মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-৩১

0
1047

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩১ ( প্রথমাংশ )

বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সুঠামদেহী মানব। যন্ত্রণায় কাতর মস্তক। দপদপ করে চলেছে কপালের রগ। র’ক্তিম আভা ছড়িয়ে চোখের সফেদ অংশে। রাতের সতেজতা, ঝিরিঝিরি পবন তাকে স্বস্তি দিতে ব্যর্থ। শরীরে পিছলে যাচ্ছে বেলকনির কৃত্রিম স্বল্প আলোকছটা। পড়নে ঘরোয়া রাত পোশাক। যন্ত্রণায় যখন নুয়ে আসছে মস্তক ঠিক সে মুহূর্তে আগমন হলো প্রশান্তির আরেক নাম। তার হৃদরাণী! স্বামীর পানে চায়ের কাপ বাড়িয়ে মেয়েটি। চোখের ভাষায় কাপটি নিতে বললো। কৃতজ্ঞতাসূচক চাহনিতে তাকিয়ে মানুষটি চায়ের কাপ হাতে নিলো।

” মাথা ব্যথা করছে। বললেই হতো। চুপচাপ যন্ত্রণা সহ্য করার কোনো মানে হয়? নিন এবার ফটাফট চা খেয়ে নিন। সমস্ত যন্ত্রণা পেছনের দরজা দিয়ে পালাবে। ”

ইরহাম তখন বেতের সিঙ্গেল সোফায় বসে। গরম চায়ের কাপে বসাচ্ছে ছোট ছোট চুমুক। চা পান করছে। অর্ধাঙ্গীর কথায় মুচকি হাসলো সে। হৃদি বেলকনির কোমর সমান উঁচু রেলিংয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে। চক্ষু নিবদ্ধ একান্ত জনে। অবলোকন করছে তার চা পান করার ভঙ্গিমা। চায়ের কাপে যখন ওষ্ঠ চাপ বসাচ্ছে মানুষটি, অজান্তেই শিউরে উঠছে কায়া। লালিমা লেপে যাচ্ছে কপোলের মসৃণ ত্বকে। ঘোর লেগে যাচ্ছে চক্ষে। অন্তরে বেজে উঠছে প্রেমের কলতান! গরম গরম চায়ে চুমুক দিয়ে মাথা ব্যথা অনেকখানি লাঘব হয়েছে। স্বস্তি বোধ হচ্ছে মানুষটির। সাংসদ হিসেবে নতুন পথচলা। দিনরাত মিলিয়ে কম তো ব্যস্ততা নয়। স্বাভাবিক ভাবেই শরীরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। প্রয়োজনের সময় সহধর্মিণীর ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র যত্নও হৃদয়ে গেঁথে যায়। যেমন করে গেঁথে গেল এই সাধারণ ক্ষুদ্র মুহূর্তটি। তৃপ্তিময় হেসে হৃদির পানে তাকালো ইরহাম। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ঘোর লাগা এক জোড়া মায়াবী নয়নে। প্রিয়তমার অক্ষিদ্বয়ের সুগভীর অতলে তলিয়ে গেল প্রেমিক সত্ত্বা। নয়নে নয়নে হলো অব্যক্ত কতশত আলাপণ। অতিবাহিত হলো কিছু হৃদয়ছোঁয়া মুহূর্ত। মানুষটি পলক ঝাপটালো যেই আচানক চেতনা ফিরলো রমণীর। হকচকিয়ে গেল সে। ত্বরিত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। নিজেকে নিজেই বকলো এমন নির্লজ্জতার জন্যে। লজ্জা কি লজ্জা! স্ত্রীর এমন লজ্জালু আভা মুগ্ধ নয়নে অবলোকন করলো ইরহাম। বাঁকা রেখা ফুটে উঠলো অধরে। তাকালো চায়ের কাপে। অর্ধ পরিমাণ চা অবশিষ্ট। মস্তিষ্কে কড়া নাড়লো দুষ্টুমি। কিছুটা গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,

” আল্লাহ্’র রহমতে ডায়বেটিকসের রোগী নই। তবে চায়ে চিনি কই? ”

হৃদি তখন প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে। প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে নিজেকে ধাতস্থ করার। আকস্মিক স্বামীর কণ্ঠস্বর শুনে থমকালো! দাঁড়ালো পিছু ঘুরে। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে। বুঝে উঠতে পারছে না উনি কিসের কথা বলছেন।

” চিনি! কোথায়? ”

এবার বিষয়টা বোধগম্য হলো। কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল।

” চিনি! দিয়েছি তো। ”

” স্বাদ গ্রন্থি এখনো ঠিকঠাক। তাহলে চিনির স্বাদ পাচ্ছি না কেন? ” ডান ভ্রু উঁচু করে তাকিয়ে ইরহাম।

হৃদি যথেষ্ট অবাক হলো! নিজের পক্ষে বললো,

” রাতদুপুরে কিসব বলছেন? আমি নিজের হাতে চায়ে চিনি মিক্স করেছি। ”

” তাহলে গেল কোথায়? ” সরল প্রশ্ন মানুষটির।

হৃদি যথেষ্ট বিরক্ত হয়ে বলল,

” ফাও কথা বলবেন না তো। আমি চিনি দিয়েছি। দেখি চিনি গেল কই? ”

অধৈর্য হয়ে কিছু বলবার সুযোগ না দিয়ে স্বামীর হাত থেকে চায়ের কাপ একপ্রকার ছিনিয়ে নিলো মেয়েটি। চুমুক দিলো স্বল্প ঠাণ্ডা চায়ে। ক্ষণিকের মধ্যেই মিলিয়ে গেল কপালের ভাঁজ। স্বামীর পানে তাকিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করলো হৃদি,

” মিয়া আপনার মুখে সমস্যা। চায়ে চিনি থাকা সত্ত্বেও টের পাচ্ছেন না! ”

বক্র হেসে শুভ্র কাপটি ফেরত নিলো ইরহাম। হৃদির পানে মা-দকতাপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে। ঘুরিয়ে ধরলো কাপ। ধীরে ধীরে সময় নিয়ে পুরু ওষ্ঠ বসালো কাপের সে স্থানে যেখানে কিয়ৎক্ষণ পূর্বে বসেছে অর্ধাঙ্গীর কোমল ওষ্ঠ চাপ। পুরো বিষয়টি স্বচক্ষে অবলোকন করলো মেয়েটি। উপলব্ধি করলো দুষ্টুমির অন্তরালে লুকায়িত মধুরতম ষ ড় য ন্ত্র। বিস্ময় প্রকাশ পেল মুখশ্রীতে। লালাভ রঙ মেখে কপোলদ্বয়ে। বর্ধিত হলো বক্ষপিঞ্জরের আড়ালে লুকায়িত যন্ত্রটির গতিবেগ। ওর পানে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো ইরহাম। নয়নে নয়ন স্থির রেখে ব্যক্ত করলো নিজস্ব অনুভূতি,

” ইটস্ সো সুইট! ”

পুরুষালি সম্মোহনী স্বরে লাজুকলতা দৃষ্টি সরিয়ে নিতে বাধ্য হলো। নচেৎ লাজে নিশ্চিত ম র ণ তার! কিছুটা সময় পেরিয়ে গেল। বাহিরে দৃষ্টি আবদ্ধ মেয়েটির। হঠাৎ কিছু মনে পড়তেই পিছু ঘুরে স্বামীর পানে তাকালো।

” আপনাকে কিছু বলার আছে ইরহাম। ”

ক্ষুদ্র গোলাকার টেবিলের কাঁচের আস্তরণে শুভ্র কাপ রাখলো ইরহাম। স্ত্রীর কণ্ঠে গাম্ভীর্য উপলব্ধি করে অনুমতি প্রদান করলো,

” হুম। বলো। ”

সময়ের পরিক্রমায় পেরিয়ে গেছে দিন কয়েক। নিশুতি রাত। নৈশভোজ সেরে লিভিংরুমে উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। অনুপস্থিত ইরহাম। ফোন করেছিল সে। ফিরবে ঘন্টা দুয়েক এর মধ্যে। এজাজ সাহেব সোফায় বসে বিশ্রাম নিচ্ছেন। মালিহা পান সাজিয়ে দিচ্ছেন শাশুড়ি মা’কে। হৃদি একে একে মা ও পাপার দিকে তাকালো। বেজার মুখে বললো,

” মা! দিস ইজ নট ফেয়্যার। ”

মালিহা শাশুড়ির হাতে সাজানো পান তুলে দিয়ে তাকালেন পুত্রবধূর পানে। প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুধোলেন,

” কি হয়েছে রে মা? ”

” হয়নি এখনো। তবে হবে। ” মুখ ফুলিয়ে মেয়েটি।

এজাজ সাহেব মেকি বিরক্তিকর অভিব্যক্তি করে বসে। যদিওবা সজাগ ওনার শ্রবণেন্দ্রিয়। পুত্রবধূ কি বলতে চাইছে শুনতে ইচ্ছুক উনি। রাজেদা খানম পান চিবোতে চিবোতে অস্ফুট স্বরে প্রশ্ন করলেন,

” কি হইবো খোলাশা কইরা ক বুইন। বুঝতেছি না তো। ”

” আমিও বুঝতে পারছি না এতবড় সংবাদ আমি কি করে মিস্ করে গেলাম। ”

হৃদির কথায় অধৈর্য হয়ে এজাজ সাহেব বলে উঠলেন,

” ভনিতা না করে সোজাসুজি বললে ভালো হয়। কথা প্যাঁচানো ভালো লক্ষণ নয়। ”

হৃদি ওনার দিকে ঘুরে বসলো। দুঃখময় চোখে তাকিয়ে। অভিমানী স্বরে বললো,

” পাঁচদিন বাদে তোমাদের অ্যানিভার্সারি। আমাকে একটুও বললে না? শেষমেষ ইনুর কাছ থেকে শুনতে হচ্ছে? আমি কি এতটাই পর! ”

কণ্ঠে কিছু তো একটা ছিল। এজাজ সাহেবের মতো দা”ম্ভিক লোকও ঈষৎ টলে উঠলো। মালিহা কন্যাসম পুত্রবধূকে মানাতে আদুরে গলায় বললেন,

” তুই তো আমার সোনা মেয়ে। পর হতে যাবি কেন? ”

হৃদি গুটিগুটি পায়ে বিপরীত সোফায় এগিয়ে গেল। বসলো মায়ের বাম পাশে। ওনার কাঁধে মাথা এলিয়ে দিলো। জড়িয়ে ধরলো বাঁ হাত। দুঃখী বদনে বললো,

” আমি বোধহয় এখনো আপন হতে পারিনি। তাই তো এমন লুকোচুরি। ”

এজাজ সাহেবের বলতে ইচ্ছে হলো, এসব মিথ্যা। তুমি আপন হয়ে উঠছো। পর নও। বলা আর হলো না। ওনার অভ্যন্তরীণ সত্ত্বা ওনাকে বলতে বাঁধা প্রদান করলো। অবরোধ হয়ে কণ্ঠনালী। ইনায়া বসে বসে মজা নিচ্ছে। উপভোগ করছে ভাবীর দুর্দান্ত অভিনয়। ইশ্! ভাবীর অভিনয় জগতে আসা উচিত ছিল। নেহাত ওসব গু’নাহ। নয়তো ভাবী দেশ-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কার লাভ করতো। কি অভিনয় রে ভাই! মালিহা পুত্রবধূর মাথায় হাত বুলিয়ে এটাসেটা বুঝিয়ে চলেছেন। আদর করছেন। শেষমেষ জায়গামতো তী”র ছুঁড়লো হৃদি।

” ঠিক আছে। আমি যে কে তোমাদের তার প্রমাণ চাই। ”

অবাক সকলে! রাজেদা খানম প্রশ্ন করে বসলেন,

” ক্যামনে? ”

সবার অলক্ষ্যে বাঁকা রেখা ফুটে উঠলো মেয়েটির অধরে। দিস ইজ দ্য মোস্ট পারফেক্ট টাইম!

তপ্ত রৌদ্রময় এক দিন। রবি’র উত্তপ্ত কিরণে ঝলসে যাবার উপক্রম ত্বক। তবুও থেমে নেই জনজীবন। রাজু ভাস্কর্য সংলগ্ন পথে তখন অগণিত মানুষের উপস্থিতি। নিজ নিজ কর্মে ব্যস্ত তারা। টুংটাং শব্দে চলছে রিকশা। হেঁটে যাচ্ছে কিছু পথচারী। কেউবা রাজু ভাস্কর্যের আশপাশে দাঁড়িয়ে ফোনালাপে লিপ্ত।

স!ন্ত্রাসবিরোধী রাজু স্মারক ভাস্কর্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত একটি ভাস্কর্য । এটি শ্যামল চৌধুরী দ্বারা নির্মিত এবং বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ভাস্কর্য হিসাবে বিবেচিত হয়। এটি বাংলাদেশ ছাত্র সংসদের কর্মী মঈন হোসেন রাজু নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের স্মৃতিতে উৎসর্গ করা হয়েছে, যিনি
স!ন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়ে নি”হত হন। এটি ১৯৯০ এর দশকের শেষের দিকে নির্মিত হয়েছিল।

ভাস্কর্য পার্শ্ববর্তী এক ভ্রাম্যমাণ চায়ের দোকান ঘেঁষে দাঁড়িয়ে বাইক। বাইকে হেলান দিয়ে বসে রাহিদ। সাথে আরো দু’টো বাইক। তাতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে চার বন্ধু। ঢাবি মাস্টার্সের শিক্ষার্থী এরা। নিজেদের মধ্যে আলাপচারিতায় লিপ্ত। কথোপকথনের ফাঁকে ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে রাহিদ। অধরে লেপ্টে হাসির রেখা। রৌদ্রের তাপে লালাভ রঙ ছড়িয়ে মুখে। সে এক মোহনীয় সৌন্দর্য! কিছুটা দূরে সতর্ক অবস্থানে দাঁড়িয়ে এ সৌন্দর্য উপভোগ করে চলেছে এক কিশোরী মেয়ে। নাম তার ইনায়া। এজাজ চৌধুরী তনয়া সে‌। দশ দিনের বিরহ সইতে না পেরে আজ একবুক সাহস সঞ্চয় করে, ঝুঁকি নিয়ে এখানে উপস্থিত হয়েছে সে। বাড়ির কেউ জানে না ইনায়া এ মুহূর্তে এখানে উপস্থিত। সকলে জানে সে কোচিং সেন্টারে। সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে বেশ ঝুঁকি নিয়ে এখানে এসেছে মেয়েটি। একটুখানি মনের মানুষরে দেখার জন্য। চক্ষু তৃষ্ণা মেটানোর জন্য। দশ দিনের দূরত্ব যে তার হৃদয়ের একূল ওকূল তোলপাড় সৃষ্টি করেছে। যখন তখন বর্ষণ আরম্ভ হয় অক্ষিদ্বয়ে। কিশোরী মেয়েটি আর সইতে পারলো না এ-ই বিরহ বেদনা। তাই তো এমন দুঃসাহসিকতা! আব্বু কিংবা ভাইয়া জানলে কি করবে জানা নেই তার। সে শুধু জানে চক্ষু তৃষ্ণা মেটাতে সক্ষম হয়েছে সে। স্বচক্ষে দেখেছে তার রাহি ভাইয়াকে। অবশেষে শান্ত হয়েছে তার উতলা হৃদয়! এ-ই তো তার ক্ষুদ্র চাওয়া!

স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল ইনায়া। এবার তার ফেরার পালা। সাহসী মেয়ের মতো একাকী বাড়ি ফিরতে হবে তাকে। বন্ধুবান্ধব সাথে আনার মতো ঝুঁকি নিতে পারেনি। তাই তো ভয় বেশি। একাকী কিছু হয়ে না যায়। সে যে গাড়ি বিহীন একাকী চলাচলে অতটাও অভ্যস্ত নয়। শেষমেষ রাহি ভাইয়ার অমোঘ আকর্ষণে কোথা থেকে কোথায় চলে এলো সে! বড় ভয়ঙ্ক”র এই টান! এটা যদি ঘুণাক্ষরেও বাড়ির কেউ জানতে পারে.. সর্বনাশ হয়ে যাবে। উফ্! কাঁধের ব্যাগ হতে মোবাইল বের করলো ইনায়া। গুগল ম্যাপে আরো একবার বুঝে নিলো তার ফিরে যাওয়ার রুট। ওষ্ঠাধর গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো।

‘ কাম ডাউন ইনু! ইনশাআল্লাহ্ পৌঁছে যাবি। ‘

নিজেকে শান্ত করলো মেয়েটি। সাবধানে ব্যাগে ঢুকিয়ে নিলো মোবাইল। এদিক ওদিক তাকালো। প্রস্তুত হলো রাস্তা পাড় হবার জন্য।

চায়ের কাপ ফিরিয়ে দিয়ে সবার বিল পরিশোধ করলো রাহিদ। হাস্যমুখে ঘুরে তাকালো। বন্ধুদের কাছে পৌঁছানোর পূর্বে স্তব্ধ হলো অন্তর! দৃষ্টি নিবদ্ধ সম্মুখে। সর্বোচ্চ গতিতে স্পন্দিত হতে লাগলো হৃৎযন্ত্রটি। ঘাম ছুটে গেল। আর এক মুহূর্তও বিলম্ব নয়। ক্ষি প্র গতিতে সম্মুখভাগে ছুটলো রাহিদ। বন্ধুরা এহেন কাণ্ডে হতবাক! এটা কি হলো!

পিপীলিকার গতিতে রাস্তা পাড় হচ্ছে মেয়েটি। সতর্ক দৃষ্টি ডানে। এদিকে বামে যে আগ্রাসী ভাবে ধেয়ে আসছে মৃ*ত্যুদূত, আছে কি সে খেয়াল! নেই তো। যেই না বাম দিক হতে দ্রুতগতিতে ছুটে আসা একটি বাস তাকে প্রায় আঘাত হানবে ঠিক সে মুহূর্তে..! শক্তপোক্ত এক হাত ত্বরিত টান দিয়ে সরিয়ে নিলো। বলিষ্ঠ বক্ষপটে আবদ্ধ হয়ে দু’জনে ছিটকে সরে গেল রাস্তার একপাশে। একটুর জন্য ভারসাম্য হারিয়ে পড়তে গিয়েও পড়লো না তারা। মানবটি ঠিক আগলে নিলো। আকস্মিক কাণ্ডে চরম উত্তেজিত হৃৎপিণ্ড। স্বেদজল গড়িয়ে পড়ছে ললাট কার্নিশ বেয়ে। ভীতসন্ত্রস্ত কিশোরী কোনোরূপ বিবেচনা বিহীন আঁকড়ে ধরলো সাহায্যকারীকে। কোমল দু হাত খামচে ধরলো মানবের পিঠ। ভিজে গেল অক্ষিকোল। এখনো লম্ফ দিচ্ছে বুকের ভেতর। হঠাৎ এক ঝটকায় ছিটকে বাহুবন্ধন হতে মুক্ত হলো ইনায়া। ভীতগ্ৰস্থ মুখখানি আতঙ্কে র’ক্তিম হলো অপ্রত্যাশিত মানব অবয়ব দেখে। রাহি ভাইয়া!

” এখানে কি করছিস? ”

আতঙ্কিত নেত্রে তাকিয়ে মেয়েটি। বাকরুদ্ধ কণ্ঠনালী। ভুলে গেল কোনোরূপ জবাব দিতে। অক্ষি গড়িয়ে পড়ছে নোনাজল। শক্ত হাতে খামচে ধরেছে পোশাকের একাংশ। জবাব না পেয়ে হিং স্র রূপে রূপান্তরিত হলো রাহিদ। সারা মুখ লাল বর্ণে রঙিন। ক্রো ধ কে দমাতে ব্যর্থ হলো সে। ভুলে গেল জাগতিক হুঁশ। লোকসম্মুখে কিশোরী মেয়েটির কপোলের কোমল আবরণে শক্তপোক্ত পাঁচটি আঙ্গুল ছাপাঙ্কিত হলো। আঘাতপ্রাপ্ত কপোলে হাত ঠেকিয়ে অবিশ্বাস্য নয়নে তাকিয়ে ইনায়া! রাহি ভাইয়া তাকে চ ড় মা”রলো! কপোলের যন্ত্রণা ছাপিয়ে অসহ্য যন্ত্রণা এখন বক্ষ মাঝারে। কারে কইবে এ বেদনার কথা!

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_৩১ ( শেষাংশ )

কৃত্রিম সাজসজ্জার বহর আজ ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ। বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত দুনিয়া। তন্মধ্যে রঙবেরঙের বাহারি আলোকছটা ছড়িয়ে লিভিংরুমে। অতিথি সমাগমে আনন্দ মুখর পরিবেশ। এজাজ সাহেবকে বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাচ্ছে কিছু অতিথি। উনি গম্ভীর বদনে এক টুকরো ভালোলাগা প্রকাশ করছেন। ইনায়া, নীতি, নিদিশা একত্রে দাঁড়িয়ে আরেক পাশে। খুনসুটিতে মত্ত। পার্টিতে আগত অতিথিদের স্বাগত জানাতে ব্যস্ত রাহিদ। ইরহাম লিভিংরুমের একাংশে নিরালায় দাঁড়িয়ে। পার্টির নিরাপত্তা বিষয়ক কথাবার্তা বলছে সাহিল এবং আরেক বিশ্বস্ত সহচরের সঙ্গে। তারা ওকে নিরাপত্তার বিষয়ে আশ্বস্ত করলো। এমনই মুহূর্তে হঠাৎ আঁধারে তলিয়ে গেল কক্ষটি। চমকালো উপস্থিত সকলে! কপালে ভাঁজ পড়লো এমপি সাহেবের। কিছু একটা ভাবতেই শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো একান্ত নারীর কণ্ঠস্বর! অন্ধকারের মাঝেই কর্ণপাত হচ্ছে,

” লেডিস অ্যান্ড জেন্টেলম্যান! আসসালামু আলাইকুম। আপনাদের সকলকে সুস্বাগতম আজকের এই আনন্দঘন পরিবেশে। অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের মাঝে হাজির হয়ে আমাদের খুশিতে সামিল হওয়ার জন্য। চলুন এবার দেখে নেয়া যাক আজকের পার্টির মূল আকর্ষণ মা এবং পাপাকে। প্লিজ গিভ অ্যা রাউন্ড অফ অ্যাপ্লস্ ফর দ্যা ক্ল্যাসি কাপল! ”

করতালির ধ্বনিতে হটে গেল আঁধারিয়া চাদর। স্পট লাইটের আলো পড়লো কপোত-কপোতীর ওপর। দেখা মিললো আজকের পার্টির মূল আকর্ষণ মিস্টার অ্যান্ড মিসেস এজাজ চৌধুরীর! সিঁড়ির ধারে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে দু’জনে। এজাজ সাহেব এবং তার সহধর্মিণী মালিহা। বরাবরের মতই সাহেবী অবতারে উপস্থিত এজাজ সাহেব। মালিহার পড়নে শাড়ি। হিজাবে আবৃত কেশ। মুখে হালকা প্রসাধনীর ছোঁয়া! পুত্রবধূর অভাবনীয় কর্মে অপ্রস্তুত বোধ করছেন উনি। এই বয়সে এসে এত রঙচঙ মানায়! ইনায়া খুশিমনে ছুটে এলো। আলিঙ্গন করলো মা’কে। মালিহা মুচকি হেসে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।

” হ্যাপি অ্যানিভার্সারি আম্মু, আব্বু। ”

বাবার দিকে তাকিয়ে কিছুটা ভয় পেল মেয়েটি। যদি আব্বু রিয়েক্ট করে বসে! তবে অপ্রত্যাশিত ভাবে বাবার মুচকি হাসি ওকে স্বস্তি দিলো। কেটে গেল ভয়। অন্তরে উঁকি দিলো এক ইচ্ছে। সাহস সঞ্চয় করে সে ইচ্ছে পূরণ করতে উদগ্রীব হলো কিশোরী কন্যা। আস্তে ধীরে মা’কে ছেড়ে এগিয়ে গেল। আলতো ভাবে জড়িয়ে ধরলো বাবাকে। যথেষ্ট চমকালেন এজাজ সাহেব! ঠিক কত বছর পর মেয়ে ওনার বুকে মাথা রাখলো! এক লহমায় শান্ত হলো ওনার অশান্ত হৃদয়! এত বছর বাদে কন্যার সান্নিধ্যে ঝাঁপসা হলো নয়ন। পুত্রবধূর জোরাজুরি, ইমোশনাল ব্ল্যা!কমেইলের শিকার হয়ে আজকের এই পার্টি। মন্দ নহে! মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলিয়ে দিলেন উনি। আবেগী হয়ে পড়ছে মেয়েটি। দ্রুত নিজেকে সামলিয়ে মুচকি হেসে সরে গেল। সামান্য দূরত্বে দাঁড়িয়ে ইরহাম। দেখলো সবটুকু। হৃদয়ে অনুভূত হলো এক পশলা বৃষ্টি। মরুভূমির বুকে সে বৃষ্টি কণা সতেজতা ফিরিয়ে আনলো। মানুষটির তৃষ্ণার্ত নয়ন এদিক ওদিক ঘুরতে লাগলো। খুঁজে বেড়াচ্ছে আকাঙ্ক্ষিত নারীকে! বেশি ছটফট করতে হলো না। অবশেষে দেখা মিললো তার।

হাসিমুখে দ্বিতীয় মা-বাবার পানে এগিয়ে এলো হৃদি। আলিঙ্গনে আবদ্ধ করলো মা’কে। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানালো। পাপাকে জানাতেও ভুললো না। অজান্তেই খুশি হলো হৃদয়। মুচকি হাসলেন এজাজ সাহেব। হৃদি খুনসুটিতে মেতে উঠলো। হাসিমুখে বলে চলেছে কত কি।

মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে তার একান্ত নারী! পড়নে অপ্রত্যাশিত ভাবে শাড়ি! বেবি পিঙ্ক রঙের লাইক্রা হ্যান্ড সিকুইন এমব্রয়ডারি শাড়ি। থ্রি কোয়ার্টার স্লিভ। শাড়ির পাড়ে আকর্ষণীয় কারুকাজ! দীঘল কালো কেশ আবৃত মানানসই হিজাবে। মুখশ্রীতে প্রসাধনীর প্রলেপ। ওষ্ঠরঞ্জনী’তে রাঙা অধরে মোহনীয় হাসির দ্যুতি। ঘা’য়েল হলো পৌরুষ চিত্ত! চক্ষু তৃষ্ণা তো নিবারণ হলো। তবে হৃদয়ে জাগ্রত হলো এক সীমাহীন মিষ্টি যন্ত্রণা। তাকে কাছে পাওয়ার তীব্র অভিলাষ! কবি লেখকদের ভাষ্যে শাড়িতে নারী সবচেয়ে আবেদনময়ী। কথাটির সত্যতা আজ পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারছে এমপি সাহেব। শাড়িতে প্রথমবারের মতো অর্ধাঙ্গীর আকর্ষণীয় দর্শন! নিঃসন্দেহে পা”গলপারা অবস্থা তার। নে শা লো চক্ষুজোড়া স্থির নয় আজ। ঘুরে বেড়াচ্ছে অর্ধাঙ্গীর আপাদমস্তক। অসামান্য রূপের বহরে হয়ে যাচ্ছে ভ স্মীভূত! হৃদয়ের রানীর সামান্য রূপ বুঝি অসামান্য রূপেই ধরা দেয়! পা গ ল করে তোলে প্রেমিক পুরুষটিকে। এমপি সাহেবের অবস্থা আজ এলোমেলো। দুষ্কর হয়ে ওঠেছে নিজেকে সামাল দেয়া। এরমধ্যে হলো সর্বনা’শের শেষ ধাপ! মালিহার সঙ্গে আলাপণের এক ফাঁকে স্বামীর অবয়ব চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো হৃদির। লাইট পিঙ্ক রঙা কুর্তা পড়নে মানুষটির। কুর্তার ওপরে নেহরু জ্যাকেট। জ্যাকেটের আবরণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আয়না সমেত এমব্রয়ডারি! মসৃণ কেশ পরিপাটি রূপে সেট করা। রিমলেস চশমার অন্তরালে মোহাচ্ছন্ন অক্ষিদ্বয়! অভিব্যক্তিতে অবর্ণনীয়-মোহনীয় মা দ ক তা! রমণীর অধরকোলে লেপ্টে থাকা হাসিটুকু ধীরে ধীরে মিইয়ে গেল। লজ্জালু আভা ছড়িয়ে পড়লো বদন জুড়ে। নয়নে নয়নে হলো অব্যক্ত আলাপণ! অনুভব করলো স্বামীর অস্থিরতা। চোখের ভাষায় বুঝিয়ে দিলো প্রেমিক সত্ত্বা, আজ নিস্তার নেই তার। হতে চলেছে অভাবনীয় প্রেমাসক্ত লগন! লাজে রাঙা রমণী আর সইতে পারলো না। দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। অনুভব করতে পারলো হৃদয়ের হরতাল!
.

‘ হ্যাপি অ্যানিভার্সারি! ‘

ছেলে-মেয়েদের অনুরোধ রক্ষার্থে কেকের আবরণে একত্রে ছু রি চালালেন মালিহা-এজাজ দম্পতি। করতালির ধ্বনিতে মুখর হলো পরিবেশ। হৃদি একগাল হেসে বাবাকে বললো,

” পাপা! এবার মা’কে এক টুকরো কেক খাইয়ে দাও। ”

এজাজ সাহেবের কি হলো কে জানে! কোনোরূপ বিরূপতা না দেখিয়ে বিনা বাক্যে স্ত্রীর মুখের সামনে এক টুকরো কেক তুলে ধরলেন উনি। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে মালিহা। অশ্রু জমলো অক্ষিকোলে। বড্ড অপ্রত্যাশিত এই লগন!

” আম্মু! কি হলো? কেকটা খাও। ”

ইনায়ার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ছে উচ্ছ্বাস। মালিহা কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করলেন। কেকের এক টুকরো মুখে পুরে নিলেন। রাহিদ এবং হৃদি একত্রে বলে উঠলো,

” এবার তোমার পালা। ”

এমপি সাহেব বউয়ের পাশেই দাঁড়িয়ে। তীক্ষ্ণ চাহনিতে মেপে নিলো ভাইকে। একসাথে মিলেমিশে কথা বলা হচ্ছে! হুঁ! ছেলে-মেয়েদের অনুরোধ রক্ষার্থে মালিহা কম্পিত হস্তে স্বামীকে কেক খাইয়ে দিলেন। এক চিলতে তৃপ্তি প্রকাশ পেল এজাজ সাহেবের মুখশ্রীতে। হৃদি এবং ইনায়া করতালি দিলো বাঁধ ভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে। রাহিদ হাসিমুখে ফুপু, ফুপাকে দেখলো। হঠাৎ তার দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো ইনায়া’তে। ভাবীর সঙ্গে আলাপচারিতায় লিপ্ত মেয়েটি। এখন অবধি একটিবারের জন্যও তাকায়নি তার পানে। এত রাগ! নাকি অভিমান!

হৃদি ও ইনায়া স্বল্প ঝুঁকে নিজেদের মধ্যে ফিসফিসিয়ে কথা বলছে। ইরহাম ভ্রু কুঁচকে বোঝার চেষ্টা করছে কিসের এত গোপন আলাপ! অপেক্ষা করতে হলো না। হৃদি এবং ইনায়া সোজা হয়ে দাঁড়ালো। এজাজ-মালিহা দম্পতিকে হৃদি বললো,

” মা, পাপা! তোমাদের জন্য ছোট্ট সারপ্রাইজ রয়েছে। দেখবে না? ”

ইনায়া উত্তেজিত কণ্ঠে বললো,

” দাঁড়াও। আমি। আমি নিয়ে আসছি। ”

ছুটে গেল এবং মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলো ইনায়া। হাতে মোড়কে আবৃত গিফট বক্স। হৃদির চোখের ইশারায় এগিয়ে গেল রাহিদ। ইরহাম বোঝার চেষ্টা করছে হচ্ছেটা কি। চোখে চোখে কি চলছে! পাশাপাশি দাঁড়িয়ে রাহিদ, হৃদি এবং ইনায়া। হৃদি ওদের দু’জনের মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে। হাতে আকর্ষণীয় মোড়কে আবৃত উপহার। উপহারটি ধরে তিনজন।

” আমাদের তিনজনের তরফ থেকে তোমাদের জন্য ছোট্ট উপহার। আশা করি ভালো লাগবে। ”

হৃদির কথা শুনে এজাজ সাহেব এবং মালিহা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। রাহিদ হাসিমুখে বললো,

” কি হলো? নাও। খুলে দেখো একবার। হান্ড্রেড পার্সেন্ট গ্যারান্টি দিয়ে বলছি। পছন্দ হতে বাধ্য। ”

ইনায়া বেশ এক্সাইটেড। বাকরুদ্ধ দশা প্রায়। এজাজ সাহেব উপহারটি গ্রহণ করলেন। হৃদি খুলে দেখতে বললো। এজাজ সাহেব আস্তে ধীরে সময় নিয়ে মোড়কমুক্ত করলেন উপহারটি। উপহার স্বরূপ উন্মোচিত হলো বড়সড় আকর্ষণীয় কারুকার্য খচিত একটি ফটো ফ্রেম। অভাবনীয় উপহার! বড় মধুর। মালিহা স্বামীর নৈকট্যে এসে দাঁড়ালেন। দু’জনের চোখেমুখে বিস্ময়! পারিবারিক ফটো অ্যালবাম যেন এই ফ্রেমটি। প্রথমেই বড় করে তাদের বিবাহের ছবি। তিন কবুল বলে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার পর পাশাপাশি সোফায় বসে দু’জনে। লাজুক অভিব্যক্তি নববধূর। পাশে গম্ভীর মুখো স্বামী। এত বছরের পুরনো ফটো দেখে আবেগী হয়ে পড়লেন মালিহা। আলতো করে স্পর্শ করলেন দু’টো ভিন্ন ছবি। দুই নবজাতক সন্তান কোলে ওনার ছবি। প্রথম ছবিতে হাসপাতালের পোশাক পড়নে তার। দুর্বল শরীরে বসে বেডে। কোলে নবজাতক সন্তান ইরহাম। ওনায় মাতৃত্বের স্বাদ এনে দেয়া প্রথম সন্তান। ওনার চোখেমুখে লেপ্টে আবেগতাড়িত আভা। দ্বিতীয় ছবিতে নিজ কক্ষে বিছানায় হেলান দিয়ে বসে মালিহা। কোলে ঘুমন্ত কন্যা। ললাটে চুমু এঁকে দিচ্ছেন উনি। এছাড়াও পুরনো বেশকিছু মধুর লগ্ন ফটো রূপে স্থান পেয়েছে এই ফ্রেমে। নিঃসন্দেহে এটি অমূল্য, সবচেয়ে সেরা উপহার! নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে আবেগতাড়িত হয়ে পড়লেন মালিহা। স্ত্রীর অবস্থা দেখে পারিপার্শ্বিক অবস্থা ভুলে তার কাঁধে হাত রাখলেন এজাজ সাহেব। আলতো স্পর্শে নিষেধ করলেন কাঁদতে। বুঝিয়ে দিলেন আমি আছি তো পাশে।

ইরহাম বিমোহিত নয়নে সবটুকু দেখলো। সীমাহীন ভালোলাগায় ছেয়ে গেল অন্তঃপুর! ওষ্ঠপুটে শোভা পেল তৃপ্তির আভা। জন্মদাত্রী মা তার জন্য সাধারণের মাঝে অসাধারণ একটি সুগন্ধি ফুল নির্বাচন করেছে। জীবনসঙ্গী রূপে সে ফুলটি অতুলনীয়!
.

চলমান পার্টিতে দমবন্ধকর অবস্থা মেয়েটির। বারংবার দৃষ্টি চলে যাচ্ছে নি-ষ্ঠুর মানবের পানে। অবাধ্য নয়ন জোড়া তাকে একঝলক দেখবার জন্য আকুল! আনচান করছে অন্তঃস্থল। কিন্তু সে যে বদ্ধপরিকর। দেখবে না। তাকাবে না ওই নি-ষ্ঠুর মানবের পানে। যার মনে ওর জন্য একটুখানিও কোমলতা নেই দেখবে না তাকে। ভুলে যাবে সব। বিদ্রুপ করে ওঠে মন। ওরে! ভোলা তো যায় তারে, যে নেই কো মানসপটে। সে যে তোর মনের মধ্যিখানে বসত গেড়েছে। চাইলেই পারবি ভুলতে! উত্তর জানা সত্ত্বেও যেন অজানা। অশ্রুসিক্ত নয়ন জোড়া লুকোতে ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলো ইনায়া। দ্রুত পায়ে পার্টি ত্যাগ করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। পেছন হতে ডাকলো হৃদি। কিশোরী তা শুনলো কি! সে তো মশগুল বিরহ বেদনায়! ইচ্ছে সত্ত্বেও পিছু নিতে পারলো না হৃদি। মালিহা ডাকছে তাকে। অগত্যা এখানেই রয়ে গেল হৃদি। অগ্রসর হলো মায়ের কাছে।
.

বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে অশ্রুসিক্ত কিশোরী। হাতে একটি ফটোফ্রেম। তাতে দৃশ্যমান হৃদয়ে লুকানো অনুভূতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি। নাম যার রাহিদ। ইনায়ার রাহি ভাইয়া। ক্রন্দনে লিপ্ত মেয়েটি। ঘেঁটে গিয়েছে মুখের কৃত্রিম প্রসাধনী। ফটোতে নিষ্পলক তাকিয়ে ইনায়া। ক্রন্দনরত কণ্ঠে অসীম আকুলতা প্রকাশ করে চলেছে মেয়েটি,

” এত নি ষ্ঠুর কেন হলে তুমি? তোমার এই নি ষ্ঠুরতা যে একটু একটু করে চূর্ণ বিচূর্ণ করে চলেছে আমার হৃদয়ের আয়না। বাধ্য হচ্ছি তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে। আমি তো এ চাইনি। চেয়েছিলাম তোমার একটুখানি কোমলতা। নম্র স্বরে দু’টো আলাপ। খুব বেশি চেয়ে ফেলেছি বুঝি? তাই গলা টি পে হ*ত্যা করছো আমার হৃদয়ে লুকানো অনুভূতি? এমন করো না রাহি ভাইয়া। ভঙ্গুর হৃদয়ে বাঁচা যে বড় কষ্টকর। ভেতরটা জ্বলে পু ড়ে ছারখার হয়ে যায়। ছারখার। একটুখানি দয়া করো ভাইয়া। তোমাকে ঘৃণা করতে বাধ্য করো না। আমি যে ভালোবেসে.. ”

অসম্পূর্ণ রয়ে গেল বাক্যটি। দ্বিতীয় কারোর উপস্থিতি টের পেয়ে দ্রুত পিছু ঘুরে তাকালো ইনায়া। ধক করে উঠলো অন্তর। চোখেমুখে অসীম বিস্ময়! অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে এ কি হয়ে গেল! শেষমেষ সমস্ত লুকোচুরির সমাপ্তি ঘটেই গেল!

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে