মনের অরণ্যে এলে তুমি পর্ব-১৯

0
1108

#মনের_অরণ্যে_এলে_তুমি
#তাহিরাহ্_ইরাজ
#পর্ব_১৯

দিবাবসুর দীপ্তিতে উজ্জ্বল বসূধা। রাস্তার দু ধারে, মাথার উপরিভাগে শোভা মিলছে অগণিত নির্বাচনী পোস্টারের। মনোনীত প্রার্থীদের পোস্টার দৃশ্যমান অলিগলি সর্বত্র। তেমনই এক সংকীর্ণ সড়ক ধরে এগিয়ে চলেছে ইরহাম চৌধুরী। পিছুপিছু তার দলীয় নেতাকর্মীরা। পাড়া-মহল্লায় বইছে প্রচার প্রচারণার উত্তাল ঢেউ। মিছিল আকারে এগিয়ে চলেছে তারা। উচ্চ স্বরে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে নির্বাচনী জয়গান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্রচারপত্র বিলি করছে ইরহাম। কুশলাদি বিনিময় করছে সাধারণ জনগণের সঙ্গে। পথ চলতে চলতে তারা এক বিধ্ব-স্ত সড়কে উপস্থিত হলো। রাস্তার জনাকীর্ণ অবস্থা এবং জনদুর্ভোগ ঠিক লক্ষ্য করলো সে। আস্তে করে পাশে থাকা বিশ্বস্ত সহচর সাহিলকে কিছু বললো। মাথা নাড়ল সাহিল। চিন্তিত ভঙ্গিমায় এগিয়ে গেল ইরহাম। পথচারীদের হাতে, দোকানে দোকানে লিফলেট বিতরণ করতে লাগলো। উষ্ণ আলিঙ্গনে আবদ্ধ হলো কিছু মানুষ। তরুণরাও চোখের সামনে তাদের আইডলকে দেখে আপ্লুত হয়ে এগিয়ে এলো। করলো আলিঙ্গন। তাদের পিঠে হাত বুলিয়ে কিছু উপদেশমূলক বাক্য বিনিময় করলো ইরহাম। মাইকিং এর মাধ্যমে দলীয় কর্মীরা জনগণকে অবহিত করতে লাগলো মনোনীত প্রার্থী ইরহাম চৌধুরীর আগমনী খবর। অব্যাহত রইলো প্রচার অভিযান।

ইউনিভার্সিটি চত্বর। কংক্রিটের আসনে বসে হৃদি, আফরিন, দিয়া এবং নাদিরা। নাদিরার হাতে মোবাইল। চকচক করছে আঁখি যুগল।

” দোস্ত দেখ দুলাভাই। মাশাআল্লাহ্! কি লাগতাছে ওনারে! পুরাই আগুন। দেখ দেখ। ”

নাদিরার কথায় ব-শীকরণ হয়ে মোবাইলে ডুব দিলো আফরিন, দিয়া। তবে ওদের মধ্যখানে থাকা হৃদি সম্পূর্ণ নির্বিকার। দেখবে না ওই নি-ষ্ঠুর মানবের মুখখানি।

” উফ্! ভাইয়াকে যা লাগছে না! ঘেমেনেয়ে একাকার অবস্থা। তারপরও কি হ’টনেস! হায়! ” ক্রাশিত বান্ধবী দিয়া।

নাদিরা সহমত পোষণ করে গদগদ কন্ঠে বললো,

” সাদা পাঞ্জাবিতে ওনায় পুরো জোশ লাগে। মনে হয় সাদা রঙটা শুধুমাত্র ওনার জন্য বানানো। উফ্!
কি লা র লুক! ”

এতক্ষণ নির্লিপ্ততা ধরে রাখলেও আর পারা গেল না। ত্বরিত প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করলো হৃদি। ছোঁ মে*রে নাদিরার হাত থেকে মোবাইল কেড়ে নিলো। এলোমেলো আঙ্গুল চালনা করে বন্ধ করলো নির্বাচনী প্রচারণার ভিডিও। তেঁতো স্বরে বললো,

” লুচির দল। তোদের লজ্জা করে না বান্ধবীর সামনে তারই বরকে নিয়ে হটিনটি কমেন্ট করতে? লাজশরম বাজারে বেঁচে দিয়েছিস নাকি? ”

আফরিন দুষ্টু হেসে বলে উঠলো,

” বাব্বাহ! বান্ধবী ললিতা দেখি ভেরি জেলাস! ”

ক্ষে পে গেল হৃদি। ওর দিকে তাকিয়ে বললো,

” একদম ললিমলি বলবি না আফু। তুই কোথায় এদের নিষেধ করবি তা না। নিজেও যোগ দিয়েছে। হাট! ”

ডান কাঁধে ব্যাগ জড়িয়ে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। গটাগট কদম ফেলে সামান্য অগ্রসর হলো। ফিরে এলো আবার। নাদিরার হাতে তার মোবাইল ফেরত দিয়ে পুনরায় বড় বড় কদম ফেলে প্রস্থান করলো। পেছনে সশব্দে হেসে উঠলো তিন বান্ধবী। সমস্বরে সুরে সুরে গাইতে লাগলো,

” পরাণ যায় জ্বলিয়া রে..! ”

হাই-ফাইভ করলো তিনজনে। অধরে লেপ্টে দুষ্টু হাসির রেখা।
.

বান্ধবীদের গা’লমন্দ করতে করতে ভার্সিটির নীরব শুনশান পথ ধরে হেঁটে চলেছে হৃদি। অনবরত বিড়বিড় করে চলেছে। কতবড় দুঃসাহস! তার সুদর্শন বরের দিকে কুনজর দেয়। তার সামনেই উল্টোপাল্টা কমেন্ট পাস করে‌। সব কয়টা বেশরম হয়ে যাচ্ছে। কথায় কথায় ক্রাশ খায়। এসব খাওয়া ভালো নাকি? স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক! হুঁ। এলোমেলো ভাবনায় মশগুল মেয়েটি হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেল। শ্রবণেন্দ্রিয়ে পৌঁছালো সুক্ষ্ম শব্দ। সজাগ হলো কান ও মস্তিষ্ক উভয়েই। সতর্ক ভঙ্গিতে নয়নতারা বুলাতে লাগলো আশপাশে। কোথাও কেউ নেই। তবে সে শব্দ? শ্লথ গতিতে হাঁটতে হাঁটতে শব্দ উৎস অনুসরণ করতে লাগলো হৃদি। উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠলো হৃদয়। সরু স্বেদজলের রেখা ফুটে উঠলো ললাট কার্নিশে। কাঁধে থাকা ব্যাগটি শক্ত করে চেপে ধরলো। নিঃশব্দ পদচারণায় এগিয়ে গেল শব্দ উৎসে। দাঁড়ালো এক ঝোপ সংলগ্ন। শুকনো ঢোক গিলে নিলো। চোয়াল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো স্বেদজল। মেয়েটি আস্তে ধীরে কম্পিত হাত রাখলো ঝোপে। মন্থর গতিতে সরিয়ে দিলো ঝোপের একাংশ। হলো হতভম্ব! এসব কি!

দু’জন তরুণ দাঁড়িয়ে। আলাপচারিতায় লিপ্ত। নিজেদের মধ্যে বিনিময় করছে কিছু। এক কিনারে থাকায় তা চক্ষুতারায় দৃশ্যমান হলো না। কৌতুহল আরো বৃদ্ধি পেল। মনোযোগী দৃষ্টিতে দেখতে লাগলো হৃদি। এখানে এসব কি হচ্ছে? শুনশান স্থানে থার্ড ইয়ারের সজীব ভাইয়া আর অচেনা এক ব্যক্তি। কে এই ব্যক্তি? ভার্সিটিতে তার আগমনের মূল হেতু কি? বোধগম্য হচ্ছে না। খানিক বাদেই বিদায় নিলো অজ্ঞাত ব্যক্তিটি। সজীব হাতে থাকা জিনিসটি তৎক্ষণাৎ জিন্সের পকেটে পুরে নিলো। আশপাশে সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে প্রস্থান করলো সেথা হতে। হৃদি আর পিছু নিলো না। মগ্ন হলো গভীর ভাবনায়। অতঃপর ভাবনায় মগ্ন মেয়েটি ধীরপায়ে সেথা হতে সরে গেল। হাঁটতে লাগলো ভাবনায় ডুবে।

আঁধারে নিমজ্জিত বসুন্ধরা। নৈশভোজের জন্য উপস্থিত পরিবারের সদস্যরা। হৃদি বসলো ইনায়ার পাশে। মিষ্টি হাসি উপহার দিয়ে উল্টে রাখা প্লেট সোজা করলো। শূন্য গ্লাস পূর্ণ করলো পানিতে। সহসা দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো একান্ত জনে। ঘরোয়া পোশাক পরিহিত মানুষটি মোবাইল স্ক্রল করতে করতে আসছে। আস্তে করে দৃষ্টি সরিয়ে নিলো হৃদি। প্লেটে ভাত নিতে লাগলো। ওর বিপরীত দিকের চেয়ারে এসে বসলো মানুষটি। মোবাইল পকেটে রেখে দিলো। অর্ধাঙ্গীর পানে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেই সোজা করলো প্লেট। হৃদি উপলব্ধি করতে পারছে নভোনীল চক্ষু জোড়া তার ওপরে নিবদ্ধ। এহেন কাণ্ডে মৃদু অস্বস্তি বোধ হচ্ছে। বরফের ন্যায় জমে যাচ্ছে হাত। দ্রুততার সহিত প্লেটে খাবার তুলে নিলো মেয়েটা। ওর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে ইরহাম বলে উঠলো,

” সবজির বোলটা দাও। ”

থমকে গেল হৃদি। অবনত মস্তকে ভাবতে লাগলো কথাটি সত্যি তাকেই বলা? পুনরায় শুনতে পেয়ে নিশ্চিত হলো,

” কি হলো? দাও। ”

হৃদি আড়চোখে তাকালো। সবজির বোল তার সন্নিকটে। দিতেই হবে! আহা! তা আর হলো না। ইনায়া নিজেই বোলটা ভাইয়ের কাছে এগিয়ে দিলো। অসন্তোষ প্রকাশ পেল গম্ভীর বদনে। প্লেটে সবজি নিয়ে ভোজন আরম্ভ করলো ইরহাম। নীরবতায় আচ্ছাদিত ডাইনিং এরিয়া। সকলেই চুপচাপ খেতে লিপ্ত। মানুষটি আড়চোখে কয়েকবার তাকালো সহধর্মিণীর পানে। একটুখানি চক্ষু আলাপণ, নয়নে নয়ন মিলিত হবার বাসনা জাগলো মনে। তবে তা পূরণ আর হলো না। অবনত মস্তকে আহার সমাপ্ত করে উঠে দাঁড়ালো হৃদি। বেশ দ্রুতই খেলো বোধহয়। এঁটো হাতে সেথা হতে প্রস্থান করলো। অগ্রসর হলো বেসিনের নিকটে। একপ্রকার পলায়ন করলো যেন। বিষয়টি অনুধাবন হতেই চোয়াল শক্ত হলো ইরহামের। দৃষ্টি নত করে আহারে জোরপূর্বক মনোনিবেশ করলো সে। গোটা বিষয়টি ধরা পড়লো এক বিচক্ষণ চোখে।
.

তমস্র রজনী। আকাশের বুকে শোভা পাচ্ছে শীতাংশু। উন্মুক্ত বেলকনিতে দাঁড়িয়ে হৃদি। ঝিরিঝিরি হাওয়া ছুঁয়ে যাচ্ছে কায়া। নৃত্যরত কৃষ্ণবর্ণ কেশ। দৃষ্টি নিবদ্ধ আকাশের বুকে। শীতাংশু-তে। উপভোগ করে চলেছে রাতের সৌন্দর্য। প্রসন্ন হচ্ছে চিত্ত। সহসা তার ধ্যান ভঙ্গ হলো। গোলাকার ক্ষুদ্র টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলে নোটিফিকেশনের ধ্বনি নিঃসৃত হলো। পিছু ঘুরে তাকালো সে। হাতে নিলো মোবাইল। খুদে বার্তা ওপেন করতে দেখা মিললো,

‘ কথা আছে। রুমে এসো। ‘

ভ্রু যুগল প্রথমে মৃদু কুঞ্চিত হলেও স্থায়ী হলো না। ললাটের ভাঁজ মিলিয়ে গেল। ডিসপ্লে অফ করে কক্ষে প্রবেশ করলো হৃদি। বিছানায় আয়েশ করে বসে ইনায়া। ওকে দেখে হাসিমুখে বললো,

” ভাবী এসো। রণবীর কাপুরের জোশ একটা মুভি হচ্ছে। ”

একগাল হেসে ননদের পাশে বসলো হৃদি। দু’জনেই বেডের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসে। মুভি দেখতে দেখতে হৃদি অনুভব করলো আরেকটি খুদেবার্তা এসেছে। ভ্রুক্ষেপ করলো না মেয়েটি। ননদের সঙ্গে উপভোগ করতে লাগলো রণবীর কাপুর অভিনীত মুভি।

অন্ধকারাচ্ছন্ন কক্ষটি। টেবিলের ওপর রাখা ল্যাপটপ। যার আলোতে উজ্জ্বল আজগর সাহেবের মুখখানা। গভীর মনোযোগের সহিত চ্যাটিংয়ে লিপ্ত উনি। ওপাশে থাকা ব্যক্তিকে উনি পরপর তিনটি নাকের ইমোজি পাঠালেন। সে ব্যক্তি পাঠালো পাঁচটি নাকের ইমোজি এবং ‘ ওয়ান ওয়ান ওয়ান ‘. উনি চিন্তিত বদনে কিছু ভাবলেন। অতঃপর লিখলেন চারটি নাকের ইমোজি এবং ‘ এইট জিরো ‘. কিছুক্ষণ মতবিরোধ চললো দু পক্ষের মধ্যে। অতঃপর ওপাশ হতে এলো ‘ ডান ‘ লেখা সম্বলিত ইমোজি। আজগর সাহেবের অধরে ফুটে উঠলো তৃপ্তিময় বক্র রেখা। উচ্ছ্বসিত বদনে ল্যাপটপের শাটার অফ করলেন উনি। দেহ এলিয়ে দিলেন চেয়ারে। নিমীলিত হলো ওনার আঁখি যুগল। অধরে কুটিল রেখার অস্তিত্ব।

দিনমণির কিরণে আলোকিত বসুন্ধরা। বেলকনির মেঝেতে বসে হৃদি। পেছনে বেতের সিঙ্গেল সোফায় রাজেদা খানম। উনি পান চিবোতে চিবোতে নাতবউয়ের চুলে তেল মেখে দিচ্ছেন।

” ছে ম ড়ি! চুলের যতন না করতে করতে চুলডার কি অবস্থা করছোছ? এক্কেরে ফুলঝাড়ু বানাই হালাইছোছ। এইডা চুল? ”

হৃদি ত্বরিত প্রতিবাদ জানালো।

” দাদি আমার চুলের অবস্থা অতটাও খারাপ নয় যে ঝাড়ুর সাথে তুলনা দেবে। অনেকের চুলের অবস্থা এরচেয়েও নাজুক। আমার তো সে-ই তুলনায় বেটার ই আছে। ”

” মাইনষের কথা ছাড়। নিজেরডা ভাব। আল্লাহ্ কি সুন্দর চুল দিছে। কই যত্নআত্তি করবি। হ্যা না খালি আকাম। এহন থে নিয়ম কইরা চুলে তেল দিবি কইয়া রাখলাম। ”

” আচ্ছা। ”

হৃদি নীরস বদনে সম্মতি জানালো। তেল দেয়া তার মোটেও পছন্দ নয়। চুলে কি এক তেল চিটচিটে অবস্থা হয়ে যায়। ইশ্!

” বুঝলি বুইন! কোনোকিছুই অযতন করা উচিত না। হ্যা চুল হউব কিংবা সোয়ামি। অযতন করলে নিজেরই ক্ষতি। হয় চুল পইড়া নাইড়া হবি। আর রইলো সোয়ামির কথা? হে থাকতেও সোয়ামির আদর সোহাগ কপালে জুটতো না। বুঝলি? ”

বেশ চমকালো হৃদি! দাদি এসব কি বলছে? তবে কি সে কিছু টের পেয়েছে? এজন্য এমন কথা বলছে? সর্বনাশ! দাদি জানলো কি করে? সে তো বিষয়টি গোপন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছে। তবে? মেয়েটির ভাবনায় ছেদ পড়লো দাদীর কথায়। রাজেদা খানম বললেন..

চলবে.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে