কীভাবে ভালো থাকি! আমার আমানত যখন তোমার কাছে?’
‘মানে!’
‘না, কিছু না। আয়মান ভাইয়া কই? অফিসে চলে গেছে?’
তরী মাথা দুলিয়ে জবাব দিয়ে দিলো,মুখে কিছু বলল না।
‘আচ্ছা আয়মান ভাইয়াকে ফেসবুকে ম্যাসেজ দিলে সিন করে না কেন? তুমি নিশ্চয়ই তাকে বলছো, আমার সাথে কথা না বলতে, তাই না?’
তরী আকাশ থেকে পড়ল।
‘আমি তাকে এসব বলতে যাব কেন!’
‘তাহলে আগে আমার সাথে এত কথা বলতো, আর এখন বলে না কেন?’
‘আমি তো জানি না। তাকেই জিজ্ঞেস করো।’
তরী কাজে মন দেওয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু ভেতরটা খচখচ করছে হঠাৎই। আয়মান সানার সঙ্গে কী ধরনের কথা বলতো! তা জানতে খুবই ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের ইচ্ছেকে জোরপূর্বক দমানোর চেষ্টা করলেও সানার পরবর্তী কথায় তরীর মাথায় রক্ত চড়ে গেল আচানক।

সানা বলল, ‘ভাইয়া চেঞ্জড পুরোপুরি! আগে কত মজা করতো আমার সাথে। এখন আর করে না। আগে আমরা ক্লোজ ছিলাম, আই মিন ক্লোজ ফ্রেন্ড আর কী। কত ঘুরে বেড়াইছি একসাথে। ভাইয়ার সাথে আমার কত ছবি আছে! দেখবা? এই দেখো…’ নিজের ফোন থেকে কিছু ছবি বের করে তরীর সামনে ধরলো সানা। দুটো ছবি স্লাইড করে সরে যাওয়ার পর তৃতীয় যেই ছবিটা এলো, তরীর মাথা পুরোপুরিভাবে ব্ল্যাংক হয়ে গেল। ছবিটা বেশ আগের, আয়মানের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে। আয়মান দাঁড়িয়ে আছে জিন্সের পকেটে হাত ঢুকিয়ে, আর তার গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা রেখে দাঁড়িয়ে সানা… এছাড়াও প্রতিটি ছবিতে আয়মানের পাশাপাশি দাঁড়ানো, কোনোটায় দুজনের হাত ধরাধরি…
ছবিগুলো বিয়ের আগে হোক, কিন্তু কোনো স্ত্রী কী এসব সহ্য করতে পারবে? মন খারাপ হবে না? তরীর মন খারাপ হয়ে গেল। সে কিছু বলার আগেই সানা পুনরায় বলল, ‘তুমি আসার পর ভাইয়া আমার থেকে দূরে দূরে থাকে। নিশ্চয়ই তুমি মানা করছো,তাই না?’
‘দেখো আপু, আমি কিছুই বলিনি। তোমাদের কীরকম সম্পর্ক ছিল তাও জানি না। উনাকে যদি এতই চোখে হারাও তুমি, তাহলে ধরে রাখলে না কেন সারাজীবনের জন্য? আমি তো পরে আসছিলাম, তোমরা তো ছোট থেকেই একসাথে। তাহলে এখন আমাকে এসব বলে,দেখিয়ে কষ্ট দেওয়ার মানে কী আপু?’
সানা হেসে দিলো,যেন কোনো মজার ঘটনা ব্যাখ্যা করছে তরী! তরী উত্তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে রান্নাঘর ছাড়ার জন্য উদ্যত হলো। ঠিক তখনই সানা বলে উঠল, ‘ভাইয়াকে কল করে আসতে বলো বিকেলের ভেতর। তুমিও বলবা,আমিও বলবো। কার কথা শোনে,দেখা যাক?’
তরী নিষ্পলক সানার অবজ্ঞা মাখানো মুখপানে চেয়ে নিরবে প্রস্থান করে। খালা শ্বাশুড়ির সামনে নাশতার আয়োজন করে নিজের ঘরে চলে এলো সে। দরজা ভেজিয়ে ফোন করল আয়মানকে।
ফোনটা ধরেই একরাশ বিরক্ত মাখানো ধমকের স্বরে বলে উঠল আয়মান, ‘বাসা থেকে আসতে পারলাম না,কল কীসের এখনি!’
তরী ঢোক গিলে চোখের পানি দমন করল। সানার কথায় এমনিতেই মন খারাপের চূড়ান্ত, এখন আবার আয়মানের ধমক খাওয়া এমনি এমনি!
‘আজকে বিকেলের দিকে বাসায় আসবেন একটু?’
সাহস করে আবদারখানা পেশ করল আয়মানের নিকট। আবদার রাখা তো দূর, গলার স্বরটাও নরম করল না আয়মান। পুনরায় ধমকে বলল, ‘এটা তো তোমার বাপের অফিস। যখন ইচ্ছে চলে আসবো। যত্তসব! রাখি..’
ফোন কাটতেই দীর্ঘশ্বাসের সঙ্গে সঙ্গে একফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে গাল ছুঁলো তরীর। পেছন থেকে কারও অট্টহাসি শুনতে পেয়ে চকিতে চোখ মোছে তরী। সানা ক্রুর হাসি ছুঁড়ে দিলো। নিজের ফোন দিয়ে ফোন করল আয়মানকে।
‘ভাইয়া,আমি সানা। হ্যাঁ,তোমার বাসায় আসছি আজকে। সন্ধ্যায় চলে যাব। বিকালে আসবে? কতদিন তোমার সাথে আড্ডা দেই না ভাইয়া।’
ওপাশে আয়মান কী বলল,তা শুনতে অধীর আগ্রহে তাকিয়ে আছে তরী।
‘থ্যাংকিউ ভাইয়া’ বলে মুচকি হাসির সহিত ফোনটা কান থেকে নামালো সানা। তরীকে উদ্দেশ্য করে এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল, ‘আসবে ভাইয়া..’
আহত হলো তরী। আয়মান পুরোপুরি ভাবে তার মন ভেঙে দিলো আজকে….

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে