মনের ক্যানভাসে পর্ব-০৯

0
801

#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৯.
_______________

বউ সেজে রাশেদের রুমের বেডের মাঝখানে চুপটি করে বসে আছে মিতু। এইতো কিছুক্ষণ আগেই তিন কবুল পড়ে রাশেদ সাথে নিজেকে জড়িয়ে নিয়েছে সে। তাদের বিয়েতে তেমন কোনো আয়োজন হয়নি। না হয়েছে বাসর সাজানো। রুমটা বড্ড অগোছালো হয়ে পড়ে আছে। কেবল বেডে লাল রঙের একটা চাদর বিছানো হয়েছে। রুমের দক্ষিণ দিকের জানালাটা বন্ধ। অনেকদিন যাবত বোধহয় খোলা হয়না। সিগারেটের তীব্র গন্ধ সারা রুম জুড়ে। মিতু ধীর পায়ে খাট থেকে নেমে জানালা খুলে দিলো। পড়নের লাল রঙের শাড়িটার আঁচল কোমরে গুজে রুমটাকে থাকার উপযোগ্য করে তোলখর মিশনে নামলো। ঘন্টা দুয়েক পর রাশেদের আগমন ঘটলো। মিতু তখন সবে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ করে ঘেমে নেয়ে অগোছালো হয়ে বেডে সটান করে শুয়ে আছে। রাশেদকে দেখা মাত্র লাফিয়ে উঠে বসে সুন্দর করে মাথায় ঘোমটা টেনে নিলো। কিন্তু রাশেদ জেন তা দেখেও দেখলো না। হাতে থাকা প্যাকেটটা খাটের উপর রেখে ওভাবেই রুম থেকে বের হয়ে গেল। লম্বা ঘোমটার আড়ালে থাকা মিতু রাশেদের চলে যাওয়ার ব্যাপারটা বুঝতে না পেরে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকলো তার ঘোমটা তোলার। অনেক সময় অতিবাহিত হওয়ার পরও যখন কেউ তার ঘুমটা সরালো না তখন সন্দেহের বশে সে ঘোমটা নিচ থেকে উঁকি দিল। রুমে কারো অস্তিত্ব নেই বুঝতে পেরে ঘোমটা সরিয়ে গাল ফুলে বসলো। খাটের উপরে থাকা প্যাকেটের দিকে নজর পড়তেই দ্রুত হাতে প্যাকেট খুলতে তার মাঝ থেকে সুন্দর একটি লাল বেনারসি শাড়ি বের হয়ে এলো। মুহূর্তেই মন খারাপ হওয়ায় মিলিয়ে গেল। হঠাৎ করে বিয়ে হওয়ায় বিয়ের শাড়িটাও কেনা হয়েছিল না। রাশেদের মায়ের পুরোনো একটা লাল শাড়ি ছিল সেটা পড়েই বিয়ের আসরে বসতে হয়েছে তাকে। মিতু শাড়ি হাতে দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেল। রাশেদ নিশ্চই এই শাড়ি পরিহিত মিতুকে দেখতে চায়!

______________

রাশেদ ভাইয়ের বিয়ের কথা বাতাসের সাথে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়লো। বেলা করে ঘুম থেকে উঠে এমন গরম গরম খবর শুনে আমি হতভম্ব হয়ে বসে রইলাম। কানের কাছে কেবল বেজে চলছে রাশেদ ভাইয়ের বিয়ের কথা। কেমন একটা ঘোরের মাঝে রয়েছি যেন। স্বাভাবিক হতে সময় লাগলো বেশ কিছুক্ষণ। কৌতুহল দমাতে না পেরে মা কে ডাকলাম। কিন্তু কেউ এলো না। বুঝলাম ঘরে আপাতত কেউ নেই। রুমের দরজা বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করে বসে রইলাম। এই অপ্রিয় সত্যটা আমি মানতে পারছি না। রাশেদ ভাই আমার না কথাটা কেন যেন আমার মস্তিষ্ক মেনে নিতে পারলো না। গুম ধরে সেদিন সারাক্ষণ রুম বন্দী হয়ে থাকলাম। মা কয়েকবার ডাকতে এসেছিলো কিন্তু বিভিন্ন অযুহাতে তাকে ফিরিয়ে দিয়েছি। আমি এখনো জানিনা রাশেদভাই কাকে বিয়ে করেছে বা কিভাবে কি হলো। আমি জানতেও চাই না। রুম বন্দী হয়েই কাটলো সেদিন।

পরদিন খুব সকাল করেই ঘুম ভাঙল। রুম থেকে বের হতেই ফুপির সাথে দেখা হলো। ফুপির মুখটা কেমন চুপসানো লাগলো কিন্তু আমি সেদিকে তেমন গুরুত্ব দিলাম না। ভালোমন্দ জিজ্ঞেস করে হ্মিতু আপুর কথা জানতে চাইতেই ফুপি কেমন
চোখে যেন তাকালো। অবাক কান্ঠে বলল,

‘হ্যারে মিতা তুই কিছু জানিস না? এতকিছু হয়ে গেল তুই তো দেখছি কিছুই জানিস না। আরে মিতুর ই তো কাল বিয়ে হলো রাশেদের সাথে। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে আমার সোনার টুকরো মেয়েটাকে ঐ চালচুলোহিন রাশেদের গলায় ঝুলায়ে দিল। তুই বল মিতা, আমার মিতুকে তুই চিনিস না? আমার সহজ সরল মেয়েটাতো ওদের এই নোংরা চাল ধরতে পারেনি। এগুলো সব ঐ রাশেদের প্লান। ওরা ভাবছে আমি বোধহয় বুঝতে পারবো না।’

‘কেঁদনা ফুপি। যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। আল্লাহর উপর ভরসা রাখ।’

ফুপি শুনলনা। বিলাপ করে কান্না করছে সাথে রাশেদ ভাইয়ে গালিগালাজ। আমি আর কোনো কথা না বলে চুপটি করে ঐ স্থান ত্যাগ করলাম। কৌতুহল জাগছে খুব। রাগ, বেদনা, কষ্ট সব ভুলে সিদ্ধান্ত নিলাম রাশেদ ভাইদের বাড়িতে যাওয়ার। ওখানে গেলেই আসল ঘটনা জানা যাবে।

এসব খবর পাঁচ কান হতে সময় নেয়না। মানুষের এ ধরনের ঘটনায় আগ্রহ বেশি। রাশেদ ভাইয়ে ঘটনাটাও বাতাসের মতো হুরহুর করে পুরো এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। চায়ের দোকান, আড্ডা মহল, ক্লাব, মহিলাদের গল্পের আসর সব জায়গায় এখন রাশেদ ভাইকে নিয়ে চর্চা হচ্ছে। নানা লোকের নানা মতামত শুনতে শুনতেই রাশেদ ভাইদের বাসার পথে রওনা দিলার। পথি মধ্যে এক মাঝ বয়সী লোককে দেখরাম অন্য একজনকে বলছে,
‘ঐ বাড়ির পোলা রাশেদরে চিনোস না? সে তো ঘরের মধ্যে ফুপাতো বুনরে নিয়া অকাম করতে যাইয়া ধরা পরছে। ঐ বাড়ির কাজের ছেমড়ি দেইখা লোক ডাইকা বিয়া পড়াই দিছে। আজকালকার পোলাপাইনের কথা আর কি কমু।’

রাশেদ ভাইকে নিয়ে এমন জঘন্যতম কথা শুনে আমার চোখে পানি চলে আসলো। ইচ্ছ হলো তাদের সামনে যেয়ে চিৎকার করে বলতে আমার রাশেদ ভাই মোটেই অমন ছেলে নয়। তোমরা সবাই ভুল। তোমরা কেউ চেননা আমার রাশেদ ভাইকে। চোখের পানি মুছে দ্রুত পায়ে রাশেদ ভাইদের বাসায় যেতেই দেখলাম সেখানে অনেক লোক। অনেকে বউ দেখতে এসেছে অনেকে এসেছে নিন্দা করতে। কিছু মানুষ এসেছে এসব কিছু দেখে মজা উড়াতে। ঘরের ভেতরে ঢুকতেই দেখা হলো রাশেদ ভাইয়ের খালার সাথে। এই মহিলাকে দেখলেই আমার হাঁটু কাঁপা অবস্থা হয়ে যায়। পৃথিবীতে অনেক ধরনের মানুষ আছে। তাদের এক প্রকার মানুষ আছে যাদের কাজ কেবল সকলের মাঝের খুঁত খুঁজে বেরানো। এই মহিলা সেই প্রজাতিরই একজন।আমার মিতু আপুর জন্য চিন্তা হলো খুব। ইনি নিশ্চই মিতু আপুর দু চারটা ক্লাস এতক্ষণে নিয়ে ফেলেছেন। এ বাড়িতে মোট চারটা শোবার কক্ষ আছে। উত্তর দিকের শেষ প্রান্তের কক্ষটা রাশেদ ভাইয়ের। পা চালিয়ে রুমে ঢুকতেই মিতু আপুর নাস্তানাবুদ অবস্থা দেখে বুঝে গেলাম আমার ভাবনা ভুল ছিল না। নাকের জল চোখের জল এক করা মিতু আপুর এমন রূপ দেখে এই সিরিয়াস মোমেন্টেও কেন যেন আমার পেট চেপে হাসতে মন চাচ্ছে। কিন্তু নিজের এমন অস্বাভাবিক ইচ্ছেকে আমি প্রাধান্য দিয়ে ভুল করলাম না। আমাকে দেখতে পেতেই মিতু আপু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরলো। যেন এতক্ষণে আপন কাউকে পাশে পেয়েছে। আমার মিতু আপুর জন্য সত্যি ভিষণ মায়া হলো। এমন পরিস্থিতিতে একটা মেয়ে কতটা অসহায় সেটা উপলব্ধি করতেই চোখ থেকে এক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। ঈর্ষার বসে আর যাইহোক মনুষ্যত্ব হারিয়ে ফেলতে পারি না।

রাশেদ ভাইয়ের সাথে দেখা হলো ঠিক দুপুরে। মিতু আপুর থেকে সবটা শোনার পর কেন যেন আমি কারো উপর রাগ করে থাকতে পারলাম না। হয়তো তাদের অসহায়ত্ব আমার মানবতাকে জাগিয়ে তুলেছে বলেই।

খুব ছোট্ট করে ঘরোয়াভাবে খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয়েছে রাশেদ ভাইয়ের বিয়ে উপলক্ষে। সকাল থেকে মা কাকির হাতে হাতে টুকটাক কাজে সাহায্য করলাম। হাতে গোনা কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন এসেছে। দুপুরে খাওয়ার টেবিলে রাশেদ ভাইয়ের মামি মিতু আপুকে কিছুটা খোঁচা মেরে বলল,

‘নতুন বউকি রান্না কিছু পারো?’

মিতু আপু খুব সৌখিন ভাবে বড় হয়েছে। কখনো রান্নাঘরে ঢুকেছে কিনা সন্দেহ। এমন প্রশ্নে ভয়ে ভয়েই মাথা নাড়িয়ে না উত্তর দিলো আপু।

‘তাহলে আমাদের ছেলের গলায় ঝুললে কোন মন্তব্যে?’

দেখলাম মিতু আপু ঠোঁট চেপে কান্না আটকে রেখেছে। আমি আগেই বুঝেছিলাম এই মহিলার মতলব ভালো না। এত নিচু মানসিকতার মানুষ আমার একদম পছন্দ না। আমি কিছু বলতে যাবো তার পূর্বেই রাশেদ ভাই কথা বললেন।

‘কেন মামি ও আমার গলায় না ঝুললে বুঝি তোমার মেয়েকে ঝুলিয়ে দিতে? তোমার ঐ মুটি মেয়েকে আমার গলায় ঝুলিয়ে দিলে দুদিন পর আমাকে খুঁজে পাওয়া দায় হয়ে যেত। তার চাইতে এটাই ঠিক আছে।’

মামির মুখটা শুকিয়ে একটু হয়ে গেলো। তিনি কিছুটা রেগেও গেলেন।

‘তুই আমাকে কথা শোনাচ্ছিস রাশেদ?’

‘ভুল বুজছেন মামি। আমি আপনাকে কথা শোনাবো কেন? আমি কেবল আমার কর্তব্য পালন করছি।’

আমাকে আর কিছু বলতে হলোনা। তবে আমি অবাক হলাম। শুধু আমি নই সকলেই অবাক হলো। রাশেদ ভাই কখনো কারো হয়ে প্রতিবাদ করে না। তার মতে যার যার ব্যাপার সে সামলাবে। যেচে পরে অন্যের কাজে নিজেকে জড়ানোর কি দরকার? আজ সেই রাশেদের এমন পরিবর্তন আমাকে অবাক না করে পারলো না। আসলেই রাশেদ ভাই বদলেছে। বহুখানি। মামি খাওয়া ছেড়ে উঠে গেলেন। তবে কেউ কোনো কথা বললেন না। সবাই নিজের মতো খেতে শুরু করেছে। কেবল আমি পারলাম না। কোনো অজানা কারণে আমার খুব কান্না পেতে লাগলো। কিছুক্ষণ প্লেটে ভাত নড়াচড়া করে উঠে গেলাম। আজ আর এ ভাত আমার গালে উঠবে না।

চলবে…….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে