মনের ক্যানভাসে পর্ব-০৩

0
732

#মনের ক্যানভাসে
#লাবিবা_আল_তাসফি

৩.
____________

ঘড়িতে সময় দুপুর দেড়টা। জানালা থেকে সূর্যের রঙিন আলো এসে পড়েছে ঘরের মেঝেতে। কিছু আলো এসে পড়েছে দেয়ালে টাঙ্গানো রাশেদ ভাইয়ের বড় ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটায়। উজ্জ্বল মুখখানির উপর রোদের আলো যেন ঝলমল করছে। দৃষ্টি থমকালো সেই সুদর্শন মুখখানির উপর। কে বলবে এই অতিব সুদর্শন ছেলেটা এমন ছন্নছাড়া? হতাশ চিত্তে কাজে হাত লাগালাম। পড়ে থাকা শেষ শার্টটা ভাজ করে কাবার্ডে তুলতেই ওয়াশরুমের দরজা ঠেলে বেরিয়ে এলো রাশেদ ভাই। তার পরিহিত ধূসর রঙের গেঞ্জিটার অনেকাংশই পানিতে ভিজে গেছে। চুল থেকে টুপটাপ জলকণা ঝরে ভিজিয়ে দিচ্ছে পরিহিত পোশাক। কপালে থাকা জলরাশি গুলো সূর্যের আলোয় মুক্তোর মতো জ্বলছে। এই মুহূর্তে সময়টা থেমে গেলে কেমন হতো? কে-ড্রামার মতো যদি এই মুহূর্তে আমি সময়কে কন্ট্রোল করতে পারতাম তবে অবশ্যই এই সময়কে থমকে দিতাম। আলতো হাতে ছুঁয়ে দিতাম রাশেদ ভাইয়ের কপালের মুক্ত দানাগুলোকে। হঠাৎ করেই হাতে থাকা টাওয়ালটা আমার দিকে ছুড়ে মেরে বেডে ধুপ করে বসে পড়লো রাশেদ ভাই। হঠাৎ এমন হওয়ায় প্রথমে কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও কিন্তু পরক্ষণেই সামলে নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমার রেগে যাওয়ার কথা ছিল। রেগে দু চারটা কথা শুনিয়ে দরজা ধুপ করে আটকে এখান থেকে প্রস্তান নেওয়ার কথা ছিল। আমার জন্য এগুলো অতিব সাধারণ ছিল। কিন্তু আমি তেমন কিছুই করলাম না। রাশেদ ভাই অবাক হলেন বুঝি। আমার দিকে তাকিয়ে কপাল কুচকালেন। বুঝতে চাইলেন বোধহয় আমার পদক্ষেপ। আমি তখনও নিষ্পলক তাকিয়ে। আমাকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে অপ্রস্তুত ও হলেন বোধহয়। পরিবেশ ঠিক করতে সে সবসময়ের মতো দুষ্টু হেসে আমাকে লজ্জায় ফেলতে বললেন,’ তোকে বউ বউ লাগছে মিনি। খুব শীঘ্রই তোর বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। আর কতদিন আমাদের ঘাড়ের উপর থাকবি?’

আমি কোনো প্রতিউত্তর করলাম না। আমাকে চুপ দেখে রাশেদ ভাই আবারো অবাক হলেন। আজ যেন তার অবাক হওয়ার দিন। কিন্তু আমি তাকে আরো অবাক করে দিয়ে টাওয়েল হাতে এগিয়ে এলাম। আলতো হাতে অগোছালো ভেজা চুলগুলোকে মুছে দিলাম। রাশেদ ভাই কিছু বলতে চেয়েছিলেন বোধহয়। কিন্তু পারলেন না। শান্ত নিশ্চল চোখে কেবল দেখে গেলেন আমার কাজ। আমি তার সে শীতল দৃষ্টিতেও দৃষ্টি মিলিয়েছিলাম। কেন করেছিলাম জানিনা। তবে ঐ দৃষ্টি আমার মনের দুয়ারে কড়া নেড়েছে প্রবল ভাবে। চুল মোছা শেষ হতেই রাশেদ ভাই ব্যস্ত পায়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি হতবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এভাবে চলে যাওয়ার কারণ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলাম না। তবে নিজের করা কাজের জন্য নিজের উপর প্রচন্ড বিরক্ত হলাম। সাথে একঝাঁক লজ্জাও জায়গা করে নিলো মুখশ্রীতে। আর দেরী করলাম না। কাউকে না জানিয়েই বাসায় ফিরে এলাম। এরপর টানা দুদিন আমি খাওয়া ছাড়া রুমের বাহির হইনি। অনুভূতি এমন যেন বাহির হলেই সকলে আমার লজ্জার কারণ বুঝে নিবে। সকলের দৃষ্টি থেকে লজ্জাকে লুকিয়ে রাখতে নিজেকে পুরোপুরি আড়াল করে নিয়েছিলাম দুদিন। কিন্তু আমার করা এ কাজটা বিশাল এক ঝামেলা বয়ে আনলো। হঠাৎ এভাবে নিজেকে আড়াল করায় মা খুব চিন্তায় পড়ে গেলেন। তিনি ভেবে বসেছেন নিশ্চই প্রেমে বিরহ জনিত কারণে আমি এমন আচরণ করছি। একমাত্র মেয়ে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে দেবদাসি হয়ে যাচ্ছে মা হয়ে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না। মা হয়ে মেয়ের কষ্ট সে কিভাবে সহ্য করবে? ইতিমধ্যে মায়ের কল পেয়ে কিশোরগঞ্জ থেকে ছোট মামা ছুটে এসেছেন। রাশেদ ভাইয়েরা সকলেও সকাল সকাল এসে উপস্থিত হয়েছেন। বাবা কাজের সূত্রে নারায়ণগঞ্জ অবস্থান করছেন। কাজ ফেলে ছুটে আসা তার সম্ভব হয়নি। তবে মিনিটে মিনিটে কল করে আপডেট জেনে নিচ্ছেন। কি একটা বাজে অবস্থা। বর্তমানে আমি লিভিং রুমে আসামির ন্যায় সকলের সামনে বসে আছি। কাকা নিশ্চুপ হয়ে বসে আছেন। চোখে মুখে গম্ভীরতা বিরাজমান। তার পরিবারের মেয়ে প্রেম জনিত কারণে পাগলাটে আচরণ করছে এটা তার কাছে খুবই লজ্জাজনক ব্যাপার। মা কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে মুখে আচল গুজে গুনগুনিয়ে কাঁদছেন। পাশেই কাকিমা দাঁড়িয়ে মাকে শান্ত হতে বলছেন। সোফার একপাশে রাশেদ ভাই বসে ফোনে ভিডিও গেম খেলছেন। এই মানুষটার যেন কোনো কিছুতেই মন নেই। সে তো নিজের দুনিয়ার মানুষ। এ দুনিয়ার খোঁজ রাখার সময় কোথায় তার? তাকে দেখা মাত্র এক সুন্দরী রমনীর বুকে বেজে ওঠা দামামার শব্দ কি সে শুনতে পাচ্ছে? সে কি জানে এই দুটোদিন তাকে দেখার জন্য মোন কতটা ব্যাকুল হয়েছিলো? না! সে জানেনা। জানার কথাও না। হঠাৎ-ই মন ভিষণ খারাপ হলো। শ্রাবণের মেঘের মতো একরাশ কালো মেঘ ঘিরে ধরলো আমায়। বুকে কোথায় একটা সূক্ষ্ম চিনচিনে ব্যথা অনুভব হলো। মোন ভাঙার তীব্র কষ্ট অনুভব করতে পারছি যেন। ভেজা নয়ন ঘুরিয়ে তাকালাম মানুষটার দিকে। কতটা নিশ্চিন্তে বসে গেম খেলছে! মানুষটা কি কখনো সত্যিই আমার অনুভূতিকে বুঝবে?

‘হ্যা রে আমার ভাগ্নি হয়ে কিনা তুই সেকা খেয়া বেকা হয়ে বসে আছিস? আমার ভাগ্নিকে হতে হবে স্ট্রং। শ খানেক ছেলেকে একসাথে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাতে না পারলে সুন্দরী হওয়াই বেকার। আর তুই? আমার সম্মানটাতো রাখবি নাকি?’

কৌতুহল দমাতে না পেরে অবশেষে ছোটমামা মুখ খুলল। আমি গোলগাল চোখে মামার দিকে তাকালাম। মামাও যেন নিজের ভুল বুঝতে পারলো। তৎক্ষণাৎ সে টেবিলে থাকা পায়েসের বাটি হাতে নিয়ে দু চামচ পায়েস মুখে পুরে নিলো। ছোটমামা বেশ রশিক মানুষ। অল্প বয়স হওয়ায় মামার সাথে আমার বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। তবে ভুল সময়ে ভুল কথা বলার বাজে রকম অভ্যাস রয়েছে মামার। এ কারণে বাবার সাথে মামার খুব একটা মেলেনা। সাপে নেউলে সম্পর্ক তাদের। দুজন সামনাসামনি হলেই তর্ক বিতর্ক শুরু হয়ে যায়। আজ বাবা নেই বলে পরিবেশ এখনো শান্ত। নয়ত এতক্ষণে হয়তো মামা আমাদের বাড়ির গেটের বাহিরে থাকতো।
কাকা সোফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন। বুঝলাম এমন পরিস্থিতিতে তিনি প্রস্তান নিতে চান। তাই কাকা কিছু বলার পূর্বেই আমি মুখ থেকে আওয়াজ ছাড়লাম।

‘অযথা তোমরা কথা বাড়াচ্ছো। তোমরা যেমনটা ভাবছো তেমন কিছুই হয়নি। আমার সামনে এক্সাম। তাই নিজেকে পড়াশোনার মাঝে ব্যস্ত রাখছি। ব্যাস এটুকুই।’

এতক্ষণে মায়ের কান্না থামলো। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছে নাক টেনে জানতে চাইল,’দরজা কেন বন্ধ করে ছিলি? এমনটা আর কখনো করবি না।’

আমি মেনে নিলাম। কাকা তখনি বাজারের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেলেন। বাজারে তার চালের গোডাউন আছে দুটো। ব্যাবসা খুব ভালো হয়। কাকার বয়স হয়েছে। একা সামলাতে কষ্ট হয়। রাশেদ ভাইকে অনেকবার বলেছে দায়িত্ব নিতে। কিন্তু সে কিছুতেই এ দায়িত্ব নিতে রাজি হয়নি। এসব ব্যাবসায় তার আগ্রহ নেই। সে তো মুক্ত পাখির মতো ছুটতে চায়। দায়িত্বের বোঝা ঘাড়ে নিলে কি আর ছুটতে পারবে? তার এমন ছন্নছাড়া কাজের জন্য কাকা তাকে দু মাস হাত খরচ দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। কিন্তু তাতে লাভের কিছুই হয়নি। বরং কাকার নাক কাটা গেছে। রাশেদ ভাই কাকার পরিচিত লোকদের কাছ থেকে কাকার নাম করে নিজের হাত খরচের টাকা ধার হিসেবে নিয়ে নিয়েছিলো। এরপর কাকা আর কখনো এ ব্যাপারে রাশেদ ভাইয়ের সাথে কথা বলেননি। পড়াশোনাটাও ছেড়েছে আজ কিছুদিন হলো। এসব পড়াশোনা তার আর ভালো লাগে না। এটা একটা বাড়তি প্যারা। তার মতো বুদ্ধিমান মানুষ এমন বাড়তি ঝামেলা কেন বহন করবে? কোনো প্রশ্নই আসে না। এমন ছন্নছাড়া, কেয়ারলেস মানুষটাকে কি করে মনে জায়গা দিলাম ভাবতেই রাগ হয়। এই মানুষটা কি আদেও ভালোবাসার যোগ্য?

চলবে……..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে