#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২০ ( প্রথমাংশ )
” সোয়ামিরে শাড়ির আঁচলে বান্ধি রাখতে হয় বুঝলি বুইন? একবার হাত ফসকাই গেলে বিলাপ করা ছাড়া উপায় নাই। ”
হৃদি অবাক নেত্রে তাকিয়ে দাদির পানে। রাজেদা খানম ওর কেশের ভাঁজে আঙ্গুল চালনা করতে করতে বললেন,
” সোয়ামি হইলো সব থে কাছের জন। হ্যারে আগলাই রাখতে হয়। বুঝোছ ই তো বেডা মাইনষের মন। একবার বাইরে চকচকা ঘ্রাণ পাইলে ঘরে আর মন টিকতো না। এই লাইগা সাবধান। সময় থাকতে আঁচলে বান্ধি রাখ। ফসকাই না যায়। যে মাইয়ার সোয়ামি থাইকাও নাই হ্যার দুঃখের শ্যাষ নাই। পুরা জীবনডা ই বেদনার। ”
দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রাজেদা খানম। হৃদি সবটুকু শুনলো। গেঁথে নিলো মস্তিষ্কে। আনমনে ভাবতে লাগলো কত কি। এখন তার কি করণীয়!
•
নিশুতি রাত। ডাইনিংয়ে বসে ইরহাম। করছে পানি পান। ওষ্ঠাধর ঠেকে গ্লাসে। কিন্তু মনোযোগ নিবদ্ধ অন্যত্র। মস্তিষ্কে হানা দিচ্ছে বিবাহ পরবর্তী তাঈফ এবং রাহিদের কিছু সাবধান বাণী।
মামাতো ভাই রাহিদ সেদিন বলেছিল,
” ভাইয়া এত সুন্দর বউ পেয়েছো। এখন একটু ভাবস্ দেখানো ছাড়ো। সুন্দরী বউ। আদরে সোহাগে ভরিয়ে রাখো। বুঝলে? ”
তাঈফ অসন্তুষ্ট কণ্ঠে বলে উঠেছিল,
” ব্যা টা এখন তো একটু রোমান্টিক হ। নইলে দেখা যাইবো নতুন বউ দুইদিন পর নারী অধিকার কমিশনে অভিযোগ করছে। ”
” কিংবা নতুন বউপাখি ফুরুৎ। উড় গাড়া। ”
দু হাতে উড়ে যাওয়ার ভঙ্গিমা করে দেখিয়েছিল রাহিদ। এ দেখে খ্যাক খ্যাক করে হেসেছিল তাঈফ।
বিয়ের রাতের সে-ই সাবধানী বাণী স্মরণে আসতে চৌধুরী সাহেব কি একটু হলেও ভীত হলো না! আসলেই তো পাখি এখন উড়াল দেবার পথে। আপাতত ঘর থেকে বেরিয়েছে। বাড়ি থেকে বেড়োতে কতদিন? যেকোনো মুহূর্তে অপ্রত্যাশিত, ভ-য়ঙ্কর অঘটন ঘটে যেতে পারে। টেবিলে গ্লাস রাখলো ইরহাম। দু হাতের কনুই ঠেকলো টেবিলে। দু হাতের আঙ্গুল একত্রিত হয়ে মোচার ন্যায় আকার ধারণ করলো। সেথায় থুতনি ঠেকিয়ে অসীম ভাবনায় মশগুল হলো চৌধুরী সাহেব।
হৃদি শেখ! দেখতে নিঃসন্দেহে মাশাআল্লাহ্! পড়ালেখা? চলে কোনোরকম। চলনবলন আকর্ষণীয়। যেকোনো পুরুষের হৃদয়ে ঝড় তোলার মতো। সে মেয়েটি দিনের পর দিন স্বামী হতে দূরে। একপ্রকার অবহেলিত। ওপর ওয়ালা না করুক শ*য়তানের প্ররোচনায় বিপথগামী হতে কতক্ষণ? এই তো তিনদিন আগের কথা। জরুরী কাজে হৃদির ভার্সিটির পথে গিয়েছিল ইরহাম। স্বচক্ষে দেখেছে কিভাবে তার বউপাখি পথের ধারে ছেলে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, খুনসুটিতে মত্ত ছিল। স্বামীর থেকে অবহেলা পেয়ে পেয়ে মেয়েটি যদি অন্য পুরুষে মজে যায় তখন কি হবে? বিষয়টি ভাবতেই কুঞ্চিত হলো ভ্রু যুগল। শক্ত হলো চোয়াল। হাঁ মেয়েটি হয়তো তার অবচেতন মনে অঙ্কিত রমণীর মতন নয়। ভিন্ন স্বভাবের। তবে সে চাইলে কি মনের মতো গড়ে নিতে পারবে না? অবশ্যই পারবে। সে দেখেছে তো হৃদি কেমন কুইক লার্নার। অল্পতে নতুন কিছু আয়ত্ত্ব করতে পারে। সেখানে ইরহামের তো সুবিধা ই হলো। নিজের মনমতো গড়ে নিতে পারবে সহধর্মিণীকে। বলা চলে হৃদি মেয়েটা একদলা মাটির ন্যায়। তাকে ইচ্ছেমতো গড়ন দেয়া মোটেও দুষ্কর নয়। সহজসাধ্য। হুম। এলোমেলো ভাবনায় লিপ্ত ইরহাম। তার পৌরুষ স্বত্ত্বা অনবরত সাবধান করে দিচ্ছে। হৃদয়ে অনুভূত হচ্ছে উত্তাল তোলপাড়। ভুল হয়ে যাবে। হৃদি তার জীবন থেকে হারালে মস্ত বড় ভুল হয়ে যাবে। এক জীবনে সে মেয়েটির অনুপস্থিতি কি কভু মেটানো যাবে!
•
অপরাহ্ন প্রহর। পকিমন’কে কোলে নিয়ে করিডোর ধরে হেঁটে চলেছে হৃদি। হাসিমুখে দুষ্টুমি করে এটাসেটা বলছে। বিনিময়ে পকিও ‘ ম্যাঁও ‘ ডেকে উঠছে। তাতে প্রসারিত হচ্ছে হৃদির অধর। সহসা মেয়েটি থমকে গেল। সম্মুখে দন্ডায়মান মানুষটির উপস্থিতি তাকে বাধ্য করলো দাঁড়িয়ে পড়তে। মেয়েটি চোখ তুলে তাকালো না। দাঁড়িয়ে রইল অবনত মস্তকে। কিছু বললো না অবধি। নীরবতা ভঙ্গ করে মুখ খুললো ইরহাম। গম্ভীর স্বরে বললো,
” তোমার সাথে কিছু কথা আছে। রুমে এসো। ”
হৃদি দু কদম পিছিয়ে গেল। মৃদু স্বরে আপত্তি জানিয়ে বললো,
” কথা বলতে ইচ্ছুক নই। পথ ছাড়লে খুশি হতাম। ”
দু কদম এগিয়ে হৃদির অতি সন্নিকটে দাঁড়ালো ইরহাম। অবনত বদনে স্থির চাহনিতে তাকিয়ে বললো,
” অনেক পথ ছেড়েছি। শেষমেষ আমরা এখন ভিন্ন পথের দু পথিক। আর নয়। এখন থেকে পথ চলবো একসঙ্গে। ইনশাআল্লাহ্। ”
ব’জ্রপাত হলো বুঝি কর্ণ গহ্বরে! চমকিত চোখে তাকালো হৃদি। নভোনীল চক্ষু জোড়ায় চোখ পড়তে সহসা সম্মোহিত হলো। নয়নে মিলিত হলো নয়ন। তাকিয়ে রইলো অপলক দৃষ্টিতে। দু সপ্তাহের বিচ্ছেদ শেষে দু নয়ন জোড়া মিলিত হলো। একে অপরের পানে তাকিয়ে মিটিয়ে নিচ্ছে চক্ষু তৃষ্ণা। অনুভব করছে মুহুর্তটুকু। বিচ্ছেদের অবসান ঘটিয়ে এ মুহূর্তের আগমন। বেশ স্পেশাল। আবেগময়। নভোনীল শান্ত অসীম সাগরে তলিয়ে যেতে লাগলো হৃদি। জোরে জোরে স্পন্দিত হতে লাগলো হৃৎযন্ত্র। গম্ভীর মুখো মানুষটির অধরে ফুটে উঠলো তৃপ্তিকর আভা। তার মুগ্ধ অক্ষিদ্বয় অর্ধাঙ্গীর মুখশ্রীতে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। মায়াবী আঁখি, সুডৌল নাসিকা, নে-শালো ওষ্ঠাধর। বাদ পড়লো না কিছুই। কিন্তু দু সপ্তাহের তৃষ্ণা কি এক পলকে মেটানো সম্ভব? সম্ভব নয়। তবুও তৃষ্ণা নিবারণে ব্যস্ত মানুষটি। অর্ধাঙ্গিনীর কৃষ্ণকালো নয়নের গভীরতায় পৌঁছাতে উদগ্রীব সে। আকস্মিক ‘ ম্যাঁও ‘ শব্দে দু’জনার ঘোর কেটে গেল। একপ্রকার ছিটকে কয়েক কদম পেছনে চলে এলো হৃদি। মুচকি হাসলো ইরহাম।
সে যেই না কিছু বলতে উদ্যত হলো অমনি বাঁধা প্রদান করলো স্মার্টফোন। পকেট হতে মোবাইল বের করলো মানুষটি। হৃদি একঝলক তাকিয়ে দ্রুত পায়ে সেথা হতে প্রস্থান করলো। ওর গমন পথে তাকিয়ে কল রিসিভ করলো ইরহাম।
.
বিভাবরীর কৃষ্ণাবরণে আচ্ছাদিত ধরিত্রী। বিছানায় বসে নোটস্ তৈরিতে ব্যস্ত আফরিন। বইয়ের পাতা হতে গুরুত্বপূর্ণ লাইন খুঁজে খুঁজে খাতায় টুকে নিচ্ছে। সম্পূর্ণ মনোযোগ এদিকে। আকস্মিক জোরালো শব্দে তার কক্ষের ভিড়িয়ে রাখা দ্বার উন্মুক্ত হলো। অবাক নেত্রে সেথায় তাকালো আফরিন। গম্ভীর স্বরে বলে উঠলো,
” এগুলো কেমন অস*ভ্যতামি ছোট? দরজা ভেঙে ফেলবি নাকি? ”
কক্ষে প্রবেশ করলো এক কিশোরী। সে তেজ দেখিয়ে বললো,
” হাঁ হাঁ। দরকার পড়লে আমি ভেঙে ফেলবো। ”
আফরিন সোজা হয়ে বসে চক্ষু বুজে শ্বাস ফেললো। শান্ত স্বরে বোনের দিকে তাকিয়ে বলল,
” এখানে আয়। বস। শান্তভাবে বল কি হয়েছে? ”
” শোন আপু আমি এখানে বসে ভজন গাইতে আসিনি। আমি শুধু এটা ইনফর্ম করতে এসেছি যে আমার ব্র্যান্ড নিউ মেকআপ কিট কোথায়? সেটা এখনো হাতে পাইনি। কেন? ”
” কারণ আমি সেটা অর্ডার করিনি। ” শান্ত স্বরে বললো আফরিন।
তেঁতে উঠলো মেয়েটা, ” হুয়াই? আমি সেটা গত মাসের পনেরো তারিখে চেয়েছি। আর তুই এখনো কিনিসনি? কেন? ”
” তোর অলরেডি বেশ কয়েকটা কিট আছে। নতুন করে অত দামী কিট কেনার প্রয়োজন নেই। ”
” আমার কি দরকার না দরকার সেটা আমি বুঝে নেবো। তুই জাস্ট ওটা কিনে দিবি। ”
আপত্তি জানালো আফরিন,
” সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে আমার হাতে অল্প টাকা আছে। মাসের এখনো বেশকিছু দিন বাকি। ওটা দিয়েই চলতে হবে। এ মুহূর্তে কোনো এক্সট্রা খরচ করতে খরচ পারবো না। ”
বিদ্রুপ করে হাসলো মেয়েটা।
” বাহ্ বাহ্। নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য ছোট বোনকে কষ্ট দেয়া। চমৎকার! ”
আফরিন অবাক চাহনিতে তাকালো!
” তুই এসব কি বলছিস ছোট? আমি নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য.. ”
” তা নয়তো কি? সেলফিশ একটা। ছোট বোন সামান্য একটা মেকআপ কিট চেয়েছে সেটাও দিচ্ছে না। টাকা বাঁচিয়ে করবি টা কি? সে-ই তো ছেলেদের সঙ্গে ঢলাঢলি। ”
” ছোট! ” ধমকে উঠলো আফরিন।
সেসবে পাত্তা না দিয়ে মেয়েটা মেঝেতে পা ঠুকে বড় বড় কদম ফেলে কক্ষ হতে বেরিয়ে গেল। প্রস্থানের পূর্বে দরজাটা জোরে ধাক্কা দিতে ভুললো না। দুঃখময় চোখে তাকিয়ে রইল আফরিন। ছোট বোনকে মেকআপ কিট উপহার দিতে না পারায় এমন প্রতিদান!
•
দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসূধা। মোবাইল স্ক্রল করতে করতে করিডোর দিয়ে হেঁটে চলেছে হৃদি। দৃষ্টি নিবদ্ধ মোবাইলে তবে ভাবনা অন্যত্র। সেথায় বারংবার উঁকিঝুঁকি দিয়ে চলেছে এক গোমড়ামুখো দুষ্টু লোক। দুষ্টু লোকটা তাকে জ্বা’লাতনে অতিষ্ট করে তুলছে। উফ্! ভাবনা থেকে বিদায় হচ্ছে না কেন? বিরক্তিকর অভিব্যক্তি প্রকাশ পাচ্ছে হৃদির। সে মোবাইলের পাওয়ার বাটন ক্লিক করে আনমনে হাঁটতে লাগলো। সহসা ডান হাতে অনুভূত হলো জোরালো এক টান। সে টানের শিকার হয়ে পার্শ্ববর্তী কক্ষে ঢুকে পড়লো হৃদি। পিঠ ঠেকলো দেয়ালে। আচানক কাণ্ডে ধকধক করছে হৃৎপিণ্ড। ভয়ে বুজে এসেছে নেত্রজোড়া। ঘনঘন পড়ছে শ্বাস প্রশ্বাস। আস্তে ধীরে শান্ত হলো মেয়েটি। ধীরে ধীরে আঁখিপল্লব মেলে তাকালো। থমকালো মুখোমুখি দণ্ডায়মান মানুষটিকে দেখে! অস্ফুট স্বরে আওড়ালো,
” আ প নি! ”
” জ্বি ম্যাডাম। ভূত দেখার মতো চমকে উঠলেন যে? ”
হৃদি এবার রীতিমতো ভূত দেখার মতোই চমকে উঠলো! এ কে? খারুস চৌধুরীর ভূত নাকি? একসঙ্গে এত কথা তা-ও আবার ভিন্ন ভঙ্গিমায়! এ কি অঘটন! ইন্না লিল্লাহ্! হৃদির বড় বড় চোখ এবং আদুরে অভিব্যক্তি দেখে মুচকি হাসলো ইরহাম। এবার হৃদির চক্ষু চড়কগাছ! গোমড়ামুখো মানবের অধরে মুচকি হাসির আভা! হৃদি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলো মানুষটিকে। এ ইরহাম হতেই পারে না। ভিন্ন কেউ। ‘ Judwaa ‘ মুভির মতো ডুপ্লিকেট নয়তো! সেরকম হলে কোথাও না কোথাও ঘাপলা মিলবেই। আপাদমস্তক মানুষটিকে দেখতে লাগলো হৃদি। ট্রাকসুট পড়ুয়া মানুষটির সবই তো ঠিকঠাক। কোথাও কোনো গণ্ডগোল নেই। তারমানে এ সত্যিই ইরহাম চৌধুরী! ক্যামনে কি ভাই? ভাবুক মেয়েটির ভাবনায় ছেদ পড়লো। তার ডান হাতটি উঠে এলো মাথার পার্শ্বে। পেলব হাতটি বন্দী পুরুষালি হাতের মাঝে। নভোনীল চক্ষু জোড়া নিবদ্ধ তার মুখশ্রীতে। অপ্রত্যাশিত আচরণে কিঞ্চিৎ বিব্রত মেয়েটি। মৃদু স্বরে বলে উঠলো,
” কি করছেন এসব? হাতটা ছাড়ুন না। ”
” যদি না ছাড়ি? ”
একপলক তাকিয়ে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো মেয়েটি। দৃঢ় স্বরে বললো,
” ছাড়িয়ে নিতে বাধ্য হবো। ”
মুচকি হাসলো ইরহাম। উপহাস করে বললো,
” এই তো এতটুকু চুনোপুঁটির শরীর। পারবে আমার সাথে? ”
চমকালো হৃদি! এ কেমনতর আচরণ! হাত ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে বললো,
” আপনার কি হয়েছে একটু বলবেন? এমন অদ্ভুত আচরণ করছেন কেন? এটা তো আপনি নন। ”
” জ্বি না ম্যাডাম। এটা আমিই। আমার মধ্যকার লুকানো স্বত্ত্বা। ”
” সে স্বত্ত্বা অনায়াসে আমার সামনে উপস্থাপন করছেন! কে হই আমি? ”
কথাটার মধ্যে লুকায়িত অভিমান উপলব্ধি করতে পারলো ইরহাম। অনুশোচনা প্রকাশ পেল চোখেমুখে। নম্র স্বরে মানুষটি বলতে লাগলো,
” নারী ফুলের ন্যায় কোমল, ক*লুষতা বিহীন। তার সঙ্গে বিন্দুমাত্র অসদাচরণ বেমানান। ফুলের ন্যায় নারীকেও আদরে যতনে আগলে রাখতে হয়। উচ্ছিষ্টের মতন দুর্ব্যবহার নয়। কাপুরুষ সে ব্যক্তি যে নারীর ওপর জোর প্রয়োগ করে পুরুষত্ব জাহির করে। সেদিন রাগের বশীভূত হয়ে আমিও কাপুরুষোচিত আচরণ করেছি। তোমায় কথা শুনিয়েছি। সেসব তুমি ডিজার্ভ করো না। আমি ক্ষমাপ্রার্থী হৃদি। আমায় ক্ষমা করে দাও। এমন অসদাচরণ ইনশাআল্লাহ্ আর হবে না। আমি চেষ্টা করবো ক্রো’ধকে দমিয়ে ভালোবাসার বীজ রোপণ করতে। দেবে না সে সুযোগটুকু? বলো। ”
মায়াবী নেত্রযুগল টলমল করছে। আর’ক্ত আভা ছড়িয়ে দু কপোলে। অবিশ্বাস্য চাহনিতে তাকিয়ে মেয়েটি। এ কি শুনছে সে? আদৌও এ কথাগুলো সত্য? তার কর্ণ গহ্বর বে-ইমানি করছে না তো? টুপ করে কপোলের কোমল আবরণে মুক্তোর দানা গড়িয়ে পড়লো। সিক্ত হলো অক্ষিপুট। ইরহাম অনিমেষ নেত্রে তাকিয়ে। অবলোকন করছে অর্ধাঙ্গিনীর ভেজা মুখায়ব। ক্রন্দনের ফলে ভেজা অক্ষিপুট, লালচে সুডৌল নাক, কম্পিত ওষ্ঠাধর। কিছুই দৃষ্টির অগোচরে রইলো না। মোহাচ্ছন্ন নয়নে সবটুকু অবলোকন করলো সে। মায়ায় ভরা মুখখানিতে নতুন করে ফেঁসে গেল। বক্ষপিঞ্জরের অন্তরালে লুকায়িত হৃদযন্ত্রটি সগৌরবে জানান দিলো
‘ মায়াবিনীর মায়ায় শেষমেষ ফেঁসেই গেলে চৌধুরী!’.. বিষয়টি অনুধাবন হতেই অধরকোলে তৃপ্তিময় ঝলক পরিলক্ষিত হলো। দেয়ালে সেঁটে থাকা পেলব হাতটি আরেকটু দৃঢ় ভাবে স্বামীর হাতের মধ্যে বন্দী হলো। ঘনিষ্ঠ হয়ে দাঁড়ালো মানুষটি। কপালে ঠেকে গেল কপাল। নিমীলিত হলো দু’জনার আঁখি পল্লব। স্বস্তির নিশ্বাস ছাড়ল ইরহাম। মৃদু শিউরে উঠলো তার সঙ্গিনী। এভাবেই আরম্ভ হলো এক নতুন সূচনার! ইরহাম হৃদি থেকে হৃ’হাম হয়ে ওঠার!
•
রবি’র উষ্ণ কিরণে আলোকিত পৃথিবী। কলেজ হতে বেরিয়ে এলো ইনায়া। পরিহিত পোশাকের অবস্থা ঘেমেনেয়ে একাকার। লালাভ রঙ ধারণ করেছে মুখশ্রী। কাঁধে ভারী ব্যাগ। দুই বান্ধবী ওকে বিদায় জানিয়ে প্রস্থান করলো। ইনায়া দাঁড়িয়ে বাড়ির গাড়ির জন্য। অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। ক্লান্ত শরীর আর দাঁড়িয়ে থাকতে নারাজ। পদযুগল বেঁকে আসছে দুর্বলতায়। আকস্মিক হতভম্ব হলো ইনায়া! ওর ঠিক সম্মুখে এসে উপস্থিত হলো এক আগন্তুক। ভয়ে দু কদম পিছপা হলো মেয়েটি। এখনো ধুকপুক ধুকপুক করছে হৃৎপিণ্ড। এ কেমন ভীতি জাগানো আগমন! আরেকটু হলেই তো পরাণ পাখি উড়াল দিতো। উফ্! ভীত ইনায়া কোনোমতে নিজেকে ধাতস্থ করে সম্মুখে তাকালো। চমকালো বেশ! ইনি!
চলবে.
#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_২০ ( শেষাংশ )
” তুমি এখানে! ”
ইনায়ার কণ্ঠে ঝড়ে পড়ছে বিস্ময়! হেলমেটের কাঁচ নামিয়ে ওর দিকে তাকালো রাহিদ।
” হাঁ আমি। এমন ভাব করছিস যেন মহাকাশ থেকে এলিয়েন টপকে পড়েছে। ”
সহসা কিছু মনে পড়ার ভঙ্গিমায় রাহিদ জিজ্ঞেস করলো,
” হাঁ রে! তোর চোখ ঠিক আছে তো? তুই কি আমার বদলে সত্যিই এলিয়েন দেখতে পাচ্ছিস? ”
একে ক্লান্ত শরীর। এর ওপর অহেতুক কথাবার্তা। মেজাজ বিগড়ে যাচ্ছে মেয়েটার। দাঁতে দাঁত চেপে সে বললো,
” রাহি ভাইয়া! আমি সম্পূর্ণ ঠিক আছি। আপাদমস্তক। ওকে? এবার বলে ফেলো তুমি এখানে কি করছো? বাড়ির গাড়ি কোথায়? ”
” চিকিৎসালয়ে। ” নির্লিপ্ত জবাব।
চমকালো ইনায়া, ” কিহ্! ”
রাহিদ বাম হাতে কান চেপে ধরে মৃদু আর্তনাদ করে উঠলো,
” আহ্! এত চেঁচামেচি করছিস কেন? কানের পর্দা ফাটিয়ে দিবি নাকি? ”
” প্রয়োজন পড়লে দেবো। ভরদুপুরে এমনিতেই আমি টায়ার্ড। এরমধ্যে তুমি রসিকতা শুরু করেছো। গাড়ি কোথায়? ”
” বললাম না চিকিৎসালয়ে। ওটার পেট খারাপ হয়েছে। তাই চিকিৎসা চলছে। ”
ওষ্ঠাধর গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো ইনায়া। স্বেদজল উপস্থিত মুখশ্রী, গলদেশে। লালাভ রঙ ধারণ করেছে মুখ। তা লক্ষ্য করে রাহিদ বললো,
” বোস আমার পেছনে। ফুপি দায়িত্ব দিলো তোকে বগলদাবা করে নিয়ে যাওয়ার। আয় আয়। বস। ”
বাইকে একসাথে ভ্রমণ! বিষয়টি মস্তিষ্কে কড়া নাড়তেই চরম আশ্চর্যান্বিত হলো ইনায়া! একবার রাহিদ আরেকবার বাইকের পেছনাংশে তাকাচ্ছে। ওর কাণ্ড দেখে রাহিদ দিলো এক ধমক,
” ব য় রা হয়ে গেছিস নাকি? কথা কানে ঢোকে না? বস।”
বেজার মুখে কাঁধের ব্যাগ সামলিয়ে বাইকের পেছনাংশে বসলো ইনায়া। দু’জনের মধ্যে বাঁধাস্বরূপ ব্যাগটি রাখা। হেলমেটের কাঁচ উঠিয়ে ফেললো রাহিদ। পেছনে থাকা কিশোরীকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” ঠিকমতো ধরে বস। পড়ে যাবি তো। তখন আবার ফুপাজান বাংলা সিনেমার চৌধুরী সাহেবের মতো তেড়েফুঁড়ে আসবেন। ”
ইনায়া বেজার মুখে বিড়বিড় করে আওড়ালো,
” যতসব ফাউল কথাবার্তা! ”
এমনিতেই অস্বস্তিতে গাঁট অবস্থা! তন্মধ্যে এত নিকটে এ পুরুষের উপস্থিতি। হিমশীতল শিহরণ বয়ে যাচ্ছে তনুমন জুড়ে। স্বেদজলের সরু রেখা গড়িয়ে পড়ছে দু কপোল ছুঁয়ে। অবশেষে বাইক চলতে আরম্ভ করলে মিললো স্বস্তি! শহরের পথ ধরে এগিয়ে চলেছে বাইক। সঙ্গে অনাকাঙ্ক্ষিত সঙ্গী। বুকের ধারে ব্যাগটি এক হাতে আঁকড়ে ধরে ইনায়া। উপভোগ করছে এ ভ্রমণ। ডানে বাঁয়ে রাস্তাঘাট, দোকানপাট সবই চেনাজানা। তবুও আজ অনুভূত হচ্ছে নতুনত্ব। লাগছে বেশ ভালো। চেনা সড়কের যানজট, কোলাহল সবই ভালো লাগছে। শ্রবণেন্দ্রিয়ে বেজে চলেছে,
‘ এই পথ যদি না শেষ হয়… ‘
.
বাড়ি নয় বরং ভিন্ন গন্তব্যে এসে থামলো বাইক। রাহিদ হেলমেট খুলতে খুলতে আদেশ প্রদান করলো,
” নাম। ”
” হাঁ! এখানে কেন? বাড়ি যাবো না? ”
” না রে। তোকে এখানে মে রে বালুচাপা দেবো। নাম বলছি। ”
শেষোক্ত ধমকে সুড়সুড় করে নেমে গেল মেয়েটি। রাহিদ বিরক্তিসূচক শব্দ করে বাইক হতে নেমে এলো। যথাযথ ভাবে স্ট্যান্ড করলো বাইকটি। ইনায়া ব্যাগ কাঁধে আশপাশে তাকাচ্ছিল। অনুধাবন করতে পারলো কোথায় এসেছে তারা। কিন্তু হঠাৎ এখানে কেন?
” চল। ”
রাহিদের পিছুপিছু রেস্টুরেন্টে প্রবেশ করলো ইনায়া। রাহিদ একটি ফাঁকা টেবিল দেখে সেদিকে অগ্রসর হলো। বসলো সোফায়। ইনায়া ব্যাগ নামিয়ে বিপরীত দিকের সোফায় বসলো। রাহিদ ওকে শুধালো,
” বল কি খাবি? ”
” খেতে ইচ্ছে করছে না ভাইয়া। এখানে না থেমে বাড়ির পথে যেতে। আম্মু চিন্তা করবে তো। ”
” ফাও বকিস না তো। আমি থাকতে কিসের চিন্তা? এখন কিছু খেয়ে নে। সে-ই কোন বেলায় খেয়েছিস। পরে রাস্তাঘাটে ফিট খেলে সামলাবে কে? ”
” কেন? তুমি! ”
মুখ ফসকে কথাটি বলে নিজেই চমকালো ইনায়া! এসব কি বলছে সে! দ্রুত নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো। রাহিদ বিদ্রুপের স্বরে বললো,
” মাথা নষ্ট? আমি কোনো ঝামেলায় নেই। পিওর নির্ঝঞ্ঝাট মানুষ আমি। ”
প্রত্যাশিত জবাব পেয়েও মনোক্ষুণ্ন হলো মেয়েটির। আস্তে করে দৃষ্টি নত করে নিলো। রাহিদ টেবিলের ওপর রাখা মেনু কার্ডে দৃষ্টি বুলাতে বুলাতে প্রশ্ন করলো,
” এখন কি খাবি বল? লাঞ্চ টাইম। সে-ই মোতাবেক বল। কি খাবি? ”
” তোমার যা ইচ্ছা। ”
” ওকে। ”
রাহিদ ওয়েটার ডেকে নিজের পছন্দমতো অর্ডার প্লেস করলো। আর নীরবে শান্ত রূপে বসে রইলো ইনায়া। শূন্য দৃষ্টি নিবদ্ধ রেস্টুরেন্টের জানালা গলিয়ে বাহিরে।
•
রৌদ্রোজ্জ্বল এক দিন। দেশজুড়ে নির্বাচনী প্রচারণা চলছে পুরোদমে। আর মাত্র দু সপ্তাহ। এরপর ‘ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ‘. এ বছর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে চলেছে বছরের মাঝামাঝি সময়ে। গরমের মধ্যে ব্যস্ত সময় পাড় করছেন মনোনীত প্রার্থীরা। তেমনই এক ব্যস্ত দিন আজ।
ছোটোখাটো এক মঞ্চে দাঁড়িয়ে ইরহাম চৌধুরী। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে ভাষণ দিচ্ছেন। সম্মুখে দাঁড়িয়ে অসংখ্য জনগণ। তন্মধ্যে রয়েছে দলীয় নেতা-কর্মী প্রমুখ। সাংবাদিকরা গোটা বিষয়টি কভার করছে। উপস্থিত জনগণের ভীড়ে লুকায়িত তিন দেশদ্রো-হী। বিভীষণ। এ তিন তরুণ ভীড়ের মধ্যে আনাচে কানাচে ছড়িয়ে। ইরহামের দলীয় কর্মী ব্যতিত তাদের রয়েছে ভিন্ন এক পরিচয়। ঘরের শ ত্রু বিভীষণ তারা। যাদের অন্তরে লুকায়িত কুটিল পরিকল্পনা। পরিকল্পনা মোতাবেক কাছে পিঠেই আজগর সাহেবের দল প্রচারণায় ব্যস্ত। মধ্যকার দূরত্ব অতি সামান্য। ইরহাম যখন ভাষণ প্রদানে লিপ্ত তখনই কুটিল কর্মে নিযুক্ত হলো এক তরুণ। উপস্থিত জনগণের দৃষ্টি বাঁচিয়ে সে আস্তে ধীরে সরে গেল নিরালায়। দেয়ালে সেঁটে থাকা এক পোস্টারে তাকিয়ে বক্র হাসলো।
অতঃপর অতিবাহিত হলো কিছু মুহূর্ত। আকস্মিক শুরু হলো স-হিংসতা! ইরহামের দলীয় নেতা-কর্মীদের ওপর ধেয়ে এলো অনাকাঙ্ক্ষিত আঘাত। আজগর সাহেবের দলবল অনবরত আঘাতের ওপর আঘাত করছে এদের। সবটার মূল হেতু মাটিতে পড়ে থাকা আজগর সাহেবের কিছু ছেঁড়া পোস্টার। অগ্নিশিখায় জ্বলছে যা। সামান্য এ ঘটনাকে ইস্যু করে অরা*জকতায় লিপ্ত হলো বিরোধী দল। লাঠিসোঁ*টা নিয়ে আ*ক্রমণ করলো তারা। পরিস্থিতি অস্বাভাবিক দেখে ইরহাম দ্রুত মঞ্চ হতে নেমে এলো। ফাঁকা এক স্থানে দাঁড়িয়ে ফোন করলো বন্ধু তাঈফকে। দু পক্ষই লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছে। একপক্ষ মেটাচ্ছে ব্যক্তিগত আ*ক্রোশ তো আরেকপক্ষ প্রতিরোধে লিপ্ত। লাঠির আঘাত পেরিয়ে হাত-পাও চলতে লাগলো। ঘু*ষি, লা-থ পড়লো না বাদ। আহত হতে লাগলো ইরহামের দলীয় কর্মীরা। ইরহাম দ্রুত ফোনালাপ সেরে নিজেও ঘটনাস্থলে উপস্থিত হলো। প্রতিরোধ করতে লাগলো এ সহিং*সতা। অনবরত নিজ দলীয় কর্মীদের নিষেধ করতে লাগলো আ**ক্রমণাত্মক না হতে। শুনলো না কেউই। সাংবাদিকরা নিরাপদ অবস্থানে দাঁড়িয়ে সকল দৃশ্যই ক্যামেরা বন্দী করছে। চলছে দু পক্ষের ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া। সং*ঘর্ষ।
কিছুক্ষণ পর উপস্থিত হলো স্থানীয় পুলিশ। লাঠিপে*টা করে তারা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করছে। ছুঁড়ছে টিয়ারগ্যাস। গোটা পরিস্থিতি হাতের বাহিরে চলে যাচ্ছে। বাধ্য হয়ে কঠোরতম রূপে আবির্ভূত হলো পুলিশের সদস্যরা।
.
নিশুতি রাত। কলিংবেলের আওয়াজ কর্ণপাত হচ্ছে। দ্বার উন্মুক্ত করলেন এক পরিচারিকা। হতভম্ব হলেন আগত ব্যক্তিদের দেখে! তাঈফ সালাম দিয়ে বন্ধুর হাত ধরে ধরে মন্থর গতিতে ভেতরে প্রবেশ করলো। লিভিংরুম পেরিয়ে দোতলায় উঠলো সিঁড়ি বেয়ে। করিডোরে উপস্থিত হতেই দেখা মিললো ইরহাম পত্নীর। হৃদি পুলিশের পোশাক পরিহিত তাঈফকে লক্ষ্য করে হাসিমুখে সালাম দিলো,
” আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কে ম ন.. ”
আর বলা হলো না হৃদির। হতবিহ্বল মেয়েটির মুখনিঃসৃত হলো মৃদু আর্ত।
” ই-রহাম! ”
টলমল করে উঠলো নেত্রযুগল। দ্রুত পায়ে ছুটে এলো হৃদি। ধরলো স্বামীর বাঁ হাত। অস্ফুট স্বরে শুধালো,
” এ কি হয়েছে আপনার? ”
তাঈফ পরিস্থিতি অনুধাবন করে স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,
” ভাবী ভেতরে চলেন আগে। তারপর না হয়.. ”
হাঁ সূচক মাথা নাড়ল হৃদি। কপোল ছুঁয়ে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা নোনাজল। স্বামীর বাম হাতটি দৃঢ়রূপে আঁকড়ে ধরলো মেয়েটি। অগ্রসর হতে লাগলো কক্ষের পানে। তাঈফ বন্ধুর হাতটি আগেই ছেড়ে দিয়েছে। সে ধীরপায়ে পিছুপিছু এগোতে লাগলো। তবে কক্ষের দ্বারে পৌঁছে থেমে গেল। ভাবলো কিছু। ভাবনা শেষে ভেতরে আর প্রবেশ করলো না। পিছু হটে সেথা হতে সরে গেল।
আহত স্বামীর হাত ধরে তাকে বিছানায় বসালো হৃদি। নোনাজলে ভরপুর আঁখি জোড়া ঝাপসা হয়ে আসছে। লালিমা লেপে চোখেমুখে। এ কি হাল হয়েছে মানুষটির! শ্বেত শুভ্র পাঞ্জাবির কাঁধের অংশে লাল লাল র-ক্তের ছোপ। মাথায় মোড়ানো সরু সাদা ব্যান্ডেজ। সেখানেও র-ক্তের ছোপ ছোপ দাগ। চশমা অনুপস্থিত। ভেঙে গিয়েছে কি? আবেগপ্রবণ রমণী আলতো হাতে স্বামীর চুলে হাত বুলিয়ে দিলো। ওর পানে ব্যথাতুর চাহনিতে তাকালো ইরহাম। বেদনা মিশ্রিত হাসার চেষ্টা করলো। মৃদু স্বরে আশ্বস্ত করতে বললো,
” আ মি ঠিক আছি হৃদি। কেঁদো না। ”
” আমি তো সকালে আমার সুস্থসবল মানুষটিকে বিদায় জানিয়েছিলাম। এ কি রূপে ফিরে এলেন আপনি? আমার যে অন্তরে জ্বা’লা করছে। আপনাকে এমন র*ক্তাক্ত রূপে দেখতে পারছি না। ”
ফুঁপিয়ে ক্রন্দনে ভেঙে পড়লো হৃদি। কি থেকে কি করবে, কেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করবে জানা নেই। দিশেহারা অবস্থা। প্রথমবারের মতো তো। ওর মনোভাব উপলব্ধি করতে পারছে ইরহাম। সে দুঃখময় চোখে তাকিয়ে আলতো হাসলো। ক্রন্দনরত সহধর্মিণীর হাতটি ধরে ঠেকালো নিজের ডান কপোলে। চক্ষু বুজে লম্বা শ্বাস প্রশ্বাস ছাড়ল। মিহি কণ্ঠে বললো,
” আলহামদুলিল্লাহ্ আ’ম ফাইন। কেঁদো না মেয়ে। ”
নাক টেনে ওষ্ঠাধর গোলাকার করে তপ্ত শ্বাস ফেললো হৃদি। হাতের উল্টো পিঠে অশ্রু কণা মুছে নিলো। স্বামীর কপোল হতে হাত সরিয়ে ভেজা কণ্ঠে বললো,
” আপনি বসুন। আমি জামা নিয়ে আসছি। চেঞ্জ করতে হবে। ”
মানুষটিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কাবার্ডের ধারে এগিয়ে গেল হৃদি। বের করলো ঘরের পোশাক। পিছু ঘুরে তাকাতেই চমকালো! আবেগতাড়িত মালিহা দাঁড়িয়ে দরজায়।
” মা! ”
মালিহা ভেতরে প্রবেশ করে ছেলের কাছে এলেন। শাড়ির আঁচলে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলেন। ইরহামের অবস্থা করুণ। মা কাঁদে, বউ কাঁদে। কারে রেখে কারে সামলাবে? মা’কে সামলানোর পন্থা নাহয় পুরনো, পরিচিত। কিন্তু বউ? একে সামলাবে কি করে? ছেলের কাঁধ আঁকড়ে ধরে ক্রন্দনে লিপ্ত মালিহা। ইরহাম কোনোমতে মা’কে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ঝাপসা চোখে তা অবলোকন করতে লাগলো হৃদি।
.
.
‘ আনন্দাঙ্গন ‘ এ ছড়িয়ে পড়েছে ইরহামের আহত হবার খবর। কি ঘটেছিল আসলে?
সহিং*সতা চলাকালীন সময়ে কেউ একজন কাপুরুষের ন্যায় আড়াল হতে ইটের টুকরো ছুঁড়ে মে-রেছে। সে টুকরো সরাসরি আঘাত করেছে ইরহামের কপালের ডান অংশে। চশমাও কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঘাতপ্রাপ্ত স্থান হতে মুহূর্তের মধ্যেই র*ক্তপাত হতে লাগলো। ডান হাতে আহত স্থান চেপে ধরলো মানুষটি। তা লক্ষ্য করে সাহিল আঁতকে উঠলো,
” ভাই! ”
সাহিল এবং দলীয় দু’জন কর্মী ছুটে এলো। ইরহামের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে যথাসম্ভব দ্রুত প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থা করলো তারা। ততক্ষণে সেথায় উপস্থিত পুলিশের এসপি তাঈফ। বন্ধুর অবস্থা অনুধাবন করে এগিয়ে এলো সে। প্রাথমিক চিকিৎসা সমাপ্ত হলে দলের আহত নেতা-কর্মীদের নিয়ে ছোটাছুটি আরম্ভ হলো। শরীরের অবস্থা অবজ্ঞা করে নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো চৌধুরী। স্থানীয় হাসপাতালে আহত সঙ্গীদের ভর্তি করলো। নিশ্চিত করলো সুচিকিৎসা। যাদের র ক্ত দরকার চেনা পরিচিত ডোনার হতে র”ক্তের ব্যবস্থা করলো।
র ক্ত দেওয়া বৈধ তবে এর বিনিময় নেওয়া অবৈধ। কিন্তু যে শর্তের ভিত্তিতে র ক্ত দেওয়া জায়েজ, ওই অবস্থায় যদি র’ক্ত বিনামূল্যে পাওয়া না যায়, তখন তার জন্য মূল্য দিয়ে র’ক্ত ক্রয় করা জায়েজ। তবে যে র-ক্ত দেবে তার জন্য র-ক্তের মূল্য নেওয়া জায়েজ নয়। র ক্ত কেনা কিংবা বেচা উভয়ই মানব জীবননা’শের আ*শঙ্কা তৈরি করে। (আল বাহরুর রায়েক : ৬/১১৫; জাওয়াহিরুল ফিকহ : ২/৩৮)
এভাবেই দিন পেরিয়ে রাতের আগমন। ইরহামের শরীর দুর্বল হয়ে উঠলো। আর সইছে না শরীর। টলমল করছে পদযুগল। দাঁড়াতে অপারগ। অতঃপর ওকে সহায়তা করে বাড়ি অবধি এলো তাঈফ।
.
আঁধারে তলিয়ে ধরিত্রী। বিছানায় হেলান দিয়ে বসে আহত ইরহাম। কর্ণে ঠেকানো মোবাইল। ফোনালাপে ব্যস্ত মানুষটি। তখনই..
চলবে.