মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-২৫

0
1180

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৫ ( প্রথমাংশ )

” বাব্বাহ্! মায়ের আদুরে ধন এর পদধূলি পড়লো তবে?”

ব্যঙ্গাত্মক কণ্ঠে ভঙ্গ হলো মা ও ছেলের মধুর লগন। একরাশ ঘৃণা এসে অন্তরে স্থান করে নিলো। মায়ের ললাটে চুম্বন এঁকে উঠে দাঁড়ালো রাহিদ। ছেলেকে উঠতে দেখে পল্লবীও ভীতগ্ৰস্থ হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। ওনার হৃদয়ে লুকায়িত আতঙ্কের ছাপ। রাহিদ মা’কে উষ্ণ আলিঙ্গন করে নম্র স্বরে বললো,

” আজ আসছি মা। নিজের খেয়াল রেখো। ”

” দাঁড়াও। ”

জহির সাহেবের কণ্ঠস্বরে অনিচ্ছা সত্ত্বেও দাঁড়ালো রাহিদ। এ লোকটার মুখ দর্শন করতে সে বিন্দুমাত্র ইচ্ছুক নয়। তাই তো ওনার অনুপস্থিতিতে মায়ের সঙ্গে একটু মধুরতম, স্নেহাতুর মুহূর্ত কাটাতে এসেছিল। এরমধ্যে যে এই লোকটা আকস্মিক হানা দেবে ভাবেনি। ওকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াতে দেখে জহির সাহেবের অভিব্যক্তি পরিবর্তিত হলো। উনি নিঃশব্দে বসলেন সোফায়। পল্লবী ভয় ও সংকোচের মিশ্রণে দৃঢ় রূপে ছেলের বাম হাতটি আঁকড়ে ধরলেন। রাহিদ তা অনুধাবন করে মায়ের দিকে তাকালো। চোখের ইশারায় স্বাভাবিক থাকতে বললো। ছেলের কথামতো উনি স্বাভাবিক থাকতে পারছেন না। কেননা ওনার স্বামী নামক মানুষটির উপস্থিতি যে ওনাদের মা-ছেলের জন্য মঙ্গলজনক নয়। রাহিদ কিঞ্চিৎ তাড়া দেখিয়ে বললো,

” কিছু বলতে চান? বলার থাকলে বলে ফেলুন। আমার হাতে অত ফ্রি টাইম নেই। ”

বিদ্রুপ করে হাসলেন জহির সাহেব।

” আচ্ছা? কি এমন রাজকার্য করবে শুনি? আছে তো শুধু ওই.. ”

রাহিদ ওনার দিকে ঘুরে দাঁড়ালো। বাক্যটি অসমাপ্ত রেখে নিজেই বলে উঠলো,

” ইউজলেস কথাবার্তা রিপিটেডলি শুনতে ভালো লাগে না। আশা করি নতুন কিছু বলবেন। ”

রাশভারী কণ্ঠে জহির সাহেব বললেন,

” হ্যাডাম দেখাচ্ছো? ভুলে যেয়ো না এই মুহূর্তে তুমি কোথায় অবস্থান করছো। এটা আমার বাড়ি। ”

” আমার মায়েরও। আশা করি সেটা ভুলে যাননি। ”

অসন্তোষ প্রকাশ পেল ওনার চেহারায়,

” দিনদিন চরম বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো। কার সাথে কিভাবে কথা বলতে হয় ভুলে যাচ্ছো। ”

রাহিদ হাতঘড়িতে সময় দেখে নিলো। হাতে সময় কম। যেতে হবে। রাহিদ মায়ের দিকে একঝলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। জহির সাহেবের উদ্দেশ্যে বললো,

” আশা করি আপনার গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা শেষ। আসছি। আই হোপ বুড়ো বয়সে ইবলি*শের রূপ ধারণ করা থেকে বিরত থাকবেন। আসসালামু আলাইকুম। ”

মা’কে হালকা আলিঙ্গন করে বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেল রাহিদ। পল্লবী অশ্রুসিক্ত নয়নে ছেলের গমন পথে তাকিয়ে। সাপের ন্যায় হিসহিস করে উঠলেন জহির সাহেব। বে!য়াদব ছেলে হয়েছে একটা।

পুব দিগন্তে উদিত হয়েছে দিনমণি। তার কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। মুক্ত বিহঙ্গের দল উড়ে বেড়াচ্ছে গগণে। আরশির সম্মুখে দাঁড়িয়ে হৃদি। হাতে তোয়ালে। সদ্য স্নাত রমণীর তনুয় লেপ্টে স্বল্প সিক্ত বসন। ভেজা চুল গড়িয়ে পড়ছে বিন্দু বিন্দু জলকণা। ভিজে যাচ্ছে মেঝে। সেদিকে ভ্রুক্ষেপ আছে কি মেয়ের? সে তো ব্যস্ত ভেজা চুলে তোয়ালে চালনা করতে। ভেজা চুলের ভাঁজে ভাঁজে তোয়ালে ছুঁয়ে শুষে নিচ্ছে জল। গভীর চিন্তায় মগ্ন মেয়েটি। কি যেন এক তীক্ষ্ণ সূঁচ খুঁচিয়ে চলেছে অভ্যন্তরে। হিম হয়ে আসছে তনু। শুকিয়ে কাঠ গণ্ডস্থল। শুকনো ঢোক গিলে নিলো মেয়েটি। সে মুহূর্তে কক্ষে প্রবেশ করলো চৌধুরী সাহেব। তুষারের ন্যায় শুভ্রতা ছড়িয়ে পোশাকে। বাহিরে যাওয়ার জন্য পরিপাটি অবয়ব। ফোনালাপে লিপ্ত মানুষটি ব্যস্ত পায়ে কক্ষে প্রবেশ করলো। অগ্রসর হতে লাগলো ড্রেসিং টেবিলের ধারে। এখনো লক্ষ্য করেনি অর্ধাঙ্গীর শীতলতম আবেদনময়ী রূপ। ফোনালাপ সমাপ্ত করে পাঞ্জাবির পকেটে মোবাইল পুরে নিলো ইরহাম। ড্রেসিং টেবিলের সন্নিকটে পৌঁছাতেই ধক করে উঠলো বক্ষ পিঞ্জর। এ কেমন স্নিগ্ধ রূপে হাজির হয়েছে তার অর্ধাঙ্গিনী! যে স্নিগ্ধতা হৃদয়ের অলিগলি অনুভূতির বহ্নি শিখা প্রজ্বলিত করে চলেছে। বর্ধিত হচ্ছে হৃদস্পন্দন। পদযুগল থমকে গিয়েছে কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই। স্নিগ্ধতায় মোড়ানো রমণীর স্নিগ্ধ শোভন রূপে সম্মোহিত হলো ইরহাম! ধীরপায়ে এগোতে লাগলো অমোঘ আকর্ষণে ব”শীভূত হয়ে। নৈঃশব্দ্যে উপস্থিত হলো স্ত্রীর পেছনে।

টুলের ওপর ভেজা তোয়ালে রেখে ভেজা চুলে একবার অঙ্গুলি চালনা করে নিলো হৃদি। ভাবনায় মশগুল মেয়েটি স্বামীর উপস্থিতি উপলব্ধি করতে ব্যর্থ। তার এই অন্যমনস্ক আকর্ষণীয় রূপে বেসামাল হলো পৌরুষ চিত্ত। সিক্ত চুলের নে শা য় মত্ত হবার অভিলাষ জাগ্রত হলো অন্তরে। অন্যমনস্ক হৃদি আকস্মিক স্তব্ধ হলো! পুরুষালি দু’টো শক্তপোক্ত হাত পেছন হতে আঁকড়ে ধরেছে তার বাহুদ্বয়। থুতনি স্থাপিত হয়েছে ডান কাঁধে। স্তব্ধ নেত্র জোড়া আরশিতে নিবদ্ধ হয়ে চরম আশ্চর্যান্বিত হলো! উচ্চ স্বরে ধুকপুক ধুকপুক করে চলেছে হৃৎপিণ্ড। কাঁধে থুতনি ঠেকিয়ে রাখা মানুষটির নাসিকা ছুঁলো ভেজা চুলের একাংশ। কাঁধের ধারে ছড়িয়ে থাকা চুলের ভাঁজে ব”শীকরণ হলো প্রেমা”তাল চিত্ত! দৃঢ় রূপে আঁকড়ে ধরলো সঙ্গিনীর দু বাহু। আবেশিত রমণীর নেত্রযুগল নিমীলিত হলো। তার ভেজা চুলের সুবাসে মা”তাল প্রায় সঙ্গী। চশমা প্রদত্ত বাঁধা পেরিয়ে অর্ধাঙ্গীর কেশরাশি’তে বিমোহিত ইরহাম! অনুভূতির নতুনত্বে জাগতিক হুঁশ হারালো দু’জনে। কতটা সময় অতিবাহিত হলো জানা নেই। সহসা বিপ বিপ শব্দে চেতনা ফিরলো দু’জনের। একপ্রকার ছিটকে দূরে সরে গেল হৃদি। বক্ষদেশে হাত রেখে অনুভব করতে পারলো হৃদস্পন্দনের বেহাল দশা। এখনো কম্পিত তনুমন। উফ্! কি এক মা;দকতায় আচ্ছন্ন মুহূর্ত! অনুভূতির সাগরে তলিয়ে যাচ্ছিল দুজনা।

আস্তে ধীরে আড়চোখে ডানে ঘুরে তাকালো হৃদি। স্বামী নামক মানুষটি মোবাইলে আলাপণ করতে করতে কক্ষ হতে বেরিয়ে যাচ্ছে। দরজা পাড় হবার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে পিছু ঘুরে তাকালো ইরহাম। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। ভীতগ্ৰস্থ হলো কোমল হৃদয়। দা”নবীয় দং শ ন অনুভূত হলো অন্তঃস্থলে। অবচেতন মেয়েটির অক্ষিকোল হলো সিক্ত। কেমন দুর্বোধ্য চাহনিতে তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মানুষটি। বড় বড় কদম ফেলে প্রস্থান করলো। রমণীর কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা নোনাজল। নিজেই চমকালো হৃদি! এ অশ্রুপাতের কারণ কি? কেন অর্ধাঙ্গের বিদায়ে কাঁদছে হৃদয়! এ কিসের পূর্বাভাস!
.

দীর্ঘদিনের জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে আগামীকাল ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন।’ অন্তিম মুহূর্তের ব্যস্ততায় কাটছে দলবলের সময়। মনোনীত প্রার্থীরা সুবাহ হতে রাত্রি শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত। ভোটারদের সমর্থন কুড়োতে তাদের কৌশলের শেষ নেই। ভিন্নধর্মী বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে চলেছে তারা। জয় করতে চাইছে জনগণের মন। ইরহামও তাদের ব্যতিক্রম নয়। দিনভর ব্যস্ত সময় অতিবাহিত হলো। যথাসময়ে ভোজন অবধি সারেনি মানুষটা। এতটাই ব্যস্ত সময় কাটছে। শান্তিতে শ্বাস ফেলাও এখন দুষ্কর। অন্যদিকে আজগর সাহেব! উনি প্রবীণ এক রাজনীতিবিদ। দুইবারের মন্ত্রী। স্বাভাবিক ভাবেই এক তরুণের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় উনি অতটাও চিন্তিত নন। তবুও মন যে মানে না। ওই দু’দিনের তরুণের একের পর এক ভিন্নধর্মী কৌশল, ব্যক্তিত্ব, সততা এবং বুদ্ধিদীপ্ত মানসিকতা ওনাকে বারংবার দুশ্চিন্তায় ফেলে দিচ্ছে। তন্মধ্যে ঘটেছে আরো দু’টো অনাকাঙ্ক্ষিত ক্ষতিকর কাণ্ড। যা সম্পর্কে অজ্ঞাত সাধারণ জনগণ। ও-ই দু’টো কাণ্ডে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েছেন আজগর সাহেব। তাই তো দু’দিনের পথের কাঁটাকে পথ হতে উপড়ে ফেলতেও কালক্ষেপণ করতে চাইছেন না। পথের কাঁটা উপড়ে ফেলার সঠিক সময় তবে চলেই এলো!
.
.

তমসাচ্ছন্ন রজনী। ঘড়ির কাঁটা তখন এক এর কাছাকাছি। মধ‌্যরাত। চারিদিক নিস্তব্ধ। ভেসে ভেসে শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছাচ্ছে নিশাচরের কলবর। উত্তপ্ত দিন শেষে রাতের ঠাণ্ডা হাওয়া শরীরের পশম দাঁড় করিয়ে দেবার মতন। নিরিবিলি পথ ধরে হেঁটে চলেছে ইরহাম, সাহিল এবং তিনজন দলীয় কর্মী। আগামীকালের নির্বাচনী আলাপচারিতায় লিপ্ত পাঁচজন। দু পাশে দণ্ডায়মান দালান যেন দা-নবীয় ভঙ্গিতে শির উঁচু করে দাঁড়িয়ে। স্ট্রিট লাইটের মৃদুমন্দ আলো ওদের দেহে পড়ছে। রাস্তার বুকে দৃশ্যমান হচ্ছে পাঁচ মানবের চলন্ত কৃষ্ণবর্ণ ছায়া। ভূতুড়ে হিমশীতল পরিবেশ। নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ মানুষটি ওদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা প্রদান করছে। আর মাত্র স্বল্প দূরত্ব। এরপরই ইরহামের গাড়ি এবং মূল সড়ক। বিচ্ছিন্ন হবে ওদের পথ। যে যার গন্তব্যে রওনা হবে। ওদের পরিকল্পনা মাফিক পথচলায় আকস্মিক বাঁধা পড়লো। পাঁচ মানবের পথরোধ করে উপস্থিত হলো একটি জিপ গাড়ি। গাড়ির ফ্রন্ট লাইট সরাসরি সম্মুখে দণ্ডায়মান ইরহামের চোখে পড়লো। আকস্মিক আলোকরশ্মিতে ধাঁধিয়ে গেল চক্ষু। ডান হাতের উল্টো পিঠ চোখের ওপর রেখে তীব্র আলো হতে চক্ষু বাঁচালো সে। আস্তে ধীরে চোখের সামনে হতে হাত সরিয়ে ফেললো। চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো একটি জিপ গাড়ি। আর সাত আটজনের মতো মুখোশধারী আগন্তুক। কপালে চিন্তার বলিরেখা পড়লো। সাহিল আস্তে করে এগিয়ে এসে ইরহামের কানে ফিসফিসিয়ে বললো,

” ভাই সুবিধার লাগছে না। ”

ইরহাম চোখের ভাষায় ওকে কিছু বুঝিয়ে দিলো। শঙ্কিত সাহিল মাথা নেড়ে পূর্বের স্থানে দাঁড়ালো। সহচর তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। চোখের সামনে জিপ গাড়ি হতে একে একে নেমে এলো অজ্ঞাত মুখোশধারী আগন্তুকের দল। কৃষ্ণবর্ণ পোশাক পড়নে তাদের। মুখে অদ্ভুত মুখোশ লেপ্টে। চেহারা চেনার সম্ভবনা অতীব ক্ষীণ। হাতে ওদের ধারালো
অ স্ত্র। এদের আগমনের মূল হেতু বুঝতে অসুবিধা হলো না ইরহামের। ভীতিকর পরিস্থিতি একটুও কাবু করলো না তাকে। বরং অকুতোভয় বীরের ন্যায় শত্রুর মোকাবেলায় প্রস্তুত সে। নেতা গোছের একজন দু পাশে থাকা সঙ্গীদের ইশারা করলো। ইশারা পাওয়া মাত্রই
ক্ষি প্র গতিতে ছুটতে আরম্ভ করলো দু’জন মুখোশধারী। ধারালো অ স্ত্র হাতে ইরহামকে নিশানা করে ছুটে আসছে তারা। স্ট্রিট লাইট এবং জিপ গাড়ির ফ্রন্ট লাইটের সংমিশ্রনে এক অদ্ভুত আলোকছটা ছড়িয়ে। আক্রমণকারীর পানে তীক্ষ্ণ চাহনিতে তাকিয়ে ইরহাম। চক্ষু হতে চশমা খুলে পাঞ্জাবির পকেটে পুরে নিলো। সুদক্ষ ভঙ্গিতে গুটিয়ে নিলো পাঞ্জাবির স্লিভ। প্রস্তুত সে।

ধারালো অ স্ত্র হাতে আঘাত করতে উদ্যত হলো একজন। শিরদাঁড়া সোজা করে অকুতোভয় দৃঢ় চিত্তে দাঁড়িয়ে ইরহাম। যেই না লোকটি অতি সন্নিকটে হাতের নাগালে এলো অমনি চতুরতার সহিত আক্রমণকারীর চোয়াল বরাবর ডান হাতে হুক পাঞ্চ করলো ইরহাম। চোয়ালে আকস্মিক আঘাতে খেই হারিয়ে ফেললো লোকটি। দুর্বল হলো স্নায়ু। সে সুযোগে তাকে প্রতিহত করে দ্বিতীয় আক্রমণকারীর পাঁজরের খাঁচা বরাবর শক্তপোক্ত লা থ চালালো ইরহাম। ছিটকে দূরে পড়লো লোকটি। আর হাতের নাগালে থাকা লোকটির নাকে পড়লো মুষ্ঠিমেয় এক ঘু ষি। অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধে চমকে গেল শত্রুপক্ষ! আরো দু’জন ছুটে এলো আঘাত করবার উদ্দেশ্যে। একজনের ঘাড়ে আঘাত করে দ্বিতীয় জনের লিভার বরাবর আঘাত হানলো চৌধুরী সাহেব।দু’জনেই দুর্বল হয়ে পড়লো। চেষ্টা করতে লাগলো আক্রমণ করার। সাহিল এবং সঙ্গী তিনজন প্রসন্ন চিত্তে রাস্তার এক পাশে দাঁড়িয়ে লাইভ ফাইটিং দেখছে। তাদের ‘ ভাই ‘ একা হাতেই জাস্ট ফাটিয়ে দিচ্ছে।

আর একজন পাশ হতে আঘাত করতে উদ্যত হলো। ইরহাম তার সোলার প্লেক্সাসে বসিয়ে দিলো এক হাতুড়ি সম ঘু ষি। কঁকিয়ে উঠলো সে লোক। সুদক্ষ ভঙ্গিতে মারাত্মক ‘ ক্রভ মাগা ‘ কৌশল অবলম্বন করে শত্রুদের একাই ধরাশায়ী করে ফেলছে বলিষ্ঠদেহী মানব। মরণা*স্ত্র নিয়ে উপস্থিত শত্রুর দল এখন নিজেরাই চোখের সামনে ম র ণ দেখছে। বলশালী চৌধুরীর একেকটি আঘাত তাদের বিধ্ব-স্ত করে চলেছে। অসীম যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে আহত লোকেরা। কেউ কেউ আহত শরীর নিয়েই আঘাত করবার চেষ্টায় লিপ্ত। এমনই ভাবে ঘটলো অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা। কাপুরুষের ন্যায় পেছন হতে ছু-রিকাঘাত করলো এক দু*র্বৃত্ত। শুভ্র পাঞ্জাবি ভেদ করে পিঠের মসৃণ ত্বকে আঘাত হানলো ছু রি। চামড়া চিঁ’ড়ে বেরিয়ে এলো র-ক্তকণিকা। আঁতকে উঠলো সাহিল এবং তিন সহচর!

” ভাই! ”

সাহিল ছুটে এলো। ইরহামকে ধরার পূর্বেই ইরহাম পিছু ঘুরে আঘাতকারীর শ্রবণ অঞ্চল বরাবর শক্তিশালী
ঘু ষি বসিয়ে দিলো। অতঃপর পাঁজরের খাঁচায় এক
লা থ। ছিটকে দূরে গিয়ে ল্যাম্পপোস্টে আঘাত পেল লোকটি। ইরহাম বাঁ হাতে পিঠের ক্ষত স্পর্শ করার বৃথা চেষ্টা চালালো। যন্ত্রণায় বিকৃত হয়ে আসছে মুখশ্রী। সাহিল ত্বরিত এগিয়ে এসে পকেট হতে রুমাল বের করে ‘ভাই’ এর ক্ষতস্থানে চেপে ধরলো। তিন সহচর এবার কুপোকাত করতে লাগলো দুর্বল শত্রুদের। ঠিক সে মুহূর্তে…

চলবে.

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২৫ ( শেষাংশ )

নিস্তব্ধতার চাদর হটিয়ে কর্ণপাত হচ্ছে পুলিশের গাড়ির আগমন। বিপদের বার্তা সমেত ধেয়ে আসছে সাইরেন এর আওয়াজ। বাঁধা পড়লো শত্রু শত্রু খেলায়। ত্বরিত আহত শরীরে উঠে পড়লো একেকজন দু”র্বৃত্ত। তড়িঘড়ি করে তাদের জিপে উঠে বসলো। উল্টো পথে পলায়ন করলো চোখের পলকে। ইরহামের দলীয় তিন কর্মী বাঁধা দিতে গিয়েও ব্যর্থ। তখনই ওদের সম্মুখে এসে দাঁড়ালো পুলিশের গাড়ি। আহত ‘ভাই’ এর পিঠে রুমাল চেপে র”ক্তক্ষরণ বন্ধের চেষ্টায় লিপ্ত সাহিল। ধীরপায়ে পুলিশ ও চৌধুরী মুখোমুখি হলো। গুরুত্বপূর্ণ আলাপ শেষে ইরহাম উঠে বসলো তাদের গাড়িতে। নিশুতি রাতে গাড়ি রওনা হলো চিকিৎসালয়ের উদ্দেশ্যে।
.

ঘড়ির কাঁটা তখন পৌনে পাঁচের নিকটবর্তী। কৃষ্ণাবরণ দূরীভূত হয়ে শ্লথ গতিতে আলোর আভা ফুটে উঠছে দিগন্তে। ডুপ্লিকেট চাবি ব্যবহার করে ‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ প্রবেশ করলো ইরহাম। সদর দরজা বদ্ধ করে দুর্বল কদম ফেলে সিঁড়ির ধারে অগ্রসর হলো। পরিবারের সদস্যরা তখন জাগ্রত সালাত আদায়ের উদ্দেশ্যে। তাদের দৃষ্টির আড়ালে ইরহাম পৌঁছে গেল নিজ কক্ষে। যন্ত্রণায় ছিঁড়ে যাচ্ছে পৃষ্ঠদেশ। বিনিদ্র রজনী কাটানোর ফলস্বরূপ চোখের সফেদ অংশ র”ক্তবর্ণ ধারণ করেছে। চোখেমুখে অবর্ণনীয় ক্লান্তির ছাপ। দুর্বলতায় ভারসাম্য হারিয়ে বেঁকে আসছে পদযুগল। ফুটন্ত লাভার ন্যায় টগবগ করছে মস্তিষ্ক। ধীরপায়ে কক্ষে প্রবেশ করে হতবাক হলো মানুষটি! আলোকছটা ছড়িয়ে সারা ঘরে। শূন্য বিছানা। হালাল সঙ্গিনী তবে কোথায়? ছোট ছোট কদম ফেলে ভেতরে গেল ইরহাম। যাতনা মিশ্রিত চোখে এদিক ওদিক তাকাতেই থমকে গেল! প্রশান্তি নেমে এলো চক্ষুতারায়। শীতল পবন বয়ে গেল অন্তঃপুরে। ডিভানে গুটিসুটি ভঙ্গিতে শুয়ে তার অর্ধাঙ্গিনী। দেখেই বোঝা যাচ্ছে অগণ্য মুহূর্ত অপেক্ষা করতে করতে এমনতর নিদ্রার আগমন। তৃপ্তির আভা ছড়িয়ে পড়লো চোখেমুখে। ধীরগতিতে পা ফেলে একপ্রকার ব”শীভূত হয়ে সঙ্গিনীর পানে এগোতে লাগলো ইরহাম। অনুভব করতে লাগলো বর্ধিত স্পন্দনের গতিবেগ। লাব ডাব লাব ডাব ধ্বনি কড়া নাড়ছে কর্ণ গহ্বরে। অবচেতনে তৃপ্তিময় রেখা ফুটে উঠলো অধরকোলে। ভেতরকার যন্ত্রণা, অস্থিরতা, ক্লান্তি ভুলে অর্ধাঙ্গীর নৈকট্যে পৌঁছালো মানুষটি।

ঘুমন্ত মায়াবিনীর মায়াজালে জড়িয়ে ইরহাম। মোহাচ্ছন্ন হয়ে হাঁটু গেড়ে বসলো ডিভানের ঠিক পার্শ্বে। সঙ্গিনীর মুখ বরাবর। নিষ্পলক তাকিয়ে রইল মায়ায় ভরপুর মুখখানিতে। ঘুমন্ত কন্যার মুখে এখনো বিরাজমান দুশ্চিন্তার ছাপ। তা উপলব্ধি করেই অদ্ভুত শান্তিতে প্রচ্ছন্ন হলো হৃদয়! এই যে অন্তরে কিছু মুহূর্ত পূর্বেও উচাটন করছিল, পীড়নে পু’ড়ছিল স্বত্ত্বা তা এখন কই হারিয়ে গেল! সেথায় বিরাজ করছে আবেগী মধুর তোলপাড়। শান্তিতে বুজে আসতে চাইছে অক্ষিজোড়া। একটুখানি সঙ্গিনীর গভীর স্পর্শের লো ভে মরিয়া অন্তর। বেসামাল স্বত্ত্বা অনবরত ছটফটিয়ে যাচ্ছে। আর দমানো গেল না নিজেকে। নিদ্রাচ্ছন্ন রমণীকে দু হাতের বাঁধনে বেঁধে নিলো। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো হৃদি। স্বামীর বুকের বাঁ পাশে মিললো ঠাঁই। গভীর নিদ্রায় শায়িত রমণী টেরও পেলো না এ মুহূর্তে তার অর্ধেক অংশ তার স্বামীর ভেতরে চলমান তুফানের গতিবেগ। প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্যে চঞ্চল হয়ে উঠল পৌরুষ চিত্ত। আবেশে নিমীলিত হলো নেত্র। প্রগাঢ় রূপে বুকের বাঁ পাশে মিশে রইলো হৃদয়ের একচ্ছত্র অধিকারিণী। ঘুমন্ত কন্যার চুলের ভাঁজে উষ্ণ পরশ বুলিয়ে তাকে দু হাতে পাঁজাকোলে তুলে নিলো। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো পিঠের ক্ষত’তে কেউ ভয়ঙ্ক”র এ!সিডের প্রলেপ মেখে দিয়েছে। চিড়চিড় করে উঠলো সদ্য প্রাপ্ত ক্ষত। পরিহিত নতুন পাঞ্জাবির আড়ালে লুকায়িত সফেদ ব্যান্ডেজে দেখা মিললো ছোপ ছোপ লাল বর্ণের। তবুও দমে গেল না মানুষটি। হৃদিকে পরম যত্নে বাহুডোরে আগলে নিয়ে অগ্রসর হলো বিছানায়। শুয়ে দিলো বিছানার নরম আবরণে। বেদনা মিশ্রিত চাহনিতে তাকিয়ে রইলো কয়েক পল। মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বেদনাদায়ক ঢোক গিললো। দাঁড়ালো সোজা হয়ে।

ভোর হয়ে এসেছে। সূর্য উঠছে পুব দিগন্তে। মসজিদ থেকে সালাত আদায় করে আসায় সে কর্ম নেই। আর অর্ধাঙ্গিনী যে ছুটিতে রয়েছে সে বিষয়ে জ্ঞাত সে। তাই আর নিদ্রা ভঙ্গ করে উঠালো না। আরামে থাকতে দিয়ে সে অগ্রসর হলো কাবার্ডের ধারে। সতেজতার জন্য আনচান করছে শরীর। ফ্রেশ হওয়া আবশ্যক হয়ে দাঁড়িয়েছে। গতরাতে কম তো ছোটাছুটি হয়নি। শত্রু শত্রু খেলা। এরপর চিকিৎসালয় ভ্রমণ করে পুলিশ স্টেশনে গমন। পিঠের ক্ষতস্থানে সেলাই পড়েছে। এ অবস্থাতেও থেমে নেই মানুষটি। রাতভর ছোটাছুটি করে ভোরে ফিরলো আপন নীড়ে। কাটলো এক বিনিদ্র রজনী।

‘ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘ আজ। সে-ই বহুল প্রতীক্ষিত দিন। সকাল হতেই আনন্দাঙ্গনে উত্তেজনাময় পরিবেশ। মালিহা, হৃদি, ইনায়া বেশ উত্তেজিত আজকের দিনটি নিয়ে। তাদের আপনজন যে প্রথমবারের মতো নির্বাচনী লড়াইয়ে নেমেছে। কে জানে বিজয়ের মুকুট কার মাথায় উঠবে। শুধু এতটুকু জানে তাদের আপনজন মানুষটি নিজের সেরাটা দিয়ে লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। প্রচেষ্টা চালিয়েছে শেষ বিন্দু অবধি। দেখা যাক কি থেকে কি হয়।
.

সকাল আটটা থেকে আরম্ভ হয়েছে ভোট প্রদান। চলবে বিকাল চারটা পর্যন্ত। রৌদ্রজ্জ্বল এ দিনে অগণিত ভোট কেন্দ্রে ভোটারদের উপচে পড়া ভিড়। সকাল থেকেই দলে দলে উপস্থিত হয়েছে তারা। কোথাও কোথাও দুপুর বারোটার পর ভোটারদের উপস্থিতি বৃদ্ধি পেয়েছে। প্রত্যেক কেন্দ্রে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে দায়িত্বরত পুলিশ, আনসার সদস্য সহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। বেশ কিছু কেন্দ্র ঝুঁকিমুক্ত। সেথায় নির্বিঘ্নে ভোটদান প্রক্রিয়া চলছে। রিটার্নিং কর্মকর্তার মতে, নির্বাচনে কোনো রাজনৈতিক চাপ নেই। কয়েক প্লাটুন বিজিবিসহ মাঠে অবস্থান করছে মোবাইল কোর্ট ও স্ট্রা*ইকিং ফোর্স। রাস্তায় রাস্তায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা। বিভিন্ন কেন্দ্রে দেখা মিলছে মনোনীত প্রার্থীর। ইরহামও ব্যতিক্রম নয়। আহত শরীর নিয়ে কেন্দ্রে অবস্থান করছে। সঙ্গে রয়েছে দলীয় সমর্থক এবং সাহিল।

রৌদ্রের কিরণ সরাসরি পড়ছে দেহে। ঘর্মাক্ত ক্লান্ত শরীরে ভোট প্রদান করতে লাইন ধরে দাঁড়িয়ে অসংখ্য মানুষ। নারী পুরুষের ঢল নেমেছে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রায় সকলেই নিকটস্থ কেন্দ্রে পছন্দের কাঙ্ক্ষিত প্রার্থীকে ভোট দিতে এসেছে। ধৈর্য ধরে রোদের উত্তাপ সয়ে কেন্দ্রে প্রবেশ করছে তারা। নিয়ম কানুন মান্য করে ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট প্রদান করছে। অতঃপর স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে প্রস্থান করছে সেথা হতে। সকলের চোখেই সুন্দর এক রাজনৈতিক ব্যবস্থার স্বপ্ন। কবে গড়ে উঠবে আকাঙ্ক্ষিত সোনার বাংলা!

নগরীর বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা ব্যবস্থা থাকা সত্ত্বেও সহিংস*তার দেখা মিললো। ব্যালট পেপারে সিল মা”রা কিংবা ভোট কারচুপির অভিযোগে সমর্থকদের মধ্যে সংঘ*র্ষ বেঁধে গেল। আরম্ভ হয় ধাওয়া, পাল্টা ধাওয়া। উপস্থিত ভোটাররা এতে প্রচুর ভীতসন্ত্রস্ত, বিব্রত হয়ে পড়ে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে পুলিশ। তাদের কার্যকারী কৌশলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসতে বাধ্য হয়।

দিনভর ভোট প্রদান কার্যক্রম চললো। ঘড়ির কাঁটা তখন চারের ঘর পেরিয়েছে। সমাপ্ত হলো ভোটদান প্রক্রিয়া। আরম্ভ হতে চলেছে গণনা কার্যক্রম।
.

গোধূলি লগ্ন। লিভিংরুমে উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। মনোযোগ তাদের টিভির পর্দায়। বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলে গণনা কার্যক্রমের সর্বশেষ আপডেট দেখানো হচ্ছে। সোফায় বসে মালিহা, হৃদি, ইনায়া এবং রাজেদা খানম। সঙ্গে রয়েছে নতুন অতিথি। নীতি, নিদিশা, পল্লবী এবং রায়না। আজকের বিশেষ দিনে তারা না এসে পারলো না। মালিহা বারবার চ্যানেল পরিবর্তন করে সর্বশেষ আপডেট দেখছেন। আর উৎকণ্ঠা প্রকাশ করছেন। কেননা সর্বশেষ আপডেট মোতাবেক ইরহামের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী আজগর সাহেব এগিয়ে। পল্লবী বিষয়টি অনুধাবন করে মালিহাকে বললেন,

” শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করো না। সবে তো গণনা শুরু হয়েছে। এখনো অনেক সময় বাকি। দ্যাখো কি হয়। ”

মালিহা নীরস বদনে তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন। বারবার উচাটন করছে মন। ওনার ছেলের স্বপ্ন জড়িয়ে এ নির্বাচনী লড়াইয়ে। সে স্বপ্ন কি তবে পূরণ হবে না? আজগর নামক এক তুখোড় রাজনীতিবিদের নিকটে তবে হেরে যাবে! কি হতে চলেছে লড়াই শেষে?
.

নিজ কক্ষে বিছানায় বসে হৃদি। হাতে মোবাইল। তাতে প্রদর্শিত হচ্ছে সর্বশেষ আপডেট। হতাশা ঘিরে ফেলছে আষ্টেপৃষ্ঠে। কৃষ্ণবর্ণ মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে মন। ওর দু পাশে বসে দুই চাচাতো বোন নীতি ও নিদিশা। ওরা বোনের অবস্থা অনুধাবন করতে পারছে। পরিস্থিতি একটুখানি স্বাভাবিক করতে নিদিশা রসিকতার স্বরে বলে উঠলো,

” উফ্ হৃদিপু! তুমি শুধু শুধু টেনশন করে হাই প্রেশারের রোগী হয়ে যাচ্ছো। আরে আমাদের ভাইয়া যা মানুষ না.. ওনার পারসোনালিটি আর হ্যান্ডসাম চেহারা দেখেই লোকে ভোট দেবে। স্পেশালি মেয়ে ভোটার। দেখো কোনো বুড়া ভাইয়ার কাছে টিকবেই না। ”

হৃদি মোবাইল কোলে রেখে ওর দিকে সরু চোখে তাকালো। বললো,

” এটা জাতীয় সংসদ নির্বাচন বোন আমার। কোনো ফ্যাশন শো কিংবা বিউটি কনটেস্ট না যে চেহারা দেখিয়ে জিতে যাবে। ইটস্ ইলেকশন। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচন। বুঝতে পারছিস? ”

নীতি অবাক নেত্রে তাকিয়ে বোনের পানে!

” বাব্বাহ্! হৃদু দেখি নির্বাচন নিয়ে কত কি জেনে গেছে! অথচ বিয়ের আগ অবধি তুইও আমাদের সাথী ছিলি। বলতি ওসব ইলেকশন টিলেকশন কোনো কঠিন বিষয় না। চাইলেই জেতা যায়। ”

হতাশা প্রকাশ করে হৃদি বললো,

” কোনো বিষয়ে কাছ থেকে না দেখলে কিংবা সঠিক জ্ঞান অর্জন না করলে যা হয়। কখনো তো কাছ থেকে কোনো পলিটিশিয়ানকে দেখিনি। বুঝতে পারিনি ইটস্ নট অ্যা কাপ অফ টি। বিষয়টা অনেক জটিল। ঝুঁকিপূর্ণ। ”

ওদের দিকে তাকিয়ে,

” জানিস? গতরাতে উনি বাড়িতেই ছিলেন না। রাতভর বাহিরে ছিলেন। কখন ফিরেছেন টেরও পাইনি। অপেক্ষা করতে করতে তিনটার দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ঘুম থেকে উঠে সকালে একঝলক দেখা পেয়েছিলাম। কোনোমতে নাকেমুখে খেয়েই উনি বেরিয়ে পড়লেন। মানুষটা না এই নির্বাচন নিয়ে খুব আশাবাদী। আমি নিজের চোখে দেখেছি। উনি দিনরাত এজন্য কত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন। উনি সৎ, নিষ্ঠাবান একজন মানুষ। তোরা তো গুজব শুনেছিস ই ওই আজগর সাহেব লোকটা অত সুবিধার নয়। অসৎ। তাই মন প্রাণ দিয়ে চাইছি ইরহাম জয়লাভ করুক। ওনার স্বপ্ন পূরণ হোক। বাংলা পাক এক সৎ, নিষ্ঠাবান পথপ্রদর্শক। ”

নীতি ও নিদিশা বিস্মিত নয়নে বোনের পানে তাকিয়ে! এ কি তাদের সে-ই হৃদিপু! কল্পনাপ্রবণ, চঞ্চল মেয়েটি এভাবে গভীর রূপে ভাবতে শিখলো কবে থেকে! এ যে সম্পূর্ণ নয়া রূপ। এতদিন পর দেখাসাক্ষাৎ। ওরা যেন বোনকে ঠিক চিনে উঠতে পারছে না। বিয়ের প্রায় চার মাস হতে চললো। এত অল্প সময়ে এমন রূপান্তর! অভাবনীয়! হৃদি ওদের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো। মোবাইলে মনোনিবেশ করে দেখতে লাগলো আপডেট। মনে মনে স্মরণ করতে লাগলো মহান রব’কে। আজ ওঁনার রহমত বিহীন সব অসম্ভব। বৃথা।
.

তরুণ প্রতিদ্বন্দ্বী হতে বেশ এগিয়ে আজগর সাহেব। নির্বিঘ্নে আয়েশ করে সময় অতিবাহিত করছেন উনি। ওনার সমর্থকরা এখনই বিজয় উদযাপনের প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছে। দু’দিনের নিব্বাকে পরাজিত করে সিংহাসনে বসতে চলেছে তাদের নেতাজী। উদযাপন করবে না!

” ও রে! বাজি কিনে আন। ”

” পেপসি, বিরিয়ানি চাই কিন্তু। ”

কত কি পরিকল্পনা! উচ্ছ্বাস! দেখা যাক শেষমেষ কি হয়।
.

এজাজ সাহেব লিভিংরুমে উপস্থিত হয়েছেন কিয়ৎক্ষণ পূর্বে। ভাবখানা এমন উনি ব্যবসায়িক কর্মে লিপ্ত। হাতে অফিসের ফাইল। প্রকৃত বিষয়টি যে সম্পূর্ণ ভিন্ন। উনি হয়তো তাকিয়ে ফাইলের পাতায় তবে সজাগ শ্রবণেন্দ্রিয়। টিভির পর্দায় প্রকাশিত সর্বশেষ আপডেট ঠিক ওনার কর্ণে পৌঁছে যাচ্ছে। মালিহা উৎকণ্ঠিত হয়ে সোফায় দেহ এলিয়ে দিয়েছেন। যন্ত্রণা হচ্ছে মাথায়। এত দুশ্চিন্তা সইছে না শরীর। কিছুক্ষণ পূর্বে প্রকাশিত আপডেট মোতাবেক এখনো পিছিয়ে ইরহাম। হতাশ হয়ে উনি টিভি বন্ধ করে দিলেন। রাজেদা খানম ইষৎ বিরক্তিকর কণ্ঠে বললেন,

” বউ তোমার পোলা একলা নির্বাচনে খাড়ায় নাই। আরো মাইনষে খা”ড়াইছে। হ্যাগো মা বুইন তোমার লাহান দাপাদাপি করতাছে না। একটু শান্ত হও। অ্যামন করলে চলে? ”

মালিহা আবেগী হয়ে পড়ছেন। একমাত্র পুত্রের স্বপ্ন ভঙ্গের বিষয়টি উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে মানসপটে। হতাশায় বিধ্ব-স্ত উনি। আকস্মিক লিভিংরুমে উপস্থিত চারজন সিনিয়র সদস্য হকচকিয়ে গেল। চেঁচাতে চেঁচাতে দুরন্ত পায়ে সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছে হৃদি। উচ্চ স্বরে জানান দিচ্ছে আশার বাণী,

” মা ইরহাম এখন এগিয়ে। ”

ঝলমল করে উঠলো সকলের মুখ। এজাজ সাহেব যদিওবা তা প্রকাশ করলেন না। মালিহা তড়িঘড়ি করে টিভি অন করলেন। প্রথমেই নজর কাড়লো ইরহাম যে আসনে দাঁড়িয়েছে তার সর্বশেষ আপডেট। আসলেই আজগর সাহেব হতে কিছুটা এগিয়ে ইরহাম। আবেগপ্রবণ হয়ে পড়লেন মালিহা। ওনার পাশে এসে বসলো ইরহাম পত্নী। দু’জনের চোখেমুখে আশার আলো শোভা পাচ্ছে। তবে কি পূরণ হতে চলেছে বহুদিনের লালিত স্বপ্ন!

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে