#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৫.
—————
লাইব্রেরির এককোণে একা বসে হুমায়ূন আহমেদের অপেক্ষা উপন্যাসটি পড়ছি। এই নিয়ে সপ্তমবার আমি উপন্যাসটা পড়লাম। তবুও যেন প্রত্যেক লাইনে থাকে অসীম আগ্রহ। কেন যেন এই উপন্যাসটা আমার ভেতরটা খুব কাঁদায়। উপন্যাসটা পড়তে পড়তে অশ্রু বিসর্জন দিচ্ছিলাম। ঠিক তখনি কেউ যেন আমার সামনে একটা সাদা রুমাল এগিয়ে দিল। উক্ত ব্যক্তির দিকে তাকাতেই আমি হতভম্ভ, বিমুঢ়। এটা সত্যিই রাশেদ ভাই। তাকে এর আগে কখনো লাইব্রেরিতে দেখা যায়নি। এ যেন অমাবস্যার রাতে চাঁদের দেখা মেলার মতো ঠেকলো। মন আমার তখন আকাশ ছুঁই ছুঁই। এ যেন অন্যরকম ভালোলাগা। বুঝলাম প্রেমে পড়ে মন আমার বড্ড ছেলেমানুষী হয়ে গেছে। এই যে রাশেদভাই আমার চোখের জল মুছতে রুমাল এগিয়ে দিল এ সামান্য ব্যাপারটা আমার হৃদয় নিতে পারছে না। কেমন অস্বাভাবিক ভাবে বুক কাঁপছে। হাত ও কিছুটা কাঁপছে বোধহয়। এ অনুভূতিকে আমি কিভাবে লুকাবো? নিজেকে দেখে উপহাস করতে মন চাচ্ছে। যখন আকাশ কুসুম ভাবনায় বিভোর ছিলাম ঠিক তখনই আমার মাথায় আসলো রাশেদ ভাইতো কলেজে আসা বন্ধ করে দিয়েছিলো তবে আজ কেন? প্রশ্নবিদ্ধ চোখে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকাতেই সে যেন আমার না বলা প্রশ্ন বুঝে নিল। আমার পাশের চেয়ার টেন তাতে গা এলিয়ে দিলো। চোখ বন্ধ রেখেই বলল,
‘তোর বাপ চাচারা বড্ড বিরক্তিকর মিনি। তাদের অত্যাচার আমার উপর দিনকে দিন বেড়েই চলছে। ভেবেছিলাম কোনো একদিকে চলে যাব কিন্তু হাতে টাকা নেই। টাকা গুছানো পর্যন্ত তাই তাদের সহ্য করতে হবে। বাড়িতে থাকলে সারাক্ষণ কানের কাছে মাছির মতো ভনভন করবে তাই ভাবলাম অনার্স টা শেষ করেই ফেলি। সো কলড সার্টিফিকেট ও হবে আর তোর বাপ চাচাদের ভনভন শোনা থেকেও কয়েক ঘন্টার জন্য মুক্তি মিলবে।’
হাহ! এই মানুষটাকে বোঝানোর মতো ভাষা আমার কাছে নেই। যে বুঝেও বুঝতে চায়না তাকে কিভাবে বোঝাবো? আমরা সকলে তার একটা সুন্দর ভবিষ্যৎ চাই। কিন্তু এটা বুঝতেই চায়না সে। ইতিমধ্যে লাইব্রেরি রুমে মেয়েদের ভীর জমেছে। যেন মেলা বসেছে এখানে। কয়েকটা মেয়ে বই পড়ার অযুহাতে রাশেদ ভাইয়ের পাশে চেয়ার টেনে বসলো। তারা পড়ছে কম দেখছে বেশি। বিষয়টা আমার হজম হচ্ছে না। সহজ ভাবে বলতে গেলে আমি জ্বলছি। ভিষণ ভাবে জ্বলছি। পড়ার জন্য অন্য কোনো টেবিল নেই? এখানেই কেন বসতে হবে? আমি কোনভাবে রাগ চাপিয়ে রাশেদ ভাইকে বললাম,
‘উঠেন এখানে আপনার কোনো কাজ নেই। ঘুমাতে হলে বাসায় গিয়ে ঘুমান। লাইব্রেরিতে মানুষ পড়তে আসে ঘুমাতে না।’
রাশেদ ভাই চোখ খুলে তাকিয়ে আবারো চোখ বন্ধ করে নিল। এখান থেকে ওঠার ইচ্ছে নেই তার সেটাই বোঝাতে চাইলো। কিন্তু আমি এত সহজে কেন হাল ছেড়ে দিব? এই যে মেয়েগুলো চোখ দিয়ে তাকে গিলে খাচ্ছে এটাতো মোটেই মেনে নেওয়া যায় না। একজন লয়াল প্রেমিকা হিসেবে আমার দায়িত্ব রাশেদভাইকে এসকল কুনজর থেকে রক্ষা করা। আমি সেটাই করবো। আমি এবার কোন কথা ছাড়া রাশেদ ভাইয়ের হাত ধরে টেনে তুললাম।
‘তোর শরীর ঠিক আছে মিনি? এভাবে হাত ধরে টানাটানি কেন করছিস? কোনো ছেলের হাত ধরে টানাটানি করা মোটেই ভালো লক্ষণ না। হাত ছাড় বলছি।’
বিমর্ষ চোখে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। লাইব্রেরিতে থাকা সকলে তখন রাশেদ ভাইয়ের কথায় তীব্র হাসিতে ফেটে পরেছে। তীব্র দুঃখ, অপমানে বাক্যহারা হয়ে গেলাম। এমনটা নয় যে এই প্রথম আমি তার হাত ধরলাম। এর আগেও ধরেছি বহুবার। তখনতো এমন বলেনি। আজ কেন এত মানুষের সামনে এভাবে অপদস্থ করলো? কোন কথা ছাড়া বেরিয়ে এলাম। আজ আর কোনো ক্লাস করার মানসিকতা নেই। সোজা কলেজ থেকে বের হয়ে এলাম। রাশেদ ভাইয়ের করা এ সামান্য অপমান আমার মন নিতে পারছে না। ইতিমধ্যে রাশেদ ভাই ও এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছে।
‘রিকশা ঠিক করে দিব? বাড়ি যাবি?’
‘আমি একাই করে নিব। আপনাকে ভাবতে হবে না।’
আমি আর রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম না। কেন যেন মনে হচ্ছে তার দিকে তাকালেই আমি কেঁদে ফেলবো। কিন্তু তার সামনে আমি কাঁদতে চাইনা। একদমই না। ইতিমধ্যে রাশেদ ভাই একটা রিকশা ঠিক করে তাতে চেপে বসেছেন। রিকশা আমার সামনে এসে থামতেই রাশেদ ভাই হাত বাড়িয়ে দিলেন।
‘উঠে আয়।’
আমার ভিষণ রাগ হলো। ইচ্ছা হলো এই হাতটাকে কেটে ময়লা পানিতে ছুড়ে ফেলতে। কিছুক্ষণ আগে এই হাত ধরা নিয়েই আমায় কথা শুনিয়ে এখন আবার নিজ থেকেই হাত বাড়িয়ে দিচ্ছে। হাজার অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি কেন যেন তার বাড়িয়ে দেওয়া হাত ফিরিয়ে দিতে পারলাম না। এটাই প্রথম আমার রাশেদ ভাইয়ের সাথে একই রিকশায় ভ্রমন। আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছে। বৃষ্টি হলে বেশ ভালো হতো। উপলব্ধি করলাম আমার মন খুব বেশিই ফুরফুরে লাগছে। এমন প্রেমময় পরিবেশে ভালোলাগার মানুষটার সাথে একসাথে রিকশা ভ্রমন আমার প্রেমি হৃদয়কে প্রেমময় বৃষ্টিতে সিক্ত করে তুলছে। আবেশে বন্ধ হয়ে এলো চোখ। উপলব্ধি করলাম সময়টা খুব বেশিই স্পশাল।
বাসায় এসে লম্বা শাওয়ার নিলাম। মা আমাকে সুন্দর দেখতে গোলাপি রঙের একটা শাড়ি দিয়ে গেছে পড়ার জন্য। শাড়িটা আমার হবু শশুর বাড়ি থেকে পাঠানো হয়েছে। শাড়িটা বেশ সুন্দর। আজ ও বাড়ি থেকে আমায় দেখতে আসবে। শুনেছি ছেলে দেশের বাইরে থাকে। মাস ছয়েক পর দেশে ফিরলে তখন বিয়েটা হবে। এই ছয় মাস ই আমার জন্য যথেষ্ট। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও শাড়ি পড়ে হালকা সাজলাম। আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেই প্রশংসা করলাম। সত্যিই শাড়িটা বেশ মানিয়েছে। ওবাড়ি থেকে লোক আসতে আসতে দুপুর গড়িয়েছে। তারা আবার সন্ধ্যার পরপরই ফিরে গেছেন। সকলে বেশ মিশুক। আমাকে যেন তারা নিজেদের একজন ভেবে নিয়েছেন। আমার বেশ খারাপ লাগছে। এই মানুষগুলো কখনোই আমার পরিবার হতে পারবে না যে! আমার দুনিয়াতো কেবল আমি রাশেদ ভাইকে নিয়ে সাজিয়েছি। যেখানে এই মানুষগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই।
______________
এক পশলা বৃষ্টি শেষে পরিবেশ এখন বেশ শিতল। এত ঠান্ডার মাঝেও ফুল স্পিডে ঘু্রে চলছে রাশেদের রুমের বৈদ্যুতিক পাখাটা। অবিরাম ভাবে ঘুরতে থাকা পাখাটার যেন কোনো ক্লান্তি নেই। পাখার ক্যাটক্যাট শব্দ নিশ্চুপ পরিবেশকে ভারী করে তুলছে। কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে রাশেদ বইয়ের পরবর্তী পাতা উল্টালো। দীর্ঘ দু ঘন্টা যাবত বইয়ের পাতা উল্টে চলছে সে। কোনো ভাবেই বইয়ের মাঝে মনোনিবেশ করতে পারছে না। বারবার ঘুরেফিরে মিতালিতেই যেন মন বাধা পড়ছে। বাস্তবিক ভাবে দেখতে গেলে মিতিলি খুব সাধারণ একটা মেয়ে। প্রথম দেখায় প্রেমে পড়ার মতো না হলেও মায়াবি চোখের মায়ায় আটকে পড়াটা খুব স্বাভাবিক। তার থেকেও বড় কথা রাশেদ কখনোই মিতালিকে অন্য নজরে দেখেনি। ছোট থেকেই বড় ভাইয়ের মতো আগলে রেখেছে। কিন্তু কে জানতো এই পরিণত বয়সের মিতালি তার মনে প্রেমের জোয়ার বয়ে আনবে? ব্যাকুল করে তুলবে হৃদয়কে? এক দম বন্ধকর অবস্থায় ফেঁসে আছে সে। কোনো ভাবেই নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। বুকের ভেতরটা কেমন অশান্ত হয়ে আছে। মাথায় সর্বদা মিতালি নামের মেয়েটা কলরব করে চলছে। রাশেদ চায়না তার মনকে প্রশ্রয় দিতে। মিতালি মেয়েটা ভালো। ওর সুন্দর একটা ভবিষ্যত আছে। তার সাথে মিতালি কখনোই সুখি হবে না। সে চায়না তার সাথে জড়িয়ে মিতালির সুন্দর জীবনটাকে ন্ষট করে দিতে। সে বোঝে মিতালির চোখের দৃষ্টি। যা বারবার প্রমাণ করে দেয় তার প্রতি মিতালির দুর্বলতা। সবটা বুঝেও রাশেদ বারবার সে আকুতি ভরা চোখকে অগ্রাহ্য করে চলছে। কিন্তু কতদিন? এরতো একটা শেষ চাই।
চলবে……….