মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-৩৪ এবং শেষ পর্ব

0
1449

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#অন্তিম_পাতা [ প্রাপ্তমনস্কদের জন্য ]

” মামী ভালো নেই, তাই না ইরহাম? ”

আঁধার রাতে অর্ধাঙ্গীর মুখে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে যথেষ্ট চমকালো ইরহাম! ঘুরে দাঁড়ালো সে। বেলকনির দ্বারে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে হৃদি। ম্লান বদনখানি। কি হয়েছে ওর? ধীরপায়ে হেঁটে স্বামীর ডান পাশে দাঁড়ালো মেয়েটি। ইরহাম কিছুটা অনুধাবন করতে পারলো কি! তাই বোধহয় নীরব রইলো। সময় দিলো ওকে। নিজেকে সামলিয়ে সে নিশ্চয়ই বলবে সবটা। তাই হলো। কিছুক্ষণ বাদে স্বামীর দিকে ঘুরে তাকালো হৃদি। মলিন স্বরে বলতে লাগলো,

” মামীর নিমন্ত্রণে আজকে ও বাসায় গিয়েছিলাম। আমি, ইনু। ভাবতে পারিনি হাসিখুশি যাচ্ছি আর ফিরবো এতখানি হতাশা নিয়ে। ”

অপ্রসন্ন কণ্ঠে,

” মামা কি করে এমনটা করতে পারেন? ওনারা একসাথে এতগুলো বছর কাটালেন। বড় বড় দুই ছেলেমেয়ে আছে। এই বয়সে এসে উনি স্ত্রীর গায়ে হাত তোলার মতো অপকর্ম করছেন! কি করে? আর মামি? উনিওবা কেন মুখ বুজে সহ্য করছেন? প্রতিবাদ করছেন না কেন? ”

স্ত্রী হতে মুখ ফিরিয়ে বাহিরে তাকালো ইরহাম। হতাশ কিন্তু কঠিন স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,

” সেই চিরাচরিত নারীসুলভ আচরণ। নারীজাতি বড় কোমলমতি হয়। এটারই অপব্যবহার করে কিছু জ’ঘন্য শ্রেণীর কাপুরুষ। মিস্টার জহির সেই কাপুরুষদের অন্তর্ভুক্ত। আজ থেকে নয়। বহু আগে থেকেই। ”

আশ্চর্যান্বিত হলো মেয়েটি! অস্ফুট স্বরে শুধালো,

” এসব কি বলছেন? ”

” এটাই সত্য। আনফরচুনেটলি ওই লোকটা আমার আপন মামা হয়। মানুষ নামের ক ল ঙ্ক। অনেকবার চেষ্টা করা সত্ত্বেও শুধরালো না। আজো পশুর মতো আচরণ করে। বউ পে টা য়।”

ঘৃণিত অভিব্যক্তি প্রকাশ করলো হৃদি। চোখের সামনে ভেসে উঠছে লোকটার নি-ষ্ঠুর রূপ। কি করে কেউ সহধর্মিণীর ওপর হাত তুলে পুরুষত্ব জাহির করতে পারে! ছিঃ! এরা তো পুরুষ রূপী আস্ত কাপুরুষ। পশুর চেয়েও অধম। ধিক্কার এদের মতো মানুষদের। বলার মতো ভাষা খুঁজে পাচ্ছেনা হৃদি। তাই নীরবতাকেই বেছে নিলো। কিছুক্ষণ পর অনুভব করলো স্বামীর দীর্ঘশ্বাস। বাহিরে এখনো দৃষ্টি নিবদ্ধ তার। মৃদু স্বরে বলে উঠলো,

” সামান্য কারণে তোমার সঙ্গে প্রথমবারের মতো মিসবিহেভ করেছিলাম সেদিন। একদিন তুমি জানতে চেয়েছিলে কেন অমন আচরণ করেছিলাম। বলতে পারিনি আমি। সুক্ষ্ম ভাবে বিষয়টা এড়িয়ে গিয়েছিলাম। কি করে বলতাম বলো? ওসব মুখ ফুটে বলার মতো কি? তবে আজ যখন টের পেয়েই গিয়েছো, বলছি তাহলে। ”

হৃদি অবাক নেত্রে তাকিয়ে! মানুষটা সত্যিই নিজে থেকে সেই রাতের কথা বলতে চাইছে! আসলেই তো কি হয়েছিল সেদিন? কেন অসদাচরণ করেছিলেন উনি? উনি তো শর্ট টেম্পারড্ কিংবা অস’ভ্য নন! তবে কি হয়েছিল সে মুহূর্তে? কেন হুট করে ক্রো ধে র ওপর নিয়ন্ত্রণহারা হলেন? মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় দাঁড়িয়ে হৃদি। তাকিয়ে স্বামীর পানে। সবটা শুনতে ইচ্ছুক সে।

” নির্বাচনী প্রচারণা চলছে তখন। প্রচুর ব্যস্ততা। দম ফেলার ফুরসত নেই। সন্ধ্যা রাতের দিকে একটু ফাঁক পেয়ে চায়ের দোকানে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ ফোন এলো। মোবাইল হাতে নিয়ে দেখলাম রায়না কল করেছে। অবাক হয়েছিলাম বটে। ও তো সাধারণত এমন অবেলায় কল করে না! তাহলে আজ! কিছুটা চিন্তিত হয়ে কল রিসিভ করলাম। রিসিভ করতেই শুনতে পেলাম ওর কান্না ভেজা কণ্ঠ। ”

এতটুকু বলে থামলো ইরহাম। শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরলো রেলিং। বদলে গেল অভিব্যক্তি। কঠোরতা প্রকাশ পাচ্ছে চোখেমুখে। হৃদি লক্ষ্য করলো তা। তবে কথোপকথনে ব্যঘাত ঘটালো না। অপেক্ষায় বাকিটা শোনার জন্য।

