মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-২৬+২৭

0
1208

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৬

নিকষকৃষ্ণ রজনী। নগরীর বুকে চলছে আনন্দ উদযাপন। ফলাফল ঘোষণার পর বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস প্রকাশ পাচ্ছে যত্রতত্র। বিভিন্ন স্থানে সদ্য বিজয়ী এমপি ও তার দলবল বিজয় উদযাপন করছে। শুধুমাত্র কয়েকটি আসনের ফলাফল এখনো প্রকাশিত হয়নি। আশা করা যাচ্ছে সেগুলো খুব শীঘ্রই প্রকাশিত হতে চলেছে।

নগরীর অন্যতম বড় এক কেন্দ্রে উপস্থিত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী। চৌধুরী এবং আজগর সাহেব। উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা বিরাজমান তাদের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। আজগর সাহেবের বিপি হাই। ওনার কয়েকজন চ্যা লা ওনাকে সামলাতে ব্যস্ত। অন্যদিকে ইরহাম? নির্বিকার অভিব্যক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে। বেলাশেষে ক্লান্তি পরিলক্ষিত হচ্ছে চেহারায়। হালকা পবনে শিরশির করে উঠছে কায়া। দু হাত পেছনে বেঁধে ধীরপায়ে হেঁটে চলেছে সুঠামদেহী, সুশ্রী মানবটি। ওর সহচরেরা প্রচুর চিন্তিত। শেষ মুহূর্তের গণনা স্থির নয়। কখনো আজগর সাহেব কখনোবা এগিয়ে ইরহাম। শেষমেষ কে হতে চলেছে এই আসনের বিজয়ী?

অন্ধকার আকাশের দিকে মুখ করে পেছনে দু হাত বেঁধে দাঁড়িয়ে ইরহাম। বুকে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। চক্ষুতারায় ভেসে উঠছে এক দেশনায়ক। জনগণের মাঝে সে পরিচিত ‘বঙ্গবন্ধু’ নামে। হাঁ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাবনা উদিত হয়েছে মানসপটে। বঙ্গবন্ধু এবং তার স্বদেশ প্রেম। ওনার যুগান্তকারী সাত ই মার্চের সে-ই ভাষণ। যু”দ্ধ বিধ্ব-স্ত দেশে স্বাধীনতা পরবর্তী সোনার বাংলা গঠনের অসংখ্য পদক্ষেপ। ওই একটি মানুষ ই তো তার আদর্শ। যারে আইডল হিসেবে মেনে এসেছে শৈশব হতে। হতে চেয়েছে একজন পরোপকারী, দেশের সেবক। সে ‘এমপি’ নামক ট্যাগ নিয়ে ঘোরার জন্য নির্বাচনী লড়াইয়ে নামেনি। লড়াইয়ে নেমেছে একটি সুন্দর, ক”লুষতা বিহীন দেশ গঠনের স্বপ্নে। আমাদের দেশনায়কের অপূর্ণ সোনার বাংলা গঠনের উদ্দেশ্যে। সে কোনো মহামানব কিংবা ‘নেতা’ ট্যাগের অধিকারী হতে নয় বরং জনগণকে আঁধারে দিশারী হয়ে পথ দেখাতে এসেছে। মাতৃভূমির সেবায় সদা নিয়োজিত তার তনুমন। দেশমাতৃকার সেবা করতে সে কখনো কার্পন্য করবে না। সততার সঙ্গে সেবা করে যাবে। নিঃস্বার্থ ভালোবাসা দেবে দেশমাতৃকা রে। বিনিময়ে চাইবে না সোনা-রূপা কিংবা কোনো ক্ষ”মতাশালী গদি। সে এমপি নয় জনগণের বন্ধু রূপে বেঁচে থাকতে চায়। পূরণ করতে চায় বুকে থাকা অগণিত স্বপ্ন। এতটুকুই তার চাওয়া। আদৌও পূর্ণ হবে কি সে স্বপন!
.

” ভাই জিতে গেছে। আলহামদুলিল্লাহ্! ”

আঁধার দিগন্তে তাকিয়ে মনে মনে দোয়া পড়ছিল মানুষটি। স্মরণ করছিল সারা জাহানের মালিক, মহান স্রষ্টাকে। সে মুহূর্তে কোলাহলে মুখরিত পরিবেশে উচ্চ স্বরে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে লাগলো সাহিলের উচ্ছ্বাস! থমকে গেল ইরহাম। কর্ণ গহ্বরে প্রবেশ করে চলেছে সমর্থকদের আনন্দমেলা। স্তব্ধ মানুষটির নেত্রজোড়া ধীরে ধীরে নিমীলিত হলো। একফোঁটা তপ্ত জল গড়িয়ে পড়লো নেত্র বেয়ে। মহান রব এর নিকটে অনবরত শুকরিয়া আদায় করলো মন। পেছন থেকে ছুটে এসে জাপ্টে ধরলো সাহিল। পিঠের যন্ত্রণা ভুলে মুচকি হেসে চক্ষু মেলে তাকালো ইরহাম। সমর্থকদের মাঝে চাপা পড়লো সদ্য জয়ী এমপি সাহেব! হাই প্রেশারের রোগী আজগর সাহেব হতভম্ব নয়নে এদিকে তাকিয়ে! অবিশ্বাস ছড়িয়ে ওনার শিরায় শিরায়। এ কি হয়ে গেল! তার এত বছরের সাজানো গোছানো ক্ষ”মতাশালী সিংহাসনে আজ নতুন রাজা! সব শেষ। সব।
.

আবেগতাড়িত হয়ে টিভির পর্দায় তাকিয়ে মালিহা। ওই তো ওনার পুত্রের হাসিমুখের দেখা মিলছে। মুচকি হাস্যরত মানুষটির গলায় বেশ কয়েকটি পুষ্পমালা জড়িয়ে দিলো সাহিল এবং দলীয় নেতা-কর্মী। মিষ্টি মুখ করালো একজন মাঝবয়সী সহচর। চলছে আনন্দ উদযাপন। এ দৃশ্য দেখে শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কেঁদে উঠলেন মালিহা। এজাজ সাহেবও কিঞ্চিৎ আবেগপ্রবণ হয়ে তাকিয়ে। শেষমেষ ওনার একমাত্র পুত্রের দেশসেবক হবার পথচলা শুরু হয়েই গেল! হৃদি বিমুগ্ধ চাহনিতে তাকিয়ে টিভির পর্দায় দৃশ্যমান স্বামীর অবয়বে! গলায় পুষ্পমালা জড়িয়ে তার। অধরে লেপ্টে মুগ্ধকর হাসি। আলিঙ্গন করে চলেছে সহচরদের। সমর্থকদের ভালোবাসায় সিক্ত হচ্ছে বারংবার। গর্বিত হলো নারীমন। স্বামীর সফলতা, তার বিজয়ে শুকরিয়া আদায় করলো রবের। নোনাজলে ভরে গেল নয়ন জোড়া। সহসা থমকে গেল। ক্যামেরা বরাবর তাকিয়ে হৃদয়কাড়া হাসি উপহার দিলো সদ্য নির্বাচিত এমপি সাহেব। তার ও-ই মোহনীয় হাসির রেখা যেন অর্ধাঙ্গীর হৃদয় বরাবর সরাসরি ভালোবাসার তীর বি দ্ধ করলো। যেন তার উদ্দেশ্যে এই হাসিমুখ! লজ্জা মিশ্রিত হেসে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি। ইশ্! মানুষটি এমন করে হাসি উপহার দিলো.. উচ্চ ধ্বনিতে ধুকপুকানি হচ্ছে হৃদযন্ত্রে। পাছে কেউ শুনে না নেয়! শুনলো না কেউই। ইনায়া তখন দাদি এবং রায়নাকে আলিঙ্গন করে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে।
.

সদর দরজা পেরিয়ে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এর আনন্দমেলায় প্রবেশ করলো চৌধুরী। বরাবর সামনে দাঁড়িয়ে মমতাময়ী মা। মুচকি হেসে মায়ের পানে এগিয়ে আসছে ইরহাম। তুষারের ন্যায় শুভ্রতা ছড়িয়ে তার দেহে। শুভ্র পাঞ্জাবি পরিহিত একমাত্র পুত্র এগিয়ে আসছে মায়ের পানে। মালিহার চোখের সামনে ভেসে উঠলো পুরনো এক সোনালী স্মৃতি। নয় বছর বয়সী ইরহাম দু হাত ছড়িয়ে সদর দরজা দিয়ে ছুটে আসছে। নৈকট্যে এসে ঝাঁপিয়ে পড়লো মায়ের বুকে। উত্তেজনা প্রকাশ করে বললো,

” আম্মু আম্মু! আমিও বঙ্গবন্ধু হবো। নেতার মতো। ”

আজ আর নয় বছর বয়সী ইরহাম নেই। সময়ের পরিক্রমায় সে এখন ত্রিশের কোঠা পেরোনো এক দামাল ছেলে। সুঠামদেহী ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন পুরুষ। ছেলের মুখপানে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন মালিহা। ওনার চোখে অশ্রু, ঠোঁটে হাসির রেখা। মা’কে দৃঢ় রূপে আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে নিলো ইরহাম। চূড়ান্ত রূপে আবেগের বাঁধ ভেঙে গেল। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলেন মালিহা। দু হাতে জাপটে ধরলেন ছেলেকে। কাঁদতে লাগলেন অবিরাম। মায়ের পিঠে হাত বুলিয়ে শান্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে ইরহাম। এমন হৃদয়ছোঁয়া দৃশ্যে হৃদির চোখেও জমলো নোনাজল। ইনায়া খুশিমনে এই দৃশ্য মোবাইলে ক্যামেরা বন্দী করে নিলো‌। উপস্থিত সকলের চোখেমুখে খুশির ঝিলিক।
.

নিজ কক্ষে বিছানায় বসে হৃদি। নোনাজলে ঝাপসা প্রায় অক্ষি জোড়া। চোখেমুখে পরিতৃপ্তির ছাপ। মানসপটে বারংবার ভেসে উঠছে একান্ত জনের অবয়ব। তার হাসিমুখ, আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব! এই তো ক’দিন পূর্বের কথা। ইরহাম পত্নী রূপে এ গৃহে প্রবেশ হলো তার। দেখতে দেখতে বিবাহিত জীবনের প্রায় চার মাস শেষের পথে। মাত্র চার মাসেই হৃদয়ের আপনজন হয়ে উঠলো মানুষটি। কবে কখন কি করে হৃদয়ের বদ্ধ দ্বার উন্মোচন করে প্রবেশ করলো জানা নেই। জানা আছে শুধু ‘ তারা দু’জনা একে অপরের ‘. অধর প্রসারিত হলো ভাবনায়। আসলেই তারা একে অপরের! ছেদ পড়লো ভাবনায়। দরজায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হতেই বিমোহিত হলো নারীমন! অবশেষে স্বামীর আগমন হলো! মনে পড়লো তবে সহধর্মিণীকে! ইরহামের ঝলমলে চেহারা, পরিশ্রান্ত রূপ অবলোকন করে মুহুর্তের মধ্যেই সুপ্ত অভিমান পলায়ন করলো। হৃদয়ের অলিগলি উড়াল দিলো রঙবেরঙের প্রজাপতি। প্রজাপতি ভালোবাসার! সম্মোহিতের ন্যায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। একে অপরের পানে অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে তারা। ধীরপায়ে অগ্রসর হতে লাগলো। কমতে লাগলো মধ্যকার দূরত্ব। শ্রান্ত মানুষটি দিবারাত্রি ছোটাছুটি শেষে ফিরেছে আপন নীড়ে। একান্ত মানবীর এতটুকু ছোঁয়া পেতে তৃষ্ণার্ত অন্তর। অর্ধাঙ্গিনী কি একটুখানি কাছে আসবে! কোমল স্পর্শে দূরীকরণ করবে সকল অবসাদ! তার খুশিতে সামিল হয়ে আরো মধুরতম করবে এ লগন! করবে কি?

তার হৃদয়ে লুকানো অভিলাষ পূরণ হবার পথে। চঞ্চল পায়ে ছুটে এলো হৃদি। দু হাতে স্বামীকে উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে ঠাঁই নিলো তার প্রশস্ত বক্ষপটে। পেলব দু’টো হাত আঁকড়ে ধরলো পিঠ। মৃদু আর্ত মানুষটির মুখনিঃসৃত হলো। ব্যান্ডেজের ওপর বিঁধে গেছে নখ।
র ক্ত বের হতে চলেছে কি! ভেতরকার যন্ত্রণা, অস্থিরতা গোপন করে এ মধুরতম মুহূর্তে মনোনিবেশ করলো ইরহাম। শক্তপোক্ত পেশিবহুল দু হাতের বেষ্টনীতে বন্দী হলো কোমল কায়া। নিমীলিত হলো দু’জনার আঁখি পল্লব। স্বামীর বুকের মধ্যিখানে মিশে মেয়েটি। ইরহামের মুখ লুকিয়ে সঙ্গিনীর কাঁধে। পিঠের মসৃণ ত্বকে ডেবে শক্তপোক্ত দু হাত। শিহরিত মেয়েটি আস্তে ধীরে সময় নিয়ে স্বামীর বুকের বাঁ পাশে ছোট্ট এক উষ্ণ পরশ এঁকে দিলো। মৃদু কেঁপে উঠলো কি পৌরুষ চিত্ত! বিড়াল ছানার ন্যায় বক্ষদেশে মিশে থাকা মেয়েটি মৃদু স্বরে জানান দিলো মনের কথা,

” আলহামদুলিল্লাহ্ ফর এভরিথিং! অভিনন্দন এমপি সাহেব! সফল হোক আপনার আগামীর পথচলা। ”

দৃঢ় হলো বাঁধন। আর কিচ্ছুটি বললো না কেউ। নৈঃশব্দ্যে অতিবাহিত হতে লাগলো এ মুহুর্ত। একে অপরের সংস্পর্শে খোঁজ পেল স্বর্গীয় সুখানুভূতির!
.

সমাপ্তির পথে রাত। নগরীর একপ্রান্তে যখন বিজয় উল্লাস তখন কোনো এক প্রান্তে ক্রো’ধের মারাত্মক বহিঃপ্রকাশ। হাতের নাগালে থাকা শোপিস, আসবাবপত্র সব লণ্ডভণ্ড করে ফেলছে ষাটোর্ধ্ব মানুষটি। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে চ্যা”লারা। দেখছে তাদের নেতাজীর পরাজিত সিংহের ন্যায় আ ক্রো শ। চেঁচিয়ে চলেছে মানুষটি। উঁচু স্বরে জানান দিচ্ছে,

” না। নাহ্! এ হতে পারে না.. ”

আবারো জোরালো শব্দ। টেবিলের কাঁচ ঝনঝনানিতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়লো মেঝেতে। কেটে গেল হাত। তবুও থেমে নেই আজগর। আজ রাতভর চলবে এই তা ণ্ড ব। হাতের নাগালে থাকা সব হবে ধ্বং-স। বিনষ্ট।
.

জনশূন্য কক্ষে নিশ্চিন্তে উদোম দেহে বেরিয়ে এলো ইরহাম। ওয়াশরুমে সাবধানতার সহিত ফ্রেশ হয়েছে। ব্যান্ডেজে পানি লাগানো নিষিদ্ধ। তাই বড় সাবধানে ফ্রেশ হতে হয়েছে। পানির সংস্পর্শে এখন সতেজতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে দ্রুত হস্তে ভেজা চুলে তোয়ালে চালাতে লাগলো ইরহাম। তার মনে লুকায়িত শঙ্কা শেষমেষ সত্যি হয়েই গেল। মিষ্টি মুখে কক্ষে প্রবেশ করলো হৃদি। অস্ফুট স্বরে মিষ্টি খাওয়ার ফাঁকে কিছু বলতে যাচ্ছিল মেয়েটি। তবে তা আর হলো না। থমকে গেল আকস্মিক! আতঙ্কিত নেত্র জোড়া নিবদ্ধ হলো পিঠের ক্ষতস্থানে।

” ই-রহাম! ”

ব্যস্ত পায়ে ছুটে এলো হৃদি। স্তব্ধ হয়ে গেল ইরহাম। দ্রুততার সহিত অর্ধ ভেজা তোয়ালে দিয়ে পিঠের ক্ষতস্থান লুকানোর বৃথা চেষ্টা চালালো। যা দেখার তা তো দেখা হয়েই গেছে। নৈকট্যে এসে দাঁড়ালো মেয়েটি। ইতিমধ্যে সিক্ত হয়ে উঠেছে আঁখি যুগল। পেশিবহুল ডান বাহুতে আলতো করে হাত রেখে ভেজা কণ্ঠে থেমে থেমে শুধালো,

” এস-ব কি করে হলো? ”

কণ্ঠ কেঁপে কেঁপে উঠছে। ভেতরকার ভয়, অস্থিরতা স্পষ্ট ভাবে বোঝা যাচ্ছে। অনবরত শুকনো ঢোক গিলছে মেয়েটি। মিষ্টি আঁটকে পড়েছে খাদ্যনালীতে। দমবন্ধকর অবস্থা। কষ্ট হচ্ছে শ্বাস প্রশ্বাসে। সঙ্গিনীর এমন ভীতসন্ত্রস্ত, দুঃখী অবস্থা হৃদয় মানতে নারাজ। আলতো করে বাঁ হাত টেনে হৃদিকে কাছে আনলো ইরহাম। বুকের মাঝে মিশিয়ে নিলো বউপাখিটা’কে। স্বামীর ডান হাতে আলিঙ্গনে আবদ্ধ মেয়েটি। আস্তে ধীরে স্বাভাবিক হলো। অভিমানী হৃদি চুপটি করে মিশে রইলো বুকের ভেতর। তার স্বামীর এই দুরবস্থা, ক্ষত! আর সে কিনা এ বিষয়ে অজ্ঞাত! কেন? কেন বললো না তাকে? কেন চতুরতার সহিত লুকিয়ে গেল বিষয়টি? সে কি এতটুকু জানার অধিকার রাখে না! কেন লুকালো? ভীত রমণী আলতো করে সাবধানী ভঙ্গিতে স্বামীর পিঠের কার্নিশে হাত বুলাতে লাগলো। তার অশ্রু কণা লেপ্টে যাচ্ছে প্রশস্ত উদোম বক্ষে। ক্ষণে ক্ষণে কম্পিত হচ্ছে কায়া। সবটা অনুধাবন করছে ইরহাম। তবে কোনোরূপ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলো না। হতে দিলো সবটুকু। অভিমানী কন্যার দীঘল কেশে হাত বুলিয়ে প্রশান্তি অনুভব করাতে লাগলো। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শান্ত হয়ে এলো মেয়েটি। মুক্ত হলো স্বামীর বাহুবন্ধন হতে। দৃষ্টি নত করে সরে গেল। মনোনিবেশ করলো বিছানা ঠিক করতে। বড় শ্বাস ফেলল ইরহাম। অভিমানী পাখির অভিমান এখন ভাঙাবে কি করে? হুঁ?

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৭

বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। বালিশে মাথা ঠেকে মেয়েটির। নোনাজল জমায়েত অক্ষিকোলে। চোখের পর্দায় বারংবার ভেসে উঠছে স্বামীর ক্ষতস্থান। ইশ্! শুভ্র ব্যান্ডেজের অন্তরালে ক্ষত। না জানি কতখানি আঘাত লেগেছে! খুব বেশি র-ক্তক্ষরণ হয়েছিল কি! এ আঘাত কবে পেলেন উনি! ও কি করে দেখলো না! ও বোকা নয় যে এমন একটা ঘটনা দেখেও অদেখা করে যাবে। তবে কবে আঘাতপ্রাপ্ত হলেন উনি! কাল, পরশু, কবে! আজ আনন্দঘন এই মুহূর্তে সকল আনন্দ যেন এক লহমায় ভেস্তে গেল। ভীতির সৃষ্টি হলো অন্তঃপুরে। যাতনায় ছিন্নভিন্ন অন্তর। অঝোর ধারায় বর্ষণ হতে লাগলো অক্ষি বেয়ে। শঙ্কিত হৃদয় এখনো কেঁপে কেঁপে উঠছে। আবেগঘন এই মুহূর্ত খুব কাছ থেকে অবলোকন করলো ইরহাম। দাঁড়িয়ে সে বিছানা সংলগ্ন। নিদ্রা ও ক্লান্তির মিশ্রণে বুজে আসছে আঁখি যুগল। তবুও তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে মুখশ্রীতে। সঙ্গিনীর এ যন্ত্রণা, ক্রন্দন সব যে শুধু তারই জন্যে! এর চেয়ে মধুর, তৃপ্তিময় মুহূর্ত আর কি হতে পারে? কক্ষের আলো নিভিয়ে ডিম লাইট জ্বালালো। অধর প্রসারিত করে বিছানায় বসলো মানুষটি। পিঠে টান লেগে চিনচিনে ব্যথা অনুভূত হলো। এ ব্যথা সয়ে ঘুমানো কিছুটা কষ্টসাধ্য হতে চলেছে। আড়চোখে হৃদিকে দেখে ইরহাম ইচ্ছাকৃতভাবে বেদনা মিশ্রিত স্বরে বলে উঠলো,

” ব্যথা হচ্ছে খুব! ”

আবেগী রমণী অভিমানের পাহাড় গুঁড়িয়ে মুহুর্তের মধ্যে উঠে বসলো। ছুটে এলো স্বামীর পানে। ব্যতিব্যস্ত হয়ে স্বামীর বাহুতে হাত রেখে শুধোতে লাগলো,

” খুব ব্যথা হচ্ছে? কোথায় হচ্ছে? ”

উদগ্রীব হয়ে পিঠে ক্ষতস্থান নিরীক্ষা করে দেখতে লাগলো হৃদি। বাহ্যিক ভাবে সব ই তো ঠিকঠাক। তবে! ইরহাম বিমোহিত নয়নে স্ত্রীর যত্নশীল অবতার উপভোগ করতে ব্যস্ত। হৃদি কিছুটা শাসনের ভঙ্গিতে বললো,

” আপনি না বড্ড একরোখা। পিঠে এভাবে আঘাত পেয়েছেন। তবুও কোনো বিশ্রাম নেই। দিনরাত ছোটাছুটি করেই চলেছেন। ঠিকমতো চিকিৎসা নিয়েছেন তো? নাকি তা-ও হয়নি? হুঁ? ওষুধের ধারেকাছে গিয়েছেন? ”

ইরহাম পুলকিত চিত্তে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে! তার থেকে কোনোরূপ জবাব না পেয়ে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লো হৃদি। স্বামীর মুখপানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ভেজা কণ্ঠে বললো,

” নিজেকে কেন এত অবহেলা করছেন ইরহাম? কেন বুঝতে পারছেন না আপনার শরীরে বিন্দুমাত্র আঁচ পড়লে তা কারো হৃদয় ভ”স্মীভূত করে! অসহনীয় যাতনা হয় বুকের ভেতর। অন্যের তরে বাঁচতে গিয়ে দয়া করে নিজেকে শেষ করে দেবেন না ইরহাম। একটু যত্ন নিন। প্লিজ! ”

সহধর্মিণীর এমন আকুলতা মানুষটির হৃদয়ের কুঠুরিতে সরাসরি প্রভাব ফেললো। অবাক নেত্রে তাকিয়ে রইল ইরহাম! ক্রন্দনের ফলে অর্ধাঙ্গিনীর লালাভ মুখশ্রী, ভেজা আঁখি পল্লব, কম্পিত ওষ্ঠাধর তার হৃদয়ে যেন শূ’লের ন্যায় বি দ্ধ হতে লাগলো। অন্তর্দাহ বেড়ে চলেছে। পিঠের যন্ত্রণা ছাপিয়ে এখন যন্ত্রণা হচ্ছে বুকের মধ্যিখানে। হৃদি তখনো ক্রন্দনে লিপ্ত। দিশেহারা অবস্থা দু’জনের। ভিন্ন ভিন্ন কারণে। তবে মূল সূত্র একই। দুঃখের রেশ কাটিয়ে যথাসম্ভব দ্রুততার সহিত হৃদির হাত ধরে কাছে টেনে নিলো মানুষটি। আবদ্ধ করলো সবচেয়ে সুরক্ষিত, আবেগময় বাহুডোরে। বাঁ হাতটি পিঠের মসৃণ ত্বকে চেপে বসেছে। ডান হাত আলতো করে বুলিয়ে চলেছে চুলের ভাঁজে। কানের কাছে ফিসফিসিয়ে কোমল স্বরে জানালো আপত্তি,

” হুশশ! কাঁদে না মেয়ে। শান্ত হও। এত কাঁদে না তো। আমি এখনো জীবিত। তোমার স্বামী ম রে যায়নি। একটু শান্ত হও হৃদি। ”

হিতে বিপরীত হলো। বুকের মাঝে লুকানো আদুরে পাখিটা মৃ ত্যু নামক ভয়ঙ্ক”র ক্ষুদ্র শব্দে আরো আতঙ্কিত হয়ে পড়লো। পেলব দু হাতে আঁকড়ে ধরলো স্বামীকে। ছাড়বে না। কাছছাড়া করবে না নিজ হতে। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো মেয়েটা। ব্যথিত বদনে সঙ্গিনীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো ইরহাম। ছোট ছোট কিছু উষ্ণ পরশ অঙ্কন করলো ললাট কার্নিশে। কতটা সময় পেরিয়ে গেল হুঁশ রইলো না। আস্তে ধীরে শান্ত হয়ে এলো মেয়েটি। স্বামীর বাহুডোর হতে মুক্ত হয়ে ডান হাতের উল্টো পিঠে অশ্রুবিন্দু মুছে নিলো। লালিমা লেপে মুখের সর্বত্র। ভাঙা স্বরে সে বললো,

” শেষ রাত প্রায়। একটু ঘুমিয়ে নেবেন। আসুন। ”

অবশেষে শান্ত হলো মেয়েটি। বেদনাগ্ৰস্থ চাহনিতে তাকিয়ে ইরহাম। অবলোকন করে চলেছে চঞ্চল, দুষ্টুমির সম্রাজ্ঞী তার সহধর্মিণীর এক ভিন্ন রূপ। অতি আবেগী সত্ত্বা। স্বামীর বালিশটি ঠিকঠাক করে তাকে শুয়ে পড়ার আহ্বান জানালো হৃদি। ইরহাম বালিশে একপলক তাকিয়ে মৃদু স্বরে বললো,

” পিঠে ব্যাথা। ”

না চাইতেও শক্তপোক্ত সামর্থবান মানুষটি আজ বারবার দুর্বলতা প্রকাশ করছে। অবচেতন মনে কি চাইছে সে! সঙ্গিনীর আরো বেশি উষ্ণতা, একটুখানি যত্নের প্রলেপ! হয়তো তা-ই। চিন্তায় পড়ে গেল হৃদি। ভাবনায় শুধু একটাই বিষয়। তার স্বামীর যন্ত্রণা হচ্ছে। প্রায় দু রাত নির্ঘুম সে। একটু আরামের নিদ্রা আবশ্যক। কি করে আরামের ব্যবস্থা করবে সে! কি করে! ইরহাম অনিমেষ নেত্রে স্ত্রীর পানে তাকিয়ে। সে-ও জানতে ইচ্ছুক কি করবে তার হালাল সঙ্গিনী! কি করে যন্ত্রণা বিহীন নিদ্রার আয়োজন করবে। সহসা চমকালো মানুষটি! বালিশে মাথা এলিয়ে শুয়ে পড়েছে হৃদি। দুর্বোধ্য এক চাহনিতে তাকিয়ে তার পানে। কি করতে চাইছে মেয়েটি? এমনতর চাহনির অর্থ কি? তার যন্ত্রণা অগ্রাহ্য করে শুয়ে পড়লো! পারলো এমন নির্দয় আচরণ করতে! হঠাৎ চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে স্ত্রীর মুখপানে তাকালো ইরহাম! নরম-কোমল দু হাত দু’দিকে প্রসারিত করে শুয়ে হৃদি। অন্তরস্পর্শী কণ্ঠে বিস্ময়কর আহ্বান জানালো তার সঙ্গিনী,

” আপনার সেবায় নিয়োজিত জনাব। আসুন। আরামের শয্যা গ্রহণ করুন এমপি সাহেব। ”

প্রাণোচ্ছল হাসি অধরে লেপ্টে মেয়েটির। ইরহাম নিঃশব্দ চোখের ভাষায় শুধালো সত্যিই কি তাই! আলতো করে মাথা নাড়লো সঙ্গিনী। অপ্রত্যাশিত চমকে ঝলমলে হাসলো ইরহাম। বড় হৃদয়কাঁড়া সে হাসি! মুগ্ধতা ছড়িয়ে পড়লো হৃদির অন্তরে। রাত্রির শেষভাগে আরো একবার স্বামীর হাস্যরত রূপে বড্ড বিমোহিত হলো! স্রষ্টার নিকটে প্রার্থনা করলো সে, সদা অটুট থাক তার স্বামীর এ প্রাণবন্ত আভা। ধীরস্থির ভঙ্গিতে শয্যা সঙ্গিনীর পানে অগ্রসর হতে লাগলো ইরহাম। তা লক্ষ্য করে ছড়িয়ে রাখা দু’টো হাত কি একটু হলেও শিউরে উঠলো! সন্নিকটে পৌঁছে হৃদির নয়নে নয়ন স্থির করে কিছু মুহূর্ত তাকিয়ে রইল মানুষটি। অতঃপর ক্লান্তির নিকটে হার মানলো। আস্তে করে মাথা এলিয়ে দিলো অর্ধাঙ্গীর বক্ষদেশে। শিরশির করে উঠলো কোমল কায়া। কল্লোল আছড়ে পড়লো হৃদয়ের উপকূলে। নিমীলিত হলো অক্ষি জোড়া। আরামদায়ক শয্যাস্থানে ভালোমতো মাথা এলিয়ে দিলো মানুষটি। দু হাতে আলতো করে বেষ্টিত করলো নির্মেদ কটি। বদ্ধ হলো চোখ। স্বল্প সময়ের মধ্যেই গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়ে গেল ইরহাম। আর তার বউপাখি! শিহরণে আবিষ্ট মেয়েটি নিদ্রা ভুলে জাগ্রত। স্বামীর স্বল্প ভেজা চুল ছুঁয়ে তার থুতনি। পেশিবহুল দু’টো হাত আঁকড়ে ধরেছে কটি। এমনতর ঘনিষ্ঠতা এ প্রথমবার! নিদ্রা হবে কি করে! হুঁ! জাগ্রত মেয়েটি পেলব হাতে স্বামীর চুলে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। নিশ্চিত করতে লাগলো সর্বোচ্চ আরাম। এবার একটু শান্তিতে ঘুমিয়ে নিক মানুষটি। তার যেন কোনোরূপ যন্ত্রণা-সমস্যা না হয় সেজন্য নাহয় একরাত বিনিদ্র কাটলো। অসুবিধা কি!

আলো ঝলমলে সন্ধ্যা। ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ প্রাঙ্গনে আজ বসেছে আনন্দ মেলা। একত্রিত হয়েছে পরিবার-পরিজন। ঘনিষ্ঠ স্বজন কেউ বাদ নেই। সকলেই উপস্থিত হয়েছে। কৃত্রিম আলোয় উজ্জ্বল প্রাঙ্গন। সেখানেই আয়োজিত ঘরোয়া এই পার্টি। এমপি সাহেবের বিজয় উদযাপন করতে তরুণ প্রজন্মের পক্ষ থেকে এই উদ্যোগ। বলাবাহুল্য এসবের মূল কাণ্ডারি অন্য কেউ নয় বরং এমপি পত্নী মিসেস হৃদি শেখ। প্রাঙ্গনের বিভিন্ন স্থানে হলদে আভা ছড়িয়ে রেখেছে কৃত্রিম আলোকসজ্জা। একাংশে অবস্থিত ডিনার টেবিল। টেবিলের ওপর খাবারের সমারোহ। সাথে বেশকিছু ক্যান্ডেলস্টিক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। তাতে বহ্নি শিখা ছড়িয়ে মোমবাতি। কিছু বোটানিক্যাল কাগজের গোলাকার লণ্ঠন শোভা পাচ্ছে মাথার উপরিভাগে। সবমিলিয়ে এক নজরকাড়া আয়োজন!

হৃদির বাবার বাড়ি থেকে সকলেই উপস্থিত হয়েছে। মালিহার একান্ত অনুরোধ ফেলতে পারেনি তারা। জহির সাহেবও সপরিবারে উপস্থিত হয়েছেন। ঘরোয়া এ পার্টিতে সকলেই ব্যস্ত। কেউ আলাপচারিতায়, কেউবা ফটোসেশনে।

নীলাভ সিকোয়েন্সের এমব্রয়ডারি করা লেহেঙ্গা পড়নে মেয়েটির। অপ্রত্যাশিত ভাবে কৃষ্ণবর্ণ কেশ আজ লুকিয়ে হিজাবের অন্তরালে। লেহেঙ্গার দোপাট্টা শালীনতার সহিত দেহে জড়িয়ে। মুখে মানানসই প্রসাধনীর ছোঁয়া। এমন নয়া অবতারে চমৎকার লাগছে! দাদির হাত ধরে হাসিমুখে কথা বলতে বলতে পার্টি প্রাঙ্গনে উপস্থিত হলো হৃদি। পথিমধ্যে দেখা হলো রায়নার সঙ্গে।

” ভাবী ওয়ান ফটো! ”

রায়নার অনুরোধ রক্ষার্থে দাদিকে সাবধানে একপাশে দাঁড় করিয়ে হৃদি গেল রায়নার কাছে। ননদ ভাবী যুগল মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে সেলফি তুললো। হাসিমুখে কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করলো রায়না। হৃদি ওর কপোল টিপে দিয়ে আলতো হাসলো। বিদায় নিয়ে হাজির হলো রাজেদা খানমের নিকট। উনি তখন ফারহানা’র সঙ্গে কথা বলছিলেন। এক সপ্তাহ বাদে মা’কে দেখে আপ্লুত হলো হৃদি!

” আম্মু! ”

মা’কে শক্ত করে আলিঙ্গন করলো হৃদি। ফারহানাও আবেগী হয়ে পড়লেন মেয়েকে দেখে। কতদিন পর মেয়েটাকে দেখলেন! পুরো সাত সাতটা দিন! উনিও মাতৃস্নেহে বুকে জড়িয়ে নিলেন। চোখে জমলো অশ্রু কণা। রাজেদা খানম মুচকি হাসলেন এ দৃশ্য দেখে। মা মেয়ের এমন আবেগের আলোড়ন যুগ যুগ ধরে চলমান। কভু মিইয়ে যাবার নয়।
.

রাহিদ, ফাহিম, তাঈফ এবং ইরহাম একত্রে দাঁড়িয়ে। আজকের পার্টির মূল আকর্ষণ এমপি সাহেব। পড়নে তার শ্বেত শুভ্র পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবির ওপরে নীলাভ স্লিভলেস নেহরু জ্যাকেট। বরাবরের মতই পরিপাটি, সুদর্শন রূপে দাঁড়িয়ে। রাহিদ দুঃখ প্রকাশ করে বললো,

” কি দিন এলো ভাইয়া! জিতলে তুমি। কোথায় আমাদের ট্রিট দিয়ে খাওয়াবে তা না। আমরা খাবার ভর্তি ডেকচি নিয়ে ছোটাছুটি করছি। ইজ ইট ফেয়্যার?”

ইরহাম ভাইয়ের কথার পৃষ্ঠে গম্ভীর স্বরে বললো,

” আমি কিছু ভাবার আগেই কেউ যদি ভাবীর কথায় নৃত্য শুরু করে আমি কি করতে পারি? ”

চরম আশ্চর্যান্বিত হয়ে আকাশ থেকে ছিটকে পড়লো রাহিদ!

” আ আমি নৃত্য করছি? ”

তাঈফ দাঁত কেলিয়ে হাসলো,

” ইয়েস। গিন গিন গিন নাগিন ড্যান্স। ”

রাহিদ অসন্তোষ প্রকাশ করে বললো,

” এই জন্য। এই জন্য কারোর ভালো করতে নেই। ”

চারপাশে চোখ বুলিয়ে আহাজারি করে,

” ভাবী গো! কোথায় তুমি? দ্যাখো তোমার দেওরকে কি বলে ওরা! ”

রাহিদ ন্যা কা ভঙ্গিতে হৃদির খোঁজে যাচ্ছিল। তবে এমপি সাহেব স্বশরীরে উপস্থিত থাকতে তা কি করে সম্ভব! আচানক পেছন হতে রাহিদের ঘাড়ের দিকে শার্টের কলার চেপে ধরলো ইরহাম। থেমে যেতে বাধ্য হলো ছেলেটা। পিছু ঘুরে তাকাতেই মুখোমুখি হলো নভোনীল রূঢ় চোখ জোড়ার। শুকনো ঢোক গিলে বোকা হাসি উপহার দিয়ে পূর্বের জায়গায় ফিরে এলো রাহিদ। আস্তে করে ওর কলার ছেড়ে হাত ঝাড়ল মানুষটা। তাঈফ ও ফাহিম তা লক্ষ্য করে মিটিমিটি হাসছে। রাহিদ সরু চোখে ভাইয়ের দিকে তাকালো। ইশ্! সে-ও না। এমপি সাহেবের উপস্থিতিতে তারই একমাত্র বউকে নিয়ে মশকরা করতে যাচ্ছিল! সর্বনাশ! সে যে এখনো ভ*স্মীভূত হয়নি এ-ই আজকের সেরা চমক! উফ্! বড় করে শ্বাস ফেললো রাহিদ। তাঈফ দুষ্টু হেসে বন্ধুর পাশে এসে দাঁড়ালো। বাঁ হাতে গলা জড়িয়ে অসম্ভব বেসুরো গলায় আওড়ালো জনপ্রিয় গানের কয়েক লাইন,

” আহা কেমনে রাখি বাঁ”ন্ধিয়া
এই মনের পাখি বাঁ”ন্ধিয়া
তুমি কাছে তব যে দূরে
কতো যে দূরে ওরে বঁধূয়া
পরান যায় জ্বলিয়া রে ”

গম্ভীর মানুষটা মুহুর্তের মধ্যেই অগ্নিশর্মা রূপ ধারণ করলো। তা লক্ষ্য করে নিরাপদ দূরত্বে জায়গা করে নিলো তাঈফ। সমস্বরে সে ও রাহিদ সুরে বেসুরে গাইতে লাগলো,

” পরাণ যায় জ্বলিয়া রে! ”

ফাহিম না চাইতেও ফিক করে হেসে উঠলো। আর না। এমপি সাহেব এমন ধৃষ্টতা আর সইতে পারলেন না। পাঞ্জাবির গুটানো স্লিভে হাত রাখতেই দু’জন দৌড়ে দুই প্রান্তে উড় গায়া। বোকা বনে গেল বেচারা ফাহিম। সে এভাবে একলা ফেঁসে গেল! দূর হতে এই অস্বাভাবিক-অদ্ভুদ দৃশ্য দেখতে পেল হৃদি। দূরত্বের জন্য বুঝলো না কিছুই। হচ্ছেটা কি ওখানে?
.

রাহিদ একাকী হাসতে হাসতে হেঁটে চলেছে। ইরু ভাইয়া পারেও বটে। ভালোবাসা সত্যিই বদলে দেয় একজনকে। নাহলে সামান্য কারণে ইরু ভাইয়া ঈর্ষান্বিত হয়ে সাপের মতো ফোঁস করবে! এটা তো তার স্বভাব বিরুদ্ধ আচরণ। হা হা হা। হেসে পকেট হতে মোবাইল বের করে স্ক্রল করতে লাগলো রাহিদ। তখনই..

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে