#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি
৪.
——————
টিমটিম সন্ধ্যা তারা জ্বলছে আকাশে। মেঘের আড়ালে চাঁদ ঢাকা পড়েছে। কিছু সময় পরপর মেঘের আড়াল থেকে উঁকি দিয়ে নিজের অস্তিত্বকে জানান দিচ্ছে যেন সে। ছাদে দাঁড়িয়ে চাঁদ মামার হাইড এন্ড সিক খেলা দেখছিলাম। ঠিক তখনি আগমন ঘটলো রাশেদ ভাইয়ের। নিঃশব্দে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে একইভাবে আকাশের দিকে মুখ করে দাঁড়াল। আমি না তাকিয়েও বুঝে নিয়েছি মানুষটাকে। তার গায়ের কড়া পারফিউম নাকে এসে ঠেকছে। পারফিউমটা বেশ মিষ্টি। কেমন মাতাল করা ঘ্রাণ।
‘মিনি?’
‘হুম’
‘চকলেট খাবি? বেশ টক। একদম তোর মতো।’
রাশেদ ভাইয়ের কথা শুনে হাসলাম। সবাই সবাইকে মিষ্টি, ফুল এসবের সাথে তুলনা করে। সে আমায় টক উপমা দিল। কিন্তু এতেও আমি বেশ খুশি। যদিও টকটা আমার একদমই পছন্দ না কিন্তু রাশেদ ভাইয়ের পছন্দ। তাই তার দেওয়া এই উপমাটাও আমার পছন্দ হলো।
‘মিনি?’
আমি কোনো উত্তর না দিয়ে তার দিকে ঘুরে দাড়ালাম। রাশেদ ভাইয়ের দৃষ্টি আমার দিকেই। কেমন অদ্ভুত ঠেকলো সে দৃষ্টি। আমি সে দৃষ্টিতে তাকাতেই রাশেদ ভাই যেন চমকে উঠলেন। কোনো অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটলে যেমনটা ঠিক তেমন ভাবে। কয়েকবার চোখের পাতা ঝাপটে অন্যমনস্ক দৃষ্টিতে বললেন,
‘ তোর যদি কোনো সমস্যা থেকে থাকে আমাকে বলতে পারিস। এভাবে দরজা বন্ধ করে বসে থেকে বাকি সবাইকে চিন্তায় ফেলার কোনো মানে হয়না। প্রেম ঘটিত ব্যাপার হলেও বলতে পারিস। ভয়ের কিছু নেই। সমাধান করার চেষ্টা করবো।’
একবারে এতটা বলে নিঃশ্বাস ছাড়লো রাশেদ। কোনো অজানা কারণে বুকের ভিতর তীব্র এক অস্বস্থি দানা বেঁধেছে। পা দূটো কাঁপছে অস্বাভাবিক ভাবে। যেন দাঁড়িয়ে থাকতে অক্ষম তারা। বিশ্রাম চাই তাদের। রাশেদ আর দাঁড়াল না। আর না দ্বিতীয়বার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা রমণীর দিকে তাকানোর সাহস করলো। অগোছালো এলোমেলো পায়ে এক প্রকার পালিয়ে এলো ছাদ থেকে।
——————
ঝমঝমে বৃষ্টি থেমে এসেছে প্রায়। থেমে থেমে ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি হচ্ছে। কলেজ গেটের সামনে দাঁড়িয়ে রিকশার জন্য দাড়িয়ে আছি। এক ঘন্টার মতো হলো তবুও কোনো রিকশার হদিস নেই। বৃষ্টির সময় এই একটা সমস্যা। রিকশার দেখা মেলা দায়। দু একটা যা দেখতে পাওয়া যায় তাদের চাহিদা আকাশ সমান। ন্যায্য ভাড়ায় রিকশা পাওয়া আকাশের চাঁদ হাতে পাওয়ার সমান।
কলেজের সামনের চায়ের দোকানে বসে চা খেতে খেতে মিতালির বিরক্ত হওয়া দেখছিল রাশেদ। তার মতে মেয়েদের সব থেকে সুন্দর লাগে যখন তারা রেগে যায় কিংবা কপাল কুঁচকে চোখ মুখ গম্ভীর করে রাখে তখন। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে এমন সুন্দর দৃশ্য দেখার মধ্যে আলাদা রকম প্রশান্তি রয়েছে। চার নম্বর চায়ের কাপে শেষ চুমুক বসিয়ে উঠে দাঁড়ালো রাশেদ। দোকানদারকে উদ্দেশ্য করে মিষ্টি হেসে বলল,
‘মামা খুচরা টাকা নেই সাথে। হিসাবের খাতায় তুলে রাখেন। মাসের শেষে বাপ দিয়ে যাবে টাকা।’
দোকানদার লোকটাও লাল দাঁত বের করে হাসলেন। চার কাপের জায়গায় সে পাঁচ কাপ চায়ের দাম খাতায় তুলে রাখলেন। এভাবে আরো কয়েক কাপ বাড়িয়ে লিখলে মাস শেষে বেশ টাকা লাভ হবে। রাশেদ আড়চোখে সবটাই দেখলো। কিন্তু কিছু বললো না। কথায় আছে চোরের দশ দিন গৃহস্থের একদিন। একদিন ঠিক এর কারসাজি ধরে আচ্ছা মতো টাইট দেওয়া যাবে।
রিকশার জন্য দাড়িয়ে থাকতে থাকতে অধৈর্য হয়ে শেষ পর্যন্ত বৃষ্টিতে ভিজেই বাড়ি ফেরার পরিকল্পনা করলাম। ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিত হবে রাশেদ ভাই তার বিখ্যাত বাইক নিয়ে হাজির হলেন সামনে। ব্যাপারটা আমার অনেকটা বাংলা সিনেমার মতো মনে হলো। কিছু সময়ের জন্য নিজেকে বাংলা সিনেমার নাইকা ভেবে লাজুক দৃষ্টি নিয়ে রাশেদ ভাইয়ের দিকে তাকালাম। কিন্তু তাকানো মাত্রই রাশেদ ভাইকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে থাকতে দেখে বিব্রত হলাম। মুখ খুলে কিছু বলতে নিব তার পূর্বেই রাশেদকে বললেন,
‘উঠে বস। নামিয়ে দিয়ে আসছি। আর ভুলেও আমাকে তোর হিরো ভেবে জড়িয়ে ধরবি না। তাহলে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দিবো। কাঁধে হাত রেখে শক্ত করে বোস।’
মোন খারাপ হলো বেশ। এভাবে বলল? আমি কি একবারও তাকে বলেছি আমাকে পৌঁছে দিতে? নিজেই তো এলো। এখন আবার হুমকিও দিচ্ছে। ভাবনার মাঝেই আবারো রাশেদ ভাই ধমক দিলেন। ভাবনা বাদ দিয়ে চুপচাপ বাইকে উঠে বসলাম। খুব সতর্কতার সাথে তার থেকে কিছুটা দূরত্ব রেখে বসেছি। মনে মনে বললাম,’একান্তই ঠেকেছি বলে বাইকে উঠলাম। নয়তো আপনার বাইকে উঠতে আমার বয়েই গেছে।’
_____________
নাজিয়া বেগম ব্যস্ততার সাথে চুলায় চা চাপিয়েছেন। ফ্রিজ থেকে মিষ্টি বের করে প্লেটে সাজিয়েছেন। মিতালির জন্য সম্বন্ধ এসেছে। বেশ বড় বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব এসেছে। পাত্র ও শিক্ষিত। তাছাড়া মেয়ের ও বিয়ের বয়স হয়েছে। ভালো পাত্র হাতে থাকতে দেড়ি করবার কি আছে? চাহিদা থাকতে মেয়েকে সুপাত্রের হাতে তুলে দিলে চিন্তামুক্ত। সব মায়েরাই চায় মেয়েকে ভালো পরিবার দেখে বিয়ে দিতে। নাজিয়া বেগম ও তার বিপরীতে নয়।
বাড়ি ফিরতেই মাহিন মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে আমার রুমে হাজির। আমি একবার ওর দিকে তাকিয়ে জামাকাপড় হাতে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে বললাম,’আমি মিষ্টি খাব না। আমার ভাগেরটা তুই খেয়ে নে। এখন রুম থেকে দূর হ।’
পড়নের কাপড় রাস্তায় জমে থাকা পানির ফলে অনেকাংশ ভিজে গেছে। অল্প সময়ের মাঝেই গোসল শেষ করে বের হলাম। মাহিন আমার রুমের খাটের উপর বসে মিষ্টির প্যাকেটটা নাড়াচাড়া করে দেখছে খুব মনোযোগ সহকারে। চুলের পানি মুছতে মুছতে ওর পাশে বসলাম।
‘এখনো এখানে বসে আছিস কেন?’
আমার কন্ঠ শুনতেই মাহিন লাফ দিয়ে ওর হাতে থাকা মিষ্টির প্যাকেট আমার হাতে ধরিয়ে দিল। আমি চোখ কুঁচকে তাকাতেই সামনের ফাঁকা মাড়ি বের করে হাসলো।
‘তোমার বিয়ের মিষ্টি তাই তোমাকে খেতে দিলাম। নয়তো সবকটা আমি খেয়ে নিতাম।’
ওর কথা বুঝতে না পেরে আমি বোকা মুখ করে তাকালাম। ও এবার লাফ দিয়ে আমার পাশে এসে বসলো। আস্তে আস্তে আমার কানের কাছে এসে বলল,
‘আজ তোমার জন্য বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। ইয়ে বড় বাড়ি থেকে। মা বলেছে তারা অনেক বড়লোক। তোমাকে জানাতে মানা করছে। কিন্তু তাও বললাম। তুমি আবার মা কে বইল না।’
আমি কোনো কথা বললাম না। চুপচাপ উঠে জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালাম। অসহায় লাগছে নিজেকে। এ বিয়েটা যে আমি করতে পারবো না! কি কি বলবো মাকে? আমি রাশেদভাইকে ভালোবাসি এটা বলবো? কিন্তু তাতেকি কোনো লাভ আছে? রাশেদভাই কি আমায় ভালোবাসে? আমার যে সময় দরকার। সবটা ঠিক করার জন্য সময় দরকার। ঠিক ততটা সময় যতটা সময়ে আমি আমার অনুভূতি তাকে জানাতে পারবো। তার সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে বলতে পারবো ভালোবাসি। ততটা সময় দরকার যতটা সময়ে আমি বুকে সাহস নিয়ে বলতে পারবো চলেন না পালিয়ে যাই! এত বড় পৃথিবীতে আমাদের ছোট্ট একটা সংসার গড়ার জায়গা ঠিক পেয়ে যাব। ব্যাস এতটুকু সময় হলেই হবে আমার।
___________
রাত আনুমানিক কত হবে হিসাব করা গেল না। চারদিকে ঝিঁ ঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে। তার সাথে তাল মিলিয়ে মশারা মিছিল নামিয়েছে যেন। সিগারেটের প্যাকেটে থাকা অবশিষ্ট একটা সিগারেট ও শেষ। আরো এক প্যাকেট হলে ভালো হতো। রাশেদ টান টান হয়ে ভেজা ছাদের মাঝেই শুয়ে পড়লো। বুকের ভেতরকার তুফান সামলাতে ব্যর্থ সে। এমন পরিস্থিতিতে কিভাবে নিজেকে সামলাতে হয় তা তার জানানেই। এই প্রথম সে এমন অনুভূতির স্বিকার। আচ্ছা এই অনুভূতির কি কোনো নাম দেওয়া যায়? রাশেদ চোখ বন্ধ করে নিল। বড় করে শ্বাস নিয়ে আনমনে বলল,’মিনি! তুই অন্যকারো হবি ভেবেই কি এই অস্থিরতা?’
চলবে….