” সেদিনও সামান্য কারণে মামা পশুর মতো আচরণ করেছে। মামির গায়ে হাত তুলেছে কয়েকবার। বাচ্চা মেয়েটা ভয় পেয়ে আমাকে কল করলো। কাজকর্ম ফেলে ছুটে গেলাম আমি। মামির গালে পাঁচ আঙ্গুলের স্পষ্ট ছাপ। ঠোঁটের কোল ফেটে র ক্ত বের হচ্ছে। বিধ্ব-স্ত অবস্থা। রাগ সংবরণ করতে পারলাম না। তর্কাতর্কি হলো ওই লোকটার সাথে। ভেবেই নিয়েছিলাম ওইদিন ই জাহান্নাম থেকে মামীকে মুক্ত করে আনবো। তবে তা আর হলো কোথায়? বাঙালী নারী। স্বামীর মা`র খেয়ে খেয়ে ম রে যাবে তবুও স্বামীকে ত্যাগ করবে না। মামীও সেই অবলা শ্রেণীর নারী। মা`র খেয়ে করুণ অবস্থা তবুও স্বামীকে আমার হাত থেকে বাঁচিয়ে যাচ্ছিল। নিজের কাঁধে দোষ নিচ্ছিল। আর ওই ন-রপশুটা? ওর চোখেমুখে ছিল পৈ”শাচিক আনন্দ! ব্যস! সহ্য হলো না আর। প্রচুর রাগ নিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলাম। মনমেজাজ কোনোটাই ঠিক ছিল না। দপদপ করছিল কপালের রগ। ব্যর্থতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল। বারবার চোখের সামনে ভাসছিল ওই লোকটার বি শ্রী হাসি। তার পৈ-শাচিকতা! এরমধ্যে তুমি! ”

থেমে গেল মানুষটি। বিস্ময়ে বাকরুদ্ধ হৃদি! বাক্যগুলো মস্তিষ্কে হুঁ`লের ন্যায় ফুটছে যেন। ভাবতেই পারছে না চোখের সামনে আপনজনকে বিধ্ব-স্ত অবস্থায় দেখেও ব্যর্থ হবার দুঃখ ঠিক কতটা যন্ত্রণার! সেদিন ইরহাম কি করে নিজেকে সামলাতে পেরেছিল! সে হলে বোধহয় একদফা তুলকালাম হয়েই যেতো। আহত স্বজনকে কিছুতেই মৃ ত্যুপুরীতে ছেড়ে আসতো না। আসলেই কি তাই? নাকি সে-ও ব্যর্থ হতো স্বামীর মতো! জলে পূর্ণ হলো নেত্র। শুকিয়ে কাঠ গণ্ডস্থল। পীড়ন হচ্ছে বুকে। ভাবনায় ছেদ পড়লো। নয়নে স্থির হলো নয়ন। ইরহাম তখন ওর দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে। ব্যথিত বদনে বলে চলেছে,

” আ’ম স্যরি হৃদি! সেদিন আমার মাঝে আমি ছিলাম না। ব্যর্থতা কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছিল আমায়। তাই কি থেকে কি করেছি, বলেছি নিজে বোধহয় জানতেও পারিনি। খুব কষ্ট দিয়ে ফেলেছিলাম তোমায়, তাই না? ”

হৃদির কর্ণে ভেসে উঠলো সে রাতে স্বামীর বলা একটি বাক্য,

‘ দুনিয়াটা রঙ্গমঞ্চ পেয়েছে সব। যে যা খুশি করে যাবে। বাঁধা দেয়ার কেউ নেই। কেউ নেই। ‘

আজ অনুধাবন করতে পারছে সে ক্রো’ধ ওর তরে নয়। মানুষ রূপী মামার উদ্দেশ্যে ছিল। সেদিনের ক্রো ধ, বিরূপ প্রতিক্রিয়া সবটাই ভুল ছিল। একজনের রাগ আরেকজনের ওপর ঝেড়েছিল মানুষটি। টুপ করে অশ্রুবিন্দু গড়িয়ে পড়লো কপোল ছুঁয়ে। ব্যর্থ সৈনিকের ন্যায় অনুভূতি হচ্ছে ইরহামের। ক্লেশে জর্জরিত অভ্যন্তর। প্রিয়তমার ক্রন্দনে তার অপরাধবোধ পুনরায় জাগ্রত হচ্ছে। অধম অনুভূত হচ্ছে নিজেকে। পু ড় ছে অন্তর। হাত বাড়িয়ে স্ত্রীকে কাছে টেনে নিলো মানুষটি। বুকের বাঁ পাশে মাথা ঠেকলো রমণীর। দু হাত আলতো করে স্থাপিত হলো চওড়া পৃষ্ঠে। নীরবে দুঃখ দূরীকরণে লিপ্ত মেয়েটি। মানসপটে ভেসে আসছে সেদিনে স্বামীর তরফ হতে অপ্রত্যাশিত আচরণ, পল্লবী মামীর দুরবস্থা। আবেগী রমণী নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হলো। অক্ষিকোলে হতে লাগলো বর্ষণ। সে মুহূর্তে কর্ণপাত হলো অনুতপ্ত স্বর,

” ক্ষমা চাইছি জান! তোমাকে যন্ত্রণা দেয় এমন সবকিছু ত্যাজ্য করলাম আজ এই মুহূর্ত থেকে। আর কাঁদে না তো। একটু শান্ত হও। হুশশ! ”

মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে চলেছে মানুষটি। আহ্লাদ পেয়ে বুকের বাঁ পাশে আরেকটু মিশে গেল হৃদি। সিক্ত হতে লাগলো ইরহামের বক্ষপট।

রৌদ্রময় এক দিন। রোড সাইড স্টলের কাঠের বেঞ্চিতে বসে রাহিদ। ঘামে ভিজে দেহ। শ্যামবর্ণ মুখখানা রোদের উত্তাপে র’ক্তিম। স্বেদজলে সিক্ত শার্ট লেপ্টে তনুয়। হাতে ঠাণ্ডা মিনারেল ওয়াটার বোতল। মুখে বোতল ঠেকিয়ে ঢকঢক করে পানি পান করছে ছেলেটি। স্বস্তি মিলছে তনুমনে। শীতল হচ্ছে অন্তঃস্থল। অর্ধেকের বেশি পানি পান করলো রাহিদ। আটকে নিলো বোতলের ছিপি। দৃষ্টি স্থির হলো কলেজ গেইটে। ছুটির বেল বেজেছে। একে একে বেরিয়ে আসছে শিক্ষার্থীদের দল। ছেলে-মেয়েদের মিশ্র সমারোহ গেইটে। অসংখ্য ছেলে-মেয়ে বেরিয়ে আসছে গেট দিয়ে। পড়নে তাদের কলেজ পোশাক। সকলের ভীড়ে রাহিদের চোখ খুঁজে বেড়াচ্ছে একজনকে। বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো সে। বোতল রয়ে গেল কাঠের আবরণে। চঞ্চল দৃষ্টি খুঁজতে লাগলো তাকে। অবশেষে দেখা মিললো তার। জবা এবং এক ছেলে সহপাঠীর সঙ্গে কথা বলতে বলতে গেইট পেরিয়ে বের হলো ইনায়া। কলেজ পোশাক পড়নে তার। মাথায় হিজাব বাঁধা। কাঁধে ব্যাগ। ঘর্মাক্ত কিশোরীকে বেশ মোহনীয় লাগছে! কিউট! হঠাৎ তীক্ষ্ণ হলো চাহনি। ছেলেটার সঙ্গেই বেশি কথা বলছে ইনু। কিছু নিয়ে হেসে চলেছে তারা। পাশে হাসিমুখে হাঁটছে জবা। সহসা বিগড়ে গেল মেজাজ। র’ক্তিম মুখ আরো র’ক্তিম হলো কি!

হাস্যরত ইনায়া দাঁড়ালো নির্দিষ্ট স্থানে। গাড়ির খোঁজ করছে। গাড়ি কি এখনো আসেনি! এখানেই তো দাঁড়ায় সবসময়। সহপাঠীর দুষ্টুমিতে নিঃশব্দে হাসলো ইনু। হঠাৎ থমকে গেল স্পন্দন। পরিবর্তিত হলো অভিব্যক্তি। রাস্তার অপর পাশে দাঁড়িয়ে মানুষটি। তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে এদিকে। তাকেই দেখছে বুঝি! দলা পাকিয়ে অশ্রুর আগমন হলো। অভিমানের শৃঙ্গ তখন বহু উঁচু। ধরাছোঁয়ার বাইরে। নিজেকে সামাল দিতে দ্রুত মুখ ফিরিয়ে নিলো ইনায়া। টের পেল তার পানে এগিয়ে আসছে মানুষটি। ছটফট করছে ইনায়া। বারবার এদিক ওদিক তাকিয়ে গাড়ির খোঁজ করছে। কোথায় গাড়ি! দেখা মিলছে না কেন?

” চল। ”

পুরুষালি গমগমে স্বরে বিহ্বল হলো ইনায়া! দৃষ্টি স্থির নিজ পায়ের জুতোয়। তাকাবে না অন্যত্র।

” কিছু বলেছি আমি। ”

ইনায়ার বাঁ পাশে দণ্ডায়মান ছেলেটির পানে তাকিয়ে কথাটি বললো রাহিদ। বলেছে কিন্তু ইনুকেই। তবে সে মেয়ে সাড়া দিলে তো। সাড়া না পেয়ে মেজাজ গরম হলো রাহিদের। চকিতে আঁকড়ে ধরলো কোমল হাত। জবা এবং সহপাঠী ছেলেটি অবাক! আকাঙ্ক্ষিত মানবের একটুখানি স্পর্শে বুক ফেটে কান্না পাচ্ছে। গুঁড়িয়ে যাচ্ছে অভিমানের উঁচু শৃঙ্গ। তবে তা হতে দেয়া যাবে না। অসম্ভব! এক ঝটকায় হাতটি ছাড়িয়ে নিলো ইনায়া। আনত নয়নে মৃদু স্বরে বললো,

” রাস্তাঘাটে মেয়েদের হাত ধরে টানাহেঁ’চড়া করা ভালো মানুষের স্বভাব নয়। ”

আর দাঁড়ালো না ইনায়া। বন্ধুদের বিদায় না জানিয়েই দুরন্ত পায়ে হেঁটে গেল। পথিমধ্যে একটি রিকশা পেয়ে দ্রুত তাতে উঠে পড়লো। গন্তব্য ‘ আনন্দাঙ্গন ‘. পেছনে রয়ে গেল রাহিদ। অবিশ্বাস্য চাহনিতে দেখতে পেল এক পরিবর্তিত রূপ! এতটা বদলে গেছে ইনু! হাঁ বদলে গেছে। রিকশায় একাকী নৈঃশব্দ্য ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো ইনায়া। জানলো না, দেখলো না কেউ। এ যাতনা যে একাকী তার।

নিশুতি রাত। বিছানার কিনারে বসে এমপি সাহেব। থমথমে মুখশ্রী। ভেতরকার অবস্থা বোঝা দুষ্কর। অনেকক্ষণ যাবত এমন দুর্বোধ্য ভাবসাব । কেন এই অবস্থা এমপি সাহেবের?
_____

ঘড়ির কাঁটা তখন নয়ের ঘরে। আজ একটু তাড়াতাড়ি ই বাড়ি ফিরেছে ইরহাম। কলিংবেলের শব্দে দ্বার উন্মুক্ত করলো এক পরিচারিকা। যথারীতি বাড়ি ফিরে প্রিয়তমার মুখ দর্শন করতে না পেরে কিছুটা অসন্তুষ্ট হলো মানুষটি। সালাম দিয়ে প্রবেশ করলো ভেতরে। শূন্য লিভিংরুমে চোখ বুলিয়ে দেখা মিললো না তার। অগত্যা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেল। নৈশভোজের সময়ও তার দেখা মিললো না। গম্ভীরমুখো মানুষটি ইচ্ছে সত্ত্বেও এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলো না। চুপচাপ ভোজন পর্ব সেরে নিজ কক্ষে ফিরে গেল। অধৈর্য হলো যখন ঘড়ির কাঁটা এগারোর ঘরে পৌঁছালো। আর অপেক্ষা করা গেল না। দেহে টি-শার্ট গলিয়ে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল ইরহাম। করলো স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণ। হাজির হলো ছোট বোনের ঘরের সামনে। এসে তো পড়লো। এখন অপ্রস্তুত বোধ করছে। ডাকবে কি ডাকবে না! শেষমেষ আলতো করে দরজায় কড়া নাড়লো। ভিড়িয়ে রাখা দ্বার উন্মুক্ত করে চমকালো ইনায়া! তোতলাতে তোতলাতে বলে উঠলো,

” ভা ই য়া! ক্ কিছু বলবে? ”

গম্ভীর স্বরে ছোট প্রশ্ন,

” ভাবী কোথায়? ”

থতমত খেল ইনায়া, ” ভাবী! সে তো ব্ বাড়িতে। ”

” দেখলাম না যে? ”

এবার অবাক হবার পালা ইনুর! সে ধীরলয়ে শুধালো,

” তুমি জানো না ভাইয়া? ”

কিঞ্চিৎ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ইরহাম। বুঝতে পারছে না কিসের কথা জিজ্ঞেস করছে বোন। ইনায়া বোধহয় তা বুঝতে পারলো। তাই মৃদু কণ্ঠে বললো,

” ভাবী তো তাদের বাসায় গিয়েছে। বিকেলে। তুমি জানতে না? ”

নিশ্চুপ কয়েক সেকেন্ড। অতঃপর ইরহাম চিরপরিচিত গম্ভীর স্বরে বললো,

” অনেক রাত হয়ে গেছে। ঘুমিয়ে পড়। গুড নাইট। ”

কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো ইরহাম। কিছুই বোধগম্য হলো না ইনুর। এটা কি থেকে কি হলো!
_____

মিনিট ত্রিশ পূর্বের কথা স্মরণে এলো। ফোঁস করে নিশ্বাস ছাড়ল ইরহাম। ডানেবায়ে তাকিয়ে মোবাইল খুঁজলো। পেল বেড সাইড টেবিলের ওপর। হাত বাড়িয়ে মোবাইল নিলো। কল লিস্ট স্ক্রল করে পেয়ে গেল নম্বর। ডায়াল করলো। অপেক্ষা কল রিসিভ হবার।
.

চোখেমুখে গাম্ভীর্য! বাঁকা অ্যাঙ্গেলে দাঁড়িয়ে সে। গালে হালকা চাপদাঁড়ির উপস্থিতি। পড়নে কৃষ্ণবর্ণ সোয়েট শার্ট এবং ট্রাউজার। সোয়েট শার্টের হাতা গুটিয়ে কনুইয়ে তুলে রাখা। বাঁ হাতে কালো বেল্টের মোটা ডায়ালের ঘড়ি। মুখখানি স্বল্প ঊর্ধ্বমুখী! ভার্সিটি জীবনে তোলা এই ভীষণ আকর্ষণীয়, নজরকাড়া ফটো! রয়ে গিয়েছে অনলাইন প্লাটফর্মে। সে-ই ছবিটি এখন সেভ করা রমণীর মোবাইলের হোম স্ক্রিনে। এমপি সাহেবের পুরাতন কিন্তু সুদর্শন লুকে ঘা য়ে ল তার কোমল হৃদয়! লালাভ রঙ ছেয়ে মুখশ্রীতে। ওষ্ঠপুটে লজ্জালু আভা। সহসা এই লজ্জার মধ্যে বাঁ হাত ঢুকিয়ে দিলো কর্কশ রিংটোন। হস্ত কেঁপে মোবাইলটি পড়তে গিয়েও পড়লো না। ঘাবড়ে গেল মেয়েটি। বেলকনিতে রাতের আঁধারে এ কেমন ভূতুড়ে কল! উফ্! তপ্ত শ্বাস ফেলে মোবাইল সোজা করে ধরলো হৃদি। চমকালো বেশ! খারুস চৌধুরী কলিং।

” ইরহাম! ”

দ্বৈত অনুভূতির সৃষ্টি হলো মনে। জিভ দিয়ে ওষ্ঠাধর সিক্ত করে কল রিসিভ করলো মেয়েটি। সালাম দেবার পূর্বেই থমকালো! ওপাশ হতে ভেসে এলো রাশভারী কণ্ঠস্বর,

” বড্ড অবাধ্য হয়ে যাচ্ছো আজকাল। কঠিনতর শাস্তি পাওয়ার জন্য প্রস্তুত থেকো মিসেস চৌধুরী। ”

বিস্ময়ে বাকশূন্য মেয়েটি! ভুলে গেল কোনোরূপ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে। শাস্তি!

” হ্যালো ইরহাম! আ আপনি কিসের শাস্তির.. ”

আর বলা হলো না। উপলব্ধি করলো ওপাশ হতে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছে। দ্বিধান্বিত চোখে মোবাইলের স্ক্রিনে তাকালো হৃদি। রাতদুপুরে এ কি হলো! মানুষটা অমন হুড়ুম গুড়ুম করলো কেন? সে কি না বুঝে কোনো ভুল করে ফেলেছে! ভাবনায় পড়ে গেল মেয়েটি। সারাদিনের কর্মকাণ্ড একবার স্মরণ করে নিলো। উঁহু। সবই তো ঠিকঠাক। সে তো মানুষটাকে জানিয়েও এসেছে যে আজ এ বাড়িতে আসছে। ফোনে পায়নি তাই মেসেজ পাঠিয়েছে। তাহলে উনি অমন খারুস অবতার ধারণ করলেন কেন? হুঁ? আঁধারিয়া রাতে মিললো না এ প্রশ্নের উত্তর! ভাবনায় মশগুল হয়ে পড়লো হৃদি। ‘শাস্তি’ শব্দটি মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই কাঁপলো অন্তঃপুর।

খারুস বরের হুমকিতে অতিষ্ঠ হয়ে বাবার বাড়ি একরাত কাটিয়েই বর্তমান বাড়ি অর্থাৎ ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ ফিরলো হৃদি। ভাগ্যক্রমে বর সাহেবের দেখা মিললো না। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল সে। যাক বাবা। অন্তত দু বেলা তো বাঁচা গেল। পরেরটা পরে নাহয় দেখা যাবে। হুম।
.

তমসাচ্ছন্ন কক্ষ। পর্দায় আবৃত বাতায়ন। ভেতরকার সবটুকু ক্রো’ধ, যন্ত্রণা প্রকাশ করতে ব্যস্ত এক তরুণ। ঘর্মাক্ত দেহ। স্বেদজলে সিক্ত চুল। ললাট কার্নিশ হতে কপোল গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। দেহের উপরিভাগে সফেদ স্লিভলেস গেঞ্জি। সাথে ধূসর রঙা ট্রাউজার। ঘর্মাক্ত দেহে লেপ্টে গেঞ্জি। রাগ ঝাড়ছে সে তরুণ পাঞ্চিং ব্যাগের আবরণে। শক্তপোক্ত দু হাতে একের পর এক ঘু ষি দিচ্ছে পাঞ্চিং ব্যাগে। শক্তিশালী ঘু”ষিতে টলে উঠছে ব্যাগটি। লালাভ রঙ ধারণ করছে হাত। তবুও থেমে নেই সে। অনবরত পাঞ্চিং ব্যাগে আঘাত করে নিজেকেই যন্ত্রণা দিচ্ছে তরুণ। চোখের পর্দায় বারংবার ভেসে উঠছে এক কিশোরীর অশ্রুসজল নয়ন। তার দুঃখে জর্জরিত মুখভঙ্গি। পাহাড়সম অভিমান। মৃ ত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসার যন্ত্রণাদায়ক মুহুর্ত। সব মিলিয়ে সে এক বিমর্ষতাপূর্ণ অবস্থা! আরো জোরে আঘাত করতে লাগলো তরুণ। আঙ্গুলের চামড়া চিঁ’ড়ে নিঃসৃত হচ্ছে র ক্ত বিন্দু। তবুও থামলো না সে। প্রহার করতে লাগলো নিজেকে নিজেই। একসময় থেমে গেল। পাঞ্চিং ব্যাগে ঠেকলো মস্তক। আলতো দু হাতে আঁকড়ে ধরলো ব্যাগ। অবনত মস্তকে ম্লান বদনে অত্যন্ত আকুলতা প্রকাশ করে ডেকে উঠলো,

” ইনু! ”

বড় আবেগময় সে ডাক। অভিমানী কিশোরী শুনতে পেলে পারতো কি নিজেকে সামলাতে! ছুটে আসতো না অভিমানের ভাষা ভুলে! হয়তো হ্যাঁ! সব ভুলে ছুটে আসতো একান্ত জনের পানে। মিশে যেতো প্রশস্ত বক্ষপটে।
.

সারাটি দিন দুশ্চিন্তায় কাটিয়ে দিলো হৃদি। এমপি সাহেব প্রথমবারের মতো এমন রূঢ় ভাষায় শাস্তি প্রদানের কথা বলেছে। না জানি কি থেকে কি শাস্তি দিয়ে বসে। বেলাশেষে মেয়েটির মনে হলো, সে কেন শাস্তি পাবে? কোন অপরাধ করেছে সে, যার জন্য শাস্তি প্রাপ্য! জবাব মিললো না। ইহ্ ! বললেই হলো শাস্তি দেবে! আর সে বুঝি চুপচাপ শাস্তি মেনে নেবে? কখনোই না। দুষ্টুমির সম্রাজ্ঞী মিসেস হৃদি বহু ভাবনাচিন্তা করে এক নতুন পদ্ধতি অবলম্বন করলো। এ পদ্ধতি সফল হবে নিরানব্বই দশমিক নয় নয় ভাগ নিশ্চিত সে।

‘ এমপি সাহেব! এরপরও কি পারবেন আমায় শাস্তি দিতে? ‘

দুষ্টু হাসি লেপ্টে অধরকোলে। দেখা যাক কি করেন এমপি মহাশয়!
.

আঁধারিয়া রজনী। অন্তরীক্ষে মেঘমালার আচ্ছাদন। ঢাকা পড়েছে নিশাকর। শোঁ শোঁ হাওয়ায় নৃত্যশৈলীতে লিপ্ত বৃক্ষরাজি। ঝড়ো আবহাওয়া। বৃষ্টি হতে চলেছে বুঝি। নিজ পরিকল্পনা ভেস্তে দিয়ে বেলকনিতে ছুটে গেল মেয়েটি। লহমায় শীতল হাওয়া ছুঁয়ে গেল কায়া। মোহনীয় দ্যুতি ছড়িয়ে পড়লো মুখশ্রীতে। চঞ্চল পায়ে রেলিং সংলগ্ন দাঁড়ালো হৃদি। দু হাতে রেলিং আঁকড়ে ধরে মুখ বাড়িয়ে দিলো একটুখানি সম্মুখে। আবেশে বুঁজে গেল আঁখি। ঠাণ্ডা হাওয়া আদুরে পরশ বুলিয়ে যাচ্ছে চোখেমুখে। হাস্য আভা ফুটে উঠলো রমণীর ওষ্ঠপুটে। খানিকের অপেক্ষা সমাপ্ত হলো। ঝিরিঝিরি বর্ষণে সিক্ত হতে লাগলো জমিন। জলকণার স্পর্শ পেয়ে আদুরে রূপে রূপান্তর হলো বৃক্ষপল্লব। আহ্লাদী হয়ে উপভোগ করতে লাগলো জলনৃত্য। ধূলোকণা মুছে সতেজতা ফিরে এলো চারিদিকে। বর্ষণে মত্ত মেয়েটি টেরও পেল না কখন ঘরে ফিরেছে স্বল্প সিক্ত স্বামী। সে তো মগ্ন বারিশে!

উদোম দেহে ওয়াশরুম হতে বেরিয়ে এলো সুঠামদেহী মানব। বাঁ হাতে তোয়ালে দিয়ে শুষে নিচ্ছে চুলে থাকা প্রতি বিন্দু জল। ডিম লাইটের আলোয় ঘরটি বড় মোহনীয় লাগছে! এদিক ওদিক তাকালো সে। কোথায় তার বউপাখিটি! বাড়ি ফিরেই বোনের কাছে দুষ্টুমি মিশ্রিত স্বরে শুনলো, সে ফিরেছে সকালে। তবে গেল কোথায়? শাস্তির মাত্রা না বাড়িয়ে থামবে না নাকি! অসন্তুষ্ট বদনে তোয়ালে ছুঁড়ে ফেললো ডিভানে। ভেজা চুলে আঙ্গুল চালনা করতে করতে হঠাৎ থমকালো! কর্ণে পৌঁছালো রিনিঝিনি হাস্য কলরব। শব্দ উৎস অনুসরণ করে বেলকনির পানে তাকালো ইরহাম। তাতেই হলো মহা সর্বনা’শ! স্তব্ধ হলো মানুষটি। স্থির হলো নয়ন জোড়া। ভুলে গেল জাগতিক সকল হুঁশ!

শ্বেত শুভ্র রঙা সিল্কের শাড়ি পড়নে রমণীর। স্লিভলেস ব্লাউজ। দৃশ্যমান দু হাতের অধিকাংশ। রেলিংয়ে পিঠ ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে সে। মুখখানি কিছুটা পেছনে এলিয়ে। বৃষ্টির ফোঁটা ফোঁটা জল বড় আহ্লাদে ছুঁয়ে যাচ্ছে বদন। মায়াবী বদন গড়িয়ে গ্ৰীবা, সেথা হতে শাড়ির অন্তরালে। বৃষ্টির ঝাপটায় স্বল্প ভিজে সিল্কের আবরণ। বদ্ধ আঁখি পল্লব। উপভোগ করছে টুপ টাপ বৃষ্টির পরশ। মিষ্টি হাসি ছড়িয়ে ওষ্ঠপুটে। দু হাত স্বল্প প্রসারিত করে রাখা দু দিকে। এ যেন বর্ষণ মাঝে এক টুকরো শুভ্রতার উপস্থিতি! প্রিয়তমার আবেদনময়ী রূপের ঝলকানিতে ঝ ল সে গেল পৌরুষ চিত্ত! ঘোর লেগে গেল চক্ষে। মোহনীয় শুভ্রতায় ব শীভূত হয়ে শ্লথ পায়ে এগোতে লাগলো মানুষটি। ধীরে ধীরে এগোচ্ছে এবং চক্ষুতারায় স্পষ্ট রূপে দেখা মিলছে মানবীর অবয়ব। দীঘল কালো কেশ আঁচড়ে বাঁ কাঁধে ছড়িয়ে রাখা। ডান কানের পিঠে গুঁজে টকটকে র ক্তলাল গোলাপ! গোলাপের পল্লবে বৃষ্টিস্নাত ছোঁয়া। আদুরে ভঙ্গিতে নুয়ে পড়েছে পুষ্পরানী। রমণীর ওষ্ঠে লালাভ ওষ্ঠরঞ্জনীর প্রলেপ। অবর্ণনীয় সন্মোহক এ কোমল রূপ! একদম নৈকট্যে এসে থামলো ইরহাম। পুরোদমে ব শীভূত তার তনুমন! অস্থির নয়ন জোড়া বুলিয়ে চলেছে প্রিয়তমার মুখশ্রীতে। একটুও থেমে নেই। কখনো বদ্ধ আঁখি পল্লব, কখনো সুডৌল নাসিকা কখনোবা নে শালো ওষ্ঠাধর। ঘন শ্বাস পড়তে লাগলো তার। নিজেকে সামাল দেয়া হয়ে উঠলো দুঃসাধ্য! মুঠো হয়ে আসছে দু হাত।

বৃষ্টিস্নাতা রমণী আনমনে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে। সহসা অতি সন্নিকটে অনুভব করলো সে জনকে। চমকে তাকালো মেয়েটি! চক্ষু নিবদ্ধ হলো বিমোহিত স্বামীতে! কাজলটানা নয়ন জোড়ায় হারিয়ে গেল ইরহাম। সে-ও হারালো ধীরে ধীরে। আকস্মিক বলিষ্ঠ হাতের এক থাবা। প্রশস্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়লো কোমলকায়া। বিহ্বল রমণীর দু হাত আঁকড়ে ধরলো প্রশস্ত কাঁধ। বর্ধিত হলো শ্বাস প্রশ্বাসের গতিবেগ। দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব তখন শূন্যের কোঠায়। নভোনীল চক্ষু জোড়ায় আজ দেখা মিলছে ভাবনাতীত আস’ক্তির! এক মা-দকতায় আচ্ছন্ন আহ্বান চক্ষে ভেসে। ধীরলয়ে মুখ বাড়িয়ে দিলো মানুষটি। ওষ্ঠ ঠেকালো সঙ্গিনীর শ্রবণেন্দ্রিয়ে। মোহাচ্ছন্ন স্বরে থেমে থেমে বললো,

” খু ন হয়ে গেলাম আজ, জান! ”

কর্ণপাতায় উষ্ণ পরশের শিরশিরানি। পরক্ষণেই দন্তাঘাতে বেসামাল হলো কায়া। মুখনিঃসৃত হলো মৃদু আর্ত। মানুষটি ঘাড়ের বাঁ পাশে গলিয়ে দিলো পুরুষালি শক্তপোক্ত হাত। মায়াবী আদল আনলো আরেকটু নিকটবর্তী। বাম হাতটি সদর্পে স্থাপিত হলো নির্মেদ কটিদেশে। আবেশে মুদিত রমণীর নয়ন যুগল। ধীরে ধীরে ঘাড়ের ডান পার্শ্বে উত্তাপ অনুভূত হতে লাগলো। আসন্ন মুহুর্ত স্মরণ করতেই থমকালো স্পন্দন! নখ বিঁধে গেল স্বামীর বাহুতে। এলোমেলো নে শাতুর পরশ অঙ্কিত হয়ে চলেছে মসৃন ত্বকে। থেমে নেই আজ মানুষটি। অর্ধাঙ্গীর আবেদনময়ী রূপের ঝলকানিতে ভেঙে চূর্ণ বিচূর্ণ সকল সংযমের বাঁধ। তনুয় লেপ্টে থাকা বৃষ্টি কণার ওপরেও আজ সে জনের একচ্ছত্র আধিপত্য। অবাধ মা-দকতায় আচ্ছন্ন রমণীর অভ্যন্তর। নিজেকে ধাতস্থ করবার মিলছে না বিন্দুমাত্র সুযোগ। কোমলতায় অবিরাম অঙ্কিত হয়ে চলেছে আর্দ্র ছোঁয়ার রঙ-তুলি। সহসা বেকাবু জনের ওষ্ঠে বন্দিনী হলো সে। প্রগাঢ় সে বন্দী দশা! অবিন্যস্ত রূপ শুভ্র শাড়ির। কিয়ৎক্ষণ বাদে মুক্তি মিললো সে মধুরতম বন্দিত্ব হতে। কপালে ঠেকে গেল কপাল। ঘন শ্বাস পড়ছে দু’জনের। একটুখানি শান্ত হয়ে পুরু ওষ্ঠ চাপ বসলো ভ্রুদ্বয়ের মধ্যিখানে। চঞ্চল স্পন্দন প্রক্রিয়া। স্বামীর ভালবাসাটুকু হৃদয়ের গভীরতা দিয়ে চোখ বুঁজে অনুভব করতে লাগলো হৃদি।

বলিষ্ঠ হস্তদ্বয়ের বেষ্টনীতে বন্দী হলো রমণীর কায়া। পদযুগল মেঝে হতে সামান্য উঁচুতে। লেপ্টে একান্ত জনের সনে। সঙ্গিনীকে নিজের সঙ্গে আগলে মন্থর পায়ে ঘরে প্রবেশ করলো ইরহাম। পায়ের স্পর্শে বদ্ধ হলো বেলকনির দ্বার। বাহিরে তখন ঝড়োহাওয়ার বেগ। অন্দরে প্রেমাতুর লগন! বহুদিনের অপেক্ষা শেষে আজ কাছাকাছি দু’জনে। একে অপরেতে হারিয়ে তারা। বড় অবাধ্য, বেসামাল মানুষটি। অস্থিরতার বহিঃপ্রকাশ প্রতিটি পরশে-স্পর্শে। সে পরশে মধুরতম যাতনায় ক্লিষ্ট রমণী। অবিন্যস্ত দু’জনার বসন! সর্বদা নারী সান্নিধ্য হতে দূরত্বে থাকা মানুষটি আজ একটু বেশিই নিয়ন্ত্রণহারা হালাল সঙ্গিনীর সংস্পর্শে। একবুক ভালোবাসার সবটুকু অর্পণ করে চলেছে হৃদরানীর চরণে। প্রকাশ করে চলেছে লুকায়িত বেপরোয়া এক প্রেমিক সত্ত্বা। অত্যন্ত মধুময় এ মুহূর্তে আকস্মিক কর্কশ ধ্বনিতে মুখরিত হলো ঘর। থমকালো হৃদি! অবর্ণনীয় ঘোর এখনো বিদ্যমান। কম্পিত তনুমন। ঘন শ্বাস পড়ছে। আকস্মিক রিংটোনের ধ্বনি যেন মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। মস্তিষ্ক বন্ধ করে দিয়েছে কর্ম সম্পাদন। তন্মধ্যে স্বামীর বেসামাল পরশে দুর্বল স্নায়ু। কোনমতে স্নায়ু যু দ্ধে জয়লাভ করে কম্পিত বদনে এদিক ওদিক তাকালো সে। অনুভব করলো বেড সাইড টেবিলের ওপর বেজে চলেছে স্বামীর ফোন। ঘন শ্বাস ফেলতে ফেলতে নে শা ক্ত স্বামীকে ক্ষীণ স্বরে ডেকে উঠলো হৃদি,

” ই..রহাম! ফো ন বাজছে। ”

প্রিয়তমায় বিভোর মানুষটি এ ডাকে বিন্দুমাত্র সাড়া দিলো না। সে মগ্ন আপন কর্মে। রিংটোন বেজে উঠলো দ্বিতীয়বারের মতন। স্বামীর স্পর্শে পুনরায় বুঁজে গেল অক্ষিপুট। শিউরে উঠলো কায়া। কোনোমতে নিজেকে সামলানোর ফাঁকে স্বামীর বাহুতে হাত বুলিয়ে তাকে ডাকতে লাগলো মেয়েটি। নে শা লো স্বরে আপত্তি জানালো মানুষটি,

” বাজুক জান। একটু শান্ত হও। ছটফট করে না তো। ”

জাগতিক হুঁশ হারিয়ে তখন প্রিয়তমায় মত্ত মানুষটি। অন্য কোথাও মনোনিবেশ করতে নারাজ সে। তৃতীয়বারের মতো রিংটোন এবং স্ত্রীর জোরালো ডাকে হঠাৎ হুঁশ ফিরলো মানুষটির। এলোমেলো রূপে আছড়ে পড়লো বালিশে। অবাধ্য শ্বাস প্রশ্বাস। দ্রুত কাঁপা কাঁপা হস্তে নিজেকে ঠিক করে নিলো হৃদি। উঠে বসলো। অস্থির রূপে পরিপাটি করতে লাগলো এলোকেশ। ইরহাম কিছুটা সময় নিজেকে ধাতস্থ করতে ব্যয় করলো। র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে চোখেমুখে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে নে শা। জোরপূর্বক নিজেকে স্বাভাবিক করার প্রয়াস চলমান। তবে মন যে মানে না। অবাধ্য প্রেমিক সত্ত্বা আকস্মিক পেলব হাতটি ধরে নিজের কাছে টেনে নিলো। প্রশস্ত বক্ষপটে আছড়ে পড়লো হৃদরাণী। নে শা চড়ে বসলো অন্তঃস্থলে। একান্তে যেতে উদ্যত হতেই বাঁধা প্রদান করলো মোবাইলের বিরক্তকর ধ্বনি। বিরক্তিসূচক শব্দ নিঃসৃত হলো মানুষটির মুখ হতে। অর্ধাঙ্গীকে বাঁ হাতে নিজের সনে আগলে কম্পিত হাতে মোবাইল নিলো ইরহাম। চমকালো কলার আইডি দেখে! ভাঁজ পড়লো কপালে। ত্বরিত কল রিসিভ করলো।

” হ্যালো আসসালামু আলাইকুম! ”

ওপাশ হতে শোনা গেল অপ্রত্যাশিত সংবাদ! চরম আশ্চর্যান্বিত হলো ইরহাম! হৃদি স্বামীর মুখভঙ্গিতে তাকিয়ে। বোঝার চেষ্টা করছে কি হয়েছে।

তমসাচ্ছন্ন কক্ষ। গরিবানা বিদ্যমান যত্রতত্র। খাটের পায়ায় পিঠ ঠেকে মানুষটির। র ক্তজবার ন্যায় চক্ষের সফেদ অংশ। হাতের মুঠোয় ক্ষুদ্র এক সিসি। সে সিসি’তে ক্ষুধার্তের ন্যায় তাকিয়ে সে। লোভাতুর চাহনি। টগবগিয়ে উঠছে র”ক্তকণিকার দল। অস্বাভাবিক হৃদস্পন্দনের গতি। ভেতরকার সত্ত্বা আকস্মিক যেন চিৎকার করে উঠলো। আর সইতে পারলো না। একটু একটু করে ম-রণঘাতী সিসি মুখের ধারে আনলো। ওষ্ঠপুটে লেপ্টে মুক্তির স্বাদ। তৃপ্তিকর আভা। কালক্ষেপণ না করে সিসিতে বিদ্যমান তরল ঢেলে দিলো গলায়। ঝ ল সে গেল গণ্ডস্থল। যেন এক সিসি এ সি ড পড়েছে গলায়। গলাকাটা মুরগির ন্যায় ছটফট করতে লাগলো মানুষটি। হাত ফসকে পড়ে গেল সিসি। পিঠ লেগে গেল খাটের পায়ায়। ডান হাতে খামচে ধরেছে গলা। তবুও ওষ্ঠপুটে লেপ্টে খুশির ছোঁয়া। চোখে জল অধরে লেপ্টে হাসি। এ কেমন বিরল মৃ ত্যুর স্বাদ আচ্ছাদন! সে কি জানে না কুরআন এর সেই বাণী,

” তোমরা নিজেদেরকে হ ত্যা করো না, নিশ্চয় আল্লাহ্ তোমাদের প্রতি পরম দয়ালু এবং যে কেউ সীমালঙ্ঘন করে আত্মহ!ত্যা করবে তাকে অ’গ্নিতে দ গ্ধ করব এটা আল্লাহ্’র পক্ষে সহজ (সূরা আন নিসা আয়াত-২৯, ৩০)”

জানে না। তাই তো নিজেকে শেষ করার মতো ঘৃণ্য খেলায় মেতেছে এ। শেষ করলো ইহকাল ও পরকাল উভয়ই!

আঁধার চিরে কর্ণপাত হলো ভ য় ঙ্ক র স্বরে এক আদেশ বার্তা,

” অনেক হয়েছে। আর নয়। তুলে ফেল ওটাকে। ”

হুকুম প্রেরণকারীর আদেশ নির্দ্বিধায় মান্য করতে উদ্বুদ্ধ হলো শিষ্যবৃন্দ। এ কেই ব্যক্তি? কাকে তুলে ফেলার চলছে ভয়ান’ক পরিকল্পনা!

• অসমাপ্ত •

[ আসসালামু আলাইকুম পাঠকবৃন্দ। অপ্রত্যাশিত চমক! আজ এখানেই সমাপ্ত হলো ‘ মনের অরণ্যে এলে তুমি ‘ এর প্রথম পরিচ্ছেদ। ভালোবাসাময় পথচলা এবং গুটিকয়েক রহস্য নিয়ে ছিল এই পরিচ্ছেদ। হৃ’হাম পেয়েছ পাঠকদের অঢেল ভালোবাসা। এজন্য হৃদয়ের অন্তঃস্থল হতে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি পাঠকগণ! দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ অতি শীঘ্রই আসছে। প্রগাঢ় ভালোবাসা এবং একঝাঁক রহস্য নিয়ে ফিরছে দ্বিতীয় অর্থাৎ সর্বশেষ পরিচ্ছেদ। প্লট সাজাতে কিছুটা সময় দরকার। ইনশাআল্লাহ্ খুব শীঘ্রই ফিরবো দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ। সে পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন তো?

ধন্যবাদ সবাইকে পাশে থাকার জন্য। ভালোবাসা অবিরাম। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে