গল্প- মন খারাপের ডায়েরি
পর্ব- ১
লেখিকা- #অলিন্দ্রিয়া_রুহি
(১)
তরী নিঃশব্দে কাঁদছে। পাশে আয়মান শুয়ে রয়েছে কপালের উপর এক হাত রেখে। তার চোখজোড়া বন্ধ, ঘুমোনোর চেষ্টা চালাচ্ছে। তরীর দিকে ফিরেও তাকাল না সে। মাত্র দুই বছরের সাংসারিক জীবনেই এত অতৃপ্তি কোথাথেকে ভরিয়ে দিয়েছে মন, আয়মান জানে না। শুধু জানে,নিজেকে বন্দী মনে হয়। ভালো লাগে না কিছু,তরীকেও না। তরীর কান্না আয়মানের কাছে নাটক বৈ কিছুই নয়। তরীর কান্না টা রোজকার। প্রতিদিন আয়মানের কোনো না কোনো অবহেলায় তার বুক ভাঙে। এই যেমন আজ রাতের ঘটনা ধরা যাক। আয়মান অফিস থেকে ফিরে এলো এগারোটায়। বাসার সবাই খেয়ে নিলেও তরী খায়নি। আয়মান এলে একসঙ্গে খেতে বসায় আয়মান চোখ রাঙিয়ে ধমকের সুরে বলে উঠল, ‘কে বলেছে আমার জন্য অপেক্ষা করতে? আমি বলেছি একবারও? নাটক যতসব!’
তরী একটিও জবাব দেইনি। এক লোকমা ভাতও এরপর আর মুখে উঠেনি। কতক্ষণ নিঃশব্দে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে একসময় উঠে গেছে তরী। আয়মান দেখেও দেখেনি। সে তার মতো খেয়ে নিয়েছে। পেটের ক্ষুধা চাপিয়ে রেখে অন্যের জন্য বসে থাকা স্রেফ বোকামী বৈ আর কিছু কী! বোকা আয়মান! সে কী জানে না,তরী কীসের টানে তার জন্যে অপেক্ষা করে?
একসময় আপনমনে উঠে বাথরুমে যায় তরী। চোখেমুখে পানির ঝাপটা দিতে গিয়ে চোখ বোজে। সেই অলক্ষণে অবাধ্য মনটি ছুঁটে যায় অতীত স্মৃতির পাতায়।
আয়মানরা দেখতে এসেছিল পূর্নিমার রাতে। সন্ধ্যার পর থেকেই ভরা জ্যোৎস্না। ছাতিম রঙের একটা কাতান শাড়িতে ষোড়শী কিশোরী সাজতে চেয়েছিল যুবতী নারীর ন্যায়। গ্রামীন এলাকায় এসএসসি পাশকরা মেয়ে অনেক লেখাপড়া করে ফেলেছে- এমনটাই ভাবে সকলে। তরীর বাবা-মাও এই মতের অমিলে ছিল না। তরীকে তাই দ্রুত বিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তারা। ঢাকা থেকে আগমন পাত্রের, লম্বা-চওড়ায় মাশা-আল্লাহ, পাত্রের মায়ের আচরণ সুন্দর, এক বোন বাদে সাতকূলে আর তো কেউ নেই… শ্বাশুড়ি, ননদ আর স্বামীর ছোট্ট সংসারে সুখী হবে তরী মা। সেই চিন্তাভাবনা থেকেই আয়মানের সঙ্গে তরীর বিবাহ দেওয়া। বয়সের দিক থেকে বেশ ভালোই দূরত্ব দু’জনার মাঝে। প্রায় আট বছরের! কিন্তু শারীরিক দিক থেকে তরীকে একটুও দূরত্বে রাখেনি আয়মান। এমন এক রাত ছিল না,যেদিন ছোট্ট তরীকে সুখের দুয়ারে ভাসিয়ে নিয়ে যায়নি আয়মান! সংসার ও স্বামীর খেদমত বুঝতে বুঝতে দেড় বছর পার হয়ে গিয়েছে এতদিনে। এখন যখন আয়মানের মায়াজালে আরও ফেঁসে গিয়েছে তরী,ঠিক তখনই আয়মানকে অচেনা লাগতে শুরু করেছে ভীষণ। মনে পড়ে যায়,সেই দিনগুলোর কথা… যখন তার চোখে পানি দেখলে আয়মানও কেঁদে ফেলত পুরুষ হয়ে! আর আজ তরী কাঁদলেও আয়মান পাত্তা দেয় না। দু’দিন আগে তরী অন্তরের বেদনায় ঝরঝর করে কাঁদছিল একলা একাকী বারান্দায়, আয়মান সবেমাত্র রাতের খাবার খেয়ে ঘরে এসেছে। বারান্দায় পা রাখে গামছা নেবার উদ্দেশ্যে। আয়মানের উপস্থিতি বুঝতে পেরে দ্রুত কান্না থামায় তরী। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে চোখজোড়া মুছে নিয়ে হাসি হাসি মুখ করে তাকায় ভ্রু কুঁচকে থাকা আয়মানের দিকে। তরী জানতে চায়, কিছু প্রয়োজন?
উত্তরে আয়মান বলে, ‘তোমার এসব নাটক থেকে মুক্তির প্রয়োজন তরী! তোমাকে বিয়ে করা জীবনের সবচাইতে বড় ভুল। কিছু থেকে কিছু হলেই কান্নাকাটি! আর তোমাকে কিছু বলাও যায় না বাবা… এমন বিহেভ করো,যেন ঘরে সতিন নিয়ে এসেছি! যত্তসব।’
গামছা না নিয়েই বারান্দা ত্যাগ করে আয়মান। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয় তরী। তার চোখজোড়া ছলছল করে আবারও,কিন্তু ঠোঁটের কোণায় এক চিলতে হাসি। মনে মনে বলে, ‘সতিন নিয়ে এলেও অবাক হবো না এখন। আপনাকে বড্ড অচেনা লাগে আয়মান..’
(২)
‘সকাল সকাল উঠে পড়েছো বউমা!’
হালিমা বেগমের কথার প্রত্যুত্তরে তরী মুচকি হাসি প্রদান করল। সে আটা মাখাতে ব্যস্ত। সাড়া ছ’টা বাজছে ঘড়ির কাটায়। আয়মান সাতটায় উঠে পড়বে। আটটার ভেতর নাশতা খেয়ে বেরিয়ে পড়ছে আপন কাজের উদ্দেশ্যে। তার আগেই নাশতা তৈরি করা প্রয়োজন। সারারাতে এমনিতেও ঘুম হয়নি তার। একবার এপাশ করেছে আরেকবার ওপাশ ফিরেছে। আয়মানের বুকের ওঁম পেতে খুব ইচ্ছে করছিল তরীর। কিন্তু সাহস হয়নি ওকে ছোঁয়ার। দেখা যাবে মাঝরাতে চিৎকার করে উঠবে। কী দরকার! কতক্ষণ বারান্দাতেও দাঁড়িয়ে ছিল তরী। একটা সময় ছিল, যখন আলো জ্বালানো থাকার পরেও একা এক রুমে থাকতে ভয়ে কুঁকড়ে যেতো তরী। আর আজ একা একা অন্ধকারেও ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটায়। মরে গেলে মাটির তলায় একাই থাকতে হবে। অন্ধকারকে ভয় পাওয়ার কী প্রয়োজন? বরং এখন থেকেই অভ্যেস করা যাক। নইলে কবরের ভেতর একলা থাকতে কষ্ট হবে যে খুব!
বিভা ঘুমাচ্ছে। হালিমা বেগম বিভার গালে আলতো করে চড় মারলেন,বিভা লাফিয়ে জেগে উঠে বসল।
‘কী মা! প্রতিদিন সকালে এভাবে উঠাও কেন?’ আর্তনাদের স্বরে বলল বিভা।
হালিমা বেগম ধমকের স্বরে বললেন, ‘ঘরে আরও একটা মেয়ে আছে আমার। সে সকাল ছয়টায় উঠে নাশতা বানায়। আর তুই নয়টার আগে উঠতে পারিস না।’
‘মাত্র সাতটাও বাজে নাই! এখনই উঠে করবটা কী? প্লিজ মা.. আটটায় উঠে পড়ব,যাও। এখন একটু ঘুমাতে দাও। দয়া করো..’ ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে আবার শুয়ে পড়ে বিভা। হালিমা বেগম তার পাশেই বসে রইলেন বেশ কিছুক্ষণ। আজকে সোনালীর আসার কথা। সোনালী তার ছোট বোন। সোনালী ও তার মেয়ে সানা আসবে আজকে। খুব কাছেই থাকে তারা। প্রায় প্রায় এসে গল্প করে চলে যায়। একটা সময় ছিল যখন সানার জন্য আয়মানকে বেছে নিয়েছিল সোনালী। হালিমা বেগমেরও এই বিষয়ে আপত্তি ছিল না কোনো। কিন্তু এরপর এমন কিছু কারণ ঘটেছে যার কারণে সানার সঙ্গে আয়মানের বিয়েটা হয়ে ওঠেনি। তা নিয়ে একবিন্দু আফসোস নেই হালিমা বেগমের। তরী গ্রামের মেয়ে হলেও বেশ সুশৃঙ্খল, আদব কায়দা জানে। কাজেও পটু। তার মতো বউ পেয়ে হালিমা বেগম সত্যিই মন থেকে খুশি।
আয়মান ঘুম থেকে উঠার পর একদফা চিল্লাচিল্লি সাড়লো তরীর সঙ্গে। রাগারাগির কারণ,তরী কেন তাকে ডেকে তোলেনি! অথচ কিছুদিন আগে ঘুম থেকে উঠানোর জন্য বারবার ডাকার ফলে একগাদা বকার সঙ্গে একটি থাপ্পড়ও খেয়েছিল তরী আয়মানের হাতে। তারপর থেকে ভুলেও সে আয়মানকে ডাকতে যায় না। আয়মান নিজেই ফোনে এলার্ম দিয়ে রাখে। সময় মতো উঠে পড়ে। আজ যে এলার্ম শুনেও উঠতে পারবে না তা তো আর তরী জানতো না! সে রান্নাঘরে ব্যস্ত ছিল। বিক্ষিপ্ত মেজাজ নিয়ে গোসল সেড়ে ডায়নিংয়ে বসে আয়মান। রুটির প্লেটটা সরিয়ে রাখে। কটমটে চোখে তরীর দিকে তাকাতেই তরী দাঁত দিয়ে জিভ কাটে। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে পরোটার প্লেটটা নিয়ে এলো। আয়মান রুটি খায় না। তরী সব আনতে গিয়ে পরোটার প্লেট আনতেই ভুলে গিয়েছিল! কথায় আছে,যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যে হয়! টুকটাক কিছু কথা চালাচালির পর আয়মান খাওয়া শেষ করে নিজের ঘরের দিকে গেল। তরী টেবিল গোছাচ্ছিল, আয়মান ডেকে বলল, ‘ঘরে আসো।’
দুরুদুরু বুক নিয়ে ঘরে পা রাখে তরী।
‘কিছু বলবেন?’
‘কিছু বলবার জন্যেই তো ডাকলাম,নাকী?’
ধমকের চোটে কেঁপে উঠল তরী। মৃদু শ্বাস বেরিয়ে এলো নাসিকাপথ ভেদ করে। আয়মান রাগ নিয়ে বলল, ‘তুমি কী আশা করো,সারাদিন কামলা দিয়ে এসে রাতের বেলায় তোমার ফোঁচফোঁচ শুনবো? তারপর তোমার রাগ ভাঙাতে যাব? তোমাকে মানাতে যাব? হুম?’
তরী মাথাটা নিচু করে বলল, ‘আমি কিছুই আশা করি না বিশ্বাস করেন। শুধু চাই, আপনি আমার সাথে ভালো আচরণ করুন। সুন্দর ব্যবহার করুন। একদম আগের মতো, আপনি এতটা পাল্টে গেছেন কেন?’
‘আমি তোমার সাথে খারাপ ব্যবহার করি? হুম? আর পাল্টে আমি যাইনি, তুমি গেছো। তোমাকে আদর দিতে দিতে মাথায় তুলে ফেলছি একচুয়ালি। আমার মতো সকাল টু সন্ধ্যা কামলা দিলে তোমার নিজেরও আচরণ মানুষের মতো থাকতো না। আসলে দোষ তোমার না,তোমার বয়সের। এই বয়সের মেয়েরা প্রায়োরিটি চায় বেশি। এরা হয় বিশ্ব ন্যাকার ন্যাকা… তুমিও তাই। ন্যাকামি আর আহ্লাদী!! শোনো, এভাবেই যদি চলতে থাকে তাহলে আমি কী করব জানি না। যদি আমার সাথে থাকতে চাও,এসব ফ্যাঁচফ্যাঁচানি একদম বন্ধ রাখতে হবে। কী বুঝতে পারছো?’
মাথা কাত করল তরী। মুখে কিছুই বলতে পারল না। স্বামীর সাথেই তো আহ্লাদ করে মানুষ! মেয়ে মানুষের ন্যাকামি তো স্বামীর সঙ্গেই! অথচ আয়মান কীসব বলছে… আয়মান চলে গেল অফিসের উদ্দেশ্যে। তরী বিছানায় ঝিম মেরে বসে রইলো খানিকক্ষণ। তার মন খারাপ লাগছে আবারও। কপালের চুল সরাতে গিয়ে চোখে হাত পড়ে। বুঝতে পারল সে কাঁদছে। নাক টেনে কান্না থামানোর বৃথা চেষ্টা চালায় তরী। উঠে গিয়ে দরজা আঁটকে দেয়। তোশকের তল থেকে লুকিয়ে বের করে একটা ডায়েরি। এই ডায়েরিটা আয়মানের। আয়মান কিছুই লেখে না দেখে তরী নিয়ে নিয়েছে নিজের করে। ডায়েরিটার নাম দিয়েছে ‘মন খারাপের ডায়েরি’। এখানে তরীর সমস্ত মন খারাপের কথা লেখা থাকে। আগে লিখতে হতো না,এখন লিখতে হয়। প্রতিদিনই লেখে। যেসব কথা আয়মানকে বোঝাতে পারে না বা বলতে পারে না,তা এই ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করে মনটাকে হালকা করার চেষ্টা করে তরী।
তরী লিখতে শুরু করল,
প্রিয় আয়মান,
(চলবে)