মনের ক্যানভাসে পর্ব-০৮

0
789

#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৮.
______________

খুব সুন্দর একটা ঘুম হয়েছে বহুদিন পর। কানের কাছে মোবাইলের এলার্ম বাজতেই বন্ধ চোখে হাতরে এলার্ম বন্ধ করলাম। চোখ টেনে খুলতে ইচ্ছা হচ্ছে না‌। মন চাচ্ছে আরো কিছুক্ষণ এভাবেই পরে থাকি। দরজায় ধুমধাপ ধাক্কার শব্দে না চাইতেও চোখ মেলে তাকাতে হলো। আলসে ভঙ্গিতে উঠে দরজা খুলতেই দরজার ওপারে আম্মুকে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে চোখ কুঁচকালাম। আজিব! এভাবে দরজার উপর হামলা করার কি আছে? সবেতো বারোটা বাজে। খুব বিরক্ত ভঙ্গিতে আম্মুকে বললাম,

‘আমার ঘুমের সাথে তোমার কি জমিজমা নিয়ে দন্দ আছে? সবসময় এভাবে আমার আর ঘুমের মাঝে ভিলেন হয়ে কেন দাড়াও বলোতো।’

তখনি ফোন থেকে এক পুরুষ কন্ঠ খুক খুক করে কেশে তার অস্তিত্বের জানান দিল। সাথে সাথে আম্মু ফোনটা আমার হাতে দিয়ে ইশারা করলেন কথা বলার জন্য। ফোন আমার হাতে দিয়ে ব্যস্ত পায়ে প্রস্তান করলেন। আমি আম্মুর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে চিন্তিত ভঙ্গিতে ফোন কানে ধরলাম। হ্যালো বলতেই ওপাশ থেকে আদনান বলে উঠলো,

‘আপনার আর ঘুমের মাঝে থার্ড পার্সন হয়ে আসার জন্য আশফিক বিন আদনান ভিষণ ভাবে দুঃখিত। আপনি কি তার আপনার সুন্দর হৃদয় থেকে তার ভুল ক্ষমা করতে পারবেন মিস ঘুমকুমারী?’

এটা আদনান ছিল! আমার সব কথা সে শুনে নিয়েছে! অস্বস্তি বোধ হলো। তার সাথে কিছুটা লাজুকতাও। নিজেকে সামলে কিছুটা কঠিন কন্ঠে বললাম,

‘আপনার এভাবে লুকিয়ে আমার কথা শোনা মোটেই উচিত হয়নি।’

‘এমা! লুকিয়ে কখন শুনলাম? আপনি আপনার প্রতিবেশী কাউকে জিজ্ঞেস করে দেখেন তারাও আপনার বলা প্রত্যেকটা কথা শুনতে পেয়েছে। এমন উচ্চস্বরে এনাউন্স করলে আমি কেন আশপাশের দশ গ্রামের মানুষ নিঃসন্দেহে শুনতে পাবে।’

আমি চোখ ছোট ছোট করে তাকালাম। লোকটা আমায় অপমান করছে?

‘আপনিকি কোনোভাবে এটা বলতে চাচ্ছেন যে আমি খুব উচ্চস্বরে কথা বলি?’

‘উহু। বলতে চাচ্ছিনা। অলরেডি সেটাই বলেছি। আপনি বুঝতে একটু সময় বেশি নিয়ে ফেলেছেন।’

লোকটাকে দেখে প্রথমে খুব নর্ম ভদ্র শান্ত ছেলে মনে হলেও এখন বুঝলাম এটা মোটেই কোনো ভদ্র ছেলে না। অসভ্যের সর্বোচ্চ ডিগ্রি অর্জনকারী গিরগিটি এই লোক। ওপরে ভালোমানুষী পোশাক পরে থাকে কিন্তু নিচে নিচে আস্ত এক অসভ্য মর্কা রূপ। নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে কোনোরকম দাঁতে দাঁত চেপে বললাম,

‘আপনি কি জানেন আপনি একটা চরম অসভ্য লোক?’

ওপাশ থেকে উচ্চ হাসির শব্দ এলো। বুঝলাম না এখানে হাসির কি বললাম। আজব! লোকটার কি মাথায়ও কোনো রকম গন্ডোগোল আছে নাকি?

‘মিস! আপনি সবকিছু বুঝতে এত টাইম নেন কেন? আমারতো মনে হচ্ছে বিয়ে পর বাচ্চা কাচ্চা হওয়ার পর আপনি আমায় প্রশ্ন করে বলবেন বাচ্চটা কিভাবে আসলো? তখন কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারবো না বলে রাখরাম। শজ্জা বলেওতো কিছু একটা আছে তাইনা?’

কান গরম হয়ে এলো। যেন গরম ধোঁয়া বের হয়ে আসতে চাইছে। কি ভয়ংকর লোক ভাবা যায়? নির্লজ্জ ও বটে। এমন বেশরম কথা বলতে একটুও মুখে বাঁধলো না? কট করে কল কেটে দিলাম। রাগে, অপমানে, লজ্জায় হাত পা ছুড়ে কাঁদতে মন চাচ্ছে। আয়নার সামনে দাড়াতেই লক্ষ করলাম আমি ব্লাস করছি। গালে লাল রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে। আশ্চর্য! আমি লজ্জায় লাল নীল কেন হচ্ছি? এই অসভ্য লোকের অসভ্য কথায় লজ্জা পাওয়া মোটেই উচিত না। যেটা উচিত তা হলো রেগে যাওয়া। ভয়ংকার ভাবে রেগে যেয়ে এই মুহূর্তে ঐ বাড়িতে খবর পাঠানো উচিত যে এ বিয়েটা হচ্ছেনা। আমাদের মতো ভদ্র পরিবারের মেয়েকে এমন অসভ্য ছেলের হাতে কোনোভাবেই তুলে দেওয়া সম্ভব নয়। নিজের ভাবনায় সন্তুষ্ট হলাম। মুখের ভঙ্গি সিরিয়াস করে পা বাড়ালাম মায়ের রুমে। কোনো ভাবনা ছাড়া সোজা মায়ের সামনে যেয়ে দাড়ালাম। আমাকে এভাবে দেখে বাবা মা দুজনেই আমার দিকে তাকালো। আমি একবার মনে মনে কথা সাজিয়ে নিলাম। বড় করে শ্বাস নিয়ে বলে ফেললাম,

‘আমি এ বিয়েটা করতে পারবো না।’

বাবা মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করে আমার দিকে তাকিয়ে একসাথে প্রশ্ন করলেন,

‘কারণ?’

একসাথে বলায় প্রথমে ভরকে গেলেও পরে নিজেকে সামলে নিলাম। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে বললাম,

‘ছেলেটাকে আমার মোটেই সুবিধার ঠেকছে না। এমন একটা ছেলের সাথে আমি কোনোভাবেই সারাজীবন থাকতে পারবো না। ইম্পসিবল।’

আমার কথা শুনে বাবা মাথা নাড়ল।

‘হুম। বুঝলাম।’

আমি জানতাম আমার এ কথা কাজে লাগবে। নিজেকে নিয়ে বড্ড গর্ব হলো। ফুরফুরে মন নিয়ে বাবাকে বললাম,

‘তাহরে বিয়ে ক্যানসেল?’

‘অবশ্যই না। আদনান আমাকে আগেই বলেছে তোমার প্লান। তুমি বিয়ে না করে আইবুড়ো থাকার প্লান করেছো কি ভেবেছো এটা আমরা জানতে পারবো না? তোমার এসব ড্রামা কোনো কাজে আসবে না। আদনানের মতো একটা ছেলে হয়না। তোমার বিয়ে হবে এবং সেটা আদনানের সাথেই। এখন থেকেই প্রিপারেশন নাও। দুমাসের মাঝেই আদনান ফিরবে।’

আমি পুরোই তাজ্জব বনে গেলাম। এটা কি হলো? লাইক সিরিয়াসলি? এই লোক তার ভোলা ভাল া কথায় আমার বাবা-মা কেও ফাঁসিয়ে নিয়েছে। অসম্ভব দূরান্তর এই লোক। আর আমি? আমি কবে বললাম আইবুড়ো হয়ে থাকবো? পুরোই পাল্টিবাজ। এই লোককে আমি এমন শিক্ষা দিব সারাজীবনের মতো বিয়ে করার সখ মিটে যাবে।

_____________

বিস্কুটের বয়োম থেকে একটা বিস্কুট গালে পুরে চিবুতে চিবুতে রান্নাঘর থেকে বের হতেই মিতুকে দেখে চমকে গেল রাশেদ। এই অবেলায় এই মেয়ে এখানে কেন? কৌতুহল নিয়ে কাছে যেয়ে দাড়াতেই মিতু দৌড়ে এসে রাশেদকে জড়িয়ে ধরে সশব্দে কেঁদে ফেলল। এভাবে জড়িয়ে ধরায় অসস্থিতে পরলেও ছাড়িয়ে দিলো না। মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করলো। বাসায় কর কেউ নেই। রাকিব সেই সকালে বেড়িয়েছে। বাবা আমজাদ খান বাজারে গেছেন। আর বাকি রইলো মা রাহেলা। তিনি হয়তো পাশের বাসায় গল্প করতে গেছেন। ফাঁকা বাড়িতে একটা ছেলে মেয়ে এভাবে জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা বড্ড বেমানান। রাশেদ বুদ্ধিমান ছেলে। সে জানে এমনটা কারো নজরে পড়লে তা কতটা দূর গড়াবে। একহাতে মিতুকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই মিতু আরো আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরল। রাশেদ মিতুকে বোঝানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ক্রন্দনরত মিতু কিছুই বুঝতে চাইলো না। ঠিক তখনি আগমন ঘটলো বাসার কাজের মেয়েটার। তাদেরকে এ অবস্থায় দেখা মাত্র গগনবিদারী চিৎকার করে পুরো এলাকাকে জাগিয়ে তুলল। এমতাবস্থায় মিতুর কান্নাও থেমে গেল। চোখ পিটপিট করে চাইতেই রাশেদকে ছেড়ে কিছুটা দূরে দাড়ালো। চিৎকার করার কারণ বুজতে না পেরে সে ফ্যালফ্যাল চোখে রাশেদের দিকে তাকালো। রাশেদের দৃষ্টি শীতল স্বাভাবিক। একমনে মেঝেতে তাকিয়ে আছে। ইতিমধ্যে রাহেলাও চলে এসেছেন। সাথে এসেছে আরো কিছু মানুষ। রাহেলা দৌড়ে এসে রাশেদের পাশে দাঁড়ালেন। ব্যস্ত কম্পিত কন্ঠে জানতে চাইলেন,

‘কি হয়েছে? চিৎকার করলো কে? কোনো অঘটন ঘটেছে বাবু? তুই এভাবে দাড়িয়ে আছিস কেন?’

রাশেদ কোনো উত্তর দিলো না। কেবল শখন্ত দৃষ্টিতে মায়ের দিকে তিকালো। সে জানে এই মুহূর্তে তার কথা বলা আর না বলা সমান। এখানে তার বলা কথার থেকে দূরে মুখে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কাজের মেয়ের কথার দাম হবে বেশি। এতক্ষণে মিতুর কাছেও সবটা স্পষ্ট হয়ে গেছে। সবটা বুঝতেই তার চোখ ভেঙে আবারো জল বেরিয়ে আসলো। কতবড় অঘটন ঘটতে চলছে ভাবতেই মাথা নিচু করে ফেলল। রাশেদের কথা শোনা তখন তার উচিত ছিল। অশ্রুসিক্ত চোখে রাশেদের দিকে তাকাতেই তার মনে হলো রাশেদ উপর থেকে নিজেকে শক্ত খোলসে ঢেকে রাখলেও ভেতর থেকে সেও ততটাই ভয় পাচ্ছে যতটা সে নিজে পাচ্ছে। এখন কি সে একটু এগিয়ে যেয়ে রাশেদের পাশে দাঁড়াবে? মুষ্টিবদ্ধ ঐ হাতে হাত রেখে অভয় দিয়ে জানাবে এইতো আমিও আছি তোমার পাশে! আমরা একসাথে সমস্যার মোকাবেলা করবো। কোনো ভয় নেই। এইতো আমি আছি। ঠিক তোমার পাশে।

চলবে……….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে