মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-২৮+২৯

0
1099

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৮

নিকষকৃষ্ণ রজনী। শ্বশুর মশাইয়ের সঙ্গে আলাপণে লিপ্ত এমপি সাহেব। ওকে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানালেন রায়হান সাহেব। ইরহাম মুচকি হেসে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। কথোপকথনের এক পর্যায়ে ইরহামের মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। পকেট হতে মোবাইল বের করলো মানুষটি। কলার আইডি দেখে অনুধাবন করলো গুরুত্বপূর্ণ কল।

” এক্সকিউজ মি বাবা। কলটা অ্যাটেন্ড করে আসছি। ”

রায়হান সাহেব মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন। কল রিসিভ করে কথা বলতে বলতে সেথা হতে সরে গেল ইরহাম। সন্তোষজনক চাহনিতে তাকিয়ে রায়হান সাহেব। জামাতা ওনার মনের মতো। সঠিক মানুষের হাতেই মেয়েকে হস্তান্তর করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ্ মেয়ে ওনার ভালো আছে। সুখে আছে। বাবা হিসেবে আর কি চাই?
.

নিরিবিলি স্থানে দাঁড়িয়ে কথোপকথনে লিপ্ত ইরহাম। সহসা ব্যাঘাত ঘটলো ফোনালাপে। হাস্য কলরবে বিরক্ত হয়ে পিছু ঘুরে তাকালো মানুষটি। থমকালো স্পন্দন। আলোড়ন সৃষ্টি হলো অন্তরে। বিমোহিত নয়ন জোড়া নিবদ্ধ হলো এক নীলাঞ্জনা’য়! প্রাণখোলা হাসিতে মেতে সে নীলাঞ্জনা। কোলে থাকা তুলতুলে বেড়াল নিয়ে খুনসুটিতে মত্ত খুদে ভাগ্নির সঙ্গে। শিশুর সঙ্গে শিশুসুলভ উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে হৃদি। তার কাজলটানা নয়ন, ওষ্ঠরঞ্জনী’তে রাঙা ওষ্ঠাধর, অধরে লেপ্টে থাকা মোহনীয় দ্যুতি! সবেতে মোহাচ্ছন্ন হলো ইরহাম! আনমনে বিচ্ছিন্ন হলো সংযোগ। কর্ণ হতে নেমে এলো মোবাইল। অর্ধাঙ্গীর আপাদমস্তক চক্ষু বুলাতে লাগলো সে। নীলাভ সিকোয়েন্সের এমব্রয়ডারি লেহেঙ্গা। হিজাবের অন্তরালে লুকায়িত কেশরাশি। মুখশ্রীতে মানানসই প্রসাধনীর ছোঁয়া। আকর্ষণীয় লাগছে! এ সাধারণের মধ্যেও অসাধারণ রূপের বহরে ছটফটানি অনুভূত হচ্ছে অভ্যন্তরে। সঙ্গিনীর একটুখানি সঙ্গ লাভের অভিলাষ জেঁকে বসছে প্রবল রূপে। উচ্চ ধ্বনিতে ধুকপুক ধুকপুক করছে হৃৎপিণ্ড। নে শা ধরে যাচ্ছে। আর নয়। বেসামাল নিজেকে সামাল দিতে মুখ ঘুরিয়ে দাঁড়ালো ইরহাম। ঘন শ্বাস পড়ছে। এখনো চুম্বকের ন্যায় আকর্ষিত করছে মেয়েটি। উফ্! এমন করে কেউ রূপের বহর নিয়ে হাজির হয়! চঞ্চলা মেয়ে কি জানে তার সামান্য লালিত্যে আসক্ত এক কাঠিন্যতায় মোড়ানো চিত্ত! জানে না। তাই তো এমন মোহনীয় দ্যুতি ছড়িয়ে হাজির হয়েছে। জ্ব”লেপুড়ে ছারখার হচ্ছে এক পৌরুষ মন। নিজেকে জোরালো ভাবে ধাতস্থ করে বড় বড় কদম ফেলে সেথা হতে প্রস্থান করলো ইরহাম। আর এক মুহূর্তও নয়। ঘটে যেতে পারে মস্ত বড় অনাকাঙ্ক্ষিত অঘটন!
.

রাহিদ অবাক নেত্রে তাকিয়ে! এসব কি হচ্ছে! আজকের আয়োজনে এ-ও দেখার ছিল! অবিশ্বাস্য কাণ্ড! প্যান্টের পকেটে মোবাইল পুরে কাঙ্ক্ষিত স্থানে অগ্রসর হতে লাগলো রাহিদ। গিয়ে দাঁড়ালো মেয়েটির পাশে। তারা ওর উপস্থিতি টের পায়নি। নিজ কর্মে ব্যস্ত। নীরবতা ভঙ্গ করে রাহিদ গমগমে স্বরে শুধালো,

” এসব কি হচ্ছে? ”

পুরুষালি কণ্ঠে হকচকিয়ে গেল ইনায়া এবং নিদিশা! ইনায়া দ্রুত ওষ্ঠাধর হতে ড্রিংকিং গ্লাস সরিয়ে নিলো। নিদিশা হাতে থাকা মোবাইলটি নামিয়ে ইতিউতি করছে। ভাইয়া টা এখানে কি করছে! দিলো তো ওদের ফটোসেশন বরবাদ করে! আচ্ছা তার এখন কি করা উচিত? থাকবে না পলায়ন করবে! মন বললো ‘পালা’। এখানে তোর কোনো কাজ নেই। যেই ভাবা সেই কাজ। ইনায়ার থেকে বিদায় নিয়ে তড়িঘড়ি করে পলায়ন করলো নিদিশা। যাওয়ার পূর্বে ইনায়ার মোবাইলটি ফেরত দিতে ভুললো না। স্তব্ধ ইনায়া। এবার কি হবে! নিদিশা ওকে এভাবে ফাঁ সি য়ে দিলো! ইয়া খোদা! কিশোরী মেয়েটি ভীত বদনে দাঁড়িয়ে। দৃষ্টি নিবদ্ধ ঘাসের আচ্ছাদনে। মুখে কুলুপ এঁটে রইলো। বলবে টা কি? যে ওরা ফুড আইটেম নিয়ে বাহারি ফটোসেশন করছিল! অসম্ভব! এ বলা যাবে না। রাহিদ প্রশ্নের উত্তর না পেয়ে বিরক্ত হলো বটে। একটু এগিয়ে এলো ইনুর দিকে। ওর হাতে থাকা ড্রিংকিং গ্লাস নিয়ে নিলো। ইনায়া প্রশ্নবিদ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে। রাহি ভাইয়া কি করছে! জুসের গ্লাস নিচ্ছে কেন? সে কি জুস খাবে? নাকি জুসের গ্লাস নিয়ে রঙঢঙ এর ফটো তোলায় রাগারাগী করবে! প্রথম ভাবনাই সঠিক হলো। ড্রিংকিং গ্লাস হতে জুস পান করলো রাহিদ। আয়েশী ভঙ্গিতে। বড় চমকালো ইনায়া! স্বয়ংক্রিয় ভাবে পিছপা হলো দু কদম। রাহিদ জুসের গ্লাসে ওষ্ঠ চেপে ওর পানে তাকালো। অন্তর্ভেদী সে চাহনি। অস্বস্তিকর অবস্থায় কাতর ইনায়া। অবনত মস্তকে দু হাত মুচড়ে চলেছে। অরেঞ্জ জুসে তৃষ্ণার্ত গণ্ডস্থল স্বস্তি পেল। তৃপ্তির ধ্বনি মুখনিঃসৃত হলো। খালি গ্লাসটি ইনায়ার হাতে ধরিয়ে দিলো রাহিদ। চমকে গ্লাসটি আঁকড়ে ধরলো ইনায়া।

” অনেক গেস্ট এসেছে। এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে রঙঢঙ না করে তাদের সাথে কুশল বিনিময় কর। লোকে ভদ্র মেয়ে বলবে। এইসব রঙঢঙ ভালো মেয়েরা করে না। বুঝেছিস? ”

অসন্তোষ লুকিয়ে ইতিবাচক মাথা নাড়ল ইনায়া। সে নাহয় একটু আত্মতুষ্টির জন্য ফটো তুলছিল। ওর সুন্দর সুন্দর ফটো তুলে দিচ্ছিল নিদিশা। সে-ও বিভিন্ন পোজ দিচ্ছিল। কখনো জুসের গ্লাস ঠোঁটে ঠেকিয়ে, কখনো কাবাব মুখে কখনোবা ক্যান্ডিড। তাই বলে রাহি ভাইয়া এভাবে বারবার রঙঢঙ বলে অপমান করবে! কালো মেঘে ছেয়ে গেল মুখখানি। রাহিদকে অবজ্ঞা করে সেথা হতে সরে গেল ইনায়া। পঁচা লোক একটা। খালি ওর সঙ্গেই খ্যাঁ খ্যাঁ করবে। ও যেন তার চিরশত্রু! হুহ্! ইনায়া দৃষ্টি সীমার বাহিরে চলে গেলে একটি চেয়ার টেনে বসলো রাহিদ। পকেট হতে বের করলো মোবাইল। মোবাইল স্ক্রল করতে করতে মুখে পুরে নিলো একটি ফিশ কাবাব। বেশ সুস্বাদু তো!
.

যতন করে আদুরে ভাগ্নিকে আইসক্রিম খাইয়ে দিচ্ছে হৃদি। দু’জনে বসে পাশাপাশি দু’টো চেয়ারে। মমতাময়ী রূপে অবতীর্ণ হয়েছে হৃদি। ফারিজাকে আদর করে মনভোলানো কথায় ব্যস্ত রেখে খাইয়ে দিচ্ছে। সে মুহূর্তে কর্ণপাত হলো চেনা কণ্ঠে অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন,

” বরের সঙ্গে সুখে আছিস তো? ”

ডান পাশে তাকালো হৃদি। বড় বোন রাঈশা দাঁড়িয়ে। হৃদি ফারিজার মুখে আইসক্রিমের চামচ বাড়িয়ে উল্টো প্রশ্ন করলো,

” আজকের সন্ধ্যায় তুই ই এমন প্রশ্ন প্রথম করলি আপু। হঠাৎ এমন প্রশ্ন যে? ”

রাঈশা একটি চেয়ার টেনে বোনের পাশে বসলো। বললো,

” কারণ সবাই নোটিশ না করলেও আমি নোটিশ করেছি। তাই জিজ্ঞেস না করে পারলাম না। আর ইয়্যু হ্যাপি হৃদু? ”

হৃদি ওর দিকে কোমল চাহনিতে তাকালো। লালচে আভা ফুটে উঠলো কপোলের ত্বকে। এ চাহনি, লাজে রাঙা মুখখানি; সবটা বহিঃপ্রকাশ করছে। স্বচক্ষে এমন দৃশ্য অবলোকন করেও সত্যিটা মানতে অসুবিধা হচ্ছে। তাই নিশ্চিত হতে রাঈশা প্রশ্ন করলো,

” বরের জন্য আজকের এই পার্টি। আর তুই কিনা তাকে ছাড়া এর ওর সঙ্গে ঘুরে বেড়াচ্ছিস। সত্যি করে বল তো। সব ঠিক আছে তো তোদের মধ্যে? নাকি.. ”

থামিয়ে দিলো হৃদি। এ কথার পৃষ্ঠে রসিকতা করে বললো,

” আপু। নিজেকে সুখী প্রমাণিত করার জন্য বরের পিছুপিছু লেজের মত ঘুরতে হবে, এ কেমন কথা? তখন তো লোকে জামাই পা*গলী বলবে। আর তুই খুব ভালো করেই জানিস পা গ ল ত’কমা আমার কতটা অপছন্দের। সো.. ”

অবান্তর জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারলো না রাঈশা। বারবার তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকাচ্ছে। বোঝার চেষ্টা করছে বোনের মনোভাব। আসলেই কি সুখে আছে হৃদু!
.

তমস্র রজনী। বেলকনিতে প্রবেশ করলো হৃদি। ঝিরিঝিরি হাওয়া ছুঁয়ে গেল কায়া। প্রশান্তি বয়ে গেল তনুমনে। অবাধ্য রূপে নৃত্য করে বেড়াচ্ছে কেশরাশি। হৃদি এগিয়ে গেল। দু হাতে আঁকড়ে ধরলো উন্মুক্ত বেলকনির কোমর সমান উঁচু রেলিং। আবেশে মুদিত হলো আঁখি যুগল। উপভোগ করতে লাগলো আঁধারিয়া মুহুর্ত। শ্রবণেন্দ্রিয়ে কড়া নাড়ছে নিশাচরের গুঞ্জন। চোখেমুখে তৃপ্তির আভা। মায়াবী মুখে আছড়ে পড়ছে শীতাংশু’র আকর্ষণীয় জ্যোতি। অবর্ণনীয় মোহনীয় লাগছে। চক্ষু বুঁজে আঁধার রাতে প্রকৃতি বিলাসে মগ্ন এক রমণী। নজরকাড়া সে দৃশ্য! আচানক শীতল স্রোত বয়ে গেল রমণীর শিরদাঁড়া বরাবর। বলিষ্ঠ দু হাতে বেষ্টিত হলো নির্মেদ কটিদেশ। পিঠ ঠেকলো সুঠাম বক্ষপটে। আঁখি পল্লব মেলে তাকালো হৃদি। হৃদস্পন্দনের বেহাল গতিবেগ। বাঁ কাঁধে স্থাপিত হলো একান্ত জনের থুতনি। দু’জনার মধ্যকার দূরত্ব শূন্যের কোঠায়। আবেশিত রমণী আস্তে ধীরে স্বামীর হস্ত বেষ্টনীর ওপর হাত রাখলো। আঁকড়ে ধরলো নিজের সনে। আঁখি যুগল নিমীলিত হলো দু’জনার। শহুরে প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে গেল উভয়ে। উপভোগ করতে লাগলো এ মধুময় মুহুর্ত। নীরবতার চাদর হটিয়ে কর্ণ গহ্বরে পৌঁছালো কৃতজ্ঞতা সূচক বাক্য,

” থ্যাংকস অ্যা লট ওয়াইফি। ”

কর্ণপাতায় উষ্ণ পরশ উপলব্ধি করে আঁখি পল্লব মেলে তাকালো হৃদি। আবেশিত ভাঙা স্বরে শুধালো,

” কিসের জন্য জানতে পারি, জনাব? ”

মুচকি হাসলো ইরহাম। হস্ত বেষ্টনী গাঢ় করে মোহগ্রস্ত স্বরে বললো,

” এক চমৎকার সন্ধ্যা উপহার দেয়ার জন্য। ”

মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে হৃদি বললো,

” সদ্য নির্বাচিত এমপি সাহেবের জন্য এ তো কম ই আয়োজন। আরো কিছু করতে পারলে খুশি হতাম। কিছু একটার খামতি লাগছিল। ”

” নাহ্। ইট ওয়াজ পারফেক্ট! আমেজিং। ”

বাঁ কাঁধে মুখ এনে স্বামীর মুখপানে তাকালো হৃদি। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। নভোনীল চক্ষে হারালো রমণী। অতিবাহিত হলো মনোরম মুহূর্ত! সঙ্গিনীর কপোলের কোমল আবরণে হালকা চাপদাঁড়ি আবৃত কপোল ছুঁয়ে দিলো ইরহাম। মৃদু ঘর্ষণে শিউরে উঠলো মেয়েটি। নখ ডেবে গেল উদরে স্থাপিত অর্ধাঙ্গের হাতের উল্টো পিঠে। মধুরতম হাসি উপহার দিলো ইরহাম। রাতের শহরে কাছাকাছি দু’জনে! আঁধারিয়া চাদরে মোড়ানো হৃ’হাম!

আজ সে-ই বহুল প্রতীক্ষিত দিন। সংসদ ভবনে দাঁড়িয়ে সমস্ত সাংসদ। তন্মধ্যে অন্যতম একজন সফেদ পোশাকে আচ্ছাদিত ইরহাম চৌধুরী। চোখে তার রিমলেস চশমা। হাতে শপথ বাণী। অন্তরে দৃঢ়চেতা ভাব। সততার সহিত দেশসেবার বীজ রোপণ হচ্ছে হৃদ জমিনে। মাননীয় স্পিকার মহাশয়ার সঙ্গে শপথ বাক্য পাঠ করে চলেছে সকল সংসদ সদস্য। রাজনৈতিক জীবনের আজ এক অন্যতম বিশেষ দিন। উপস্থিত সদস্যদের মধ্যে অধিকাংশই পুরনো মানুষ। ইতঃপূর্বে সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন। গুটিকয়েক নতুন সদস্য। যারা আজ প্রথমবারের মতো একজন সাংসদ হিসেবে সংসদ ভবনে উপস্থিত। ইরহাম তাদের অন্তর্ভুক্ত। সকল নিয়ম-কানুন মান্য করে শপথ গ্রহণ সম্পন্ন হলো। অতি কাঙ্ক্ষিত স্বপ্ন চূড়ায় উপনীত হবার আসন গ্রহণ করলো ইরহাম। অন্তরে স্মরণ করলো সারা জাহানের মালিক, মহান রব’কে! আরম্ভ হলো এক নতুন সূচনার!
.

সান্ধ্যকালীন প্রহর। ‘ চৌধুরী গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজ ‘ এ নিজ কেবিনে কর্মব্যস্ত এজাজ সাহেব। নিরীক্ষা করে চলেছেন একটি ফাইল। পাশে দাঁড়িয়ে ওনার পি.এ। অধৈর্য হয়ে পড়ছে অল্প বয়সী তরুণ। পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পরীক্ষা করা ফাইল দ্বিতীয়বার এত মনোযোগ সহকারে পরীক্ষা করার কি আছে, সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না। বয়স কম, ধৈর্য ধারণ ক্ষমতাও কম। তেমনিভাবে অভিজ্ঞতা, বিচক্ষণতাও কম। স্বাভাবিক ভাবেই এজাজ সাহেব কেন এমন করছেন, কেন এত সতর্কতা; তার বোধগম্য হচ্ছে না। অধৈর্য হয়ে পড়ছে শুধু। স্যার বরাবর এমনই করে। এক জিনিস একাধিক বার নিরীক্ষণ। বড় ধৈর্য্যের কাজ। ব্যস্ত এ লগ্নে আকস্মিক সশব্দে বেজে উঠলো মোবাইলের রিংটোন। কর্মে ব্যাঘাত ঘটায় বিরক্ত হলেন এজাজ সাহেব। টেবিলের ওপর থাকা মোবাইলটি এগিয়ে দিলো পি.এ। উনি মোবাইলটি হাতে নিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কলার আইডি দেখে চমকালেন উনি! অপরিচিত নম্বর! কে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক? দ্বিতীয়বার রিংটোন বেজে উঠলো। রিসিভ করে সালাম দিলেন এজাজ সাহেব। ওপাশ হতে শোনা গেল অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বর,

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম। পাপা? ”

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৯

” পাপা আমার না খুব আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। ”

অপ্রত্যাশিত কণ্ঠস্বরে হতবাক এজাজ সাহেব! কান হতে মোবাইল সরিয়ে উনি পুনরায় অপরিচিত নম্বরে চোখ বুলিয়ে নিলেন। এটি হৃদির নম্বর! জানা ছিল না। থাকবে কি করে? এ কয়েক মাসে কখনো তাদের ফোনালাপ হয়নি। প্রয়োজন পড়েনি নম্বর বিনিময় করার। তাই তো আজ এমন বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি!

” পাপা ও পাপা! ”

হৃদির কণ্ঠে চেতনা ফিরলো ওনার। তবে কিছু বললেন না। শুনতে পেলেন ওপাশ থেকে আদুরী আ’বদারী স্বর,

” অফিস থেকে ফেরার সময় আইসক্রিম নিয়ো এসো পাপা। আমার জন্য চকলেট ফ্লেভার, ইনুর জন্য ভ্যানিলা আর মা, দাদি ওদের একটা হলেই হলো। তুমি মনে করে একটা ফ্যামিলি প্যাক আইসক্রিম এনো। ঠিক আছে? ”

এজাজ সাহেবের কাছ হতে জবাব না পেয়ে হৃদি ডেকে উঠলো,

” ও পাপা! শুনতে পাচ্ছো? নিয়ে আসবে কিন্তু। রাখছি তাহলে। আসসালামু আলাইকুম। ”

সংযোগ বিচ্ছিন্ন হলো। নিঃশব্দে অধর নাড়িয়ে সালামের জবাব দিলেন এজাজ সাহেব। মোবাইল রাখলেন টেবিলের ওপর। অল্প বয়সী তরুণ পি.এ অদ্ভুত চাহনিতে তাকিয়ে। স্যার কার সঙ্গে এমন নিঃশব্দে আলাপ করলো! এপাশ থেকে কোনো কথাই হলো না। অদ্ভুত না?
_

হৃদি হাসিমুখে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ডানে ফিরলো। চমকালো বেশ! আতঙ্কিত নেত্রে তাকিয়ে ইনায়া। ঠকঠক করে কাঁপছে কি! হৃদি উৎকণ্ঠিত কণ্ঠে শুধালো,

” ইনু! বেবি তুমি ঠিক আছো তো? শরীর খারাপ করছে? ”

ইনায়া ভীতসন্ত্রস্ত স্বরে প্রত্যুত্তর করলো,

” ইয়া আল্লাহ্! ভাবী তুমি এটা কি করলে? ”

” ফোন করলাম। ” হৃদির নির্লিপ্ত জবাব।

” তুমি অফিস আওয়া’রে আব্বুকে কল করছো! এটা কি করলে ভাবী? সেধে সেধে ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে তুললে? আজ তো আমরা শেষ। ঝড় উঠবে ঝড়। ”

চক্ষু বড় বড় করে দু হাত নাড়িয়ে বোঝালো আসন্ন ঝড়। হৃদি নির্বিঘ্ন চিত্তে সোফায় বসলো। ওকে নিশ্চিন্ত করতে বললো,

” তুমি না ফাও চিন্তা করছো। কিসের ঝড় উঠবে? উল্টো আইসক্রিম আসবে। আইসক্রিম। জাস্ট চিল বেব। ”

লোভাতুর চোখে তাকিয়ে মেয়েটা। ইনায়া জোরপূর্বক হাসার চেষ্টা করলো।

” আমি না এসবের মধ্যে নেই। আব্বু ক্যা লা বে আমায়। আমি নেই। ”

ছুটে পালালো ইনায়া। পেছন হতে ডাক দিয়েও সাড়া মিললো না। হৃদি তো অবাক! এত ভয়ের কি আছে? আশ্চর্য!
.

তমস্র রজনী। সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো হৃদি। পা বাড়ালো ডাইনিংয়ে। একটি চেয়ার টেনে বসলো। গ্লাসে পানি ঢেলে নিচ্ছে তখনই কর্ণপাত হলো কলিংবেলের শব্দ। পানি পান করতে করতে দেখতে পেল মালিহা সদর দরজা উন্মুক্ত করছেন। সালাম দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলেন এজাজ সাহেব। ওনাকে দেখেই পুলকিত হলো হৃদি। দ্রুত পানি পান করে দুরন্ত পায়ে ছুটে গেল পাপা’র কাছে। একগাল হেসে সালাম দিলো।

” আসসালামু আলাইকুম পাপা। ”

মৃদু স্বরে সালামের জবাব দিলেন এজাজ সাহেব। হৃদি ওনার মুখপানে তাকিয়ে উৎসাহী কণ্ঠে শুধালো,

” পাপা আইসক্রিম? ”

এজাজ সাহেব একপলক ওর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মালিহা বুঝে উঠতে পারলেন না কিসের আইসক্রিমের কথা বলছে পুত্রবধূ! এজাজ সাহেব স্ত্রীকে বললেন,

” ওপরে যাচ্ছি। ঠাণ্ডা পানি নিয়ে এসো। ”

সেথা হতে প্রস্থান করলেন উনি। হৃদি হতাশাগ্রস্থ হয়ে ওনার গমন পথে তাকিয়ে। পাপা সত্যিই আইসক্রিম আনলো না? ও তবে ভুল ভাবলো! পাপা’র আচরণে একটুও পরিবর্তন আসেনি! ভুল সবই ভুল! মালিহা ততক্ষণে কিচেনে পা বাড়িয়েছেন। হৃদি আন্ধার বদনে সোফার দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো পুরুষালি কণ্ঠস্বর,

” মেম সাহেব এটা কোথায় রাখবো? ”

পিছু ঘুরে তাকালো হৃদি। এজাজ সাহেবের ড্রাইভার দাঁড়িয়ে। হাতে? ও এম এ! আইসক্রিমের ফ্যামিলি প্যাক! চঞ্চল পায়ে ছুটে গেল মেয়েটা। প্যাক হাতে নিয়ে মিষ্টি হাসি উপহার দিলো। প্রস্থান করলো ড্রাইভার। হৃদি অবিশ্বাস্য নয়নে আইসক্রিম প্যাকের দিকে তাকিয়ে! সত্যিই পাপা তার আবদার পূরণ করেছে? সে ভুল নয়! উফ্! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে! হাসিমুখে পিছু ঘুরে তাকালো হৃদি। দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো সোফার পেছনাংশে লুকায়িত ইনায়ার দিকে। হতভম্ব নয়নে তাকিয়ে ইনু! হৃদি দাঁতের সব কয়টি পাঁটি বের করে পৈ-শাচিক হাসি উপহার দিলো। চোখের ইশারায় শুধালো,

‘ কি? কেমন দিলাম? ‘

আব্বু! আব্বু সত্যিই ভাবীর আবদার পূরণ করলো! বেহুঁশ হবার দশা সোফার পেছনে লুকায়িত কিশোরী মেয়েটির।
.

মোবাইল স্ক্রল করতে করতে বেলকনি হতে কক্ষে প্রবেশ করলো ইরহাম। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো অর্ধাঙ্গীর অবয়ব। চকলেট ফ্লেভারের কোণ আইসক্রিম খেতে খেতে বিছানায় এসে বসলো মেয়েটি। মোবাইলের পাওয়ার বাটন চেপে ওর সন্নিকটে এলো ইরহাম। বসলো ডান পাশে। তৃপ্তি সহকারে আইসক্রিম খেতে মগ্ন মেয়েটি। কেমন আদুরে ছানার মতো লাগছে! ছোট ছোট কা’মড়ে মুখে পুরে নিচ্ছে আইসক্রিমের একাংশ। ঠোঁটের উপরিভাগে লেপ্টে অল্পসল্প ক্রিম। আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে ওর দিকে তাকালো হৃদি। একগাল হেসে উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বললো,

” জানেন এই আইসক্রিম কে এনেছে? ”

ইরহাম নেতিবাচক মাথা নাড়লো। সে জানে না। হৃদি অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বললো,

” উফ্! গেস করুন না। ”

” তুমিই বলো। ”

” ধ্যাৎ! আচ্ছা শুনুন। এই আইসক্রিম ওয়ান অ্যান্ড অনলি পাপা এনেছে। ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হলো ইরহাম! কথাটা আশ্চর্যজনক বটে!

” রিয়েলি? ”

” ইয়েস। আপনি তো তখন ছিলেন না। উফ্! কি এক শ্বাসরুদ্ধকর মোমেন্ট ছিল ওটা। আমি তো ভেবেছিলাম.. ”

হৃদি চঞ্চলা রূপে ফিরে এলো। আইসক্রিম খেতে খেতে বললো গোটা ঘটনা। চমকিত নেত্রে তাকিয়ে মানুষটি! সবটাই শুনলো। উপলব্ধি করতে পারলো পুত্রবধূর মায়ার বাঁধনে একটু একটু বদলে যাচ্ছে জনাব এজাজ চৌধুরী! আসলেই কি তাই? হ্যাঁ। যেখানে ওর মতো গুরুগম্ভীর একজনের তনুমনে পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে সেখানে এজাজ সাহেব তো দুষ্কর নন। তৃপ্তিময় হাসলো ইরহাম। হৃদি তা লক্ষ্য করেনি। সে আপনমনে আইসক্রিম খাওয়ার ফাঁকে হঠাৎ কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিতে স্বামীর দিকে তাকালো। অর্ধ খাওয়া কোণ বাড়িয়ে দিলো ওর পানে।

” খাবেন? ”

না সূচক মাথা নাড়ল ইরহাম। হৃদি জোর করে বললো,

” আরে খেয়ে নিন। বেশি বাকি নেই। পরে ভাগে পাবেন না। সব অন্যের পেটে চলে যাবে। ”

মিটিমিটি হেসে বললো হৃদি। ইরহাম আপত্তি জানিয়ে বললো,

” নো প্রবলেম। তুমি খাও। ”

অপ্রসন্ন হলো হৃদি। কোণ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,

” আপনার মতো রষকষহীন দু’টো দেখিনি। আইসক্রিম খেতেও আপত্তি! ইয়া খোদা! এ কেমন রষকষহীন পিস? ”

আইসক্রিমে সবে কা”মড় বসিয়েছে হৃদি। আচমকা শিউরে উঠলো অন্তঃস্থল। ডান কাঁধের উপর আঁকিবুঁকি করে চলেছে তপ্ত শ্বাস প্রশ্বাস। উত্তপ্ত হয়ে উঠছে কোমল ত্বক। বরফের ন্যায় জমে গেল মেয়েটি। অনুভব করতে পারলো একটু একটু করে ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য। সেকেন্ডের অপেক্ষা শেষে কর্ণপাতায় পেল ওষ্ঠের নরম ছোঁয়া। তড়িৎ প্রবাহিত হলো শিরায় শিরায়। বলিষ্ঠ একটি হাত আলিঙ্গন করলো কটি। মিশিয়ে নিলো নিজের সনে। আবেশে নিভু নিভু আঁখি জোড়া। তাকাতে পারছে না একান্ত জনে। ওপাশে তাকালেই নভোনীল চক্ষুর অন্তরস্পর্শী চাহনিতে নিশ্চিত তার ম র ণ! ওই চাহনি, উষ্ণ পরশের শিরশিরানি; স্মরণে আসতেই ধুকপুকানি বর্ধিত হলো। নিমীলিত হলো নেত্র জোড়া। সহসা ঠোঁটের উপরিভাগে রূক্ষ বৃদ্ধাঙ্গুলের স্পর্শে স্তব্ধ হলো অন্তর। ত্বরিত চক্ষু মেলে তাকালো হৃদি। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। অন্তর্ভেদী চাহনিতে তাকিয়ে মানুষটি। ওর নয়নে নয়ন স্থির রেখে বৃদ্ধাঙ্গুলের স্পর্শে ঠোঁটের উপরিভাগে মুছে দিচ্ছে আইসক্রিমের হালকা প্রলেপ। অঙ্গুলির সে ছোঁয়ায় শিহরণ বয়ে যায় তনুয়। কম্পিত ওষ্ঠাধর। ক্রিমের প্রলেপ মুছে দিয়ে আরেকটু সন্নিকটে এলো মানুষটি। ওষ্ঠ ঠেকালো কর্ণ গহ্বরে। মোহাচ্ছন্ন স্বরে থেমে থেমে শুধালো,

” সত্যিই রষকষহীন আমি? আর ইয়্যু শিওর ম্যাডাম? ”

কর্ণপাতায় হালকা দন্তাঘাতে বেসামাল হলো কোমল হৃদয়। ঝড়ো হাওয়া বয়ে গেল মানসপটে। ত্বরিত উঠে দাঁড়ালো হৃদি। গলে যাওয়া আইসক্রিম হাতে ছুটে পালালো ঘর হতে। ভুল করেও তাকালো না পিছু ঘুরে।

অপরাহ্ন প্রহর। ধানমন্ডির পথে হেঁটে চলেছে তিন নারী। বয়সে তারা ভিন্ন। তবে শখ, আহ্লাদ অনেকখানি একই। অল্প বয়সী দু’জনের পড়নে একই রঙ এবং ডিজাইনের সালোয়ার কামিজ। কেশ আবৃত মানানসই হিজাবে। দেখতে জমজ বোনের মতন লাগছে। আকর্ষণীয়! মাঝবয়সী নারীর পড়নে শাড়ি। উনিও হিজাব পরিহিতা। একই ছন্দে হেঁটে চলেছে তারা। পুলকিত রবীন্দ্র সরোবর ভ্রমণে এসে।

রবীন্দ্র সরোবর মূলত একটি অ্যাম্ফিথিয়েটার। এটি একটি অর্ধবৃত্তাকার বা ডিম্বাকৃতি অবকাঠামো যেখানে দর্শকদের জন্য আসনের স্তর দ্বারা বেষ্টিত কেন্দ্রীয় স্থান। নাটকীয়তা এবং অন্যান্য অনুষ্ঠান উপস্থাপনার জন্য এটি কেন্দ্রীয় স্থান। এই ধরনের স্থাপত্যের উজ্জ্বলতার অনুপ্রেরণা প্রাচীন গ্রীক বা রোমান থিয়েটার (সফোক্লিস এবং অন্যান্যদের) থেকে পাওয়া যায়। অতএব, নাট্য প্রকাশের প্রাচীন প্রসিদ্ধি সমগ্র স্থানকে প্রতিফলিত করে। এই রবীন্দ্র সরোবরকে ঘিরে ঐতিহাসিক ধানমন্ডি লেক। হ্রদটি মূলত কারওয়ান বাজার নদীর একটি মৃ”ত চ্যানেল ছিল এবং তুরাগ নদীর সাথে যুক্ত ছিল। ১৯৫৬ সালে, ধানমন্ডি একটি বিশিষ্ট আবাসিক এলাকা হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। সেই সময়ে মূল উন্নয়ন পরিকল্পনায়, ধানমন্ডির মোট এলাকার প্রায় ১৬% হ্রদের জন্য মনোনীত করা হয়েছিল। রবীন্দ্র সরোবর শুধু লেক নয় পুরো ধানমন্ডির কেন্দ্রীয় এলাকাকে চিহ্নিত করে।

লেক সংলগ্ন পথ ধরে হেঁটে চলেছে তিনজন। বাঁয়ে দণ্ডায়মান সারি সারি দৈ-ত্যকায় বৃক্ষ। ডানে লেকের শান্ত জল। নিরিবিলি মনোরম পরিবেশে চঞ্চল হয়ে ওঠে হৃদয়। হৃদি মায়ের বাহু জড়িয়ে ধরে। তর্জনীর ইশারায় দেখিয়ে যাচ্ছে নজরকাড়া দৃশ্য। ইনায়া ক্যামেরা বন্দী করছে মনোমুগ্ধকর দৃশ্য! কখনো কখনো ক্যামেরা বন্দী হচ্ছে তিন নারী অবয়ব। লেকের ওপর অবস্থিত ব্রিজ। ব্রিজের ওপর হাতে হাত রেখে হেঁটে চলেছে তারা। শাশুড়ি, পুত্রবধূ এবং ননদের এক অভূতপূর্ব যুগলবন্দী! এমনটি আজকালকার দিনে দেখা যায় কোথায়! হাঁটা স্থগিত রেখে ব্রিজের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালো ওরা। হৃদি প্রাণ ভরে টেনে নিলো সতেজ বায়ু। পুলকিত হলো তনুমন। বুজে গেল অক্ষিপুট। মোহনীয় এই মুখখানি ক্যামেরা বন্দী করলো ইনায়া। একফাঁকে সেলফি তুললো আম্মুর সঙ্গে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে।

পশ্চিম দিগন্তে ডুবন্ত আদিত্য। লাল ও কমলার অদ্ভুদ মিশেল ছড়িয়ে দিগন্তের বুকে। শীতল পবন ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। নৃত্যরত দোপাট্টার একাংশ। লেকের শান্ত জলের ধারে শাশুড়ি মা’কে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে হৃদি। মালিহার অধরেও খুশির ছোঁয়া। ফটাফট কয়েকটা ছবি তুলে নিলো ইনায়া। নিজেও ওদের সঙ্গ দিলো। সেলফি বন্দী হলো তিনটে হাসিমুখ।

ফুড কোর্টে বসে তিনজন। তৃপ্তি সহকারে ফুচকা খাচ্ছে হৃদি, ইনায়া। মালিহা পাশে বসে। উনি কিছু খাচ্ছেন না। আশপাশের দৃশ্য অবলোকন করে চলেছেন।

” মা! ”

হৃদির ডাক শুনে ওর দিকে তাকালেন মালিহা। হৃদি ফুচকা বাড়িয়ে।

” না মা। তুই খা। ”

” উফ্ না বলবে না তো। সুস্বাদু খাবার মানা করতে নেই। আর মেয়েদের তো মোটেও নয়। আর সেটা যদি হয় ফুচকা! তাহলে তো আরো নয়। জানো না বুঝি? হা করো বলছি। হা। ”

মুচকি হেসে হা করলেন মালিহা। ওনার মুখে ফুচকা পুরে দিলো হৃদি। দেখাদেখি ইনায়াও মা’কে ফুচকা খাইয়ে দিলো। ফুচকা খাওয়ার ফাঁকে ফটো তুলতে ভুললো না হৃদি। ফুচকা মুখে তিন হাস্যোজ্জ্বল মুখশ্রী ধরা দিলো ক্যামেরায়।
.

নিরালোক রজনী। কর্ম ব্যস্ততা সেরে সবে বাড়ি ফিরলো ইরহাম। দরজা উন্মুক্ত হতে দেখা মিললো মায়ের। অন্যসময় হৃদি ই দেখা দেয়। আজ একটু ব্যতিক্রম হওয়ায় মনোক্ষুণ্ন হলো বুঝি! হবে না! সারাদিনের দূরত্ব শেষে বাড়ি ফেরা। ফিরেই একান্ত মানবীর মুখ দর্শন। প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে যায় হৃদয়ে। শান্ত হয় উচাটন করতে থাকা মন।

” আসসালামু আলাইকুম। ”

” ওয়া আলাইকুমুস সালাম বাবা। আয় ভেতরে আয়। ”

ভেতরে প্রবেশ করলো ইরহাম। মালিহা সদর দরজা বন্ধ করে ছেলের পিছুপিছু হাঁটছেন। হাঁটতে হাঁটতে ইরহাম মা’কে শুধালো,

” দিনটা কেমন কাটলো? ”

অপ্রত্যাশিত প্রশ্নে চমকালেন মালিহা! ছেলে ওনার খোঁজখবর নিচ্ছে! ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটা সবসময় নিজেকে আড়ালে রাখতে পছন্দ করে। মনের ভাব প্রকাশ করতে অপটু। লোক দেখানো যত্ন, ভালোবাসা কোনকালেই করেনি। যা থাকবে, হৃদয়ের অন্তরালে। লোকসম্মুখে নয়। সে ইন্ট্রোভার্ট ছেলেটা আজ স্বেচ্ছায় খোঁজখবর নিচ্ছে। মাতৃহৃদয় তো! আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো। ভেজা কণ্ঠে বললেন,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ভালো কেটেছে বাপ। ”

ইরহাম একপলক মায়ের দিকে তাকালো। উপলব্ধি করতে পারলো তার অবস্থা। তবে কিচ্ছু বললো না। অধর হালকা প্রসারিত করে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগলো। পেছন হতে মালিহা জিজ্ঞেস করলেন,

” খাবার বাড়বো বাবা? খাবে? ”

ইরহাম পিছু ঘুরে তাকালো। ইতিবাচক মাথা নাড়ল। খুশিমনে কিচেনে পা বাড়ালেন উনি। ইরহাম সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেল। করিডোর পেরিয়ে প্রবেশ করলো কক্ষে। দেখতে পেল..

চলবে.

[ ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যাদি সংগৃহীত। ভুলত্রুটি হলে মার্জনা করবেন। ]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে